কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ানোর পূর্ব-মুহূর্তে কি আসামীর নাড়িতে এই চাঞ্চল্য জাগে?
কিন্তু প্রতীক্ষার তো শেষ হচ্ছে না।
ওই দূরবর্তী পথের শেষে কী আছে? কী আসবে?
একটা লালডুরে পরা ছোট মেয়ে ছুটে এসে ডাক দিল, অ বামুনকাকা, বামুন ঠাকুমা ডাকছে তোমায়?
বামুনকাকা বিরক্ত স্বরে বলে, কেন?
জানি না। বলছে যে ‘লগন’ উত্তীরনো হয়ে যাচ্ছে, এরপর কালবেলা না কি পড়ে যাবে।
যাক। বরে কনের বাবা চোখটাকে তীক্ষ্ণ করে আরো একবার দূর প্রান্তরের ওপারে দৃষ্টিটাকে পাঠাবার চেষ্টা করে। এই জ্বলন্ত মাঠের দাবদাহের ওপারে কি একমুঠো ধোয়াটে ছায়ায় আভাস পাওয়া যাচ্ছে?
নাকি দৃষ্টির ভ্রম?
ভ্রম নিরসন পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায় না, মেয়েটা আরও একবার বলে ওঠে, এসো তাড়াতাড়ি! ভটচায মশাই নাকি রাগারাগি করছে! ডেকে নিয়ে মেয়েটা আবার ছুটে ভিতরে চলে যায়। আর কেন কে জানে, সেই দিকে তাকিয়ে কনের বাবার বুকের মধ্যেটা লঙ্কাবাটের জ্বালার মত হু-হুঁ করে জ্বলে ওঠে।
কেন?
প্রায় ওরই কাছাকাছি বয়সী নিজের সদ্য উৎসর্গীকৃত বালিকা কন্যার মুখটা স্মরণ করে? আর দণ্ড দুই পরেই মেয়েটাকে বিদায় দিতে হবে, নির্বাসন দিতে হবে একটা অপরিচিত অন্তঃপুরের অন্তরালে, স্তব্ধ হয়ে যাবে তার উচ্ছল কলকাকলী, হয়তো বাপের কাছেও অপরিচয়ের অবগুণ্ঠন টানবে?
এতে যে বিচলিত হবার কিছু নেই, এটাই যে চিরাচরিত নীতি, ওর মাও তাই করেছে, দিদিমা ঠাকুমাও করেছে, এ যুক্তি জ্বালা কমাতে পারল না, বুকের মধ্যেটা মাচড় দিয়ে উঠতে লাগলো।
আবার হয়তো শুধুই কন্যা-বিবাহ-ব্যাকুল পিতৃহৃদয়ের জ্বালাটাই সব নয়, ভয়ানক একটা অপরাধবোধও বুকের ভিতরটায় খাবল মারছে বুঝি।
অপরাধ না করেও তার বোধ কেন?
ন্যায্য কাজ করেও আতঙ্ক কেন?
লোকটা যাচ্ছেতাই রকমের ভীতু তাতে আর সন্দেহ নেই।
ভিতর থেকে আবার ছুটে আসে মেয়েটা, ভীত-ত্রস্ত গলায় বলে, অ বামুনকাকা, তোমার মা যে রসাতল করছে গো! বলছে, মহারাণী না আসা অবধি কি রাজকার্য বন্ধ থাকবে?
নাঃ, এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকা চলে না। দ্রুতপায়েই ছুটতে হয় বামুনকাকাকে।
.
অথচ আর একটু দাঁড়ালেই হয়তো প্রতীক্ষারত মূর্তিটা দেখানো যেত। কারণ রুক্ষতপ্ত জ্বলন্ত প্রান্তরের ওপার থকে ধোয়া-ধোয়া ছায়াটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে, একটা অবয়ব নিচ্ছে।
ওই জ্বলন্ত অনলের প্রকোপেই গরুগুলো গড়গড়িয়ে এগিয়ে আসতে পারছে না। গাড়োয়ান যতই কটুক্তি বাক্যের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ল্যাজমোড়া দিক, তারা যেন পিছিয়েই পড়ছে।
সদু ছাইয়ের ভিতর থেকে গলা বাড়িয়ে বার বার উদ্বিগ্ন গলায় বলছে, অ ছেলে, তোমার বলদরা যে পিছুনে বাড়ছে গো! আমাদের যে বড় তাড়া–!
গাড়োয়ান ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, কী করবো বলেন ঠাকরেন, দেখছেন তো, চেষ্টা তো করছি সাধ্যমত। ব্যাটারা দৌড়চ্ছে কই? সূয্যি ঠাকুর একেবারে আগুন হানছে কিনা!
ক্ষুব্ধ বাক্য উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই গাড়োয়ান প্রবল একটা বাড়ি হানে বদল দুটো হড়বড়িয়ে এগিয়ে যায় খানিকটা। সাধন সরল এই অতর্কিত আক্রমণে টাল রাখতে না পেরে কাত হয়ে যায়, আর সত্য ছইয়ের বাঁশটা শক্ত করে চেপে ধরে শ্রান্ত গলায় বলে, থাক ঠাকুরঝি, আর সত্য ছইয়ের বাঁশটা শক্ত করে চেপে ধরে শ্রান্ত গলায় বলে, থাক ঠাকুরঝি, আর তাড়া দিয়ে কাজ নেই। শেষকালে কি গো-হত্যে হবে?
সদু দুর্গা দুর্গা করে ওঠে।
গাড়ি এবার একটু দ্রুত বেগ নেয়, পরিচিত পথের স্পর্শ পাওয়া যায়।
কিন্তু আজও এমন ঘুঘু ডাকে কেন?
সত্যর সঙ্গে হঠাৎ এমন শত্রুতা সাধবার হেতু কি ওদের?
আচ্ছা ঘুঘুর ডাক না মানুষের কান্না?
অনেকগুলো নারীকণ্ঠের হুঁ হুঁ ধ্বনি না?
এ কান্নার উৎস কোন্ দিকে? গাড়ি যত বাড়ির নিকটবর্তী হচ্ছে, শব্দটা ততই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে!
না, সত্য আর কিছু শুনবে না, ভাববে না।
যতক্ষণ না শ্মশানক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছেচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কানকে আর মনকে নিষ্ক্রিয় রাখবার সাধনা করবে।
.
উলু, উলু উলু! মুহুর্মুহু উলু পড়ছে।
সমবেত নারীকণ্ঠের উলুধ্বনি বিয়ের ঘটার অভাবটা পূর্ণ করতে চাইছে যেন।
বাসিবিয়ের সবই টাটকার উল্টো।
বাসিবিয়ের কড়িখেলার সময় আগে বর কড়ি চালে, পরে কনে। বরণ আগে কনেকে করতে হয়, পরে বরকে। বরণকত্রীও বদল হওয়া রীতি। যিনি গতকাল বিয়ের বরণকার্য সমাধা করেছেন, তিনি আজ আর মঞ্চে নেই। নতুন নায়িকার সন্ধান হচ্ছে।
কে করবে তবে? অন্ন? তা অন্নই আয় মা! একখানা চেলি-টেলি জড়িয়ে আয়, বরনডালাটা ধর।… বাজুবন্ধ নেই তোর? ঝুমকোদার তাবিজ? না থাকে, আর কারুর নে পর একজোড়া বরণ করবার সময় তাবিজ বাজু পরলে শোভা ছড়ায়।
কে একজন সক্ষোভে বলে ওঠে, আহা, মা-মাগী কিছু দেখতে পেল না! কিছু করতে পেল না! মরে যাই! এখনো এসে পড়লে বাসি-বরণটা করতে পারতো!… কপালে নেই!
কপাল!
তা কপাল ছাড়া আর কোন্ সাগরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করবে আক্ষেপের নদীরা?
কপালে গিয়েই তো সব প্রশ্নের পরিসমাপ্তি।
তাই কপালে’র হাতে সমস্ত ঘটনাকে নিবেদন করে আক্ষেপকারিণী অন্নর বাজুবন্ধের ঝুমকোর ফাস টেনে শক্ত করে দিতে এগিয়ে আসে।
আবার উলু ওঠে, ক্ষুদে একটা মেয়ে গিন্নীদের থেকেও প্রবল দাপটে শাখে ফুঁ দেয়, গিন্নীরা সকলে একত্রে কথা শুরু করেন, আর সহসাই সেই প্রবল কলকল্লোল ছাপিয়ে একটা রব ওঠে, এসেছে, এসেছে, এসে গেছে!