হ্যাঁ, বিয়ের রাত্রে বর-বিভ্ৰাট কি আর হয় না? ছাঁদনাতলা থেকেও বর উঠে যেতে দেখেছে অনেকে, কিন্তু সে সব অন্য কারণে। হয়তো পণের টাকা ঠিক সময়ে হাজির করতে না পারার জন্যে বাচসার ফলে, নয়তো বা কোন হিতৈষীর দ্বারা কোন পক্ষের কুলের ঘাটতির কথা প্ৰকাশ হয়ে পড়ায়, অথবা কন্যাপক্ষের কনেকে বদলে ফেলে কালো কুশ্ৰী কনে গছিয়ে দেবার চেষ্টার ফলে, বাচসা থেকে হাতাহাতি মারামারি হতে হতে বরপক্ষ রেগো-টেগে বর উঠিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তখনি তার পারাপারও হয়ে যায়।
কারণ লগ্ন ভ্ৰষ্ট হয়ে গেলেই মেয়ে চিরকালের মত আধাবিধবা হয়ে বাপের ঘরে বসে থাকবে, এই আক্ষেপে পাড়ার কেউ না কেউ করুণাপরবশ হয়ে কোমর বেঁধে লেগে গিয়ে রাতারাতি অন্য পাত্তর যোগাড় করে আনেন। অতএব ভদ্রলোকের জাত মান রক্ষা পায়।
কিন্তু এ যে একেবারে বিপরীত কাজ! এ যে সদ্য রাক্ষসী কন্যা!
এ হেন পতিঘাতিনী মেয়ের জন্যে আপনার ছেলেকে ধরে দেবে এমন মহানুভব ত্ৰিজগতে কে আছে?
না, বেহুলার এই মেয়ের জন্যে রাতারাতি পাত্রসংগ্ৰহ হওয়ার আশা দূরাশা। রামকালী কবরেজ অবশ্য একটু নাকি আশ্বাস দিয়ে গেছেন, চেষ্টা দেখছি বলে; কিন্তু বোঝাই তো যাচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ স্তোকবাক্য! এত বড় দুঃসংবাদটা বাড়ি বয়ে এসে দিয়ে গেলেন, মুখটা একটু হেট হল তো, তাই একটা অলীক স্তোক দিয়ে পালিয়ে গেলেন।
বেহুলা বোকা হতে পারে, কিন্তু একটু বুদ্ধি ধরে।
হায় মা ভগবতী, পটলী যে এত বড় অপয়া মেয়ে এ কথা তো কোনদিন বুঝতে দাও নি? ফুলের মত দেখতে মেয়ে, বাড়ির প্রথমা সন্তান, সকলের আদরের আদরিণী। আগানে-বাগানে হেসে খেলে বেড়িয়েছে এতদিন, ইদানীং সম্প্রতি ডাগরটি হয়েছে বলেই যা বাড়ির মধ্যে আটক ছিল। তা যেমন সুন্দরী তেমনি হাস্যবন্দনী, কে বলতে পেরেছে। এ মেয়ে সর্বনাশী রাক্ষসী?
শ্বশুর ঠাকুর তো বলেন পটলীর নাকি দেবগণ, তবে? দেবগণ কন্যে রাক্ষসগণের কপাল পেল কি করে? আর শুধুই কি আজ? ও মেয়ে যদি ঘরে থাকে সংসার তো ছারখারে যাবে।
মানদার পিসী তো স্পষ্টই বললেন সে কথা, কে নেবে মা ও মেয়েকে? কার বাসনা হবে সংসারটা ছারে-গোল্লায় দিই? ও চিরটা কাল এই দপড়া হয়ে পড়ে থাকবে। আর ঠাকুদার সংসারটা চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে, এই আর কি!
বেহুলা ড়ুকরে কেঁদে ওঠে।
কাঁদতে কাঁদতে বলে, হে মা ওলাই বিবি, হে মা শেতলা, পটলীকে তোমরা নাও, ওরা যেন এ ভিটেতে তেরাত্তির না পোহায়।
মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে বেহুলা!
কাঁদছে সবাই।
বাড়ির গিন্নী থেকে শুরু করে বিচুলিকাটুনি বাগদী মাগীটা পর্যন্ত। পরের দুঃখে কাঁদবার এত বড় সুযোগ জীবনে কবার আসে?
কাঁদছে না শুধু পটলী, যে হচ্ছে এই বিবাহবিভ্ৰাট নাটকের প্রধানা নায়িকা। সে শুধু অনেকক্ষন কাঠ হয়ে বসে থেকে সবে এইমাত্ৰ ভাবতে শুরু করেছে বিয়েটাই যদি না হয়, তা হলে এখনও পটলীকে উপুসী রেখেছে কেন এরা? কেন কেউ একবারও বলছে না, ওরে তোরা। তবে এখন পটলীকে দুটো মতিচুর কি দেদোমণ্ডা দিয়ে জল খেতে দে। পটলীর বুক থেকে পেট অবধি যেন মাঠের ধুলোর মতো শুকনো লাগছে।
কিন্তু পটলীর মুখে বুকে ধুলো বেটে যাচ্ছে, এ তুচ্ছ খবরটুকু ভাবতে বসবার সময় কার আছে? বরং পটলীর ওপর রাগে ঘৃণায় রি রি করছে সবাই!
শ্যামকান্ত বার দুই-তিন পুকুরপাড়ের দিক থেকে এসে উঁকি মেরে বাবাকে দেখে গেছে এবং যতবারই দেখেছে। বাবা তামাক খাচ্ছেন না, বাবার হাতে হুঁকো নেই, ততবারই তার প্রাণীটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সাহস করে তামাক সেজে এনে সামনে ধরে দেবে এত বুকের বল নেই, অপেক্ষা শুধু পাড়ার কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি এসে পড়েন। হয়তো তেমন কেউ এলে লক্ষ্মীকান্তের মৌনভঙ্গ হবে।
নিজের যতবড় বিপত্তিই হোক, মানীর মান অবশ্যই রাখবেন লক্ষ্মীকান্ত।
কিন্তু পাড়ার ভদ্রলোকদের আর আসতে বাকী আছে কার? তারা তো সবাই একে এসে গেছেন।
বেলা পড়ে এল।
অর্থাৎ সর্বনাশের সময় ঘনিয়ে এল।
এ হেন সময় শ্যামকান্তর প্রার্থনা পূর্ণ হল। এলেন রাখহরি ঘোষাল। রীতিমত বয়স্ক ব্যক্তি, অপেক্ষাকৃত দূরের পাল্লায় থাকেন, তাই এতক্ষণে এসে উঠতে পারেন নি। তিনি এসে নীরবে খড়ম খুলে ফরাসে উঠে বসলেন, ট্যাঁক থেকে শামুকের খোলের নস্যদানি বার করে দুটিপ নিলেন, তারপর ধীরে সুস্থে বললেন, ব্যাপার তো সব-ই শুনলাম লক্ষ্মীকান্ত, কিন্তু তুমি এভাবে মচ্ছিভঙ্গ হয়ে বসে থাকলে তো চলবে না।
লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যে বয়সের সম্মান রাখতে জানলেও ঘোষাল-ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলো তো আর নেবেন না, তাই মাথাটা একটু নিচু ভাব করে ক্লান্ত স্বরে নেপথ্যের দিকে গলা বাড়িয়ে বলেন, ওরে কে আছিস, ঘোষাল মশাইকে তামাক দিয়ে যা।
থাক থাক, ব্যস্ত হতে হবে না। রাখহরি ঘোষাল বলেন, সন্ধ্যা তো আগতপ্ৰায়, এখন কি করবে। স্থির করলে?
স্থির আর আমি কি করব ঘোষাল মশাই, লক্ষ্মীকান্ত হতাশভাবে বলেন, স্বয়ং যজ্ঞেশ্বরই যে যজ্ঞ পণ্ড করতে বসলেন–
তা বলে তো ভেঙে পড়লে চলবে না লক্ষ্মীকান্ত, কোমর বাঁধতে হবে। কন্যাকে নির্দিষ্ট লগ্নে পাত্ৰস্থ করতেই হবে। লগ্ন কখন?
মধ্যরাত্রের পর।
উত্তম কথা। সব কিছু পাচ্ছি। তুমি। আমি বলি কি, তুমি আমার সঙ্গে একবার দয়ালের ওখানে চল–