অমোঘ অচ্ছেদ্য বন্ধন! অনন্তকালের ওপার পর্যন্ত নাকি যার ক্ষমতা…ক্ষেত্র বিস্তৃত!
.
সমস্ত পশ্চিম আকাশটা জুড়ে লালের সমারোহ, সেই লাল ছড়িয়ে পড়েছে মাঠে পুকুরে গাছপালায়।
….লটকে পড়া গরু দুটো ঘাসজল আর পড়ন্ত বিকালের স্নিগ্ধ হাওয়া পেয়ে আবার সতেজ হয়ে গড়গড়িয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গাড়িখানাকে।
আজকের সন্ধ্যার মধ্যে বামুনপাড়ার এই বড় মাঠটা পার করে নিয়ে যেতে হবে এই নির্দেশ। তারপর যদি চলা নিতান্ত অসুবিধে হয়, হাটতলার ওদিকে বিশ্রাম নিলেই হবে। ঘোড়ার গাড়ি জুটে গেলে মঙ্গল।
.
অনেক দিন আগে একদিন রামকালী কবরেজ এ গ্রাম থেকে ধুলোপায়ে বিদায় নিয়েছিলেন।
আজ রামকালী কবরেজের পিতৃভক্ত মেয়ে বাপের সেই কাজের অনুকরণ করলো।
রামকালী কবরেজের সঙ্গে ছিল নিজের পালকি। তাঁর মেয়ের তা নেই। তাই অনিচ্ছুক গাড়োয়ানটাকে ঘুষ দিতে হয়েছে। বাঁ হাতটাকে তাই তার এখন শুধু শাখা আর লোহা। মোটা হাঙরমুখো বালাগাছটা নেই।
ওটাই ছিল হাতের কাছে, হাতছাড়া হয়েছে।
কিন্তু কতই বা দাম ওটার? সত্যকে সেই তার অনন্তকালের বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবার পক্ষে কি খুব বেশী?
ছাড়িয়ে নিয়ে, গ্রাম ছেড়ে চলেছে সত্য।
কিন্তু এই ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াটা কি নিতান্ত সহজে হয়েছিল?
না, তাই কি হয়? হয় না। প্রায় গ্রামসুদ্ধ সবাই এসে গাড়িখানাকে ঘিরে ধরে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেছিল বৈকি।
সত্য তাদের কথা রাখে নি।
সত্য শুধু শান্ত স্বরে একই কথা বলেছে।
বলেছে, বৃথা কেন কষ্ট করছেন! যে উপরোধ রাখতে পারবো না
শেষ পর্যন্ত এলোকেশীও এসেছিলেন। হাতজোড়ের ভঙ্গী করে বলেছিলেন, রাখতে পারবে না মানে রাখবে না, এই তো! তা আমি এই শাশুড়ী হয়ে তোমার কাছে হাত জোড় করে খাট মানছি বৌমা, অপরাধ মার্জনা করো। অন্যাই হয়েছে আমার, একশোবার অন্যাই হয়েছে স্বীকার পাচ্ছি সে কথা। বুঝতে পারি নি মেয়ে নবার নয়, একা তোমার, বুঝে তাই ঠাকমাগিরি করে ওর উবগার করতে গিয়েছিলেম!…. যাক যা হবার তা তো হয়ে গেছে, বে’ তো আর ফিরবে না, কেন আর গেরাম জানিয়ে কেলেঙ্গারটা করছো?
সত্য স্থির হয়ে বসেছিল, সত্য নিজেকে সংযত রেখেছিল। সত্য শুধু অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
আর নবকুমার?
এলোকেশীর ছেলে?
সে কি আসে নি মান ক্ষুইয়ে মান ভাঙাতে? নবকুমার আসবে বৈকি! নবকুমার আসবে না, এ কি হয়? শেষ অবধি এসেছিল। নবকুমারও প্রায় হাতজোড় করেছিল, যা হয়ে গেছে তার তো চারা নেই, তবে কেন–
এলোকেশীর সঙ্গে না হোক, এলোকেশীর ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিল সত্য। বলেছিল, চারা আছে কিনা সেইটাই শুধু ভাববো বসে বসে বাকী জীবনটা ধরে।
বাকী জীবনটা ধরে!
বাকী জীবনটা ধরে শুধু এই কথাটা ভাববে তুমি?
সত্য সেই ক্ষুব্ধ হতাশ ভিক্ষুক চোখ দুটোর দিকে তাকিয়েছিল নিজের পাথর হয়ে যাওয়া চোখ দুটো দিয়ে।
তাকিয়ে থেকে কেমন একটা অনুভূতিহীন গলায় বলেছিল, বাকী জীবনটুকু কি খুব বেশী হল? অনেকগুলো জন্ম ধরে ভাবলেই কি সে ভাবনার শেষ হবে? উত্তর পাওয়া যাবে?
নবকুমার হতাশ গলায় বলেছিল, তোমার সব কথার মানে আমি কোন কালেই বুঝতে পারি না, এসবও বুঝতে পারছি না, কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করি, সুবর্ণই তোমার সব? তুড়ু খোকা এরা কেউ নয়?
কে কতখানি, সেটাও তো ভেবে বার করতে হবে!
চিরদিনই দেখলাম মায়া মমতা তোমার কাছে কিছুই নয় জেদটাই বড়। তবু মিনতি করে বলছি, এই একবারের জন্যে অন্তত সে জেদ ছাড়ো আমার মুখ চেয়ে।
আমায় মাপ করো।
সত্য মাথার কাপড়টা একটু টেনে নিয়েছিল।
নবকুমার কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।
কোঁচার খুঁট তুলে চোখ মুছেছিল।
কিন্তু সত্য তো চিরদিনই নিষ্ঠুর।
আর আমি রাগের ঠাকুর থাকবো না প্রতিজ্ঞা করলেই কি স্বভাবটা বদলাতে পারবে?
সত্য তাই নবকুমারের মুখ থেকে চোখ না নামিয়েই বলে, তিরিশ বছর ধরে তো তোমার মুখ চেয়ে এলাম, শেষটায় একবার নিজের দিকে চাইবার ইচ্ছে হয়েছে।
তোমার সুবর্ণকে একবার আশীর্বাদও করে যাবে না?
সত্য কি বিদ্যুতের আঘাত পেল?
সত্যর মা ভুবনেশ্বরী একবার ঠিক এই রকম একটা প্রশ্নে বিদ্যুতের মত কেঁপে উঠেছিল না? সেই তার শেষ দিনে?
সত্য এবার নবকুমারের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। ধীর গলায় বলে, চিরকালের মতন চলে যাচ্ছি, বিদেয়কালে আর কেন মুখ দিয়ে কটু কথা বার করাতে চাও?
গাড়ি প্রায় এগোতে শুরু করে, তবু নবকুমার সঙ্গে সঙ্গে এগোয়, তোমার বাবা এত বিচক্ষণ ব্যক্তি, তিনিও তোমাকে আট বছরে গৌরীদান করেছিলেন, সে কথা তো কই মনে করছো না!
হঠাৎ সত্যর সেই পাথরের চোখে আগুন ঝলসে উঠেছিল।
মনে করছি না, এ কথা কে বলেছে তোমায়? জীবনভোর মনে করে আসছি। আর এবার বাবার কাছেই গিয়ে তার উত্তর চাইব!
নবকুমার তবু গাড়ির বাঁশ চেপে ধরে আছে, তোমায় আমি কথা দিচ্ছি তুড়ুর মা, তুমি যদি বল, কুটুমবাড়ির সঙ্গে একটা বিরোধ ঘটিয়ে সুবর্ণকে আবার তোমার কাছেই ফিরিয়ে এনে দেব–
সত্য হঠাৎ একটা কাজ করে বসে। এই খোলা মাঠে এর ওর সামনে হাতটা বাড়িয়ে নবকুমারের সেই গাড়ির বাঁশ চেপে ধরা হাতটা চেপে ধরে। উদভ্রান্ত গলায় বলে ওঠে, সত্যি বলছো? ফিরিয়ে এনে দেবে? এই পুতুল খেলার বিয়েটা মুছে ফিরিয়ে দেবে আমার সেই সুবর্ণকে?