তা একটু বসে থাকতে থাকতেই ঝড় এল।
কিংবা শুধু ঝড় নয়, বৃষ্টি-বজ্রাঘাতও তার সঙ্গী হয়েছে।
শঙ্করী ফিরেছে শুনে খোঁজ করতে এসেছেন কাশীশ্বরী আর মোক্ষদা।
পিছনে দর্শকের ভূমিকা নিয়ে ভুবনেশ্বরী, রামকালীর স্ত্রী।
১১. অপরাধটা হচ্ছে লক্ষ্মীর ঘরে
অপরাধটা হচ্ছে লক্ষ্মীর ঘরে যথাসময়ে প্রদীপ না দেওয়ার কিন্তু শাস্তির আশঙ্কায় সমস্ত শরীর কণ্টকিত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করীর মনের পটে যে ছবি ভেসে উঠল সেটা লক্ষ্মীর ঘট অথবা গৃহদেবতার পটগুলির নয়, নিজের যে অপরাধের শাস্তির আশঙ্কাটা সমস্ত দেহমন শিথিল করে ছিল শঙ্করীর, সে অপরাধের সঙ্গে এ বাড়ির, এমন কি এ গ্রামেরও কোন সম্পর্ক নেই।
অপরাধের জায়গাটা হচ্ছে শঙ্করীর বাপের বাড়ির আমবাগান। সময়টা গা ঝিমঝিমে ভরদুপুর।
নতুন ফাল্গুনের থেকে থেকে ঝিরঝিরি আর থেকে থেকে দমকা বাতাস বইছে আর নতুন “গুটি বাঁধা” আমগাছগুলো সে বাতাসে যেন মাতলামির খেলা জুড়েছে। কিছু কিছু গাছ কিন্তু খানিকটা পিছিয়ে আছে, তাদের এখনো বোল ঝরে আম ধরে নি। পাতার ফাঁকে ফাঁকে মঞ্জরীর সমারোহ।
নির্জন দুপুরে সেই বাগানে শঙ্করী আর নগেন।
নগেনের হাতের মধ্যে শঙ্করীর হাত।
আলগা করে এলিয়ে পড়ে থাকা নয়, হাতখানা বজ্রমুষ্টিতে ধরে রেখেছে নগেন, পাছে শঙ্করী পালিয়ে যায়! যতক্ষণ না নগেনের বক্তব্যটা সম্পূর্ণ শেষ হবে, ততক্ষণ শঙ্করীর ছাড়ান নেই।
অনেক দিন ধরে অনেক ছোটখাটো কথা, অনেক ইশারা-ইঙ্গিতের দূত মারফৎ নিজের বক্তব্য জানিয়েছে নগেন শঙ্করীকে, অনেক করুণ দৃষ্টি, অনেক চোরা হাসির সওগাতে। আজ বোধ করি একেবারে হেস্তনেস্ত করতে চায় সে।
কিন্তু নগেন কি শঙ্করীকে গায়ের জোরে এই নির্জন আমবাগানে টেনে এনেছিল? মুখে কাপড় বেঁধে, পাজাকোলা করে?
তা তো নয়।
সহায়সম্বলহীন ছেলেটার এত সাহস কোথা? মাসীর বাড়ির অন্ন খেয়ে খেয়ে তো মানুষ।
শঙ্করীর কাকীই নগেনের মাসী।
মা-মরা বোনপোকে কাছে এনে মানুষ করেছেন কাকী নিজের ছেলেদের সঙ্গে। সে সংসারে শঙ্করীও বেড়ে উঠেছে।
মাঝখানে শুধু একটা বিয়ের ব্যাপার।
কিন্তু সে আর ক’দিনের? অষ্টমঙ্গলাতেই তো তার সমাপ্তি।
একই বাড়িতে বাস করেছে দুজনে। ভাই-বোনের মত। অথচ আশ্চর্য, মনোভাবটা কিছুতেই কেন ভাই-বোনর মত তৈরী হল না!
কেন ছোট্টবেলা থেকে শঙ্করীর নিজের খুড়তুতো দাদারা শঙ্করীর চুলের মুঠি ধরেছে আর পান থেকে চুন খসলে খিঁচিয়েছে, আর নগেন কেনই বা বরাবর সেই দুঃখ-যন্ত্রণায় স্নেহের প্রলেপ লাগিয়েছে, অত্যাচারীদের প্রতি কটুক্তি করেছে!
পৃথিবীতে কি জন্যে কি হয় শঙ্করীর বোধের বাইরে। বোধের জগৎটা ওর নেহাই সীমাবদ্ধ। নইলে আঠারো বছরের বিধবা মেয়ের পক্ষে ভরা ভরদুপুরে আমবাগানে এসে একটা বেটাছেলের সঙ্গে কথা কওয়া যে কতদূর গর্হিত, সে বোধ থাকা উচিত ছিল বৈকি একটা আঠারো বছরের মেয়ের।
কিন্তু সত্যিই কি এটুকু বোধও ছিল না শঙ্করীর?
চব্বিশ ঘণ্টা কাকীর দাঁতের পিষুনিতে সে বোধ জন্মায় নি? বাগানে এসেছিল কি শঙ্করী নির্ভয় নিশ্চিন্তে?
না, অবোধ হলেও এতটা অবোধ নয় শঙ্করী। এসেছিল বুকের মধ্যে ভয়ের বাসা নিয়েই সকালে যখন নগেন এ আবেদন জানিয়েছে, তখন থেকেই বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাড় পড়ছে তার। সকল কাজে ভুলচুক হয়েছে। তবু এসেছে।
তবু কি ভাগ্যিস আজ আর রান্নাঘরের ভারটা ঘাড়ে নেই। কাল শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, বলতে গেলে জন্মের শোধই চলে যাবে, এই মমতায় গৃহকত্রী শঙ্করীকে হেঁসেলের দায়িত্ব থেকে ছুটি দিয়েছেন। আর যখন শঙ্করী নিতান্ত বিনীত মূর্তিতে, নিতান্ত কাচুমাচু মুখে আবেদন জানিয়েছে, বকুলফুলের বাড়ি একবার যাব কাকীমা? তখন না করতে পারেন নি তিনি।
বাগানে এসেই প্রথম এই ছলনার খবর শুনে হেসে উঠেছিল নগেন। বলেছিল, তা গুরুজনের সঙ্গে মিছে কথা কয়েছিস ভেবে অত মনমরা হচ্ছিস কেন? ধরে নে না আমিও তোর একটা বকুলফুল?
কিন্তু এখন আর নগেনের মুখে হাসি নেই, এখন নগেনের অন্য ভাব। এখন কেমন রুক্ষ হিংস্র উদভ্রান্ত মতন। এখন বজ্রমুষ্টিতে শঙ্করীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায় ভিন্ন এক জগতে।
পালিয়ে গিয়ে অন্য আরেক দূরের আর এক গাঁয়ে চলে যাই না? সেখানে কে চিনবে আমাদের? বলব আমরা স্বামী-স্ত্রী, আগুন লেগে ঘরবাড়ি ক্ষেতখামার সব পুড়ে গেছে, তাই মনের আক্ষেপে দেশ-ভুঁই ছেড়ে চলে এসেছি।
অমন পাপকথা বললে যে জিভ খসে যাবে নগেনদাদা। নরকেও ঠাই হবে না আমাদের। উচ্চারণ করে শঙ্করী, কিন্তু সে উচ্চারণে কোথাও কোন জোর প্রকাশ পায় না। পাপের আশঙ্কায় আগে থেকেই কি জিভ শিথিল হয়ে এল শঙ্করীর?
পাপ কিসের? তোর ওই বে-টা কি রে? স্বামীর ঘর করেছিস তুই? জন্ম-জন্মান্তর থেকে তুই আর আমি পতি-পত্নী, বুঝলি? তাই ওই একটা উটকো স্বামী সইল না তোর। নইলে এতদিন তুই কোথায় থাকতিস, আর আমি কোথায় থাকতাম। তুই মন ঠিক কর শঙ্করী, দোহাই তোর!
এ কথা কানে শুনলেও যে অনন্ত নরক নগেনদাদা।
তাই যদি হয়, নগেন উগ্রমূর্তিতে বলে ওঠে, নরকেই যদি যেতে হয়, তোকে তো একলা যেতে হবে না। আমাকেও যেতে হবে। তোর জন্যে সে ক্লেশও মেনে নিচ্ছি আমি। পৃথিবীর আর সব্বাই যাক তো স্বর্গে, তুই আর আমি নয় নরকেই থাকব। এ জন্মটা তো তবু ভাল যাবে।