রামকালী পিসীর দিকে একনজর তাকিয়ে নিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে কন্যাকে পুনঃপ্রশ্ন করেন, কই, আমার কথার জবাব দিলে না? বললে না। সতীনকাটা কি জিনিস আর তার জ্বলাটাই বা কী বস্তু?
কী বস্তু সে কথা কি ছাই সত্য জানে? তবে বস্তুটা যে খুব একটা মর্মবিদারি দুঃখজনক, সেটা বোধ করি জন্মাবার আগে থেকেই জানে। তাই মুখটা যথাসম্ভব করুণ করে তুলে বলে, সতীন মানেই তো কাটা বাবা! আর কাটা থাকলেই তার জ্বালা আছে! বড়বৌ-এর প্রাণে তো এখন তুমি সেই জ্বালা ধরিয়ে দিলে–
থামো! হঠাৎ ধমকে উঠলেন রামকালী। বিচলিত হয়েছেন তিনি, বাস্তবিকই বিচলিত হয়েছেন এতক্ষণে। বিচলিত হয়েছেন মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে নয়, সহসা মেয়ের অন্তরের মলিনতার পরিচয় পেয়ে।
এ কী?
এ রকম তো ধারণা ছিল না তার ছিল না হিসাবের মধ্যে। এটা হল কোন্ ফাঁকে? সত্যবতীর বহুবিধ নিন্দাবাদ তার কানে এসে ঢোকে, সে-সব তিনি কখনোই বড় একটা গ্রাহ্য করেন না। করেন শুধু মেয়ের স্বভাব-প্রকৃতিতে একটা নির্মল তেজের প্রকাশ লক্ষ্য করে। সত্যর হৃদয়ে হিংসাদ্বেষের ছায়ামাত্র নেই, এইটাই জমা ছিল হিসাবের খাতায়, এহেন নীচ হিংসুটে কথাবার্তা শিখে ফেললো সে কখন? কিন্তু বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়, শাসনের দরকার।
তাই আরও বাঘ-গর্জনে বলে ওঠেন, কেন, সতীন কিসে এত ভয়ঙ্করী হল? সে এসে ধরে মারছে তোমাদের বড়বৌকে?
বার বার বাঘা-হুমকিতে সত্যবতীর চোখে জল উপচে এসে পড়ছিল, কিন্তু সহজে হার মানে না সে। আর কাঁদার দৈন্যটা প্রকাশ হয়ে পড়বার ভয়ে কষ্টে ঘাড় নিচু করে ধরা গলায় বলে, হাতে না মারুক, ভাতে মারছে তো? বড়বৌ একলা একেশ্বরী ছিল, নতুন বৌ হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসল–
আ, ছি ছি ছি!
রামকালী শিউরে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মুখ দেখে মনে হল, সত্যবতী যেন সহসা তাঁর যত্নে আঁকা একখানি ছবিকে মুচড়ে দুমড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
এই ফাঁকে মোক্ষদা আবার একহাত নেন, ওই শোনো! শোনো মেয়ের কথার ভঙ্গিমে! সাধে বলি কথার ভশ্চায্যি! বুড়ো মাগীদের মতন কথা, আর ছেলেপেলের মতন দস্যিচাল্লি! হরঘড়ি অবাক করে দিচ্ছে কথার জ্বালায়!
রামকালী পিসীর আক্ষেপে কান না দিয়ে তিক্তবিরক্ত স্বরে বললেন, এমন ইতর কথাবার্তা কোথা থেকে শিখেছ? ছি ছি ছি! লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার। উড়ে এসে জুড়ে বসা মানে কি? এক বাড়িতে দুটি বোন থাকে না? সতীনকে কাঁটা না ভেবে বোন বলে ভাবা যায় না?
.
বাবা এত ঘেন্না দেওয়ার পর অবশ্য সত্যবতীর সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। একসঙ্গে অগুনতি ফোঁটা ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে চোখ থেকে গালে, গাল থেকে মাটিতে। পড়তেই থাকে, হাত তুলে মোছে না সত্য।
রামকালী চাটুয্যে আর একবার বিচলিত হন। সত্যবতীর চোখে জল! এটা যেন একটা অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য মনে হচ্ছে। মনে হল ঘেন্নাটা বোধ করি একটু বেশী দেওয়া হয়ে গেছে।
ঔষধে মাত্রাধিক্য, রামকালীর পক্ষে শোচনীয় অপরাধ। মনে পড়ল, মেয়েটার হাতের ফোস্কাটাও কম জ্বালাদায়ক নয়। এখুনি প্রতিকার করা দরকার। তাই ঈষৎ নরম গলায় বলেন, এরকম নীচ কথা আর বলো না, বুঝলে? মনেও এনো না। সংসারে যেমন ভাই বোন ননদ দেওর জা ভাসুর সব থাকে, তেমনি সতীনও থাকে, বুঝলে? কই দেখি হাতটা!
হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে সত্যবতী নিজের উদ্বেল হৃদয়ভারকে সামলাতে চেষ্টা করে দাঁতে ঠোঁট চেপে।
মোক্ষদা বোঝেন মেঘ উড়ে গেল। হয়ে গেল রামকালীর মেয়ে শাসন করা। ছি ছি ছি! আর দাঁড়াতে ইচ্ছে হল না, বললেন, যাক গে, শাস্তি শাসন হয়ে গেছে তো? এবার মেয়েকে সোহাগ করো বসে বসে। তুমিই দেখালে বটে বাবা!
রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নেন মোক্ষদা।
রামকালী আশু প্রতিকার হিসাবে একটা প্রলেপ মেয়ের ফোস্কা ঘায়ে লাগাতে লাগাতে সহসা আবার বলেন, আজকের কথা মনে থাকবে তো? আর কোন দিন এ রকম কথা বলো না, বুঝলে? মানুষ তো বনের জানোয়ার নয় যে খালি হিংসেহিংসি কামড়াকামড়ি করবে! সকলের সঙ্গে মিলেমিশে সবাইকে ভালবেসে পৃথিবীতে থাকতে হয়।
বাবার গলায় আপসের সুর।
অতএব ফের একটু সাহস সঞ্চয় হয় সত্যবতীর। তা ছাড়া প্রাণটা তো ফেটে যাচ্ছে বাবার ধিক্কারে। কিন্তু তারই বা দোষ কোথায় বুঝে উঠতে পারে না সত্যবতী। সবাইকে ভালবেসে থাকাই যদি এত ধম্মে হয়, তা হলে সেঁজুতি বত্তটি করতে হয় কেন?
মনের চিন্তা মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ে সত্যর, তাই যদি, তা হলে সেঁজুতি বত্ত করতে হয় কেন বাবা? পিসঠাকুরমা তো এ বছর থেকে আমাকে ফেন্তুকে আর পুণ্যিকে ধরিয়েছে!
রামকালী এবার বিরক্তির বদলে বিস্মিত হন। সেঁজুতি বত্ত সম্পর্কে অবশ্য তিনি সম্যক অবহিত নন, কিন্তু যাই হোক, কোনও একটি ব্রত যে মানবতাবোধ-বিরোধী হওয়া সম্ভব, সেটা ঠিক ধারণা করতে পারেন না। তাই প্রলেপের হাতটা ঘরের কোণে রক্ষিত মাটির জালার জলে ধুতে ধুতে বলেন, ব্রতের সঙ্গে কি?
কি নয় তাই বলো না কেন বাবা? চোখের জল শুকোবার আগেই সত্যর গলার সুর শুকনো খটখটে হয়ে ওঠে, সেঁজুতি বত্তর যত মন্তর সব সতীনকাটা উদ্ধারের জন্যে নয়?
রামকালী একটুক্ষণ চুপ করে থাকেন।
কোথায় যেন একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। হু, এই রকমই একটা কিছু গোলমেলে ব্যাপার ঢুকে গিয়েছে মেয়ের মাথায়। নচেৎ সত্যর মুখে অমন কথা!