আচ্ছা কিন্তু, হঠাৎ যেন সর্বশরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে শঙ্করীর, মামাঠাকুর টের পেলেন কি করে? কে বলবে, কে জানে? তাও যদি বা কোন প্রকারে সন্ধান পেয়ে থাকেন, যদি সেই পরম শত্রুটাই এসে কোন ছলে ভয়ে-ভয়ে ফাঁস করে দিয়ে গিয়ে থাকে– শঙ্করী যে আজ এই সন্ধ্যায় ডুবে মরবার সংকল্প নিয়ে ঘাটে এসেছিল, এ কথা জানতে পারলেন কি করে তিনি?
মাত্র আজই তো দণ্ডকয়েক আগে সংকল্পটা স্থির করেছে শঙ্করী, অনেক ভেবে, অনেক নিঃশ্বাস ফেলে, অনেক চোখের জলে মাটি ভিজিয়ে। বিয়েবাড়ি, শাশুড়ী দিদিশাশুড়ীর দল বাড়তি কাজে ব্যস্ত, কে কোথায় কি করছে না-করছে কেউ লক্ষ্য করবে না, আজই ঠিক উপযুক্ত সময়। তা ছাড়া আসছে কাল বাড়িতে যজ্ঞি, আত্মীয়-কুটুষের ভিড় লাগবে বাড়িতে। কে জানে কোন ছুতোয় কে শঙ্করীর রীতিনীতির ব্যাখ্যান করবে, শঙ্করীর চালচালনের নিন্দে করবে, চি-টি পড়ে যাবে বাড়িতে।
না না, মরতেই যদি হয়, আজকেই হচ্ছে তার শ্রেষ্ঠ সময়। এইসব সাত-সতেরো ভাবনার বোঝা মাথায় করে ঘাটে এসেছিল শঙ্করী, জীবনে সমস্ত বোঝা নামিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু, আবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল শঙ্করীর, কিন্তু বিধাতা নিষেধ করলেন।
মরণের দরজা থেকে জীবনের রাজ্যে ফিরিয়ে আনলেন শঙ্করীকে।
তবে আর দ্বিধা কেন?
.
শঙ্করী বিধবা হলেও ওর আনা জল নিরামিষ ঘরে চলে না। ও ‘অনাচারে’, ওর অদীক্ষিত শরীর। জলের কলসীটাকেই তাই মাঝের দালানে এনে বসাল শঙ্করী, ছেলেপুলেদের খাওয়ার দরকারে লাগবে।
কলসী নামানোর শব্দে কোথা থেকে যেন এসে হাজির হল সত্যবতী। এসেই এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, সব্বনাশ করেচ কাটোয়ার বৌ, তোমার নামে টি-টিক্কার পড়ে গেছে! বাড়িতে অনেক বৌ, কাজেই আশপাশের বৌদের তাদের বাপের বাড়ির দেশের নাম ধরে অমুক বৌ, তমুক বৌ বলতে হয়। তা ছাড়া শঙ্করী নবাগতা, ওর আর পর্যায়ক্রমে মেজ-সেজ দিয়ে নামকরণ হয় নি।
বুকটা ধড়াস করে উঠল শঙ্করীর।
কিসের সব্বনাশ!
তবে কি সব ধরা পড়ে গেছে?
ঘরের কোণে রাখা মাটির প্রদীপের আলোয় মুখের রং-গড়ন দেখা গেল না, শুধু গলার স্বরটা শোনা গেল, কাঁপা কাঁপা ঝাঁপসা।
কিসের সব্বনাশ, রাঙা ঠাকুরঝি?
আজ না তোমার লক্ষ্মীর ঘরে সন্ধ্যে দেবার পালা ছিল? সত্যর কণ্ঠস্বরে বিস্ময় আর সহানুভূতি।
লক্ষ্মীর ঘরে সন্ধ্যে দেখানোর পালা।
ওঃ, শুধু এই!
বুকের পাথরটা নেমে গেল শঙ্করীর, হালকা হল বুক। হোক এটা ভয়ানক মারাত্মক একটা অপরাধ, আর তার জন্যে যত কঠিন শাস্তিই হোক মাথা পেতে নেবে শঙ্করী।
অবশ্য এই দরদের ধিক্কারে চখে জলে এসে গিয়েছিল তার।
সত্য গলাটা আর একটু খাটো করে বলে, আর তাও বলি কাটোয়ার বৌ, এই ভরসন্ধ্যে পর্যন্ত ঘাটে থাকার তোমার দরকারটাই বা কি ছিল? সাপখোপ আছে, আনাচেকানাচে কু-লোক আছে–
শঙ্করী সাহসে বুক বেঁধে বলে, দিদিমা খুব রাগ করছিলেন বুঝি?
রাগ? রাগ হলে তো কিছুই না। হচ্ছিল গিয়ে তোমার ব্যাখ্যানা!
সত্যবতী হাত-মুখ নেড়ে বলে, আর সত্যিও বলি কাটোয়ার বৌ, তোমারই বা এত বুকের পাটা কেন? ভর-সন্ধ্যেবেলা একা ঘাটে গিয়ে যুগযুগান্তর কাটিয়ে আসা কেন? আবার আজই সন্ধ্যে দেখানোর পালা। ঠাম্মারা তো তোমায় পাশ-পেড়ে কাটতে চাইছিল।
তাই কাটো না ভাই তোমরা আমায়– শঙ্করী ব্যগ্রকণ্ঠে বলে, তা হলে তোমরাও বাঁচো, আমার মনস্কামনা সিদ্ধি হয়।
সত্য ভ্রূভঙ্গী করে গালে হাত দিয়ে বলে, ওমা! তোমার আবার কিসের মনস্কামনা? তুমি আবার বড়বৌয়ের মত বোল ধরেছ কেন? বড়বৌও যে এতক্ষণ আমায় বলছিল, আমায় একটু বিষ এনে দাও ঠাকুরঝি, খাই। তোমার দাদার হাতের সুতো খোলার আগেই যেন আমার মরণ হয়, সে দৃশ্য দেখতে না হয়।
সত্যি বলতে কি, সারদার সঙ্গে শঙ্করীর এখনও তেমন ভাব হয় নি। প্রথম তো বয়সের ব্যবধান, তাছাড়া সারদা ছিল স্বামী-সোহাগিনী নবপুত্রবতী, আর শঙ্করী ছাইফেলার ভাঙাকুলো। আরও একটা কথা– দুজনের এলাকা আলাদা। শঙ্করীকে থাকতে হয় বিধবামহলে, তাদের হাতে হাতে মুখে মুখে ফাঁইফরমাশ খাটতে– সারদা সধবা মহলের জীব। খাওয়া শোওয়া বসা সব কিছুর মধ্যেই আকাশ-মাটির পার্থক্য।
কিন্তু আপাতত সারদা অনেকটা নেমে পড়েছে, এখন শঙ্করীও তাকে করুণা করতে পারে। তাই করে শঙ্করী। দরদের সুরে বলে, তা বলতে পারে বটে আবাগী।
বলি সে নয় বলতে পারল, তোমার কি হল? তোমার অকস্মাৎ কিসের জ্বালা উথলে উঠল?
আমার পোড়াকপালে তো সব্বদাই জ্বালা ঠাকুরঝি। শঙ্করী নিঃশ্বাস ফেলে।
সত্য হাত নেড়ে বলে,আহা, কপাল তো আর তোমার আজ পোড়ে নি গো! ঠামারা তো সেই কথাই বলছিল, সোয়ামীকে তো কোন্ জন্মে ভুলে মেরে দিয়েছ, তবে আবার তোমার সদাই মন উচাটন কিসের? কিসের চিন্তে কবরা রাতদিন?
মরণের! শঙ্করী দালানের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে বলে, ও ছাড়া আমার আর চিন্তা নেই।
তা ভাল। সত্য আবার দুই হাত নেড়ে কথার সমাপ্তি টেনে মল বাজিয়ে চলে যায়, সব মেয়েমানুষের মুখে দেখি এক রা, মরব মরছি মরণ হয় তো বাঁচি! এ তো আচ্ছা ফ্যাসাদ!
শঙ্করী আর এ কথার উত্তর দেয় না, বসে বসে হাঁপাতে থাকে। আসুক ঝড়, আসুক বজ্রাঘাত, এখানে বসে বসেই মাথা পেতে নেবে সে, উঠে গিয়ে পায়ে হেঁটে ঝড়ের মুখে পড়বার শক্তি নেই।