হ্যাঁ, মনের মধ্যে নবকুমারের কথাই তোলপাড় করে উঠছে সত্যর।
হয়তো ক্ষণপূর্বকালের সেই মন-কেমনটার সঙ্গে এক আকস্মিক সংবাদের একটা যোগসূত্র ধরা পড়েছে সত্যর মনের মধ্যে।
ধরা পড়েছে বুঝি নিজের মনের দুর্বলতাও।
নইলে নবকুমারের জন্যে যেবার সাহেব ডাক্তার ডেকে দেখিয়েছিল সত্য, সেদিনের কথাই বা হঠাৎ মনে পড়বে কেন? সেদিন যে নিশ্চিন্ত সর্বনাশ’ জেনেও লড়বার শক্তি সংগ্রহ করেছিল সত্য, সে কথাটা ভেবে আশ্চর্য লাগছে এখন তার।
যাক, বিসর্জনের বাজনা তবে সত্যিই বাজলো এবার। সত্যর তেজ আসপর্দা দাপট সব কিছুই যে সেই মেরুদণ্ডহীন মানুষটাকে মেরুদণ্ড করে, এ কথা কি এখন টের পেল সত্য? যখন মানুষটা
ঠাকুরঝি, চলে যাচ্ছ তুমি?
সত্য ব্যাকুলভাবে সদুর হাত ধরে।
সদু বিচলিত হয়।
সদু এই ভয়ানক একটা অমঙ্গল আশঙ্কায় কণ্টকিত মানুষটাকে কি ওই ভয়ঙ্কর মানসিক অবস্থা থেকে উদ্ধার করবে? বলবে–
না, বেশী কিছু বলে না সদু। শুধু সত্যর হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যস্তভাবে বলে, কেন অমন উতলা হচ্ছিস বৌ, আমি বলছি নবু ভাল আছে, মঙ্গলে আছে– বলতে বলতেই দাওয়া ছেড়ে উঠোনে নামে সদু। বলে, যাই, আমারও তো যাত্রার গোছগাছ আছে একটু-তুইও যেমন পারিস গুছিয়ে নে। তুড়ু ফিরলেই আমার ওখানে পাঠিয়ে দিস।
সদু যেন একপ্রকার পালিয়েই যায়।
আর সত্য সদুর সেই যাওয়ার পথের দিকে নিথর হয়ে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
এবার নবকুমারকে ছেড়ে আর এক আশঙ্কা বুকটাকে করাত দিয়ে কাটছে। সদুর শেষ কথাটা কানে বাজছে… নবু ভাল আছে। মঙ্গলে আছে…
তবে?
কে তবে মঙ্গলে নেই?
‘সুবর্ণ’ নামটা মনে আনতেও মন শিউরে উঠছে। তবু মনের চিন্তা কে ঠেকাতে পারে?…. শতবার সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করলেও যে সেই ঠেলে রাখা দুশ্চিন্তাকে সহস্রবার ডেকে আনে মন।
এবার বোঝা গেছে।
সুবৰ্ণর ভয়ানক একটা কিছু হয়েছে, খুলে বলল না সদু!
কী সেই ভয়ানক?
খুব মারাত্মক কোনো অসুখ?
নাকি একেবারেই চরম দণ্ড দিয়ে দিয়েছেন ভগবান?
সুবর্ণ সুবর্ণ নামটা সত্যর জীবন থেকে মুছে যাবে?
বিসর্জনের বাজনাটা সত্যিই বুঝি বাজতে থাকে সত্যর প্রতিটি রক্তকণিকায়।
তবু কিছু গোছ করতেই হয়।
ছেলেরা এলে বলতেও হয় সদুর বার্তা।
এবং তারা যখন পিসিমার বাড়ি ঘুরে এস জানায় গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেছে, ঘোড়ার গাড়ি এবং গোরুর গাড়ির সাহায্যে ঘণ্টা কতকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যাবে, তখন তাদের মুখের দিকে তাকাতে সাহস করে না সত্য।
কিন্তু শুধুই কি সত্য?
হঠাৎ উতলা হয়ে যাওয়া, হাল ছেড়ে দেওয়া সত্য?
সত্যর ছেলেরাই কি মুখ দেখাতে সাহস করছে মাকে? তাদের সেই ভয়-খাওয়া কালিমাড়া শুকনো মুখ?
বাড়ি চাবি দিয়ে যেতেই হবে। ঘরে ঘরে চাবিগুলো লাগাতে থাকে সত্য, আর ওর মনে হতে থাকে, তার জীবনের সমস্ত দরজাগুলোও বুঝি বন্ধ করে ফেলছে সে।
এই বন্ধ দরজাগুলো খুলে খুলে আর যেন সংসার করবে না সত্য।
.
সত্যর বড়ছেলের বিয়ে না ক’দিন পরে?
সে বিয়ে কি সত্য দেখবে?
হবে কি সে বিয়ে?
সব যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে…অলীক মনে হচ্ছে।
গতকালই যে সকালে নিতাইয়ের বৌয়ের কাছ থেকে আসা কাটা সুপুরির গাদা বেতের ঝাপিতে ঢালতে ঢালতে আহ্লাদে উৎফুল্ল হয়েছে সত্য, সুপুরিগুলো দিব্যি সরু সরু কুচনো হয়েছে বলে, সে কথা কি কিছুতেই এখন বিশ্বাস করতে পারা যাবে?
অকারণে কী এমন হয়?
হয় না।
মন আগে থেকে টের পায়।
আর যদি অকারণেই হবে, ওরা এমন স্তব্ধ কেন? গাড়িতে যারা চলেছে সঙ্গে?
সাধন, সরল, সদু?
অন্য যে কোনো দিন হলে নিশ্চয় সত্য ওদের ওই স্তব্ধতা ভাঙিয়ে ছাড়তো। দৃঢ় গলায় বলতো, অত লুকোছাপা করে লাভ নেই, যা হয়েছে তা তো জানতেই পাচ্ছি, বেঁধে মেরে দরকার কি? যা হয়েছে শুনবো, শুনতে প্রস্তুত হচ্ছি–
কিন্তু আজ পারছে না।
কাল দুপুর থেকে সত্যর মনটা অকারণেই হঠাৎ বিকল হয়ে গেছে।
.
নির্দিষ্ট জায়গায় ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে গরুর গাড়িতে উঠতে হল। আর উঠে বসার পর সদু একবারে স্তব্ধতা ভাঙলো। সত্যকে উদ্দেশ্য করে নয়, ছেলেদের উদ্দেশ করে বলে উঠলো, তোদের পিসেমশাইয়ের আসার ইচ্ছে ছিল, শুধু এই গো-গাড়ির ভয়ে পিছিয়ে গেলেন। বয়েস হয়েছে তো! আর চিরটাকাল কলকাতায়
শেষের কথাগুলো শুনতে পায় না সত্য।
শুধু কানে বেজে উঠেছে ‘ইচ্ছে ছিল’!
ইচ্ছে ছিল মানে কি? কর্তব্য ছিল নয়, ইচ্ছে।
কোন্ দৃশ্যের মুখোমুখি হবার ইচ্ছে হচ্ছিল আয়েসী আত্মসুখী লোকটার?
নীরবতাই ভীতিকর।
কথাই সাহসের জন্মদাতা।
কথার পর তাই আবার কথা কইতে পারছে সদু, তাছাড়া বললেন, কদিন পরেই যেকালে তুড়ুর বিয়েতে যাচ্ছি, তখন পালকিতে যাবো এ পথটা-
তুড়ুর বিয়েতে যাচ্ছে!
কদিন পরে তুড়ুর বিয়েতে যাচ্ছি!
ওরা তা হলে সে আশা পোষণ করছে এখনও? তুড়ুর বিয়ে যথাদিনে হবে, লোকজন সবাই যাবে নেমন্তন্নে?
সত্য এবার যেন একটু লজ্জিত হয়।
সত্য একটু বেশী বিচলিত হয়ে পড়েছে। আর সেই বিচলিত ভাবটা ধরা পড়িয়ে ফেলেছে। সবাইয়ের কাছে। ছি ছি, কী লজ্জা!
হয়তো সামান্য কিছু অসুখবিসুখ করেছে সুবর্ণর। যে লোকটা খবর দিতে এসেছিল সেই লোকটাই বোকা হাঁদা, কি বলতে কি বলেছে!
তাই সত্য এবার কথা বলে।
বলে, তুমি চলে এলে, ঠাকুরজামাইয়ের একটু অসুবিধে হল—