তা তো এলো- নন্দরাণী বিপন্নমুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠেন, দিদি, বরকনে এসে পড়ল শুনছি—
বরকনে! এসে পড়ল!
দীনতারিণী কুটনো ফেলে ছুটে এলেন, এখুনি এসে পড়ল? রামকালীর কি এতেও তাড়াহুড়ো?
বারবেলা পড়বার আগেই বোধ করি নিয়ে এসেছেন রামকালী।
যদিচ ভাসুরপো, তথাপি ধনে-মানে এবং সর্বোপরি বয়সে বড়। কাজেই নন্দরাণী রামকালী সম্পর্কে ছেন দিয়েই বাক্যবিন্যাস করেন। এখনো করলেন।
দীনতারিণী বারবেলা শব্দটায় মনকে স্থির করে নিয়ে বললেন, তা হবে। তা তোমাদের নেমকন্মর সব প্ৰস্তুত?
নন্দরাণী আরও ব্যস্ত হাতে হাতের কোজ সারতে সারতে বলেন, প্রস্তুত তো একরকম সবই, কিন্তু দুধটা যে ওথলাতে হবে! সেটা আবার এখন কে করবে?
দুধা! তাই তো!
ওথলানোর দরকার বটে!
বৌ এসে সদ্য উথলে পড়া দুধ দেখলে, সংসার নাকি ধন-ধান্যে উথলে ওঠে।
দীনতারিণী উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করলেন, বড় বৌমা কোথায় গেলেন?
বড় বৌমা? সে তো রান্নাশালে! তাড়াহুড়ো করে একঘর বেঁধে রাখতে হবে তো! বৌ এসে দৃষ্টি দেবে।
বড় বৌমা অর্থ রাসুর মা। তাকে তাই বলে তো নন্দরাণী।
কারণ নন্দরাণী বয়সে রাসুর মার সমবয়সী হলেও মান্যে বড়, সম্পর্কে খুড়-শাশুড়ী, কাজেই বৌমা।
যাই হোক, কুঞ্জর বৌ রান্নাশালে।
অতএব দুধ ওথলাতে আর কাউকে দরকার। ওদিকে বর-কনে আগতপ্ৰায়।
দীনতারিণী মনশ্চক্ষে চারিদিক তাকিয়ে নেন, আর কে আছে? অখণ্ডপোয়াতি সোয়ামীর প্রথম পক্ষী!
দ্বিতীয় তৃতীয় পক্ষ দিয়ে তো আর পুণ্যকর্ম হবে না?
কে আছে?
ওমা, ভাবার কি আছে?
সারদাই তো আছে!
তাকেই ডাক দেওয়া হোক তবে। একা ঘরের কোণে বসে রয়েছে মনমরা হয়ে, কাজকর্মে ডাকলে তবু মনটা অন্যমনস্ক হবে–তা ছাড়া নতুন লোক নির্বাচনের সময়ই বা কোথা?
সত্য উঠোন পার হচ্ছিল তীরবেগে, দীনতারিণী তাকেই ডাক দিলেন, এই সত্য, ধিঙ্গী অবতার! যা দিকিনী, বড় না।তবৌমাকে ডেকে আন দিকিন শীগগির, বরকনে এসে পড়ল পেরায়, দুধ ওথলাতে হবে।
বৌকে? বড়দার বৌকে ডেকে দেব? সত্য দুই হাত উলটে বলে, বৌ কি আর বৌতে আছে? ভোর থেকে মাটিতে পড়ে কেন্দে কেন্দে মরছে!
কেঁদে কেঁদে মরছে? দীনতারিণী বিরক্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন, একেবারে মরছেন। কেন, এতে মরবার কি হল? ওমা, শুভদিনে ইকি অলক্ষণে কাণ্ড! যা, শীগগির ডেকে আন।
সত্য এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, কে বাবা ডাকতে যায়! তুমি তো বললে কাঁদবার কি হয়েছে? বলি নিজের যদি হত? সতীন আছে কাঁদবে না, আহ্লাদে উর্ধবাহু হয়ে নাচবে মানুষ! হেঁ! কই, কোথায় কি আছে তোমাদের? আমিই দিচ্ছি। দুধ জ্বাল দিয়ে!
তুই? তুই দিবি দুধ জ্বল?
কেন, দিলেই বা! সত্য সোৎসাহে বলে, পিসঠাকুমা যে সেবার খুন্তির দিদির বিয়েতে বলল, সত্যর বছর ঘুরে গেছে, এখন এয়োডালায় হাত দিতে পারে!
বছর ঘুরে অর্থাৎ বিয়ের বছর ঘুরে।
সেটা আর স্পষ্টাম্পষ্টি উচ্চারণ করল না। সত্য।
দীনতারিণী সন্দিগ্ধ সুরে বলেন, বছর ঘুরলেই বুঝি হল? ঘরবসতি না হলে—
জানি নে বাবা। রাখো তোমাদের সন্দ। আমি এই হাত দিলাম।
বলেই সত্য দাওয়ার পাশে দুখানা ইট পাতা উনুনের উপর জ্বলে বসানো ছোট্ট সরা চাপা মাটির হাঁড়িটার নিচে ফুঁ দিতে শুরু করে।
ঘুঁটের আগুন জ্বলছে ধিকি ধিকি, ফুঁ পেড়ে দু-চারখানা নারকেলপাতা ঠেলে দিলেই জ্বলে উঠবে। দাউ দাউ করে। তা গোছালো মেয়ে নন্দরাণী নারকেল পাতার গোছাও এনে রেখেছেন পাশে।
সত্যর সকল কাজই উদ্দাম।
তার ফুঁয়ের দাপটে বরকনে আসার আগেই দুধ ওথলাতে শুরু করল। উথরে ধোঁয়া ছড়িয়ে ভেসে গেল। গড়িয়ে পড়ে।
দীনতারিণী হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ওরে একটু রয়ে-বসে, নতুন বৌ ঢোকা মাত্তর যেন দেখতে পায়।
কথা শেষ হবার আগে বাইরের উঠোনে শাঁখ বেজে উঠল।
অর্থাৎ শুভাগমন ঘটেছে নতুন বৌয়ের।
মোক্ষদা শাঁখ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাইরে। আজ পূর্ণিমা, বিধবাদের ঘরে রান্নার ঝামেলা নেই, কোন এক সময় আমকাঁঠাল ফল মিষ্টি খেলেই হবে। কাজেই আজ ছুটি মোক্ষাদাদের।
ছুটিই যদি, তবে ছোটাছুটি না করবেন কেন মোক্ষদা? স্নান তো করতেই হবে জল খাবার আগে।
তাই মোক্ষদাই অগ্রণী হয়ে বারবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন। আছেন শাঁখ হাতে নিয়ে।
শুভকর্মে বিধবারা সমস্ত কর্মে অনধিকারী হলেও, এই একটি কর্মে তাদের অধিকার আছে, সমাজ অথবা সমাজপতিরা বোধ করি এটুকু আর কেড়ে নেন নি, ক্ষ্যামা-ঘেন্না করে ছেড়ে দিয়েছেন। শাক আর উলু।
অতএব সেই অধিকারটুকুর সম্যক সদ্ব্যবহার করতে থাকেন মোক্ষদা রাসুর দ্বিতীয় অভিযানান্তে। ৩।বর্তন উপলক্ষ্যে।
দীনতারিণী উদ্গ্ৰীব হয়ে এগিয়ে যেতে যেতে চমকে উঠে বলেন, আমন করে ফুঁ দিচ্ছিস যে সত্য? পোড়ালি বুঝি?
সত্য তাড়াতাড়ি সত্য গোপন করে ফেলে বলে, পোড়াবো কেন, হুঁ!
তবে হাতে ফুঁ পাড়ছিস কেন?
এমনি।
যাক এবার উনুনে ফুঁ পাড়, ঢোকার সময় যেন আর একবার দুধটা ফেপে ওঠে, তা উঠেছে, বৌ পয়মন্ত হবে। সেবার বরং-
কথা শেষ হবার আগেই রামকালীর গভীর কণ্ঠনিনাদ ধ্বনিত হল, তোমাদের ওই সব বরণ-টরণ তাড়াতাড়ি সেরে ফেলো ছোটপিসী, পিছনে পিছনে পাড়া ঝেটিয়ে অবগুণ্ঠনবতীর দল।
.
বিয়েটা যেভাবে আর যে অবস্থাতেই ঘটে থাকুক, বৌভাতের যজ্ঞি। একটা করতেই হবে। আমোদ-আহ্লাদের প্রয়োজনে নয়, সমাজ-জানিত করবার প্রয়োজনে। খামকা একদিন হূঁট করে লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যের পৌত্রী এসে চাটুয্যেবাড়ির অন্দরে সামিল হল, কাকে-পক্ষীতে টের পেল না, এটা তো আর কাজের কথা নয়। তার প্রবেশটা যে বৈধ, এ খবরটুকুর একটা পাকা দলিল তো থাকা চাই।