হঠাৎ সদুর মুখে একটা হাসির আলো খেলে যায়। হাসতেও পারছে তা হলে সদু?
তা পারছে।
মুচকি হেসে বলছে, তা যা বলেছিস! এখন এমন হয়েছে, উঠতে বসতে এই সদু বামনী! তাই তো বলে এলাম, এই ক’বছরেই এত! চিরটাকাল তো আমি বিহনে কাটলো! তা উত্তুর হল, আর সম্পর্কটা যে জন্ম-জন্মান্তর কালের। মাঝের ওই কটা দিনের ভুলভ্রান্তির জন্যে কি আর সে বাঁধন ঢিলে হবে?
সদুর ওই হাসি দেখে সত্যরও বুঝি বুকের বল বাড়ে। তাই সত্যও প্রায় হাসির মত করে বলে, সম্পর্ক যদি জন্ম-জন্তান্তরের, তা হলে তো স্বর্গে গিয়েও তোমার সতীন-জ্বালা ঠাকুরঝি…! তার সঙ্গেও তাহলে জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধন! কে জানে সেখানে গিয়ে অন্য কোনো জন্মের স্বর্গলাভ হওয়া আরো চারটি সতীন এসে কাড়াকাড়ি লাগাবে কিনা!
প্রায় হেসেই ফেলল সত্য।
জন্ম-জন্মান্তর শব্দটাকে কী এমন কৌতুকের খোরাক পেল সে?
৪৮. হিহি হিহি হিহি হিহি
হিহি হিহি হিহি হিহি।
অনেকগুলো মেয়ের গলার উল্লসিত হাসি একত্র হয়ে উছলে উঠলো গ্রীষ্মের দুপুরের দাবদাহকে পরাস্ত করে।
কনেকে পাঁজাকোলা করে ধরে তুলে বরের কোলে বসিয়ে দিতে গিয়েছিল ওরা, সেই ধাক্কায় বর ধরাশায়ী হয়েছে এবং বিদ্রোহিণী কনে ওদের হাত ছাড়িয়ে ঠিকরে উঠে পালাতে গিতে গাঁটছড়ার টানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, তাই এই হাসি উল্লসিত লহরিত!
দুটো পতনই তো বাসরের বিছানার ওপর, লাগে নি তো দুজনের একজনেরও তবে আর হাসিতে বাধা কি? এমন একটা বিয়েটিয়ে ছাড়া তো গলা খুলে হাসবার ছাড়পত্র মেলে না! আজকের গলায় গলা মেলানোর দরুন সঠিক ধরাও পড়ে না গলাটা বৌয়ের না মেয়ের! অতএব এই তো সুযোগ। যারা শুধু শাসনের ভয়ে লজ্জাশীলতার ভূমিকা অভিনয় করে চলে, তারা এমন সুযোগটা ভাল মতেই নেয়।
আজও নিচ্ছিল।
চুটিয়েই নিচ্ছিল।
সুবিধে যখন পেয়েছে।
বরকর্তার হুকুম মানতে হলে, হত না সারাদিন ধরে এমন আমোদ-আহাদ। সেই কোন সকালে বরকনেকে বিদেয় দিতে হত। বারবেলা পড়বার আগেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কেবলমাত্র কন্যাকর্তার কাতর আবেদন আর করুণ মিনতিতেই বারবেলা বাদে যাত্রা করতে রাজী হয়েছেন।
কন্যাকর্তা করজোড়ে জানিয়েছেন, বাসি বিয়েটিরের নানা ঝঞ্ঝাট, পেরে উঠবে না মেয়েরা, অনুগ্রহ করে এ বেলাটা
অতএব অনুগ্রহ করে এ বেলাটা কন্যাকর্তাকে কুটুম্ব-সেবার পুণ্য অর্জন করবার সুযোগ দিতে সসৈন্যে রয়ে গেলেন বরকর্তা। খানিকটা দূরে ঘোষেদের বৈঠকখানা বাড়িতে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে, কনের বাড়ির মেয়েদের কলহাস্য সেখানে পৌঁছবার ভয় নেই। সারা বেলাটা বাসি বাসরে বসে আমোদ-আহ্লাদ করছে মেয়েরা, বারবেল কাটলে তখন বাসি বিয়ে। ততক্ষণে হয়তো আসল মানুষটা এসে যাবে। বরকনে বিদেয় দেরি হলেও ভাবনা কিছু নেই। বরের বাড়ি কলকাতায় হলেও, আপাতত বিয়েটা হচ্ছে এ পাড়া ওপাড়ায়, এ বিয়ের প্রধানা ঘটকিনীর বাড়ি থেকে। সুবিধে যৎপরোনাস্তি।
এই হুল্লোড়কারিণীরা বেশীর ভাগই পাড়ার বৌ-ঝি। তবে নিতান্ত তরুণী নয়, কিছুটা মাঝবয়সী।
যদিও জ্যৈষ্ঠের দুপুর, তবু বিয়েবাড়ি বলে কথা। চেলি বালুচরী, পাশী জামদানী, যার যা আছে পরে এসেছে এবং গলদঘর্ম হচ্ছে। যদিও একখানা করে ফুল কোচানো সুতি শাড়ি এনেছে হাতে করে, খেতে বসবার সময় পরতে। তা খাওয়ার এখন বিলম্ব আছে। বরযাত্রীদের ভোগরাগ মিটলে তবে তো!
কিন্তু নিরঙ্কুশ সুখ কোথায়?
ওদের হিহি ধ্বনিতে বিরক্তচিত্ত ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণ রঙ্গমঞ্চে এসে আবির্ভূত হন। এবং বলাই বাহুল্য মুহূর্তে সে মঞ্চে শ্মশানের নীরবতা নামে। ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণ সেই নীরবতার প্রতি একবার তীব্র দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলে ওঠেন, হাসির ঘণ্টাবাদ্যি যে হাটতলা অবধি পৌঁচুচ্ছে, একটু রয়েসয়ে আমোদ করলে ভাল হয় না?
নীরবতা আরও গম্ভীর হয়।
ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণের দৃষ্টি পড়ে মূল নায়ক-নায়িকার ওপর। একজন ধরাপড়া চোরের মত হেঁটমুণ্ড অবনতনেত্র, আর একজন রোরুদ্যমানা। কুণ্ডলী পাকানো চেলিমোড়া শরীরটা তার কান্নার উচ্ছ্বাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
দৃশ্যটি অবলোকন করে ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণ সস্মিত মুখে বলেন, ছুঁড়ি যে কেঁদে কেঁদে আধখানা হয়ে গেল কাল থেকে! তোরা একটু বুঝ দিচ্ছিস না? আপনারাই হাসি-মস্করায় মত্ত।
এবার নীরব মঞ্চে শব্দ ওঠে।
একটি ঝিউরি মেয়ে বলে ওঠে, এ কান্না কি আর বুঝ দিলে থামে পিসি! তায় আবার ও
পিসি ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, নাও রঙ্গ! তোরা যে আবার মনসায় ধুনোর ধোয়া দিতে বসলি। কেঁদে কেঁদে মুখ-চোখের চেহারা যে খোলতাই হচ্ছে একেবারে। শ্বশুরবাড়িতে আর বৌ দেখে কেউ বলবে না সোন্দর মেয়ে। নে এবার ওঠা, মুখে-চোখে জল দেওয়া, এবার তোর বারবেলা কেটে এল, বাসি বে’র তোড়জোর কর। মেয়েজন্ম শ্বশুরবাড়ির জন্যে।
মেয়েটা ফিক করে হেসে ফেলে বলে, তুমি আর বলবে না কেন পিসি? শ্বশুরবাড়ি যে কী বস্তু তা তো আর জানলে না কখনো!
আমি? আমার সঙ্গে তুলনা? মরণদশা দেখো ছুঁড়ির! আমার মতন অবস্থা যেন অতি বড় শত্রুরও না হয়। ….নে আদিখ্যেতা রাখ, যোগাড়ে মন দে।
আর একবার কড়ি খেলানো হবে না পিসি?
হবে, হবেই তো! বারবেলা গেল। দেখ ততক্ষণে যদি কলকাতার মানুষরা এসে পড়ে। হুটুককার এক বে! সবই বিচ্ছিরি! তোল তোল ছুঁড়িকে, চেলির গরমে ভিরমি না যায়।