এইসব বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাকা সেই যে ছেড়ে দিয়ে গেছে, ব্যস! বছর কাবার হতে চলল, উদ্দিশ নেই। অথচ এখানে শঙ্করীর উঠতে বসতে খোঁচা খেতে হচ্ছে ‘চালচলনের’ অভব্যতায়। উনিশ বছরের আগুনের খাপরা এতখানি বয়স অবধি বাপের ঘরে কাটিয়েছে, তাকে বিশ্বাসই বা কি? বিধবার আচার-আচরণই তো শেখে নি ভাল করে। নইলে বামুনের বিধবা এটুকু জানে না যে রাতে চালভাজার সঙ্গে শশা খেতে হলে আলাদা পাত্রে নিতে হয়, এক পাত্রে রাখলে ফলার হয়! এমন কি কামড়ে কামড়েও তো খেতে নেই, আলগোছা টুকরো করে মুখের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে তবে চালভাজার সঙ্গে খাওয়া চলে। তা নয়, সুন্দরী দিব্যি করে একদিন শশা কেটে চালভাজার পাশে নিয়ে খেতে বসেছেন। যা-ই ভাগ্যিস মোক্ষদার চোখে পড়ে গেল, তাই না জাত-ধর্ম রক্ষে।
কিন্তু সেই একটাই নয়, পদে পদে অনাচার ধরা পড়ে শঙ্করীর, আর প্রতিপদে উপর-মহলে সন্দেহ ঘনীভূত হয়– এ মেয়ের রীত-চরিত্তির ভাল কি না।
তা রামকালীর এত তথ্য জানবার কথা নয়। কবে কোন্ দিন কোন্ অনাথা অবীরা চাটুয্যেদের সংসারে ভর্তি হচ্ছে, সে কথা মনে রাখার অবকাশ কোথায় তাঁর? কাজে-কাজেই রাসুর বৌয়ের প্রশ্ন নিয়েই চিন্তাকে প্রবাহিত করেছেন। তাছাড়া পুকুরের উঁচু পাড় থেকে ঠিক ঠাহরও হয় নি, সাদা ওই বস্ত্রখণ্ডটুকুর কিনারায় একটু রঙের রেখা আছে কি নেই।
কিন্তু না, সারদা মরতে আসে নি। সত্যবতী পিতৃ-আদেশের সঙ্গে-সঙ্গেই তাকে কড়া পাহারায় রাখতে শুরু করেছে। আর পাহারা না দিলেও মরা এত সোজা নয়। মরব বলেছে বলেই যে সত্যিই সদ্য আগত সতীনের হাতে স্বামী-পুত্র দুই তুলে দিয়ে পুকুরের তলায় আশ্রয় খুঁজতে যাবে সে তা নয়। জ্বালা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে তাকে অন্যকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাবার ব্রত নিয়ে।
মরতে এসেছিল শঙ্করী।
মরতে এসেছিল, তবু মরতে পারছিল না।
বসে বসে ভাবছিল মরণের দশা যখন ঘটেছে তার, তখন মৃত্যু ছাড়া পথ নেই। কিন্তু কোন্ মৃত্যুটা শ্রেয়? এই রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-সুধাময় পৃথিবী থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, না সমাজ সংস্কার সম্ভ্রম সভ্যতা মানমর্যাদার রাজ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া!
শেষের মৃত্যুটা যেন প্রতিনিয়ত কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে শঙ্করীকে। কিন্তু শঙ্করী তো জানে সেখানে অনন্ত নরক। তাই না যে পৃথিবীর সকরুণ মিনতির দৃষ্টি তাকিয়ে আছে ভোরের সূর্য আর সন্ধ্যার মাধুরীর মধ্যে, তার কাছ থেকেই বিদায় নিতে এসেছিল শঙ্করী?
কিন্তু পারল কই?
শুধুই কি মামাঠাকুরের দুর্লজ্জ আদেশ! ঘাটের পৈঠাগুলোই কি তাকে দুর্লঙ্ঘ্য বাঁধনে বেঁধে রাখে নি?
তবে কি শঙ্করীর মৃত্যু বিধাতার অভিপ্রেত নয়? তাই দেবতার মূর্তিতে উনি এসে দাঁড়ালেন মৃত্যুর পথ রোধ করে?
হঠাৎ এমনও মনে হল শঙ্করীর, সত্যিই মামাঠাকুর তো? নাকি কোন দেবতার ছল? ঠাকুর দেবতারা মানুষের ছদ্মবেশে এসে মানুষকে ভুল-ঠিক বুঝিয়ে দিয়ে যান, অভয় দিয়ে যান, এমন তো কত শোনা যায়!
বাড়ি ফিরে শঙ্করী যদি কোনপ্রকারে টের পায় রামকালী এখন কোথায় রয়েছেন, তা হলেই সন্দেহ ভঞ্জন হয়। ভাবতে ভাবতে ক্রমশ শঙ্করীর এমন ধারণাই গড়ে উঠতে থাকে, নিশ্চয় খোঁজ নিলে দেখা যাবে মামাঠাকুর এখন এ গ্রামেই নেই, রোগী দেখতে দূরান্তরে গেছেন। নিশ্চয় এ কোন দেবতার ছল। নইলে সত্যিই তো মামাঠাকুর এমন ঘুলঘুলি সন্ধ্যেয় মেয়েঘাটের কিনারায় ঘুরবেনই বা কেন?
আর সেই হাঁকপাড়াটা?
সেটাই কি ঠিক মামাশ্বশুরের কণ্ঠস্বর? মাঝে মাঝে তো ভেতরবাড়িতে আসেন মামাঠাকুর, কথাবার্তাও কন মা’র সঙ্গে, খুড়ীর সঙ্গে, কই গলার শব্দে এতটা চড়া সুর শোনা যায় না তো? মৃদুগম্ভীর ভারী ভরাট গলা, আর কথাগুলি দৃঢ়গম্ভীর।
এ মামাঠাকুরকে দেখলে পুণ্যি হয়।
বড় মামাঠাকুরের মতন নন ইনি। বড় মামাঠাকুরকে দেখলে ভক্তি-ছো ছুটে পালায়। কিন্তু কথা হচ্ছে ছদ্মবেশ সম্বন্ধে একেবারে নিঃসংশয় হবার উপায়টা কি? কোথায় মেয়েমহল আর কোথায় পুরুষমহল! চাটুয্যেদের এই শতখানেক সদস্য সম্বলিত সংসারে স্ত্রীরাই সহজে স্বামীদের তত্ত্ব পান, তা আর কেউ! অবশ্যি পুরুষের তত্ত্ববার্তা নেবার প্রয়োজনটাই বা কি মেয়েদের? দুজনের জীবনযাত্রার ধারা তো বিপরীতমুখী। পুরুষের কর্মধারার চেহারা যেমন মেয়েদের অজানা, সেদিকে উঁকি মারবার সাহস মেয়েদের নেই, তেমনি পুরুষের নেই অবকাশ মেয়েদের কর্মকাণ্ডের দিকে অবহেলার দৃষ্টিটুকুও নিক্ষেপ করবার।
একই ভিটেয় বাস করলেও উভয়ে ভিন্ন আকাশের তারা।
তবু মনে হতে লাগল শঙ্করীর, কোন উপায়ে একবার খোঁজ করা যায় না! মামাঠাকুর বাড়িতে আছেন কিনা, থাকলে কি অবস্থায় আছেন? এইমাত্র ফিরলেন, না অনেকক্ষণ থেকে বসে আছেন?
আহা, মামাঠাকুরের সঙ্গে যদি কথা কইতে পারা যেত! তাহলে বোধ করি ভগবানকে দেখতে পাওয়ার আশাটা মিটত শঙ্করীর। তা ওঁকে ভগবানের সঙ্গে তুলনা করবে না তো করবে কি শঙ্করী? এত ক্ষমা আর কোন মানুষের মধ্যে সম্ভব? এত করুণা আর কার প্রাণে আছে? শঙ্করীর মর্মকথা জানতে পারলে ত্রিজগতের কেউ কি অমন দয়া অমন সহানুভূতি দিয়ে কথা বলতে পারত? নাঃ, তারা মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গাঁয়ের বার করে দিত শঙ্করীকে। আর পিছনে ঘৃণার হাততালি দিতে দিতে বলত, ছি ছি ছি, গলায় দড়ি! তুই না হিন্দুর মেয়ে! তুই না বামুনের ঘরের বিধবা!