তোমার তো সব কথাই লম্বাচওড়া, পেল্লায় একটা যজ্ঞি কেঁদে শেষ অবধি তোক হাসাবে আর কি!
সত্য দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিল, লোকই বা হাসাবো কেন? বরাবর যেমন কাজকর্ম দেখে এসেছি, সেইভাবেই ভাবতে শিখেছি। লোক হাসবে এ কথা ভাববও না।
সত্যিই সে কথা ভাবতেই পারে না সত্য।
যাতে না কোন বিশৃঙ্খলা ঘটে, সেই প্রতিজ্ঞাই গ্রহণ করেছে সে।
.
কাজটা কলকাতায় করতে পেলে অবিশ্যি সুবিধের অবধি থাকত না, কলকাতা শহরে কড়ি ফেললে অর্ধেক রাত্রে বাঘের দুধ মেলে। কিন্তু সেই সুখসুবিধাময় মধুর কল্পনাটিকে সবলেই নির্বাসন দিয়েছে সত্য মন থেকে। প্রথম ছেলের বিয়ে, বাসাবাড়ি থেকে হওয়ার কথা ভাবাও অসঙ্গত। আর শুধু প্রথম ছেলেই বা কেন, ছেলে-মেয়ে কারো বিয়েই ভিটের বাইরে দেওয়া উচিত নয়। নান্দীমুখ শ্রাদ্ধ হবে, সাতপুরুষ জলপিণ্ড পাবেন, সে কাজ কি যেখানে সেখানে করতে আছে?
তাই দেশের বাড়িটার ওপরই সব ছবি আঁকছে সত্য, সব চিন্তা রাখছে। এ ব্যাপারে সত্যর বন্ধু, উপদেষ্টা, সাহায্যকারী সব হচ্ছে বটে ছেলে সরল।
গ্রীষ্মের ছুটি চলছে, তাই সুবিধেও আছে। যখন তখনই সত্য ডাক পাড়ছে, খোকা, দোয়াত কলমটা একাবার পাড় তো বাবা, কটা কথা মনে এসেছে এই বেলা লিখে নে, নচেৎ ভুলে যাবো।
সরল হাসে, তুমি আবার ভুলে যাবে! জ্যেষ্ঠপুত্তুরের বিয়ে বিয়ে করে তো তোমার মাথার মধ্যে রাতদিন রেলগাড়ির ইঞ্জিন চলছে!
সত্যও হেসে ওঠে, তোর বুঝি হিংসে হচ্ছে? তা তোর বিয়ের সময়ও কম যাবো না, মাথায় জাহাজ চালাবো!
নমস্কার মা। দেখেই আমার বাসনা মিটে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সরলের এই রকমই কথাবার্তা।
‘গুরুজন’ বলে শিহরিত-কলেবর কোনো সময়েই নয় সে। বাবার কথায় অনায়াসেই সে আড়ালে হেসে হেসে বলে, বাড়ির কর্তার রায় দেওয়া হয়ে গেল? বলে, যাক, কর্তার কর্তব্য সমাপন করা হয়ে গেছে
সত্য হাসি চেপে বলে, এই পাজী ছেলে! কী কথার ছিরি! গুরুজন না?
সরল সভয়ের ভান করে বলে কী সর্বনাশ! তাতে কোনো সন্দেহ দেখিয়েছি আমি? তবে হ্যাঁ, হাসির ব্যাপারে না হেসে থাকতে পারি না আমি।
সরলের যত কথা মায়ের সঙ্গে।
রান্নাঘরে জলচৌকিতে বসে হাঁড়ি কড়া বোগনো যা পায় একখানা নিয়ে তবলা ঠোকে আর গল্প করে, বুঝলে মা, আজ রাস্তায় এক তাজ্জব গাড়ি বেরিয়েছে। গাড়িও অনাসৃষ্টি, নামও অনাসৃষ্টি ট্রাম গাড়ি। ঘোড়ায় টানছে। উঃ, সেই ট্রামগাড়ি দেখবার জন্যে কী ভিড়টাই হয়েছে! রাস্তার দু ধারে কাতারে কাতারে লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে।
বলে, বুঝলে মা, আজ হেদোর ধারে একটা বন্ধুর সঙ্গে কথা কইতে কইতে হয়ে গেল এক চোট! সে বলে কিনা, বাঙালি জাতটার কিছু হবে না! ভণ্ড আর হুজুগে জাত একটা! চড়ে গেল রাগ। খুব শুনিয়ে দিলাম।
সত্য আগ্রহভরা মুখে বলে, কী শোনালি?
এবার সরল লজ্জিত হয়, হেসে ফেলে বলে, কী আর! বললাম, জাতের কলঙ্ক ঘোচাবার চিন্তা নেই, হেসে হেসে নিন্দে করতে লজ্জা করে না? গলায় দড়ি দাওগে। নচেৎ এই হেদোর জলে ঝাঁপ দাও গিয়ে।
সন্ধ্যাবেলা রান্নার সময়টা হচ্ছে সত্যর আনন্দের সময়, এই সময়ই সরল এসে বসে।
সাধন বরাবরই অন্য ধরনের। চুপচাপ মুখবোজা লাজুক। তা ছাড়া একটু বিজ্ঞ বিজ্ঞ। রান্নাঘরে এসে বসার কথা সে ভাবতেই পারে না। এক গ্লাস জল গড়িয়ে খাবার ক্ষমতাও তার নেই। যা কিছু কাজ সরল করে। সরল সত্যর ডান হাত।
এখনও ভূমিকালিপি পূর্ববৎ, শুধু সংলাপের সুর অন্য।
সরল বলে, বাবা তো শুনেছি, ভেলভেটের চোগা-চাপকান-টুপি পরে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন, দাদা কি পরে যাবে মা?
সত্য তাড়া দেয়, বটে রে ফাজিল কেষ্ট ছেলে, ভেলভেটের চোগা-চাপকান পরা সেই মূর্তি তুই দেখেছিস বুঝি?
সরল বলে, আহা, পূর্বাহ্নেই তো বলছি, শুনেছি!
কার কাছে শুনলি শুনি?
কেন, পিসির কাছে। পিসির কাছে তোমার ছোটবেলার কথা, বাবার ছোটবেলার কথা সব শুনেছি।
হুঁ, পিসি তা হলে তোকে বাপের বিয়ে দেখাচ্ছে! সত্য হাসে। তারপর বলে, তুড়ু কি পরে বিয়ে করতে গেলে মানায় তুই-ই বল!
আমি কি বলবো? আর বললেই বা শুনছে কে? চোগা না চাপাও, সেই বেগুনরঙা চেলির জোড় তো চাপাবেই তার ঘাড়ে! তবে? বিয়ে করা মানেই সং সাজা। বাব্বা!
আচ্ছা তোকে আর বিয়ের মানে ব্যাখ্যা করতে হবে না, সত্য তাড়া দেয়, মিষ্টির ফর্দটা বরং শোনা আর একবার, দেখি শুনতে কেমন লাগছে! ছাদার মিষ্টি আলাদা ধরেছিস তো?
.
কলকাতা থেকে কারিগর যাবে, মিষ্টি তারাই করবে। আজ সরলকে পাঠিয়েছিল সত্য তাদের কাছে পাকা কথা কইতে। সরল সব সন্ধান রাখে।
সরল বাড়ি নেই, সাধন তো থেকেও নেই।
নবকুমার আর সুবর্ণ আজ কদিনই বাড়িছাড়া, দুপুরবেলা হঠাৎ মনটা বড় খালি-খালি লাগলো। নেহাৎ নাকি ফর্দ লেখার উন্মাদনায় মত্ত রয়েছে ক’দিন সত্য, তাই সুবর্ণর অনুপস্থিতিটাও সয়ে গেছে। নইলে সেই কথার রাজা মেয়েটা কাছে না থাকা সত্যর পক্ষে কম শূন্যতার নয়।
দশ দিন বলে গিয়ে বারো-তেরো দিন করছে নবকুমার। এদিকে বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। সব সময় মানুষটা দায়িত্বজ্ঞানহীন।
খুচরো কাজ আপাতত হাতে কিছু নেই। বিয়ের ভোজের সুপুরি কাটবার ভার নিয়েছে নিতাইয়ের বৌ, সদু বলেছে বড়ির ভার তার। এক মণ ডালের বড়ি সে দিচ্ছে রোজ কিছু কিছু করে। সলতে পাকাবে সদুর সতীন।