অনেকগুলো কণ্ঠ আহাদের রোল তুলে গাড়ির ধারে এসে দাঁড়ায়, এতক্ষণে আসা হল?… বাবা, সকাল থেকে পথপাণে চাইতে চাইতে বাড়িসুদ্ধ লোকের চোখ ক্ষয়ে গেল! আর একটুখানি আগে এসে পড়লে ‘জামাই’-বরণটা হতো শাশুড়ীর হাত দিয়ে! যাক–তবু মন্দের ভালো, শেষমেষ চোখের দেখাটাও হবে একবার!
কে এরা?
কি বলতে চাইছে?
কাকেই বা বলছে?
শেষে একটিবারের জন্যে চোখে দেখার মত করুণতম সুখের আশ্বাসের সঙ্গে এই উৎসব মুখরতা কি মানানসই?
.
সত্য কেন এমন অমঙ্গলের ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে? চারিদিকে সবই তো মঙ্গলচিহ্ন।… দোরে মঙ্গলঘট, বার-উঠোনে আলপনার ছাপ, ভিতর-উঠোনে সামিয়ানা টাঙানো। সব কিছুই প্রখর রোদে সাদা আলোয় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
সব শুভ চিহ্ন!
কিন্তু কেন? সাধন তো সত্যর সঙ্গেই রয়েছে। পাকা দেখার মত আরও কোনো ঘটা আছে নাকি এদের কুপ্রথায়? তারই আয়োজন, প্রস্তুতি…. সদু শুধু মজা দেখবার জন্যে এমন হুড়িয়ে নিয়ে চলে এলো!
উৎকট একটু মজা!
কিন্তু উলুর শব্দগুলো এত বিশ্রী লাগছে কেন? ঘুঘুর ডাকের মত কান্না-কান্না! চিরকালই তো মেয়েমানুষের এই বুনো উল্লাসধ্বনি শুনে এসেছে সত্য। খারাপ লাগে, খারাপ লেগেছে, কিন্তু শুনে বুকের ভেতরটা এমন ফোপরা ফোপরা তো লাগে নি।
সেই একটা আলোক-ঝলকানো মুখ কই? সত্যর আসার খবরে ব্যগ্র দুখানা পুষ্টনিটোল কচি হাত কেন দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা ভঙ্গীতে ছুটে এসে সত্যকে জড়িয়ে ধরছে না?
আর….আর সেই চিরপরিচিত মুখটা? যে মুখ চিরকাল বিরাগ আর অনুরাগ–এই পরস্পর বিরোধী দুটো আকর্ষণে নিজেকে অপরিহার্য করে রেখেছে সত্যর কাছে?
ঝাপসা-ঝাপসা ছায়া-ছায়া একটা অনুভূতি নিয়ে এলোকেশীর উঠোনে এসে ঢোকে সত্য। অথবা পায়ে হেঁটে ঢোকেও না। অনেকগুলি মহিলা এবং বালক-বালিকার ঠেলাঠেলির ধাক্কায় এসে পোঁছে যায়।
আর পৌঁছেই পাথরের চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
.
আজন্মের দেখা বাঙ্গালি ঘরের চিরপরিচিত সেই ছবিখানা কে এঁকে রেখেছে সত্যর দেখার জন্যে? কিন্তু কে ও? কে?
.
বরকনে, কলাতলা, কুলো ডালা মাথায় এয়োর দল, এইসব চিরপরিচিত দৃশ্যের মাঝে কে ওই অপরিচিতা?
যার লাল চেলির ঘোমটা খসে পড়েছে নীতি-নিষেধ ভুলে?
ও মুখ কি কখনো দেখেছ সত্য? দেখেছে ওই একজোড়া আহত পশুর চোখ?
দেখে নি, জীবনে কখনো দেখে নি। এই অপরিচয়ের আঘাতে সত্যর চোখও তাই পাথর হয়ে গেছে।
.
কিন্তু কানটাও একেবারে পাথর হয়ে গেল না কেন সত্যর? কেন এত সব অচেনা গলার কথা কানে আসছে?
নবু, নবু এখন আবার কোথায় গেলি? এত ক্ষণ তো বৌ-বৌ করে ঘরবার করছিলি!…কনকাঞ্জুলির টাকাটা কাকে দিলি? হাতে মুখে একটু জল দাও বৌমা, গাড়ির কাপড়টা ছেড়ে এসে মেয়ে-জামাইকে আশীৰ্বাদ করো।…আহা, কাল এসে পৌঁছতে পারলে না বৌমা। একটা মাত্তর মেয়ে, বে’টা দেখতে পেলে না! আসবেই বা কি, খবর তো পেলে না সময়ে? তোমার শাউড়ী এত হুটুককারি করে দিলে বিয়েটা, যেন বিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। … তা যাক, বিনি খাটনিকে সোনার চাঁদ জামাই পেয়ে গেলে! দুটিতে কেমন মানিয়েছে দেখো!…. বিয়ে খাসা হয়েছে, জ্বাজ্বল্যিমান সংসার জানাশুনোর মধ্যে!
সত্যর মাথার মধ্যে ইঞ্জিন চলছে–কথাগুলো ক্রমশ যন্ত্রের শব্দের মত ঠন ঠন করে বাজছে…যাই ভাগ্যিস নবুর সঙ্গে মেয়েটাকে পাঠিয়েছিলে, আর ঠিক সেই সময় তোমার শাউড়ীর সইয়ের মেয়ে মুক্ত এসেছিল বেড়াতে, তাই না যোগাযোগ হয়ে গেল! তোমার রূপসী মেয়ে দেখে মুক্ত একেবারে গলে গেল! বলে এ মেয়ে আমি বৌ না করে ছাড়ব না! ছেলের বুঝি আষাঢ় মাসে জন্মমাস, তাই এই জ্যোষ্টিতেই সেরে ফেলে বাঁচালো। তোমার শাউড়ীও তো মেয়ের আগে ছেলের বে দেওয়া নিয়ে নবুকে না ভূতো ন ভবিষ্যতি করছিল। নবু ভয়ে ভয়ে…ও কি অ সদু, বৌমা অমন নিশিতে পাওয়ার মত পিঠ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে কোথায়? শরীর তো ভাল দেখাচ্ছে না, নাই বা গেল এখন ঘাটে। বাড়িতে এক ঘটি জল নিয়ে….ওমা ওমা, অ সদু, বৌমা যে বকুলতলার দিকে চললো! ওদিকে কি? অ নবু ওরে অ খোকারা, খোকারা তোদের মা ফের গাড়িতে গিয়ে উঠতে চায় নাকি?
পালিয়ে বেড়ানো নবু এতক্ষণে সমাজে দেখা দেয়। দেয় সদুর সামনে। ভয়-ভরা গলায় বলে ওঠে, বিয়ের কথা জানাও নি তোমাদের বৌকে?
কে জানে কেন, সদু হঠাৎ এখন কঠিন হয়! কঠিন গলায় বলে, না, জানাই নি!
তাই! তাই বুঝছি! না বলে নিয়ে এসেই এইটি হল! … নবকুমার রাগ রাগ গলায় বলে, এ কী আশ্চয্যি! আগে এলে বিয়েয় বাধা দিত, তাই জানানো হয় নি, এখন না বলে নিয়ে আসার মানে? বলতে কী হয়েছিল?
চিরদিনের সহিষ্ণু সদু হঠাৎ এমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠল কেন? সদু যেন আরো কঠিন হচ্ছে। কঠিন আর কঠোর গলায় বলছে, বলতে কী হয়েছিল সে বোঝবার ক্ষমতা তোর থাকলে তো বলবো? ঢের দিন ঢের অন্ন খেয়েছি তোদের, তার ঋণ শুধতে বৌকে সঙ্গে এনে পৌঁছে দিয়ে গেলাম তোদের হাতে! তবে কসাইয়ের কাজটা করি নি কেন, এ বলে আর চোখ রাঙাসনে! মুখ দেখে বুঝছি আর এ ভিটেয় জলস্পর্শ করবে না ও, ফিরে যাবে! আমিও চললাম ওর সঙ্গে
সদুও দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায়।
বকুলতলার দিকেই যায়।
আর বিয়ের কনেটাও একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি ঘটিয়ে বসে। হঠাৎ সেই কলতলাতেই বসে পড়ে বরের সামনেই হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে, কেন তোমরা এই সব করলে আমার! মা আমায় মেরে ফেলবে! মার পিছু পিছু যাবে তার উপায় নেই, আঁচলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা।