উৎসাহ সকলেরই।
তা ছাড়া বিয়ের কাজে সবাইয়ের সাহায্য নেওয়াই সামাজিকতা, না নেওয়াই নিন্দে। কনের বাড়ি খুব দূরে নয়। তাদের কাছ থেকেও নানা ব্যাপারে লোক আনাগোনা করছে, নমস্কারী শাড়ি কখানা দিতে হবে, ননদঝাপি কটা, এয়োডালায় কি কি দিতে হয় আপনাদের, এই সব নানা কথা।
নবকুমার কিনা এই সময় দেশে গিয়ে বসে রইল!
অভাববোধ এবং অভিমানবোধটা হঠাৎ চাড়া দিয়ে উঠে মনটা কেমন খা খা করে তুলেছে আজ। হঠাৎ খেয়াল হল–ছেলের ঘরটা সাজিয়ে ফেলি।
বারুইপুর থেকে ফিরে তো এই বাসা-বাড়িতেই বাস করতে হবে বৌ নিয়ে! বয়েসওলা মেয়ে, তাকে আর ঘরবসতের অপেক্ষায় এক বছরের মত বাপের বাড়ি রাখতে ইচ্ছে নেই সত্যর। আজকাল কলকাতায় পাড়াপড়শীদের মধ্যে একটা ব্যবস্থার চল দেখেছে সত্য- ধুলোপায়ে ঘরবসত!
অষ্টমঙ্গলার মধ্যে একবার বাপের বাড়ি ঘুরিয়ে এনে ফের বরকনেকে গাঁটছড়া বাঁধিয়ে দাঁড় করিয়ে বরণ করে তোলা হয়, তার নাম “ধুলোপায়ে ঘরবসত”। তাতে নাকি আর বছরের মধ্যে বৌ আনতে দোষ নেই।
সত্য এ ব্যবস্থাটি নেবে।
ছেলের তার বৌ-বৌ মন হয়েছে, এ বার্তাটুকু মনে মনে টের পেয়েছে সত্য।
বৌকে তাড়াতাড়িই আনতে হবে।
তা আজকে ঘরটাই বরং ঠিক করে ফেলা যাক।
দোতলায় দুখানা ঘর।
তার একটায় সাধন সরল দুই ভাই শোয়, আর একটায় সংসারের নানাবিধ জিনিস জমানো আছে। সত্য নীচের ঘরে শোয় একটা চৌকিতে সুবর্ণকে নিয়ে। আর একটা চৌকিতে নবকুমার।
যে বাসায় সুহাসকে নিয়ে থেকেছে, একতলা সেই বাসাটায় ঘর ছিল কম, জায়গা ছিল স্বল্প, নবকুমার বেচারী অনেক বঞ্চিত হয়েছে। এখনকার এ ব্যবস্থা সত্যরই। মানুষটার বয়েস হচ্ছে, রাতে একা পড়ে থাকবে? এক ঘটি জলও তো হাতে এগিয়ে দেবার কেউ থাকবে না একা থাকলে। ছেলেদের বারো মাস রাত জেগে লেখাপড়া, সে ঘরে নবকুমারের অসুবিধে। অতএব এই ব্যবস্থা। এখন আর এ ব্যবস্থা চলবে না।
এখন দোতলায় ওই জিনিসের ঘরটা খালি করে সুবর্ণকে নিয়ে সত্যকে আড্ডা গাড়তে হবে, সকলকে চালান করতে হবে নীচে নবকুমারের ঘরে। এ ছাড়া উপায় নেই। ছেলের বৌয়ের সামনে স্বামীর সঙ্গে এক ঘরে শোওয়াটা ভব্যতার আইনে বাধে। অন্তত সত্যর কাছে।
ছেলেদের ঘরটা সত্যর ভাল করেই সাজানো।
দেয়ালে দেয়ালে দেব-দেবীদের এবং মহাপুরুষদের ছবি, দেয়াল-আলমারিতে সারি সারি বই, এক কোণে পড়ার টেবিল, তার সামনে দুটি টুল, টেবিলে লেখাপড়ার সরঞ্জাম। বড় চওড়া চৌকিতে দুই ভায়ের বিছানা।
এ-ঘরের পরিবর্তন সাধন করতে করতে মনে মনে একটু হাসে সত্য, ব্রহ্মচারী এবার সংসারী হবেন! পাশে ভাইয়ের বদলে বৌ!…
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা রোমাঞ্চ জাগে সত্যর। নেহাৎ ছেলেমানুষের মত ভাবতে বসে, ওই লাজুক ছেলে না জানি কেমন করে বৌয়ের সঙ্গে ভাব করবে, কেমন করে বৌকে আদর করবে!
তারপর ভাবে, এই যে একটু বয়েস হয়ে বিয়ে হওয়া, এ কত সুন্দর! কী অদ্ভুত “কাল” ছিল সত্যদের! কনের বরের নামে গায়ে জ্বর, বরের বৌয়ের নামে কালঘাম। সত্য যখন ঘরবসতে এসেছে, তখন অবিশ্যি “ঘর-বর” পায় নি, কিন্তু যখন পেয়েছে, তখন মানসিক অবস্থা ওর থেকে উন্নত নয়। আর বিয়ে?
মানে জেনেছে তখন তার? ছি ছি! সে বিয়ে যেন ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে বড়দের পুতুল খেলার সাধ মেটানো!
মস্ত মস্ত এক লোভ দেখিয়ে রাখা হয়েছে, “গৌরীদান” “কন্যাদান” “পৃথিবীদান”! আর কিছুই নয়, মেয়েগুলোর চোখ-মুখ ফোঁটাবার আগেই হাড়িকাঠে গলা দিয়ে রেখে দেওয়া!
সত্যর মতন এত দজ্জাল আর কটা মেয়ে হয়?
ভয়ে জড়সড়, সর্বদা অপরাধিনী, এই তো অবস্থা সবাইয়ের!
আবার একটু হাসি ফুটে ওঠে সত্যর মুখে। নবকুমারের মত এমন তদগতপ্রাণ বর না হলে অবশি সত্য কি করতে পারত। সত্যে মনের অগোচর কিছু নেই, স্বামী সম্বন্ধে ভিতরে ভিতরে অনেক অবজ্ঞা আছে সত্যর, তবু হঠাৎ আজ এই গ্রীষ্মের দীর্ঘ দুপুরে খাঁ খাঁ করা মনে সেই অবজ্ঞার মানুষটার জন্যেই হঠাৎ আজ এই গ্রীষ্মের দীর্ঘ দুপুরে খাঁ খাঁ করা মনে সেই অবজ্ঞাত মানুষটার জন্যে হঠাৎ বড় বেশী মন-কেমন করে উঠল তার। নবকুমার বেচারাই কি সুখী হতে পেল? নিজেকে একটু অপরাধিনীই মনে হতে থাকলো।
সত্য যদি নেহাৎ সাধারণ একটা “সংসারসর্বস্ব” মেয়ে হত! বেচারা নবকুমারের জীবনটা অনেক বেশী সুখের হত তাতে আর সন্দেহ নেই।
এই তো আজই তো সত্য সেই বেচারার শেষ সুখটুকুও কাড়তে বসেছে। কিছু নয়, তবু এক ঘরেও তো থাকতো, দুটো গল্পগাছার সময়ই তো রাত্তির। সত্যর মনমেজাজ ভাল থাকলেই তো নবকুমারের আপিসের গল্প আর আপিসের বন্ধুদের গল্প চেগে ওঠে। সে সুখটুকু থেকে বঞ্চিত হবে এবার।
ছেলের বৌয়ের সামনে এক ঘরে বাসের নীতি যে দুর্নীতি এ কথা নবকুমারকে বোঝানো শক্ত। এলোকেশী তো স্বামীর মৃত্যুকাল পর্যন্ত ঘর আঁকড়ে থেকেছেন। সোনাটা চিরদিনই হাতছাড়া বলেই হয়তো আঁচলে গেরো দেওয়ার তত ঘটা ছিল।
অবিশ্যি দৃষ্টান্ত আরো অনেক আছে।
একা এলোকেশীকেই দোষ দিলে উচিত হবে কেন?
কাকার থেকে ভাইপো বড়, এ তো হামেশাই দেখা যায়। গিন্নীর কনিষ্ঠ পুত্তরটি পৌতুরদের কাঁথা কাজললতার প্রসাদে মানুষ হয়।…
হয় সত্য জানে। কিন্তু সত্যর তাতে বড় বিতৃষ্ণা।
তবু সত্য আজ নিজের বিছানাটা দোতলায় আনার কথা ভাবতে নবকুমারের জন্যে মন কেমন করে উঠছে। ….ছেলেপুলে কাছে কাছে থাকাই ভালো। তাতে মনে এসব পাগলামি চাগে না। সুবৰ্ণটা নেই বলেই বোধ করি এমন হু হু করে ভাব আসছে।