হাতে অনেক কাজ।
তবু রামকালী বিবেচনা করলেন, সদুপদেশের দ্বারা কন্যার হৃদয়-কানন হতে সতীন-কণ্টকের মূলোৎপাটন করা কর্তব্য; তাই ভুরু কুঁচকেই বললেন তাই নাকি? সে মন্তরটা কি?
মন্তর কি একটা বাবা? সত্যবতী মহোৎসাহে বলে, গাদা গাদা মন্তর। সব কি ছাই মনেই আছে! ভেবে ভেবে বলছি রোসো। প্রথমে তো আলপনা আঁকা। ফুল-লতার নকশা কেটে তার ধারে কোণে হাতা-বেড়ি হড়িকুড়ি এস্তক ঘর-সংসারের প্রত্যেকটি জিনিস এঁকে নেওয়া। তা’পর একোটা একোটা ধরে ধরে মন্তর পড়তে হয়। হাতায় হাত দিলাম, বললাম–
হাতা, হাতা, হাতা,
খা সতীনের মাথা।
খোরায় হাত দিয়ে
খোরা গোরা পোরা,
সতীনের মাকে ধরে নিয়ে যাক
তিন মিনসে গোরা।
তা’পর
বেড়ি বেড়ি বেড়ি
সতীন মাগী চেড়ী।
বঁটি বঁটি বঁটি
সতীনের ছেরাদ্দর কুটনো কুটি।
হাঁড়ি হাঁড়ি হাঁড়ি,
আমি যেন হই জন্ম-এয়োস্ত্রী,
সতীন কড়ে রাঁড়ী।
চুপ চুপ।
রামকালী জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, এই সব তোমাদের মন্তর?
এই সব যে ব্রতের মন্তর হওয়ার উপযুক্ত নয়, সেই সত্যটা যেন সত্যর বোধের জগতে সহসা এই মুহূর্তে একটা চকিত আলোক ফেলে যায়। সে উৎসাহের বদলে মৃদুস্বরে বলে, আরও তো কত আছে–
আরও আছে? বটে! আচ্ছা বলো তো শুনি আরও কি কি আছে! দেখি কি ভাবে তোমাদের মাথাগুলো চিবানো হচ্ছে! জানো আরও?
হ্যাঁ। সত্য বড় করে ঘাড় কাত করে বলে, আর হচ্ছে–
ঢেঁকি ঢেঁকি ঢেঁকি,
সতীন মরে নিচেয় আমি উপুর থেকে দেখি!
তা’পর গে
অশ্বথ কেটে বসত করি,
সতীন কেটে আলতা পরি।
ময়না ময়না ময়না,
সতীন যেন হয় না।
তা’পর একমুঠো দুব্বো ঘাস নিয়ে বলতে হয়, ‘ঘাস মুঠি ঘাস মুঠি, সতীন হোক কানা কুষ্ঠি’। গয়না এঁকেও ছুঁয়ে ছুঁয়ে মন্তর আছে–
বাজু বন্দ পৈছে খাড়ু,
সতীনের মুখে সাত ঝাড়।
পান এঁকে বলতে হয়–
ছচি পান এলাচি গুয়ো–
আমি সোহাগী, সতীন দুয়ো—
আচ্ছা থাক হয়েছে। আর বলতে হবে না।
রামকালী হাত নেড়ে নিবৃত্ত করেন, এসব গালমন্দকে তোমরা পূজোর মন্তর বল?
আমরা বলি কি গো বাবা? সত্যবতী তার পণ্ডিত বাপের এহেন অজ্ঞতায় আকাশ থেকে পড়ে চোখ গোল গোল করে বলে, জগৎ সুদ্ধ সবাই বলে যে। সতীন যদি বোনের মত হবে, তবে এত মন্তরের স্রেজন হবে কেন? বোনের খোয়ারের জন্যে কি কেউ বত্ত করে? আসল কথা বেটাছেলেরা তো আর সতীনের মর্ম বোঝে না, তাই একটা ঢোক গিলে নেয় সত্য, কারণ বেটাছেলে সম্পর্কে পরবর্তী যে বাক্যটি জিভের আগায় এসে যাচ্ছিল, সেটা বাবার প্রতি প্রয়োগ করা সমীচীন কিনা বুঝতে না পেরে দ্বিধা এল।
রামকালী গম্ভীর মুখে বলেন, তা হোক, এ ব্রত তোমরা আর করো না।
করো না!
ব্রত করো না!
মাথায় বজ্রপাত হল সত্যর।
এ কী আদেশ! এখন উপায়?
একদিকে পিতৃআজ্ঞে, অপরদিকে ‘ব্রেতোপতিত’। বেতোপতিত হলে তো জলজ্যান্ত নরক; পিতৃআজ্ঞে পালন না করার পাতকটা ঠিক কতদূর গর্হিত না জানা থাকলেও, সেই পাতকের পাতকীকেও যে নরকের কাছাকাছি পৌঁছতে হবে এ বিষয়ে সত্য নিঃসন্দেহ।
অনেকক্ষণ দুজনেই স্তব্ধ।
তার পর আস্তে আস্তে কথাটা তোলে সত্য, ধরা বত্ত উজ্জাপন না করে ছেড়ে দিলে যে নরকগামিন হতে হবে বাবা!
না, হবে না। এসব ব্রত করলেই নরকগামী হতে হয়।
পিসঠাকুরমাকে তা হলে তাই বলব?
কি বলবে?
এই ইয়ে– সেঁজুতি করতে তুমি মানা করেছ?
আচ্ছা থাক, এখুনি তাড়াতাড়ি তোমার কিছু বলবার দরকার নেই। যা বলবার আমিই বলব এখন। তুমি যাও এখন। হাতটা সাবধান। কোথাও ঘষটে ফেলো না।
সত্যবতীর অবস্থাটা দাঁড়ায় অনেকটা ন যযৌ, না তস্থৌ।
বাবার হুকুম চলে যাওয়ার, অথচ মনের মধ্যে প্রশ্নের সমুদ্র। সে সমুদ্রের ঢেউ আর কার পায়ের কাছে আছড়ে পড়লে সুরাহা হবে– বাবা ছাড়া?
বাবা!
কি আবার?
বত্তটা যদি অন্যায়, সতীন যদি ভাল বস্তু, তা হলে বড় বৌয়ের অত কষ্ট হচ্ছে কেন?
বড়বৌ? রাসুর বৌ? কষ্ট হচ্ছে? সে তোমাকে বলেছে তার কষ্ট হচ্ছে?
রামকালীর কণ্ঠে ফের ধমকের সুর ছায়া ফেলে।
কিন্তু সত্যবতী দমে না।
ধিক্কারে দমে বটে সত্য কিন্তু ধমকে নয়। তাই বাকভঙ্গীতে সতেজতা এনে মোক্ষদার ভাষায় ‘কথার ভশ্চায্যি’র মতই তড়বড় করে বলে, বলতে যাবে কেন বাবা? সবই কি আর মুখ ফুটে বলতে হয়? চেহারা দেখে বোঝা যায় না? কেঁদে কেঁদে চোখ-মুখ বসে গেছে, অমন যে সোনার বণ্ন, যেন কালি মেড়ে দিয়েছে। পরশু থেকে মুখে একবিন্দু জল দেয় নি। নোকনজ্জায় বলছে বটে পেটব্যথা করছে তাতেই খিদে নেই, তাতেই কাঁদছি, কিন্তু বুঝতে সবাই পারছে। কে আর ঘাসের ভাত খায় বল? মড়ার ওপর খাড়ার ঘা, তার ওপর আবার আজ নতুন বো’র হাতের সুতো খোলা! কেউ বলছে বড়বৌকে অন্য ঘরে দিয়ে ওই ঘরেই নেমকর্ম হবে, কেউ বলছে আহা থাক। বড়বৌ নাকি ও বাড়ির সাবি পিসীকে বলেছে, অত ধন্দয় কাজ নেই, চাটুয্যে-পুকুরে অনেক জায়গা আছে, তাতেই আমার ঠাই হবে।
সর্বনাশ!
প্রমাদ গণেন রামালী।
মেয়েমানুষের অসাধ্য কাজ নেই।
কে বলতে পারে মেয়েটা সত্যিই ওরকম কোন দুর্মতি করে বসবে কি না। এও তো মহাজ্বালা। কোথায় ভদ্রলোকের জাত-মান উদ্ধারের কথা ভেবে আনন্দ করবি, তা নয় এই সব প্যাঁচ!…. কেন, ত্রিভুবনে আর কারো সতীন হয় না?
হয়েছে আর কি, ওইসব অখদ্যে ব্রতপার্বণ করিয়ে শিশুকাল থেকে মেয়েগুলোর পরকাল ঝরঝরে করে রাখা হয়েছে কিনা!