মেয়েমানুষ জাতই কুয়ের গোড়া।
ঘরের লক্ষ্মী বলে সৌজন্য দেখালে কি হবে, এক-একটি মহা অলক্ষ্মী!
নইলে রেসোর এই বৌমা, কি বা বয়স, তার কিনা এত বড় কথা! জলে ডুবে মরবার সংকল্প। ছি ছি!
এই কথা বলেছেন বড় বৌমা?
অন্ধকার-মুখে বলেন রামকালী।
সাবি পিসী তো বলছিল।
বাবার মুখ দেখে এবার একটু ভয়-ভয় করে সত্যর। কিন্তু ভয় করলে তো চলবে না। তারও যে কর্তব্য রয়েছে– বাবাকে চৈতন্য করাবার।
এত বোধবুদ্ধি বাবার, অথচ সোয়ামী আর একটা বিয়ে করে আনলে মেয়েমানুষের প্রাণ ফেটে যায় কিনা সে জ্ঞান নেই! আর যদি না ফাটবে, তা হলে কৈকেয়ী কেন তিন যুগে হেয় হয়েও রামকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন? কথক ঠাকুরের কথাতেই তো শুনেছে সত্য।
রাজার রাণী তিনি, তার মনে এত বিষ!
আর বড়বৌ বেচারী নিরীহ ভালমানুষ, শুধু মনের ঘেন্নায় নিজে মরতে চেয়েছে।
সত্যর প্রাণে এত দাগা লাগার আরও একটা কারণ, বড়বৌকে দুটো সান্ত্বনার কথা বলবার মুখ তার নেই। নেই তার কারণ, এই মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক নাটকের নায়ক হচ্ছেন স্বয়ং সত্যবতীরই বাবা। ইশারায় ইঙ্গিতে ঘরে-পরে সকলেই তো রামকালীকেই দুষছে।
দুষবার কথাও। ছেলের মায়ের যে গৌরব আলাদা। বড়বৌ যদি ছেলের মা না হত তা হলে কথা ছিল। কেঁদে কেঁদে যদি ওর বুকের দুধ শুকিয়ে যায়, ছেলে বাঁচবে কিসে?
.
এদিকে রামকালী ভাবছেন বৌটাকে শায়েস্তা করার উপায় কি? গ্রামসুদ্ধ লোক নেমন্তন্ন করেছেন, রাত পোহালেই যজ্ঞি, ও যদি সত্যিই কিছু একটা অঘটন ঘটিয়ে বসে! অনেক ভেবে গলাটা ছেড়ে বললেন, ওসব হচ্ছে ছেলেবুদ্ধির কথা! তুমি আমার হয়ে বৌমাকে গিয়ে বলো গে, ওসব ছেলেমানুষী বুদ্ধি ছেড়ে দিতে। বলো গে, বাবা বললেন, মন ভাল করব ভাবলেই মন ভাল করা যায়। বলো গে, উঠুন, কাজকর্ম করুন, ভাল করে খান-দান, মনের গলদ কেটে যাবে।
সত্য আর একবার বাবার অজ্ঞতায় কাতর হয়। তবে শুধু কাতর হয়ে চুপ করেও থাকে না। একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, তা যদি কেটে যেত, তা হলে তো মাটির প্রিথিবীটা সগগো হত বাবা! রুগীর চেহারা দেখে তুমি ওপর থেকে বলে দিতে পারো তার শরীরের মধ্যে কোথায় কি হচ্ছে, আর মানুষের মুখ দেখে বুঝতে পারো না তার প্রাণের ভেতরটায় কি হচ্ছে? নিজের চোক্ষে প্রেত্যক্ষ একবার দেখবে চল তা হলে!
সহসা কেন কে জানে রামকালীর গায়ে কি রকম কাটা দিয়ে উঠল। চুপ করে গেলেন তিনি। তার অনেকক্ষণ পর হাত নেড়ে মেয়েকে ইশারা করলেন চলে যেতে।
এর পর আর চলে না যাওয়া ছাড়া উপায় কি? সত্য মাথা হেঁট করে আস্তে আস্তে ঘর থেকে চলে যায়।
কিন্তু এবারের ডাকের পালা রামকালীরই, আচ্ছা শোনো।
সত্যবতী ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়।
শোনো, বৌমাকে তোমার কিছু বলবার দরকার নেই, তুমি শুধু, মানে ইয়ে, তোমাকে খালি একটা কাজ দিচ্ছি
রামকালী ইতস্তত করছেন।
সত্যবতী অবাক হয়ে যায়।
নাঃ, আর যাই হোক বাবাকে কখনো এমন ইতস্তত করতে দেখে নি সত্য!
কিন্তু এ হেন পরিস্থিতিতেই বা কবে পড়েছেন রামকালী?
সত্যিই কি সত্যবতী তার চৈতন্য করিয়ে দিল নাকি? তাই রামকালী অমন বিব্রত বিচলিত?
বাবা কি করতে বলছিলেন?
ও হ্যাঁ, বলছিলাম যে তুমি তোমাদের বড়বৌ-এর একটু কাছে কাছে থাকো গে, যাতে তিনি ওই পুকুরের দিকেটিকে যেতে না পারেন।
সত্যবতী মুহূর্তকাল স্তব্ধ থাকে। বোধ করি বাপের আদেশের তাৎপর্যটা অনুধাবন করতে চেষ্টা করে। তার পর খুব সম্ভব অনুধাবন করেই নম্র গলায় বলে, বুঝেছি, বৌকে চোখে চোখে রেখে পাহারা দিতে বলছ।
পাহারা!
রামকালী যেন মরমে মরে যান।
তার আদেশের ব্যাখ্যা এই!
বিরক্তি দেখিয়ে বলেন রামকালী, পাহারা মানে কি? কাছে থাকবে, খেলাধুলো করবে, যাতে তার মনটা ভাল থাকে।
সত্যবতী সনিঃশ্বাসে বলে, ওই হল, একই কথা। কথায় বলে, যার নাম ভাজা চাল তার নাম মুড়ি, যার মাথায় পাকা চুল তারেই বলে বুড়ী। কিন্তু বাবা, পাহারা নয় দিলাম, ক’দিন ক’রাত দেব বলো? কেউ যদি আত্মঘাতী হব বলে প্রিতিজ্ঞে করে, কারুর সাধ্যি আছে আটকাতে? শুধুই তো চাটুয্যে-পুকুরের জল নয়, ধুতরো ফল আছে, কুঁচ ফল আছে, কলকে ফুলের বীচি আছে
চুপ চুপ!
রামকালী আতপ্ত নিঃশ্বাসে দাহ ছড়িয়ে বলে ওঠেন, চুপ করো। তোমার সেজ ঠাকুমা দেখছি ঠিকই বলেন। এত কথা শিখলে কোথা থেকে তুমি? যাও তোমাকে কিছু করতে হবে না, যাও!
১০. যাও বলে মানুষকে তাড়ানো যায়
যাও বলে মানুষকে তাড়ানো যায়, চিন্তাকে তাড়ানো যায় না। তাড়ানো যায় না মানসিক দ্বন্দ্বকে। সত্যবতীকে যাও’ বলে ঘর থেকে সরিয়ে দিলেন রামকালী, কিন্তু মন থেকে সরাতে পারছেন না সহসা উদ্বেলিত হয়ে-ওঠা এই চিন্তাটাকে, তাড়াতে পারছেন না এই দ্বন্দ্বটাকে।
তা হলে কি ঠিক করি নি?
তবে কি ভুল করলাম?
চিন্তার এই দ্বন্দ্ব রামকালীকেই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, ঘর থেকে চণ্ডীমণ্ডপে, চণ্ডীমণ্ডপ থেকে বারবাড়ির উঠোনে, সেখান থেকে বাগান বরাবর। কি জানি কেন, একেবারে চাটুয্যেপুকুরের ধারে ধারে পায়চারি করতে থাকেন রামকালী।
দীর্ঘায়ত শরীর সামনের দিকে ঈষৎ ঝোকা, দুই হাত পিঠের দিকে জোড় করা, চলনে মন্থরতা। রমিকালীর এ ভঙ্গীটা লোকের প্রায় অপরিচিত। দৈবাৎ কখনো কোনো জটিল রোগের রোগীর মরণ বাচন অবস্থায় চিন্তিত রামকালী এইভাবে পায়চারি করেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের পুঁথি নেড়ে ঔষধ নির্বাচন করেন না রামকালী, এইভাবে বেড়িয়ে বেড়িয়েই মনে করেন। হয়তো বা পুঁথির পৃষ্ঠাগুলো মুখস্থ বলেই সেগুলো আর না নাড়লেও চলে। শুধু ভেবে দেখলেই চলে।