সদু গাড়ির ছইয়ের মধ্যে বসে ছিল।
চুপ করেই বসেছিল এতক্ষণ।
এবার আস্তে বলে, মুছে ফেলব বললেই কি মুছে ফেলা যায় বৌ? এ কি মুছে ফেলার জিনিস? নারায়ণ সাক্ষীর বিয়ে
সত্য নবকুমারের হাতটা ছেড়ে দেয়। কেমন এক রকমের হাসি হেসে বলে, সব বিয়েতেই নারায়ণ এসে দাঁড়ান কিনা, সব গাঁটছড়াই জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধন কিনা, এই প্রশ্ন নিয়ে বাবার কাছে যাচ্ছি ঠাকুরঝি!
সদু নবকুমারের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে, সে প্রশ্নের উত্তরও তো একজন্মে মিলবে না!…তুই আর কেন দেরি করিস নবু? তুই বাড়ি যা, কাজের পাহাড় পড়ে আছে তোর। আরো দেরি করে চেষ্টা করে আর কুটুমের সঙ্গে বিরোধ বাধাতে হবে না!
তবু শেষ চেষ্টা করে নবকুমার।
ফিরে যেতে গিয়েও বলে, আমি অপরাধী, আমায় শাস্তি দাও, তুড়ু তো কোন অপরাধ করে নি? ওর বিয়েটা দেখবে না?
নাই বা দেখলাম, দূর থেকে আশীর্বাদ করবো।
আর এগোনো যাচ্ছে না।
সব মিনতি ব্যর্থ করে দিয়ে গাড়িটা যাচ্ছে এগিয়ে।
সব অনুভূতির আলোড়ন ওঠে, আর সেটা ফেটে বেরিয়ে পড়ে, জানি, জানতাম কথা থাকবে না! কারুর উপরোধ রাখবার পাত্র তুমি নও! কিন্তু এই বলে রাখছি, কেউ তোমায় ঘাড়ে করে কাশী পৌঁছতে যাবে না!
সত্য কি তবে বাঁচলো?
শেষ মুহূর্তে হেসে চলে যাবার পথ পেয়ে? সেই বাঁচার গলায় তাই ওর সেই পরিচিত ভঙ্গীতে হেসে উঠলো, ওমা, আমি তা বলতেই বা যাবো কেন? ঘাড় থেকেই যখন নেবে যাচ্ছি চিরকালের মত! কারুর ঘাড়ে না চড়ে শুধু নিজের পা দুখানার ভরসায় মা বসুমতীর মাটি ছোঁয়া যায় কিনা, সেটাও তো আমার আর এক প্রশ্ন!
গাড়িকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারছে না গাড়ির চালক, গরুগুলো এগোতে চায়। নবকুমার যেতে গিয়ে ফিরে এসে হঠাৎ লাফিয়ে সেই গাড়ির মধ্যে উঠে পড়ে ক্ষিপ্তকণ্ঠে বলে ওঠে, এইজন্যেই বলে মেয়েমানুষের বিষয়-সম্পত্তি থাকতে নেই! বাপের দলিলের ভরসা রয়েছে তাই স্বামীর অন্ন ত্যাগ দিয়ে চলে যাবার সাহস! মেয়েমানুষের এত সাহস ভাল নয়। এই আমি বলে দিচ্ছি, অশেষ দুঃখু আছে তোমার কপালে। স্বামী হয়ে এই অভিশাপ দিচ্ছি তোমায় আমি।
এ অভিশাপ যে নিতান্তই ক্রোধ, ক্ষোভ, হতাশা, অপমান, লোকলজ্জা আর অপমানবোধ থেকে উদ্ভূত তা বুঝতে পারে বৈকি সত্যবতী, তাই নিজে সে এত বড় অভিশাপেও বিচলিত হয় না। বরং প্রায় হেসে ফেলেই বলে, তাই তো দিয়ে আসছে তোমরা আবহমান কাল থেকে। স্বামী হয়ে, বাপ হয়ে, ভাই হয়ে, ছেলে হয়ে। ওটা নতুন নয়। অভিশাপেরই জীবন আমাদের। তবে ওই যে দলিলের কথা বললে, জেনো ওই ছেঁড়া কাগজটার কথা আমার মনেও ছিল না। মনেই যখন করিয়ে দিলে তো বলি, বাবার দেওয়া বস্তু ফেলে দেওয়া বাবার অপমান। সাধন সরল যদি মানুষ হয়, ওরা যেন বিষয়টুকু থেকে ওই ত্রিবেণীতে মেয়েদের একটা ইস্কুল খুলে দেয়। আর… আর নাম দেয় যেন ভুবনেশ্বরী বিদ্যালয়।…একটু থামো বলে সত্য আঁচলটা গলায় জড়িয়ে স্বামীকে একটা প্রণাম করে বলে, জীবনভোর অনেক অকথা-কুকথা বলেছি তোমায়, অনেক জ্বালাতন করেছি। পার তো মাপ করো।
সদু মৃদু ধমকের সঙ্গে বলে, নবু, বাড়ি যা! বৌর পিছু পিছু ছুটে এসে কোনো লাভ নেই। ওর নাগাল তুই কোনো দিনই ধরতে পারিস নি, আজও পারবি না। শুধু এইটুকুই বলতে ইচ্ছে করছে, মুখ্যুই না হয় হয়েছিলি, কিন্তু ‘মমতা’ বস্তুটা কি এক কণাও থাকতে নেই রে? মাতৃ-আজ্ঞায় মেয়ে পার করতে বসবার সময় বৌর মুখটা একবার মনে পড়ল না? তিরিশ বছর একত্র ঘর করলি, বনের পশুপক্ষীর প্রতি যে মায়া জন্মায়, তা জন্মায় নি তোর?
নবকুমার দীপ্তকণ্ঠে বলে, এই বললে তুমি সদুদি? ওর কথা আমার মনে পড়ে নি? অবস্থাটা বুঝেছ আমার? দশচক্রে ভগবান ভূত হয়ে
নবু, নেবে যা। মেয়ে জামাই এখনো ঘরে, কুটুম্ব ক্ষেপে বসে আছে, অনেক কাজকর্তব্য আছে, সেখানে না গেলে চলবে না। মেয়েটার কথা ভাব।
মেয়েটা! আমি মেয়েটার কথা ভাববো নবকুমার পাগলের মত করে, স্নেহময়ী মা যে তার বুকে মুগুর মেরে রেখে এল সেটা তো কই ভাবছ না? এই যে সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আর মা তার দিকে দৃষ্টিমাত্র না দিয়ে ঠিকরে চলে এল, বুক ফেটে গেল না তার? তার কোন অপরাধ আছে?
সত্যবতী আর কথা বলে না, শ্রান্তভাবে ছইয়ের ধারের বাঁশে মাথাটা ঠেকিয়ে চোখ বুজে বসে থাকে। সদু এবার দৃঢ়ভাবে বলে, নবু, তুই নাববি?
নেমে পড়ে নবকুমার।
পিছন দিকে না তাকিয়ে হন্ হন্ করে হেঁটে যায় কোঁচার খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে।
.
গাড়ি এগোতে থাকে।
মাঠ পার হয়ে হাটতলায় এসে পৌঁছালো বলে। এখানে ঘোড়ার গাড়ি মিলবে। সরল দেখবে তার ব্যবস্থা। সাধন মার প্রতি বিরক্তবশত আসে নি সঙ্গে।…বাবা যত বড় গর্হিত কাজ করে থাকুন, মার নির্লজ্জ কেলেঙ্কারিও তার কাছে অধিক অসহ্য!…
গরুর গাড়ির মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে, আকাশের দিক থেকে তাই চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে। সমস্ত পশ্চিম আকাশটা জুড়ে লালের সোনা।…
আকাশের ওপারে কি সত্যই আছে আর এক জগৎ? তারা ওখানে কারো চিতা জ্বেলেছে? …এ তারই অগ্নি-আলো?
নাকি আগুন নয়, শুধু রং? সেখানের কোনো নববধূ তার লাল চেলিখানা মেলে দিয়েছে শেষ রোদ্দুরে!…
একসময় সদু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, বিয়ে হয়েছে বলেই সব আশা ফুরিয়ে যাবে বৌ? একেবারে ত্যাগ দিয়ে চলে আসবে তুমি সুবর্ণকে? তুমিও তো বিয়ের পরই এতখানিটি হয়েছ!