নয়, নয়, নয়! হল তো? তিন সত্যি করেছিল রাসু।
মাত্র গতরাত্রে।
আর আজ সেই রাসু, এই টোপর চেলি পরে কলাতলায় দাঁড়িয়ে আছে, এই মাত্তর যে গিন্নীমানুষটা বরণ করছিল সে বলে উঠেছে, কড়ি দিয়ে কিনলাম, দড়ি দিয়ে বাঁধলাম, হাতে দিলাম মাকু, একবার ভ্যা কর তো বাপু!
একটা মানুষকে কতবার কেনা যায়?
বাঁধা জিনিসটাকে আবার কি ভাবে বাঁধা যায়?
হায় ভগবান, রাসুকে এমন বিড়ম্বনায় ফেলে কি সুখ হল তোমার?
আহা, রাসু যদি ঠিক আজকেই গায়ে না থাকত! রুগী দিদিমাকে দেখতে এমন তো মাঝে মাঝে গা ছেড়ে ভিনগায়ে যায় রাসু। আজই যদি তাই হত! যদি দিদিমা বুড়ী টেসে গিয়ে ওখানেই আজ আটকে ফেলত রাসুকে!
যদি ঠিক এই সময় জ্ঞাতিগোত্তর কেউ মরে গিয়ে অশৌচ ঘটিয়ে রাখত রাসুদের! যদি রাসুরও এদের সেই বরটার মতন আচমকা একটা শক্ত অসুখ করে বসত!
তেমন কোন কিছু ঘটলে তো আর বিয়ে হতে পারত না!
কন্যাদায়গ্ৰস্ত বিপন্ন ভদ্রলোকের বিপদের কথা মনের কোণেও আসে না রাসুর, মরুক চুলোয় যাক ওরা, রাসুর এ কী বিপদ হল!
এ যদি কাকা রামকালী না হয়ে বাবা কুঞ্জবেহারী হত! বাবা যদি বলত, ভদ্রলোকের বিপদ উপস্থিত রাসু, দ্বিধা-দ্বন্দূের সময় আর নেই, চল ওঠ। তা হলেও হয়ত বা রাসু খানিক মাথা চুলকোতে বসত!
কিন্তু এ হচ্ছে যার নাম মেজকাকা, যার হুকুমের ওপর আর কথা চলে না।
অনেক যদির শেষে অবশেষে হতাশচিত্ত রাসু এ কথাও ভাবল, আর কিছুও না হোক, যদি গতরাত্রে রাসুগ্ৰীষ্মের কারণে বারবাড়িতে শুতে যেত! তা হলে তো ওই সত্যবন্দীর দায়ে পড়তে হত না তাকে!
এর পর কি আর জন্মে কোন দিন কোন ব্যাপারে রাসুকে বিশ্বাস করতে পারবে সারদা? বিশ্বাস করতে পারবে, এক্ষেত্রে রাসু বেচারাও সারদার মতই নিরূপায়? কোন হাত ছিল না তার! নাঃ, বিশ্বাস করবে না। সারদা, বলবে, বোঝা গেছে বোঝা গেছে! বেটা ছেলেদের আবার মন-মায়া! বেটা ছেলের আবার তিন-সত্যি!
কিন্তু কথাই কি আর কখনো কইবে সারদা? হয়তো জীবনে আর কথা কইবে না। রাসুর সঙ্গে, নয়তো দুঃখে অভিমানে মনের ঘেন্নায়— হঠাৎ রাসুর মনশ্চক্ষে বিশালকায় চাটুয্যেপুকুরের কাকচক্ষু জলটার দৃশ্য ভেসে ওঠে।
মনের ঘেন্নায় আজ রাত্তিরেই সারদা কিছু একটা করে বসবে না তো!
বুকের ভেতরটা কে যেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চিরে চিরে নুন দিচ্ছে। রাসু বুঝি আর চুপ করে থাকতে পারবে না, বুঝি হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠবে।
না, চেঁচিয়ে ওঠে নি। রাসু, তবে মুখের চেহারা দেখে কন্যাপক্ষের কে একজন বলে উঠল, বাবাজীর কি শরীর অসুস্থ বোধ হচ্ছে?
আবার বিয়ের বরের শরীর অসুস্থ!
লক্ষ্মীকান্ত একবার এই হিতৈষী-সাজা দুর্মুখটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ দিলেন, ওরে কে আছিস, আর একখানা হাতপাখা নিয়ে আয় দিকি, নতুন নাতজামাইয়ের মাথার দিকে বাতাসটা একটু জোরে জোরে দে।
জোর জোর বাতাসে মুখের চেহারাটা রাসুর সত্যি একটু ভাল দেখাল। আর না দেখালেই বা কি, ততক্ষণে তো বিয়ে সাঙ্গ হয়ে গেছে, বরকনেকে লক্ষ্মীর ঘরে প্ৰণাম করিয়ে বাসরে বসাতে নিয়ে যাচ্ছে সবাই ধরে ধরে, পায়ের গোড়ায় ঘটি ঘটি জল ঢালতে ঢালতে।
সেখানে আবারও তো সেই সেবারের মতন উপদ্রব হবে! সারদার বাপের বাড়ির সেই সব মেয়েমানুষদের বাক্যি আর বাঁচালতা মনে করলে রাসুর এখনো হৃৎকম্প হয়।
আবার তেমনি ভয়ঙ্কর একটা অবস্থার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে এখন রাসুকে!
সম্পূর্ণ অসহায়, সম্পূর্ণ নিরস্ত্র।
হঠাৎ রাসু দার্শনিকের মত নিজের ব্যক্তিগত দুঃখজ্বালা ভুলে একটা বিরাট দর্শনের সত্য আবিষ্কার করে বসে!
মানুষ কি অদ্ভুত নির্বোধ জীব!
এই কুশ্রী কদৰ্যতাকে ইচ্ছে করে জীবনে বার বার সোধে নিয়ে আসে, বার বার নিজেকে কানাকড়িতে বিকেয়!
পরদিন সকালে এখানে বৌছত্ৰ আঁকা হচ্ছিল।
ইচ্ছে-শখের বিয়ের মত নিখুঁত করে বাহার করে না হোক নিয়মপালাটা তো বজায় রাখতে হবে?
আর এত বড় উঠোনটায় যেমন-তেমন করে একটু আলপনা ঠেকাতেও এক সেরা পাঁচ পো চাল না ভিজোলে চলবে না।
তা সেই পাঁচপো চালই ভিজিয়ে দিয়েছিলেন রামকালীর খুড়ী নন্দরাণী। রামকালীর নিজের খুড়ী নয়, জেঠতুতো খুড়ী। সংসারের যত কিছু নিয়মলক্ষণ নিতাকিতের কাজের ভার নন্দরাণীর আর কুঞ্জর বৌয়ের উপর। কারণ ওরাই দুজন হচ্ছে একেবারে অখণ্ডপোয়াতি। কুঞ্জর বৌয়ের তো সাতটি ছেলেমেয়েই ষোটের কোলে খোসমেজাজে বাহাল তবিয়াতে টিকে আছে।
নন্দরাণীর অবশ্য মাত্র দু-তিনটিই।
সে যাক, বিয়ের ব্যাপারে নিয়মপালার কাজের সব কিছুই যখন নন্দরাণীর দখলে–তখন এক্ষেত্রেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? কাজেই রাসুর এই বিয়েটাকে মনে মনে যতই অসমর্থন করুন নন্দরাণী, পুরো পাঁচপো আতপ চালই ভিজিয়ে দিয়েছিলেন তিনি উঠোনে বৌছত্তর আঁকতে। দুধে আলতার প্রকাণ্ড পাথর বসিয়ে তাকে কেন্দ্র করে আর ঘিরে ঘিরে দ্রুতহস্তে ফুল লতা শাঁখ পদ্ম একে চলেছিলেন নন্দরাণী; সাঙ্গ হতে কিছুকিঞ্চিৎ দেরি আছে এখনও, সহসা রাখাল ছোঁড়া ঘর্মািক্ত কলেবরে ছুটতে ছুটতে এসে উঠোনের দরজায় দাঁড়িয়ে আকর্ণবিস্তৃত হাস্যে জানান দিল, বরকনে এয়েলো গো! আমি উই-ই দীঘির পাড় থেকে দেখতে পেয়েই ছুটে ছুটে বলতে এনু।