দলিল আর কি! লিখিত্ব পড়িত্ তো কিছু নয় সই-সবুদও নয়, মানুষের স্মরণ-সাক্ষ্যই দলিল তা সেই স্মরণ-সাক্ষ্য আদায় করতে হলে গ্রাম-সমাজকে একদিন গলবস্ত্ৰে ডেকে এনে উত্তম ফলার খাইয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় কি?
তা ছাড়া বাঁড়ুয্যেদের মেয়ে যে চাটুয্যে পরিবারভুক্ত হল, তার স্বীকৃতিটাও তো দিতে হবে? বৌভাতের যজ্ঞিতে নতুন বৌয়ের হাত দিয়ে ভাত পরিবেশন করিয়ে জ্ঞাতিকুটুম্বের কাছ থেকে সেই স্বীকৃতি নেওয়া।
অতএব বিয়েতে যজ্ঞির আয়োজন না করলেই নয়। আগে থেকে বিলিবন্দেজ নেই, হুট্ক্কারি করে বিয়ে, তাই ভোজের আয়োজনেও হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। অনুগত জনের অভাব নেই রামকালীর, দিকে দিকে লোক ছড়িয়ে দিয়েছেন। জনাইতে মনোহরার বায়না গেছে, বর্ধমানে মিহিদানার। তুষ্ট গয়লাকে ভার দেওয়া হয়েছে দৈ-এর, আর ভীমে জেলেকে ডেকে পাঠিয়েছেন মাছের ব্যবস্থা করতে। কোন পুকুরে জাল ফেলবে ক-মণ তোলা হবে, এই সব নির্দেশ দিচ্ছিলেন রামকালী, সহসা সেই আসরে এসে উপস্থিত হলেন মোক্ষদা।
এ তল্লাটে রামকালীকে ভয় করে না এমন কেউ নেই, বাদে মোক্ষদা। রামকালীর মুখের উপর হক কথা শুনিয়ে দেবার ক্ষমতা একা মোক্ষদা রাখেন। নইলে দীনতারিণী পর্যন্ত তো ছেলেকে সমীহ করে চলেন।
অবিশ্যি ভাবা যেতে পারে রামকালীকে হক কথা শুনিয়ে দেবার সুযোগটা আসে কখন? যে মানুষটা কর্তব্যপালনে প্রায় ত্রুটিহীন, তাকে দুকথা শুনিয়ে দেবার কথা উঠছে কি করে?
কিন্তু ওঠে।
মোক্ষদা ওঠান। কারণ মোক্ষদার বিচার নিজের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে। রামকালীর মতে যেটা নিশ্চিত কর্তব্য, প্রায়শই মোক্ষদার মতে সেটা অনর্থক বাড়াবাড়ি।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক কথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সত্যবতী। হবে না-ই বা কেন? রামকালী যদি এমন মেয়ে গড়ে তোলেন যেমন মেয়ে ভূ-ভারতে নেই, তাহলে আর কথা শোনানোয় মোক্ষদার দোষ কি? সৃষ্টিছাড়া ওই মেয়েটাকে তাই যখন-তখন তার বাপের সামনে হাজির করে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করতেই হয় মোক্ষদাকে।
আজও তাই রামকালীর দরবারে একা আসেন নি মোক্ষদা, এনেছেন সত্যবতীকে সঙ্গে করে। সত্যবতীও এসেছে বিনা প্ৰতিবাদে। অবশ্য প্ৰতিবাদে লাভ নেই বলেই হয়তো এই অপ্ৰতিবাদ। অথবা হয়তো এটা তার নির্ভীকতা।
ভীমে জেলের উপস্থিতির কালটুকু অবশ্য নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিলেন মোক্ষদা। কথার শেষে ভীম রামকালীকে দণ্ডবৎ হয়ে প্ৰেণাম করে চলে যাবার পরীক্ষণেই মোক্ষদা যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
এই নাও রামকালী, তোমার গুণের অবতার কন্যের হাতের চিকিচ্ছে করো এবার। আর চেরটাকালই করতে হবে তোমাকে, এ মেয়েকে তো আর শ্বশুরঘর থেকে নেবে না। একটু দম নিলেন মোক্ষদা।
মোক্ষদা দম নেবার অবকাশে রামকালী মৃদু হেসে বলেন, কি? কি হল আবার?
হয়েই তো আছে সমস্তক্ষণ, মোক্ষদা দুই হাত নেড়ে বলেন, উঠতে বসতেই তো হচ্ছে। কাটছে ছিঁড়ছে ছড়ছে। এই আজ দেখা মেয়ের হাতের অবস্থা। পুড়িয়ে-ঝুড়িয়ে এতখানি এক ফোস্কা! আবার বলে কি বলতে হবে না বাবাকে, এমনি সেরে যাবে! দেখো তুমি নিজের চক্ষে।
ইত্যবসরে রামকালী মেয়ের হাতখানা তুলে ধরে শিহরিত হয়েছেন।
কী ব্যাপার? এ কি করে হল?
কি করে হয়েছে শুধোও-ওকেই শুধোও। মেয়ের গুণের কথা এত বলি, কথা কানে করো না তো! তবে তোমাকে এই বলে রাখছি রামকালী, এই মেয়ে হতেই তোমার ললাটে দুঃখু আছে।
কথাটা নতুন নয়, কাঁহ ব্যবহৃত। কাজেই রামকালী যে বিশেষ বিচলিত হন এমন নয়। তবে বাইরে গুরুজনকে সমীহ করবার শিক্ষা রামকালীর আছে, তাই বিচলিত ভাবটা দেখান।
নাঃ, মেয়েটাকে নিয়ে—! আবার কি করলি? এত বড় ফোস্কা পড়ল কিসে?
দুধ ওথলানো হচ্ছিল গো। কালকে যখন রেসো বৌ নিয়ে এসে ঢুকল, উনি গেলেন পাতা জ্বেলে দুধ ওথলাতে! আর এও বলি, এত বড় বুড়ো ধিঙ্গী মেয়ে, এটুকু করতে হাতই বা পোড়ালি কি दळल?
রামকালী মেয়ের হাতের অবস্থাটা নিরীক্ষণ করে ঈষৎ গম্ভীর হয়ে মেয়ের উদ্দেশেই বলেন, আগুনের কাজ তুমি করতে গেলে কেন? বাড়িতে আর লোক ছিল না?
সত্য ঘাড় নিচু করে বলে, বেশী জ্বালা করছে না। বাবা।
জ্বালা করার কথা হচ্ছে না, করলেও সে জ্বালা নিবারণের ওষুধ অনেক আছে। জিজ্ঞেস করছি, তুমি আগুনে হাত দিতে গেলে কেন?
সত্য এবার ঘাড় তোলে। তুলে সহসা নিজস্ব ভঙ্গীতে তড়বড় করে বলে ওঠে, আমি কি আর সাধে আগুনে হাত দিয়েছি বাবা, বড়বৌয়ের মুখ চেয়েই দিয়েছি। আহা বেচারী, একেই তো সতীনকাঁটার জ্বালা তার ওপর আবার দুধ ওথলাবার হুকুম। মানুষের প্রাণ তো!
সত্যর এই পরিষ্কার উত্তরপ্রদানে এক রামকালীই নয়, মোক্ষদাও তাজ্জব বনে যান। এ কী সর্বনেশে মেয়ে গো! ওই হোমরাচোমরা বাপের মুখের ওপর এই চোটপাট উত্তর! গালে হাত দিয়ে নির্বাক হয়ে যান মোক্ষদা। কথা বলেন রামকালীই। দুই ভ্রূ কুঁচকে ঝাঁঝালো গলায় বলেন,
কি জিনিস সে কথা তুমি তোমার মেয়ের কাছেই এবার শেখে। রামকালী! মোক্ষদা সত্যবতীর আগেই তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের স্বরে বলেন, আমরা এতখানি বয়সে যা কথা না শিখেছি, এই পুঁটকে ছুঁড়ী তা শিখেছে! কথার ধুকড়ি!
সত্য এই সব উলটোপালটো কথাগুলো দুচক্ষের বিষ দেখে। কেন রে বাপু, যখন যা সুবিধে তখন তাই বলবে কেন? এই এক্ষুণি সত্যকে বলা হলো বুড়ো ধিঙ্গী, আবার এখন বলা হচ্ছে পুঁটকে ছুঁড়ী! সবই যেন ইচ্ছে-খুশী!