রাসুর অবস্থাটা কি?
সে কি এখন খুব একটা অন্তর্দ্বন্দ্বে পীড়িত হচ্ছে?
তীব্র একটা যন্ত্রণা, ভয়ঙ্কর একটা অনুতাপ, প্রবল একটা মানসিক বিদ্রোহের আলোড়ন রাসুকে ছিন্নভিন্ন করছিল? বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ এই চিলের মত ছোঁ মেরে উড়িয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে এনে আরও একটা সাতপাকের বন্ধনে বন্দী করে ফেলবার চক্রান্তে কাকার ওপর কি রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল রাসু?
না, রাসুর মুখ দেখে তা মনে হচ্ছে না।
বলির পাঁঠার অবস্থা ঘটলেও ভয়ে বলির পাঁঠার মত কাঁপছিলও না রাসু, শুধু কেমন একটা ভাবশূন্য ফ্যালফেলে মুখে নিজের নির্দেশিত ভূমিকা পালন করে চলছিল সে।
হ্যাঁ, এই আকস্মিকতার আঘাতে বেচারা রাসুর শুধু মুখটাই নয়, মনটাও কেমন ভাবশূন্য ফ্যালফেলে হয়ে গিয়েছে। সেখানে সুখ-দুঃখ ভাল-মন্দ দ্বিধা-দ্বন্দু কোন কিছুরই সাড়া নেই।
সে-মনে ধাক্কা লাগল স্ত্রী-আচারের সময়। সে ধাক্কায় খানিকটা সাড় ফিরল।
সে সাড়ে মনের মধ্যে একটা ভয়ানক কষ্ট বোধ করতে থাকল রাসু।
সাত এয়োতে মিলে যখন মাথায় করে শ্ৰী, কুলো, বরণডালা, আইহাঁড়ি, চিতের কাঠি, ধুতরো ফলের প্রদীপ সাজানো থালা ইত্যাদি নিয়ে বরকনেকে প্ৰদক্ষিণ করছিল, ধাক্কাটা লাগল। ঠিক তখন।
এয়োদের অবশ্য একগলা করে ঘোমটা, কিন্তু তার মধ্যেও আদল বলে একটা কথা আছে। যে বৌটির মাথায় বরণডালা, আর আদলটা ঠিক সারদার মতন, যদিও দিনের বেলা হঠাৎ সারদার মুখটা দেখলে রাসু ঠিক চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ, তবুও আদালটা চেনে। ওই রকম বেগনী রঙের জমকালো একখানা চেলিও যেন সারদাকে মাঝে মাঝে পরতে দেখেছে রাসু। পাড়ার কারুর বিয়েটিয়েতে কি সিংহবাহিনীর অঞ্জলি দেবার সময়।
দেখেছে অবিশ্যি নিতান্ত দূর থেকে, আর ভাল করে তাকাবার সাহসও হয় নি। কারণ রাতদুপুরের আগে, সমস্ত বাড়ি নিযুতি না হওয়া পর্যন্ত কাছাকাছি আসবার উপায় কোথা? আর তখন তো। সারদা সাজসজ্জা গহনাৰ্গাটির ভারমুক্ত। তা ছাড়া সারদা ঘরে ঢুকেই কোণের প্রদীপটা দেয় নিভিয়ে। বলে, কে কমনে থেকে দেখে ফেলে যদি!
অবিশ্যি দেখবার পথ বলতে কিছুই নেই। রামকালী চাটুয্যের বাড়ির দরজা-কপট তো আর পাড়ার পাঁচজনের মত আমাকাঠের নয় যে ফাটা-ফুটো থাকবে, মজবুত কাঁঠালকাঠের লোহার পাতমোরা দরজা। দরজার কড়া-ছেকলগুলোই বোধ করি ওজনে দুপাঁচ সের। আর জানলা? সে তো জানিলা নয়, গবাক্ষ। মানুষের মাথা ছাড়ানো উঁচু তে ছোট্ট ছোট্ট খুপরি জানলা, সেখানে আর কে চোখ ফেলবে? তবু সাবধানের মার নেই।
গ্ৰীষ্মকালে অবশ্য পুরুষরা এ রকম চাপা ঘরে শুতে পারেন না, তাদের জন্যে চণ্ডীমণ্ডপে কিংবা ছাতে শেতলপাটি বিছিয়ে রাখা হয় ভিজে গামছা দিয়ে মুছে মুছে। সেখানে তাকিয়া যায়, হাতপাখা যায়, গাড় গামছা যায়, বয়ে নিয়ে যায় রাখাল ছেলেটা কি মুনিযটা। কর্তাদের অসুবিধে নেই।
প্ৰাণ যায় বাড়ির মহিলাদের, আর নববিবাহিত যুবকদের। তারা প্ৰাণ ধরে বারবাড়িতে শুতে যেতে পারে না, অথচ ভেতরবাড়ির ঘরের ভিতরের গুমোটিও প্রাণান্তকর।
তবে সারদার মত বৌ হলে আলাদা। সারদা এই গ্রীষ্মকালে সারারাত্তির পাখা ভিজিয়ে বাতাস করে রাসুকে।
প্ৰাণের ভেতরটা হঠাৎ কেমন মোচড় দিয়ে উঠল রাসুর। গতকাল রাত্ৰেও সারদা সেই পতিসেবার ব্যতিক্রম করে নি। রাসু মায়া করে বার বার বারণ করছিল বলে কচি ছেলেটার গরমের ছুতো করে নেড়েছে। সারদা। আর সব চেয়ে মারাত্মক কথা, যেটা মনে করে হঠাৎ বুকটা এমন মুচড়ে মুচড়ে উঠছে রাসুর, মাত্ৰ কাল রাত্তিরেই সারদা তাকে ভয়ানক একটা সত্যবদ্ধ করিয়ে নিয়েছিল।
বাতাস দিতে বারণ করার কথায় চুপি চুপি হেসে বলেছিল। সারদা, এত তো মায়া, এ মায়ার
রাসু ঠিক বুঝতে পারে নি, একটু অবাক হাসি হেসে বলেছিল, চিরকাল কি গরম থাকবে?
আহা তা বলছি নে। বলছি-, রাসুর বুকের একবারে কাছে সরে এসে সারদা বলেছিল, সতীনজ্বালার কথা বলছি। তখন কি আর মায়া করবে? বলবে কি আহা ওর সতীনে বড় ভয়!
রাসু যতটা নিঃশব্দে সম্ভব হেসে উঠেছিল, হেসে বলেছিল, হঠাৎ দিবাস্বপ্ন দেখছি নাকি! সতীনাওলা আবার কে দিলে তোমায়!
দেয় নি, দিতে কতক্ষণ?
অনেকক্ষণ! আমার আমন দু-চারটে বৌ ভাল লাগে না। দরকারও নেই।
সারদা। তবু জেরা ছাড়ে নি, আর আমি বুড়ো হয়ে গেলে? তখন তো দরকার হবে!
রাসু ভারি কৌতুক অনুভব করেছিল, আবার হেসে ফেলে বলেছিল, এ যে দেখি হাওয়ার সঙ্গে মনান্তর! তুমি বুড়ো হয়ে যাবে, আর আমি বুঝি জোয়ান থাকব?
আহা, পুরুষ ছেলে কি আর অত সহজে বুড়ো হয়? তা ছাড়া ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ছেলে, দেখতে সোন্দর। এত পয়সাওলা মানুষ তোমরা, কত ভাল ভাল সম্বন্ধ আসবে তোমার, তখন কি আর আমার কথা–
হঠাৎ আবেগে কেঁদে ফেলেছিল সারদা।
অগত্যাই নিবিড় করে কাছে টেনে নিয়ে বৌকে আদর সোহাগ করে ভোলাতে হয়েছে রাসুকে। বলতে হয়েছে, সাধে কি আর বলেছি হাওয়ার সঙ্গে মনান্তর।! কোথায় সতীন তার ঠিক নেই, কাঁদতে বসলো! ওসব ভয় করো না।
আরও অনেক বাক্য বিনিময়ের পর পতিব্ৰতা সারদা স্বামীকে আশ্বাস দিয়েছিল, তা বলে তোমাকে আমি এমন সত্যবন্দী করে রাখছি নে যে আমি মরে গেলেও ফের বে করতে পারবে না। আমি মলে তুমি একটা কেন একশটা বে করো, কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে নয়।