কলসীটা জলে ডুবিয়ে জল কাটছে যে মেয়েটা! ঈগল-দৃষ্টি ছুরির ফলার মত তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, নিজের অজ্ঞাতসারেই মেয়ে-ঘাটের দিকে এগিয়ে যান রামকালী, এমন সংকট মুহূর্তে ন্যায় অন্যায় উচিত অনুচিত নিয়ম অনিয়ম মানা চলে না। আর একটু ইতস্তত করলেই বুঝি ঘটে যাবে সেই সাংঘাতিক কাণ্ডটা!
দ্রুতপদে একেবারে ঘাটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন রামকালী, প্রায় আর্তনাদের মত চিৎকার করে উঠলেন, কে ওখানে? সন্ধ্যেবেলা জলের ধারে কে?
রামকালী আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন, তাঁর চীৎকারের ফলটা কি দাঁড়াল! ওই যে সাদা কাপড়ের অংশটুকু দেখা যাচ্ছিল এতক্ষণ, সেটা কি এই আকস্মিক ডাকের আঘাতে সহসা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? যেটুকু দ্বিধা ছিল সেটুকু আর রইল না? ওই তো বসে রয়েছে জলের মধ্যে পায়ের পাতা ডুবিয়ে, জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান শুধু একটি লহমার, একটি ডুবের। তার পরই তো ওর সব দুঃখের অবসান, সব জ্বালার শান্তি। ওইখানেই তো ওর হাতে রয়েছে সব ভয় জয় করবার শক্তি, তবে আর রামকালীর শাসনকে ভয় করতে যাবে কোন্ দুঃখে?
সাদা কাপড়টা দেখা যাচ্ছে এখনও, একটু যেন নড়ছে। রুদ্ধশ্বাস-বক্ষে অপেক্ষা করতে থাকেন রামকালী। অথচ এই বিমূঢ়ের ভূমিকা অভিনয় করা ছাড়া ঠিক এই মুহূর্তে আর কি করার আছে রামকালীর? যতক্ষণ না সত্যি মরণের প্রশ্ন আসছে, ততক্ষণ বাঁচানোর ভূমিকা আসবে কি করে? জলে পড়ার আগে জল থেকে তুলতে যাওয়ার উপায় কোথা?
যতই ভয় পেয়ে থাকুন রামকালী, এমন কাণ্ডজ্ঞান হারান নি যে শুধু ঘাটের ধারে বসে থাকা মেয়েটাকে হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসবেন, মেয়েটা মরতে যাচ্ছে ভেবে।
কি করবেন তবে? সাদা রংটা এখনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি, এখনও কিছু করা যাবে।
সহসা আত্মস্থ হয়ে উঠলেন রামকালী, সহসাই যেন ফিরে পেলেন নিজেকে। কী আশ্চর্য! কেন বৃথা আতঙ্কিত হচ্ছেন তিনি? এখুনি তেমন হাঁক পাড়লেই তো অঞ্চলের দশ-বিশটা লোক ছুটে আসবে। তখন আর চিন্তাটা কি? নিজের ওপর আস্থা হারাচ্ছিলেন কেন?
অতএব হাঁক পাড়লেন।
তেমনি ধারাই হক বটে। মৃত্যুপথবর্তিনীও যাতে ভয়ে গুরগুরিয়ে ওঠে। জলদগম্ভীর স্বরে অভ্যস্ত আদেশের ভঙ্গীতেই হাঁক পাড়লেন রামকালী, যে হও জল থেকে উঠে এসো। আমি বলছি উঠে এসো। ভরসন্ধ্যায় জলের ধারে থাকবার দরকার নেই। আমি’টার ওপর বিশেষ একটু জোর দিলেন।
না, হিসাবের ভুল হয়নি রামকালীর।
কাজ হল। এই ভরাট ভারী আদেশের সুরে কাজ হল। কলসীটা ভরে নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এল মেয়েটা একগলা ঘোমটা টেনে। সাদা রংটার গতিবিধি লক্ষ্য করে বুঝতে পারলেন রামকালী, ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে ও।
আর একবার চিন্তা করলেন রামকালী, পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন? নাকি নির্বুদ্ধি মেয়েটাকে একটু সদুপদেশ দিয়ে দেবেন?
সাধারণত শ্বশুর-বৌ সম্পর্কে কথা কওয়ার কথা ভাবাই যায় না, কিন্তু চিকিৎসক হিসাবে রামকালীর কিছুটা ছাড়পত্র আছে। বাড়ির বৌ-ঝির অসুখ-বিসুখ করলে মোক্ষদা কি দীনতারিণী রামকালীকে খবর দিয়ে ডেকে নিয়ে যান এবং তাদের মাধ্যমে হলেও পরোক্ষে অনেক সময় রোণিীকে উদ্দেশ করে কথা বলতে হয় রামকালীকে। যথা ঠাণ্ডা না লাগানো বা কুপথ্য না করার নির্দেশ। তেমন বাড়াবাড়ি না হলে অবশ্য রোগী দেখার প্রশ্ন ওঠে না, লক্ষণ শুনেই ঔষধ নির্বাচন করে দেন। কিন্তু বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে বলতে হয় বৈকি। অবশ্য যথাসাধ্য দূরত্ব সম্ভ্রম বজায় রেখেই বলেন। পুত্রবধূ অথবা ভ্রাতৃবধূ সম্পর্কীয়দের আপনি ভিন্ন তুমি বলেন না কখনও রামকালী।
নিধি একেবারে লঙ্ঘন করলেন না রামকালী, তবু কিছুটা করলেন। পাশ কাটিয়ে চলে না গিয়ে একটা গলাখাকারি দিয়ে বলে উঠলেন, এ সময় এরকম একা ঘাটে কেন? আর এ রকম আসবেন না। আমি নিষেধ করছি। আর একবার ‘আমি’টার উপর জোর দিলেন রামকালী।
সমুখবর্তিনী অবশ্য কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ রামকালীর সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যাবে, এমন ক্ষমতা অবশ্য থাকবার কথাও নয়।
রামকাণী কথা শেষ করলেন, বাড়িতে শুভ কাজ হচ্ছে, মন ভাল করতে হয়। এমন তো হয়েই থাকে।
দ্রুত পদক্ষেপে এবার চলে গেলেন রামকালী।
রামকালী চলে গেলেও কাঠের পুতুলখানা আরও কিছুক্ষণ কাঠপাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে, কী ঘটনা ঘটে গেল যেন বুঝতেই পারে না। কি হল? এটা কি করে সম্ভব হল?
এমন তো হয়েই থাকে, মানে কি?
উনি কি তা হলে সব জেনেছেন? জেনেও ক্ষমা করে গেলেন? মাথা ঠাণ্ডা রেখে সদুপদেশ দিয়ে গেলেন মন ভাল করতে? সত্যিই কি তবে উনি দেবতা? দেবতা ভেবেও বুকের কাপুনি আর কমতে চায় না শঙ্করীর।
হ্যাঁ, শঙ্করী!
রাসুর বৌ সারদা নয়, কাশীশ্বরীর বিধবা নাতবৌ শঙ্করী। চিরদিন পিত্রালয়বাসিনী কাশীশ্বরীর একটা মেয়েসন্তান, তাও মরেছিল অকালে। মা-মরা দৌত্তুরটাকে বুকে করে এক বছরেরটি থেকে আঠারো বছরের করে তুলে সাধ করে সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন কাশীশ্বরী, কিন্তু এমন রাক্ষসী বৌ যে বছর ঘুরল না, দ্বিরাগমন হল না। তা বাপের বাড়িতেই ছিল এ যাবৎ, কিন্তু এমনি মন্দকপাল শঙ্করীর যে, মা-বাপকেও খেয়ে বসল। ছিল কাকা, সে এই সেদিন ভাইঝিকে ঘাড়ে করে বয়ে দিয়ে গেছে চাটুয্যেদের এই সদাব্রতর সংসারে। না দিয়েই বা করবে কি? শুধুই তো ভাতকাপড় যোগানো নয়, নজর রাখে কে? শ্বশুরকুলে থাকলে তবু সহজেই দাবে থাকবে। আর কপাল যার মন্দ, তার পক্ষে শ্বশুরবাড়ির উঠোন ঝাট দিয়েও একবেলা একমুঠো ভাত খেয়ে পড়ে থাকা মান্যের। বাপ কাকার ভাত হল অপমান্যির ভাত।