যে জন্যেই যা হোক বাক্সতোরঙ্গ টানটানি আর ভাল লাগল না। হাতের কাজ অসমাপ্ত রেখে জানলার ধারে এসে দাঁড়ালো সত্য।
ঝা-ঝ করা রোদে আকাশটা যেন ফাটছে, রাস্তার ধারের গাছটা, রাস্তার ওপারের বাড়িগুলো সেই দাহে যেন পুড়ে খাক হচ্ছে।… পাশের রাস্তাটা দিয়ে বোধ করি কোন বাসনওলা যাচ্ছে, ঢং ঢং কাঁসর পিটিয়ে, শব্দটা ক্ষীণ থেকে প্রখর এবং প্রখর থেকে ক্ষীণ হয়ে গেল।
দূরে কোথায় একটা গরুর গাড়ি চলেছে, তার চাকার ক্যাচ শব্দের সঙ্গে গরুর গলার ঘন্টিটা বেজে চলেছে একতালে।…
আরো দূরে কোথায় ঘুঘুর ডাক স্তব্ধ প্রকৃতির গায়ে করুণ আর্তনাদের ছুরি বিধোচ্ছে। ঘুঘুর ডাক কি কখনো শোনে নি সত্য? জীবনভোরই তো শুনছে।
তবে হঠাৎ কেন আজ ঘুঘুর ওই কান্নাটার মত কাঁদছে ইচ্ছে করছে সত্যর? কেন মনে হচ্ছে তার কেউ কোথাও নেই, চিরদিন সে একা, চিরদিন নিঃসঙ্গ। তার উপর কারো মায়া নেই, মমতা নেই, ভালোবাসা নেই। সেই স্নেহ-ভালবাসাহীন রুক্ষ মরুভূমির পথ ধরে একা সে চলছে আর চলছে!…
রোদের আঁচ আর আগুন ঝলসানো বাতাসের হলকা চোখেমুখে এসে লাগছে, তবু জানার বাইরের ওই দৃশ্যটা যেন নেশার বস্তুর মত আটকে রেখেছে সত্যকে। সে নেশার সঙ্গে মিশে রয়েছে একটা বিধুর বিষণ্ণ বেদনা।
এ বেদনা কেন?
এ শূন্যতা কিসের?
বিছানায় পড়ে অকারণ কান্নার মত অদ্ভুত একটা কবিত্ব করতে বসবে কি সত্য?
হয়তো তাই করতো, হয়তো করতো না, হঠাৎ চোখে পড়লো সদু আসছে রাস্তা দিয়ে ভিজে গামছা মাথায় চাপিয়ে, পায়ের তলা বাঁচাতে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে।…
একটা অশুভ আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল।
এ কী! হঠাৎ এমন সময়ে কেন?
চমকে উঠে নেশা কাটলো।
জানলা থেকে সরে এসে দ্রুত পায়ে নেমে এল সত্য।
আর নীচে আসতেই সদু শুকনো গলায় বলে উঠল, এই যে বৌ! ছেলেরা কেউ নেই?
সত্য মাথা নাড়লো, বসতে বলতে ভুলে গিয়ে।
সদু একটু ইতস্তত করে কাছের চৌকিটায় বসে পড়ে বলে ওঠে, একটা খবর আছে বৌ, বলছি। সব। আগে এক ঘটি জল দে দিকি।
ঢক ঢক করে এক ঘটি জল শেষ করে, থেমে জিরিয়ে–অগোছালো এলোমেলো করে সদু যা বললো তার সারমর্ম এই, সত্যকে বারুইপুরে যেতে হবে।
বারুইপুরে যেতে হবে?
সে তো জানেই সত্য, যাবেই তো! এই তো কদিন পরেই
না না, সেই কদিন পরের কথা পরে হবে, এখন এই দণ্ডে যাওয়া দরকার। আজ হলেই ভালো হত, তবে নাকি গাড়ি-পালকির ব্যবস্থা করতে কিছু-কিঞ্চিৎ সময় তো লাগবে। অতএব কাল। আগামীকাল, একেবারে ঊষাকালে। মুখুজ্যে মশাই দিচ্ছেন সবই ব্যবস্থা করে, শুধু সত্যর বড়ছেলে একবার তার সঙ্গে বেরোক।
খুব গুছিয়ে আর খুব হালকা করে বলতে চেষ্টা করে সদু, তবু কেমন যেন উল্টোপাল্টা লাগে কথাগুলো, আর সদুকে অদ্ভুত রকমের বোকা-বোকা দেখতে লাগে।
কী যেন রেখে-ঢেকে বলছে সদু, অথচ যেন উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ছে সেই গোপন করার চেষ্টা।
সদুর মুখচোখের যে বিবর্ণতা সে শুধু এই রোদ্দুরে হেঁটে আসার বিবর্ণতা? সদুর গলার স্বরে যে উত্তেজনার কাপন, সে কি শুধু সত্যকে অভয় দেবার ব্যাকুলতায়?
হ্যাঁ, বার বার অভয় দিচ্ছে সদু সত্যকে, ভয় করিস নে বৌ, ভয়ের কিছু নেই।
কিন্তু এই অভয় দানের মধ্যেই ভয়ের বাসার সন্ধান পাচ্ছে সত্য। তাই সত্যর বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেছে, হাত-পা বারকতক কেঁপে কেঁপে হঠাৎ বুঝি কাঁপবার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে অবশ হয়ে আসছে।
একবারও প্রশ্ন করে নি সত্য, শুধু বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে সদুর মুখের দিকে। সদু কি তরে আর রেখে-ঢেকে বলবে না? সহসা খুলে বলবে সব?
না, সে সাহস নেই সদুর।
সদু তাই শুধু ফাঁকা-ফাঁকা সাহসের কথাই বলছে, ভাবনা করিস নে বৌ, মন উচাটন করিস নে, গিয়ে সব ভালই দেখবি। আমিও তো যাচ্ছি তোর সঙ্গে।
.
সদুও যাচ্ছে সত্যর সঙ্গে!
আর তবে সন্দেহের কী আছে?
সর্বনাশের কালো ছায়াটা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে সত্য।
এতক্ষণে সত্যর কণ্ঠ থেকে স্থলিত হয়ে পড়ে একটা শব্দ।
ঠাকুরঝি!
এ স্বর সত্যর?
এ হালছাড়া স্বর?
এবার কি তবে সে তার হাতের হালখানা নামিয়ে রাখছে? যে হালখানাকে শক্ত মুঠোয় বাগিয়ে ধরে অনেক সমুদ্র ঠেলে এই এতখানি এল সত্য?
কিছুতেই হার মানবে না পণ করে এতদিন চলে এসে এইবার ভাগ্যের হাতে হার মানবে?
সত্য কি ভিতরে ভিতরে এত ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল?
সদু বলে, এই দেখ কাণ্ড! তুই যে একেবারে বসে পড়লি বৌ! তুই তো কখনও এমন নয়? কোনো কিছুতেই তো হেলিস না, দুলিস না। আজ হঠাৎ এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন?
সত্য হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে।
নিজের এ অধঃপতনে লজ্জিত হয়। কিন্তু তবু শিথিল স্বরটাকে সামলাতে পারে না। তেমনি শিথিল স্বরেই বলে, কি জানি ঠাকুরঝি, হঠাৎ মনটা কেমন কু’ গাইছে, মনে হচ্ছে সব যেন ফুরিয়ে যেতে বসলো!
দুর্গা দুর্গা, ষাট ষাট।
সদু ব্যস্ত হয়ে ষাট বানায়, আমি তোকে বলছি বৌ, ভাল ভিন্ন মন্দ কিছু ঘটে নি। তবে অকস্মাৎ তলবটা কেন এল ভাল বুঝতে পারছি না!
হ্যাঁ, তলব এসেছে। বারুইপুর থেকে নাকি লোক এসেছে। এসেছে সদুর কাছে। শুধু এদের সবাইকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে বলেছে সদুকে। আজ বেরোতে পারলে আজ, না পারলে কাল যত ভোরে সম্ভব!
সত্য একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, পষ্ট কথা আমার মনই বলছে ঠাকুরঝি, মনে হচ্ছে যেন বিসর্জনের বাজনা শুনতে পাচ্ছি। সেবার ওর অত বড় অসুখেও এমন হয়নি আমার।