ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণ প্রস্থান করেন।
মেয়েরা কনেকে টেনে সোজা করে বসাবার চেষ্টা করে, কিন্তু সফলকাম হয় না। কেঁদে প্রাণ বিসর্জন দেবে এই যেন তার পণ। বাস্তবিকই আর তাকে সুন্দর মেয়ে বলে চেনা সম্ভব হচ্ছে না।
কিন্তু তাতে কি!
এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা। বিয়ের কনে কাঁদবে না?
আমোদকারিণীরা এতে বিচলিত হবে কেন? তারা আর একবার সেই ব্যর্থ চেষ্টার পুনরাভিনয় করতে বসে। জনাচারেক মিলে তুললে আর ওই ছোট মেয়েটাকে কায়দা করতে পারবে না? ছুঁড়ুক সে হাত-পা, করুক না দাপাদাপি, ওরা কেন স্ফুর্তি ছাড়বে? হিহি হিহি হিহি!
ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণের নিষেধের সম্মানার্থে হাসিটা শুধু এবার ঈষৎ চাপা।
ওদিক থেকে তোড়জোড়ের সুর উঠছে, দৈ–দৈ কোথায়? যাত্রার দৈ দেখছি না তো?… কী অব্যবস্থা বাবা, কী অব্যবস্থা! ঘট আছে তো পান নেই, পান আছে তো দৈ নেই…ওগো অ জেঠি–প্রশ্নকারিণী তৃণভর্তি প্রশ্নবান নিয়ে নিক্ষেপ করতে করতে এগিয়ে যান, আসল মানুষের তো দর্শন নেই, কনকাণ্ডুলিটা দেবে কে? হ্যাঁগা, বাসিবিয়ের বরণে তোমাদের পানের বরণ আগে না জলের বরণ আগে?… ওমা, নতুন গামছা দিয়ে তোমরা ‘সোহাগ আঁচল’ নুটোও? কী অনাছিষ্টি বাবা! আমাদের তো হলুদ ছোপানো সুতোর গোছা দিয়ে–
কে কাকে বলে এখান থেকেই বোঝা যায়, কারণ সবই পাড়ার লোক নিয়ে কাজ।
প্রশ্নকারিণী যে ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণের ভাইঝি অন্ন, বুঝতে বাকী থাকে না কারো। অন্নর গলাই বুঝিয়ে ছাড়ে। ঝিউড়ি মেয়ে গলা তুলবে বৈকি, যত ইচ্ছে তুলবে।
অন্নর প্রশ্নের উত্তর আসে কোনো নারী-কণ্ঠের ভারী স্বরের মাধ্যমে।…
আমাদের ওই গামছার খুঁইে সোহাগ আঁচল, যে বাঁশের যে ধারা!… জলের বরণ আগে না পানের বরণ আগে তোর পিসিকে জিজ্ঞেস কর, সেই ঠিক বিধেন দেবে।
সঙ্গে সঙ্গে ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণের ব্যাজার কণ্ঠ বেজে ওঠে, হ্যাঁ, চিরকাল ওই বিধেন দিয়ে এলো ক্ষ্যান্ত বামনী! হাত দিয়ে তো আর পশ্য করবার আইন নেই। আমার কেবল গলাবাজির চাকরি। শাখাউলি এয়ো সোহাগীরা হাত নেড়ে সুয়ো! চল দেখি–
ওদিকে খাটো গলায় কে একজন বলে ওঠে, দেখ দেখ, এয়োদের শাঁখা সিঁদুরে দিষ্টি দেওয়া দেখ! দুগগা দুগগা, দিষ্টি তো নয়, বিষের দৃষ্টি। শনির নজর! নিজে আজন্ম বোগনো বেড়ি নাড়লেন কিনা, তাই খাওয়া-পরা দেখে হিংসেয় চোখ জ্বলে মরে।
ঝট করে উঠে যায় একজন।
বোধকরি ক্ষ্যান্তর সুয়ো সে। অথবা “সুযোগিরি” করাই তার পেশা। টাটকা-টাটকা লাগিয়ে দিয়ে যদি একটা ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটানো যায় সেটাই লাভ। কাজকর্মের বাড়িতে এমন হয়েই থাকে। বহুবিধ কথার চাষ চলে, এবং সেই চাষের ফসল রাম-রাবণের পালা ডেনে আনে। সে পালায় শুধু পক্ষ নেওয়ার অপরাধেও অনেক মান-অভিমানের গান হয়, অনেক সখী-বিচ্ছেদ ঘটে যায়।
তবে এ সমস্তই মেয়েমহলের ব্যাপার। পুরুষদের কানে এসব পৌঁছায় না। পৌঁছলেও তারা কান দেন না। তাদের কর্মক্ষেত্রে অন্যত্র। তাদের কর্মক্ষেত্র ব্যাপক। কোনো একটা ঘোট তুলে বিয়েটা পণ্ড করা যায় কিনা, সেই চিন্তার মাথা খাটে তাঁদের …..
বিশেষ করে মেয়ের বিয়ের!
তা বলে সকলের কি আর?
কি করে কুটুমের কাছে কন্যাকর্তার মুখটা থাকবে, কি করে বরযাত্রীদের সঙ্গে সম্প্রীতি সম্বন্ধ থাকবে, এর জন্যেও অনেকেই তৎপর হন। পরের কাজে প্রাণপাত করতে এগিয়ে আসে, এমন লোকও আছে বৈকি জগতে। নইলে আর জগৎটা এখনো টিকে আছে কিসের জোরে?
হয়তো সংখ্যায় এরাই বেশী।
কিন্তু জলের থেকে আগুনের, সুধার থেকে বিষের এবং হিতের চেয়ে অহিতের দাপটটা বেশী বলে এদের সংখ্যাই কম মনে হয়। প্রতিভার প্রাবল্য না থাকলে তো আর পাদপ্রদীপের সামনে আসা যায় না।
সে যাক, হিতৈষীর সংখ্যা যত বেশীই থাকুক, কার্যকাল কন্যাকর্তার মাথা ঘোরেই। এ বাড়ির কন্যাকর্তার মাথাও ঘুরছে, বন্ করে ঘুরছে।
কিন্তু সে মাথা ঘোরা কি কেবলমাত্র কুটুম্বর কাছে সম্মানরক্ষার চিন্তায়?
নাঃ, তার মাথা ঘোরার কারণ অন্য!
তা ছাড়া ভয়ের তো খানিকটা কেটেই গেছে, বরযাত্রীদের মানসম্মান রক্ষা করে বিয়ে তো মিটেই গেছে, আজ বাসিবিয়ে। এই তো মেয়েরা কনেকে আঁচলে ঢেকে ঘিরে খিড়কিপুকুর স্নান করিয়ে নিয়ে এল। এখন শুধু বরপক্ষকে নম নম করে কনেবিদেয় করে ফেলতে পারলেই আপাতত ভয় যায়। অবিশ্যি তেমন শত্ৰুজন থাকলে বরপক্ষের কান ভারী করে শেষরক্ষে করতে দেয় না। বরকর্তা চোখ গরম করে শুধু বর নিয়ে চলে যাবার হুমকি দেখায়…হয় অনেক কিছু।
কিন্তু এক্ষেত্রে সে সব কিছুরই আশঙ্কা নেই। এখানে শত্রুজনের আশঙ্কা নেই।
তবু কন্যেকর্তা সকাল থেকে হন্যে হয়ে ঘরবার করছে। ঘর থেকে দাওয়া, দাওয়া থেকে উঠান, উঠান থেকে বাড়ির বাইরে। ক্রমশ এগোতে এগোতে বকুলতলার মোড়।
জ্যৈষ্ঠের দুপুর, রোদ যেন গিলে খেতে আসছে, ওই বকুলতলাটুকুই যা ছায়াময়। তবু আগুনের হলকা ছিটানো বাতাস তো বইছেই। তাকে তো আর রোধ করা যায় না।
তবু নেশাগ্রস্তের মত দাঁড়িয়েই আছে মানুষটা, নড়ছে না। কেবল মাঝে মাঝে গলা বাড়িয়ে ডিঙি মেরে দূরের কি যেন দেখবার চেষ্টা করছে।
সন্দেহ নেই কোন কিছুর প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু কিসের? আহ্লাদজনক কিছুর বলে তো মনে হচ্ছে না। ক্রমশই একটা আতঙ্কিত উদ্বেগের ছাপ ফুটে উঠছে ওর মুখে। এখন কোনো কবরেজ যদি ওর নাড়ি দেখতে তো নাড়ির চাঞ্চল্যে উদ্বিগ্ন হত।