দয়াল? দয়াল মুখুয্যে?
হ্যাঁ, দেখা যদি হাতেপায়ে ধরে রাজী করাতে পারো। এমনিতেই তো কালবিলম্ব হয়ে গেছে।
লক্ষ্মীকান্ত বিস্মিত দৃষ্টি মেলে বলেন, মুখুয্যে মশায়ের কাছে কার আশায় যাব ঠিক বুঝতে পারছি না তো ঘোষাল মশাই?
কার আশায় আবার লক্ষ্মীকান্ত, তুমি নেহাৎ শিশু সাজছ দেখছি। মুখুয্যের আশাতেই যাবে। নইলে রাতারাতি আর তোমার স্ব-ঘর পাত্র পাচ্ছি কোথায়?
লক্ষ্মীকান্ত কাতর মুখে বললেন, মুখুয্যে মশায়ের সঙ্গে পটলীর বিয়ে? পলটীকে আপনি দেখেছেন ঘোষাল মশাই?
দেখেছি বৈকি, রাখহরি একটু রসিকহাসি হাসেন, নাতনীকে তোমার দেখলে ওর নাম গিয়ে মুনিরও মন টলে, ঘরে মিললে আমিই এই বয়সে টোপর মাথায় নিতে চাইতাম। মুখুয্যেও তোমার গিয়ে, বয়েস হলে কি হয়, রসিক ব্যক্তি। সেই সেদিনও পথে পটলীকে দেখে বলছিল—
রাখহরি একটু থামেন।
লক্ষ্মীকান্ত কিঞ্চিৎ বিরক্তভাবে বলেন, কি বলছিলেন?
আহা দুষ্য কিছু নয়, তামাশা করে বলছিল, বাঁড়ুয্যের নাতনীটিকে দেখলে ইচ্ছে হয় আমার তৃতীয় পক্ষটিকে ত্যাগ করে ফেলে ফের ছাঁদনাতলায় গিয়ে দাঁড়াই।
লক্ষ্মীকান্ত এবার ঘোরতর বিরক্তির স্বরে বলেন, এ প্রসঙ্গ ত্যাগ করুন ঘোষাল মশাই।
বটে? ও! রাখহরি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ান, বুঝতে পারি নি, কলি পূর্ণ হতে এখনও কিছু বিলম্ব আছে ভেবেছিলাম। যাক শিক্ষা হয়ে গেল। আর যাই করি কারুর হিত করবার চেষ্টা করব না…
লক্ষ্মীকান্ত এবার ত্ৰস্ত কাতরতায় বলে ওঠেন, আপনি অযথা কুপিত হবেন না ঘোষাল মশাই, য়ামার অবস্থাটা বিবেচনা করুন। মুখুয্যে মশাই আমার চাইতেও প্রায় চার পাঁচ বৎসরের বয়োধিক, তা ছাড়া হাপানি রোগগ্ৰস্ত।
হাপানিটা যমরোগ নয় লক্ষ্মীকান্ত, রাখহরি সতেজে বলেন, আয়ুৰ্বেদমতে ওটা হচ্ছে জীওজ ব্যাবি। তাছাড়া বয়সের কথা যা বলছি। ওটা কোন কথাই নয়, পুরুষের আবার বয়েস! বরং মুখুয্যের আর দুটি পত্নীর ভাগ্য-প্ৰভাবে তোমার ঐ অলক্ষণা পৌত্রীটির বৈধব্য-যোগ খণ্ডন হয়েও যেতে পারে।
কিন্তু ঘোষাল মশাই—
থাক, কিন্তুতে আর কাজ কি লক্ষ্মীকান্ত? তবে এটা জেনো, নিজেকে সমাজের শিরোমণি ভেবে যতই তুমি নিৰ্ভয়ে থাক, এর পর অর্থাৎ তোমার ওই পৌত্রীকে নির্দিষ্ট লগ্নে পাত্ৰস্থ করতে না পারলে সদব্ৰাহ্মণের তোমার গৃহে জলগ্ৰহণ করবেন। কিনা সন্দেহ। এই দুঃসময়ে অপোগণ্ড একটা ষ্টুড়ির বুড়ো বর যুবো বরের ভাবনা তুমি ভাবতে বসছ, কুলমর্যাদা ধর্মসংস্কার জাতি-মান এসব বিস্মৃতি হচ্ছে, এ একটা তাজ্জব বটে!
ঘোষাল মশাই আপনি আমায় মার্জন করুন, বরং পটলীকে নিয়ে আমি কাশীবাসী হব-
তা হবে বৈকি, রাখহরি একটু বিষহাসি হেসে বলেন, বে-মালিক সুন্দরী যুবতীর পক্ষে কাশীর মত উপর্যুক্ত স্থান আয় কোথায় আছে? নাতনী হতে কাশীবাসের সংস্থানটাও তোমার হয়ে
ঘোষাল মশাই! লক্ষ্মীকান্ত বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আপনি আমার গুরুজনতুল্য, তাই এযাত্রা রক্ষা পেয়ে গেলেন। নচেৎ–
নচেৎ কি করতে লক্ষ্মীকান্ত, বিদ্রেরূপহাস্যে মুখ কুঁচকে রাখহরি বলে ওঠেন, নচেৎ কি মারতে নাকি?
শোধ নেবার দিন এসেছে, শোধ নেবেন বৈকি ঘোষাল। ঘোষাল-বামুনদের প্রতি লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যের অন্তঃসলিলা তাচ্ছিল্য ভাবটা তো আর অবিদিত নেই রাখহরির! যতই বিনয়ের ভাব দেখাক বাঁড়ুয্যে, ওর চোখের দৃষ্টিতেই সেই উচ্চনীচ ভেদাভেদটা ধরা পড়ে যায়। আজ সেই প্রতিশোধ নেবার সময় এসেছে, ছাড়বেন কেন রাখহরি?
ঘোষাল মশাই, আমাকে রেহাই দিন। দুই হাত জোড় করে লক্ষ্মীকান্ত বলেন, ভগবান যদি আমার জাতি ধর্ম রক্ষা করতে ইচ্ছুক থাকেন, লগ্নের আগেই উপর্যুক্ত পোত্র পেয়ে যাব, নচেৎ মনে করব।–
লগ্নের আগেই উপর্যুক্ত পোত্র! রাখহরি। আর একবার বিদ্রপহাস্যে মুখ বাকিয়ে বলেন, পাত্রটিকে বোধ হয়। স্বয়ং তিনি বৈকুণ্ঠ থেকে পাঠিয়ে দেবেন!
লক্ষ্মীকান্ত কী একটা উত্তর দিতে উদ্যত হচ্ছিলেন, সহসা শ্যামকান্ত নিজের স্বভাববিরুদ্ধ উত্তেজনায় ছুটে এসে বলে, বাবা, কবরেজ চাটুয্যে মশাই আসছেন ঘোড়ায় চেপে পিছনে কাকে যেন নিয়ে।
অ্যাঁ! নারায়ণ!
লক্ষ্মীকান্ত উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বসে পড়েন।
০৯. আসর-সাজানো বরাসনে
আসর-সাজানো বরাসনে বসবার সময় আর ছিল না, হুড়মুড়িয়ে একেবারে কলতলায় খেউরী করিয়ে স্নান করিয়ে নিয়ে সোজা নিয়ে যেতে হবে সম্প্রদানের পিঁড়িতে। সেই পিঁড়িতেই ধান দুর্বে আর আংটি দিয়ে পাকা দেখা অনুষ্ঠানের প্রথাটা পালন করে নিতে হবে।
অবিশ্যি সারাদিনে অন্তত বার পাঁচ-ছয় চর্বচোষ্য করে খেয়েছে রাসু, কিন্তু কি আর করা যাবে! এরকম আকস্মিক ব্যাপারে ওসব মানার উপায় কোথায়? বলে কত মেয়েরই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে করে। এই তো লক্ষ্মীকান্তরই এক জ্ঞাতি ভাইপোর মেয়ের বিয়ে হল সেবার ঘুমন্ত মেয়েটাকে মাঝরাতে টেনে তুলে। গ্রামের আর কার বাড়িতে বর এসেছিল বিয়ে করতে, তার পর যা হয়। কোথা থেকে যেন উঠে পড়ল কন্যেপক্ষের কুলের খোঁটা, তা থেকে বাচসা অপমান, পাত্ৰ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া।
যাক সে কথা, মূল কথা হচ্ছে, আকস্মিকের ক্ষেত্রে চর্বচোষ্য খেয়েও বিয়ের পিঁড়িতে বসা যায়।
কথা হচ্ছে—এখন রাসুকে নিয়ে।