কিন্তু সে তো দৈবাৎ।
ঔষধ নির্বাচনের জন্য চিন্তার বেশী সময় নিতে হয় না কবরেজ চাটুয্যেকে, রোগীর চেহারা দেখলেই মুহূর্তে রোগ এবং তার নিরাকরণ ব্যবস্থা দুইই তার অনুভূতির বাতায়নে এসে দাঁড়ায়। তাই চিন্তিত মূতিটা তার কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়। ঋজু দীর্ঘ দেহ– শালগাছের মত সতেজ, দুই হাত বুকের উপর আড়াআড়ি করে রাখা, প্রশস্ত কপাল, খড়গনাসা, আর দৃঢ়নিবদ্ধ ওষ্ঠাধরের ঈষৎ বঙ্কিম রেখায় আত্মপ্রত্যয়ের সুস্পষ্ট ছাপ। এই চেহারাই রামকালীর পরিচিত চেহারা। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম ঘটেছে, আজ রামকালীর মুখের রেখায় আত্মজিজ্ঞাসার তীক্ষ্ণতা।
তবে কি ভুল করলাম?
তবে কি ঠিক করি নি? তবে কি আরও বিবেচনা করা উচিত ছিল? কিন্তু সময় ছিল কোথা?
বার বার ভাবতে চেষ্টা করছেন রামকালী, তবে কি বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছেন? তাই একটা অবোধ শিশুর এলোমেলো কথার উপর এতটা মূল্য আরোপ করে এতখানি বিচলিত হচ্ছেন? কি আছে এত বিচলিত হবার? সত্যিই তো, ত্রিভুবনে সতীন কি কারো হয় না? অসংখ্যই তো হচ্ছে। বরং নিঃসপত্নী স্বামীসুখ কটা মেয়ের ভাগ্যে জোটে, সেটাই আঙুল গুনে বলতে হয়। কিন্তু এ চিন্তা দাড়াছে না। চেষ্টা করে আনা যুক্তি ভেসে যাচ্ছে হৃদয়-তরঙ্গের ওঠাপড়ায়। কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারছেন না একফোঁটা একটা মেয়ের কথাগুলোকে।
বহুবিধ গুণের সমাবেশে উজ্জ্বল বর্ণাঢ্য চরিত্র রামকালীর, পুরুষের আদর্শস্থল, তবু সে চরিত্রের গাঁথনিতে একটু বুঝি খুঁত আছে। মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেবার শিক্ষা আছে তার, শিক্ষা আছে বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান সমীহ করবার, কিন্তু সমগ্র ‘মেয়েমানুষ’ জাতটার প্রতি নেই তেমন সমবোধ, নেই সম্যক মূল্যবোধ।
যে জাতটার ভূমিকা হচ্ছে শুধু ভাত-সেদ্ধ কর! ছেলে ঠেঙাবার, পাড়া বেড়াবার, পরচর্চা করবার, কোন্দল করে অকথ্য অশ্রাব্য গালিগালাজ করবার, দুঃখে কেঁদে মাটি ভেজাবার আর শোকে উন্মাদ হয়ে বুক চাপড়াবার, তাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন এক অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছু আসে না রামকালীর। অবশ্য আচার-আচরণে ধরা পড়ে না, ধরা পড়ে না হয়তো নিজের কাছে– তবু অবজ্ঞাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু সম্প্রতি ক্ষুদে একটা মেয়ে যেন মাঝে মাঝে তাকে ভাবিয়ে তুলছে, চমকে দিচ্ছে, বিচলিত করছে, মেয়েমানুষ’ সম্পর্কে আর একটু বিবেচনাশীল হওয়া উচিত কিনা এ প্রশ্নের সৃষ্টি করছে।
আকাশে সন্ধ্যা নামে নি, কিন্তু তাল নারকেলের সারি-ঘেরা পুকুরের কোলে কোলে সন্ধ্যার ছায়া। এই প্রায়ান্ধকার পথটুকুতে পায়চারি করতে করতে সহসা রামকালীর চোখের দৃষ্টি ঈগলের মত তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। কে? ঘাটের পৈঠের একেবারে শেষ ধাপে অমন করে বসে ও কে? কই এতক্ষণ তো ছিল না, কখন এল? কোন পথ দিয়েই বা এল? আর কেনই বা এল এমন ভরা-ভরা সন্ধ্যায় একা? এ সময় ঘাটের পথে এমন একা মেয়েরা কদাচিৎ আসে, অবশ্য মোক্ষদা বাদে। কিন্তু দূর থেকে কে তা ঠিক বুঝতে না পারলেও মোক্ষদা যে নয়, সেটা বুঝতে পারলেন রামকালী।
তবে কে?
অভূতপূর্ব একটা ভয়ের অনুভূতিতে বুকের ভেতরটা কেমন সিরসির করে উঠল। রামকালীর পক্ষে এ অনুভূতি নিতান্তই নতুন।
অন্ধকার দ্রুত গাঢ় হয়ে আসছে, দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণতর করেও ফল হচ্ছে না, অথচ এর চেয়ে কাছাকাছি গিয়ে ভাল করে নিরীক্ষণ করবার মত অসঙ্গত কাজও রামকালীর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একেবারে অগ্রাহ্য করাই বা চলে কি করে? সন্দেহ যে ঘনীভূত হচ্ছে। এ আর কেউ নয়, নির্ঘাত রাসুর বৌ!
কিন্তু সত্য কি করল? সত্যবতী? পাহারা দেওয়ার নির্দেশটা পালন করল কই?
দিব্যি বড়সড় একটা কলসী ওর সঙ্গে রয়েছে মনে হচ্ছে।
যারা সাঁতার জানে, তাদের পক্ষে জলে ডুবে মরতে কলসীটা নাকি সহায়-সহায়ক। আর ছেলেমানুষ একটা মেয়ে যদি ওই কলসীটা গলায় বেঁধে
চিন্তাধারা ওই একটা দুশ্চিন্তার শিলা পাথরকে ঘিরেই পাক খেতে থাকে। কিছুতেই মনে আসে, অসময়ে জলের প্রয়োজনেও কলসী নিয়ে পুকুরে আসতে পারে লোক।
তবে এটা ঠিক, জল ভরবার তাগিদ কিছু দেখা যাচ্ছে না ও ভঙ্গীতে। কলসীর কানাটা ধরে চুপচাপ বসে থাকাকে কি তাগিদ বলে?
নাঃ, জলের জন্যে অন্য কেউ নয়, এ নির্ঘাত রাসুর বৌ। মরবার সংকল্প নিয়ে ভরসন্ধ্যায় একা পুকুরে এসেছে, তবু চট করে বুঝি সব শেষ করে দিতে পারছে না, শেষবারের মত পৃথিবীর রূপ রস শব্দ স্পর্শের দিকে তাকিয়ে নিতে চাইছে।
শুধুই কি তাই?
তাকিয়ে নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে ভাবছে না কি, কার জন্যে তাকে এই শোভা সম্পদ, এই সুখভোগ থেকে বঞ্চিত হতে হল?
হঠাৎ চোখ দুটো জ্বালা করে এল রামকালীর।
এই জ্বালা করাকে রামকালী চেনেন না। এ অনুভূতি সম্পূর্ণ নতুন, সম্পূর্ণ আকস্মিক।
কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে তো চলবে না, এখুনি একটা বিহিত করতে হবে। নিবৃত্ত করতে হবে মেয়েটাকে। অথচ উপায় বা কি? রামকালী তো আর মেয়ে-ঘাটে নেমে হাত ধরে তুলে আনতে পারেন না! পারেন না ওকে সদুপদেশ দিয়ে এই সর্বনাশা সংকল্প থেকে ফেরাতে! ডাকবেনই বা কি বলে? কোন্ নামে? রামকালী যে শ্বশুর।
অথচ এখান থেকে সরে গিয়ে কোনও মেয়েমানুষকে ডেকে নিয়ে আসবার চিন্তাটাও মনে সায় দিচ্ছে না। যদি ইত্যবসরে
আরে, আরে, স্থিরচিত্রটা চঞ্চল হয়ে উঠল যে!