শিবজায়া অবশ্য আর একবার বললেন না, শুধু মাথার কাপড়টা অল্প টেনে মুখটা একটু ফেরালেন।
মোক্ষদা একটু বিষ-হাসি হেসে বলেন, বলতে অবিশ্যি আর হবে না, কানে প্রবেশ করেছে সবই। তবে ভাবছি। সেজবৌ তুমি হঠাৎ এমন ভট্টচায্যি হয়ে উঠলে কবে থেকে? যাত্রাকালে রাসুর আমাদের পরিবারের সঙ্গে চোখাচৌখি হয় নি এই আক্ষেপে মরে যোচ্ছ তুমি? কলি আর কত পুন্ন হবে? চারকাল হয়ে তো কলি এখন উপচোচ্চে। শুভকাজে যাত্রাকালে লোকে ঠাকুর-দেবতার পট দেখে বেরোয়, গুরুজনের চরণ দর্শন করে বেরোয় এই তো জানি, জেনে এসেছি। এতকাল। পরিবারের বদন দর্শন না করে বেরোলে জাত যায়, এটা তুমিই প্রেথম শোনালে সেজবৌ।
শিবজায়া ননদকে ভয় করলেও এতজনের মাঝখানে হেরে যেতে রাজী হন না, তাই বলে ওঠেন, রাসুর কথা আমি বলি নি ছোট্ৰঠাকুরঝি, বড় নাত-বৌয়ের কথা বলছি। আবাণী জানল না। শুনল না। আচমকা মাথায় পাহাড় পড়ল, আপনার সোয়ামী একা আপনার থাকতে থাকতে একবার শেষ দেখাও দেখতে পেলে না; সেই কথা হচ্ছে।
মোক্ষদা সহসা খলখলিয়ে হেসে ওঠেন, অ সেজবৌ, আর কেন ঘরে বসে আছ? যাত্রার পালা বঁধ না। সত্য পয়ার বেঁধেছে—তুমিই বা বাকি থাক কেন? যা তোমাদের মতিগতি দেখছি, এ আর গোরস্ত-ঘরের যুগ্যি নয়। বুড়ো-মাগী তুমি, চারকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, লজ্জা এল না ও কথা মুখে আনতে? সোয়ামী কি মণ্ডা মিঠাই, যে একলা আস্তটা না খেতে পেলে পেট ভরবে না, ভাগ হয়ে গেলে প্ৰাণ ফেটে যাবে? ছিঃ ছিঃ! একটা ভদরলোকের কত বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করতে ছুটীল রামকালী, আর তার কাজের কিনা ব্যাখ্যানা বসেছে!
বড়দের এই বাকযুদ্ধের মাঝখানে সত্য হাঁ করে তাকিয়েছিল, মোক্ষদার কথা শেষ হতেই হঠাৎ ঠাকুমার কোলের গোড়া থেকে উঠে সরে এসে বলে বসে, সেজ ঠাকুমা তো ঠিকই বলেছে পিসঠাকুমা। নিয্যসি বাবার অন্যাই হয়েছে।
বাবার অন্যায়! সন্দেহযুক্ত নয়, একেবারে নিয্যস!
উঠোনে কি বাজ পড়ল!
কলিকাল শেষ হয়ে কি প্ৰলয় এল!
০৮. দুঃসংবাদের সঙ্গে সঙ্গে
দুঃসংবাদের সঙ্গে সঙ্গেই অন্দরে কান্নার রোল উঠল। এ কী হরিষে বিষযাদ! এ কী বিনামেঘে বজ্রাঘাত! এমন দুর্ঘটনা আর কবে কার সংসারে ঘটেছে? এত বড় সর্বনাশের কল্পনা দুঃস্বপ্নেও কে কবে করেছে?
এই তো এইমাত্র মেয়ে কলাতলায় শিলে দাঁড়িয়ে স্নান করে আইবুড়ো মুচি ভেঙে, গায়ে-হলুদের দরুন কোরা লালপাড় শাড়িটুকু পরে চুল বিঁধতে বসেছে, পাড়ার শিল্পী মহিলার ঝাঁক কনের কেশ-রচনায় কে কত নৈপুণ্য দেখাতে পারেন তারই আলোচনায় অন্দরের দালান মুখর করে তুলেছেন, হঠাৎ বাইরের মহল থেকে আগুনের হলকার মত এই সংবাদ এসে ছড়িয়ে পড়ল।
পরিণামে? দাবানল!
অতি বড় অবিশ্বাস্য হলেও এ যে বিশ্বাস না করে উপায় নেই। কারণ সংবাদ এনেছেন। আর কেউ নয় স্বয়ং রামকালী। যার সম্পর্কে বিন্দুমাত্ৰও সন্দেহ পোষণ করা অসম্ভব। নচেৎ মিথ্যা দুঃসংবাদ বুট কুর বিয়ে ভাল করে দিয়ে মজা দেখবে এমন আখীয়েরও অভাব নেই। কিন্তু ইনি হচ্ছেন রামকাল।
কাজেই সংবাদ মিথ্যা হতে পারে, এমন আশার কণিকামাত্ৰও নেই। নাঃ, কোন আশাই নেই। তা ছাড়া কবরেজ নিজের চোখে দেখে এসেছেন। পাত্রের শিয়রে শিমন।
অতএব কোরা শাড়ি জড়ানো বছর আষ্টেকের সেই হতভম্ব মেয়েটাকে ঘিরে প্রবল দাপটে কান্নার যা রোল উঠেছে তাতে ভয়ে মেয়েটার নাড়ি ছেড়ে যাবার যোগাড় হচ্ছে।
বিয়ের দিন যাত্ৰা-করা-বর মৃত্যুরোগ নিয়ে যাত্ৰা ভঙ্গ করে বাড়ি ফিরে গেলে এবং বিয়ের লগ্ন ভ্ৰষ্ট হলে এমন কি সর্বনাশ সংঘটিত হতে পারে, সেটা বেচারার বুদ্ধির অগম্য, অনিষ্ট যদি কিছু হয় সে নয়। তার ঠাকুর্দার হবে, তার কি?
কিন্তু তার কি, সে কথা সে কিছু না বুঝলেও মহিলার দল তাকে ধরে নাড়া দিয়ে দিয়েই তারস্বরে চেঁচিয়ে চলেছেন, ওরে পটলী, তোর কপালে এমন ছাই পোরা ছিল, একথা তো কেউ কখনও চিন্তে করি নি রে। ওরে লগ্ন-ভ্রেষ্ট মেয়ে গলায় নিয়ে আমরা কী করব রে! ওরে এর চাইতে ৩োকেই কেন শমনে ধরল না রে, সে যে এর থেকে ছিল ভাল! ওঁরা লুটোপুটি করতে থাকেন, আর প৮লী কাঠ হয়ে বসে থাকে। বসে বসে শুধু এইটুকু বিচার করতে পারে সে যে এত সব কাণ্ডকারখানা কিছুই হত না, যদি পটলীই রাতারাতি ওলাউঠো হয়ে মরত!
ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে লক্ষ্মীকান্ত বাড়ুযে মাথায় হাত দিয়ে পাথরের পুতুলের মত বসে আছেন, আর সেই পুতুলের মস্তিষ্কের কোষে কোষে ধ্বনিত হচ্ছে, এ কী করলে ভগবান! এ কী করলে ভগবান!
রামকালী চলে যাওয়ার পর থেকে লক্ষ্মীকান্ত আর একটিও কথা বলেন নি, অপর কেউ তাঁকে সম্বোধন করতে সাহস পায় নি। ওদিকে বড় ছেলে শ্যামকান্তও বিশুষ্ক মুখে ঘাটের ধারে শিবতলায় গিয়ে বসে আছে চুপচাপ, বাপের দিকে যাবার সাহস তার নেই। তার জামাই হচ্ছে বটে কিন্তু বয়সটা আর তার কি? এখনও তো তিরিশের নিচে। বাপকে সে যমের মত ভয় করে।
পটলীর মা বেহুলাও মুখ লুকিয়েছে ভাড়ার ঘরের কোণে। নিজেকেই তার সব চেয়ে অপরাধিনী মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই মহাপাপিষ্ঠা সে, নইলে তার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারেই এত বড় দুর্লক্ষণ দুর্ঘটনা! সকলেই ফিসফাস বলাবলি করছে মেয়ে নাকি তার আস্ত রাক্ষসী, তাই বাসায় না। উঠতেই সোয়ামীটার মাথা কড়মড়িয়ে চিবিয়ে খেল। থাকুক এখন বেহুলা চিরজন্ম ওই দ’পড়া সর্বনাশী মেয়েকে গলায় গেঁথে। জাত ধৰ্ম কুল সবই গেল, রইল। শুধু আমরণ যম-যন্ত্রণা।…