সত্যকে কি পেষাই করতে পেরেছে সংসার?
মাঝে মাঝে নিজেই ভাবে সত্য।
.
কিন্তু এখন মনটা উদ্বেল। এখন ওসব ভাবনা দাঁড়াচ্ছে না। এখন সত্য ভাবছে, তখন নিত্যানন্দপুরের সংসারটা কী ভালোই ছিল। সে বাড়িতে এখন বাবা নেই।
জানি কেমন সেই চেহারাটা সংসারের!
নেড়ুর কথা ভেবেও দুঃখ হয়, আবার কোথায় যে আছে সে এখন! সেই একবার কদিনের জন্যে এসে থেকে মায়া বাড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। আর পাত্তা নেই। কে বলবে সেই পড়া ফাঁকি দেওয়া নিরীহ-নিরীহ ছেলেটার মধ্যে অমন একটা ঘরছাড়া খামখেয়ালি মন ছিল লুকানো!
নিত্যেনন্দপুরের খবর পায় সত্য মাঝে মাঝে বড়দাকে চিঠি লিখে। খুবই দূরে দূরে অবশ্য। বড্ড যখন মনটা কেমন করে তখন। রাসুর উত্তরগুলো অবশ্য সংক্ষিপ্ত, তবু খবরগুলো দেয়।
রামকালী তো চিঠি দিলে উত্তরই দেন না।
একবার শুধু লিখেছেন, পত্র না পেলে দুঃখিত হয়ো না। কিন্তু কেন সেই না পাওয়ার অবস্থা ঘটবে তা লেখেন নি।
সত্য বোঝে ইচ্ছে করেই আর লিখবেন না চিঠি।
মায়ামুক্ত করছেন নিজেকে।
তবু ছেলের বিয়ে উপলক্ষে বাবাকে একবার পায়ের ধুলো দিতে আসতে বলবেই সত্য। বলবে, বাবা, আপনার আশীর্বাদ না পেলে ওদের বিয়েটাই তো বৃথা!
ছেলের বিয়ে উপলক্ষ করে চিত্তসমুদ্রের অনেক নিচের ঢেউ উপরে উঠে আসছে সত্যর, অনেক ধুলোর স্তরে চাপা পড়ে যাওয়া অনুভূতি তীব্র হয়ে সাড়া তুলছে।
একদা যে পুণ্যি সত্যর প্রাণের বন্ধু ছিল, সেই পরম মূল্যবান কথাটাও যেন ভুলতে বসেছিল সত্য। কত কাল কত যুগ যে দেখা হয় নি! অথচ বেশী দূরে থাকে না পুণ্যি, শ্রীরামপুরে তার শ্বশুরবাড়ি। নৌকোয় চেপে বসতেই যা দেরি, একদণ্ডেই পৌঁছে যাওয়া যায়। সত্যও কখনো ভাবে নি যাওয়া যায়, পুণ্যিও কখনো ভাবে নি আসা যায়।
তা সত্য অবিশ্যি না ভাবতে পারে, পুণ্যির শ্বশুরবাড়িটা কুটুমবাড়ি, মেলাই লোক তাদের, বিনা উপলক্ষে যাওয়ার কথা ওঠে না। কিন্তু সত্যর এই বাসাবাড়িটায় তো সে বাধা নেই? পুণ্যি তো একবার কালীদর্শনের ছুতোয় আসতে পারতো?
আসল কথা, সংসার মানুষকে চেপে পিষে ফেলে, বিশেষ করে মেয়েমানুষকে।
তার ভিতরকার যা কিছু মাধুর্য, যা কিছু কোমলতা, যা কিছু ছাঁচ, সব যেন ঘষে ক্ষইয়ে ভেঁতা করে শুকিয়ে চারটি ধুলোবালি করে ছেড়ে দেয়। নইলে পুণ্যির বৈধব্য-সংবাদেও তো একবার গিয়ে দেখা করে উঠতে পারে নি সত্য!
পুণ্যিকে আনতেই হবে তুড়ুর বিয়েতে।
হঠাৎ মনটা ভারী চঞ্চল হয়ে ওঠে, একটা দোয়াত কলম আর একখানা কাগজ নিয়ে পুণ্যিকে চিঠি লিখতে বসে সত্য।
শ্রীচরণকমলেষু পাঠই দেয়, যতই হোক পিসি। তুড়ুর বিয়ের সংবাদ জানিয়ে আবেদন জানায়, পিসি যেন ছেলে, ছেলের বৌ ও মেয়েদের নিয়ে নিশ্চয় করে আসার ব্যবস্থা করে, সম্মতিপত্র পেলেই আনতে লোক পাঠাবে সত্য।
লোক পাঠাতে হবে বৈকি।
নইলে অত দূর-কুটুম্ব আসবে কেন? সমাজ-সামাজিকতার মধ্যে বন্ধুত্ব কথাটার কোনো মূল্য নেই।
চিঠি লেখা হলেও এখন ডাকে দেওয়া চলবে না। নবকুমার এখন অনুপস্থিত, তাকে না দেখিয়ে এত কর্তাত্বি ফলানো ঠিক নয়। সংসারে যতই ডাকাবুকো হোক সত্য, এসব নিয়মগুলো মানে বৈকি।
নিত্যেনন্দপুরেও নিজে সে বিশদ একখানি পত্রে সবাইকে আহ্বান জানালেও, মূল পত্রটা নবকুমারকে দিয়েই লেখাতে হবে, সেটাই ভব্যতা।
বাড়িসুদ্ধ সকলকে ঢালা নেমন্তন্ন করলেও, কাকে কাকে বিশেষ জানাতে হবে তারও একটা তালিকা বানিয়ে ফেলে সত্য।
এসব কাজ যতটা লিখিত-পড়িতের মধ্যে হয় ততই ভাল, দৈবাৎ যদি কারো নামোল্লেখে ভুল হয়ে যায়, লজ্জার শেষ থাকবে না।
নবকুমারের দিকে আত্মীয়ের পাট নেই।
দূর সম্পর্কে কে নাকি এক পিসি আছে, আর জ্ঞাতি মামাতো ভাইয়েরা আছে। আর তো কখনো কারো নাম শোনে নি সত্য। আর আছেন শাশুড়ীর এক সই, তাকেই দেখেছে দু-একবার। পুজোয় তাঁর নামে শাড়ি যায়, পালা পার্বণে তত্ত্ব যেতে দেখেছে।
আর কই? এলোকেশীর সব কিছুই পড়শীদের নিয়ে।
তবে একটা বড়সড় ঘর এখন হয়েছে।
সে ঘর সদুর।
সদুর সংসারটি বড় ছোট্ট নয়।
তা সে ভাবলে চলবে না। ছেলের বিয়ে-ব্যাপারটিও তো ছোট নয়।
নিজের সেই বাল্য-কথা মনে পড়ে যায় সত্যর।
কত বড় বড় যজ্ঞি হত এক-একটা কাজে! ভাত পৈতে বিয়ে তো দূরের কথা, ঠাকুমার ‘অনন্তচতুর্দশী ব্রত’ উদযাপনেই যা ঘটা হয়েছিল সেবার, উঃ!
ভাতমাছের যজ্ঞি নয়, সবই লুচিমিষ্টির ব্যাপার, তবু সে কী কাণ্ডর ভিয়েন! ‘জুলি’ কেটে কেটে উনুন বানিয়েছিল, হালুইকর ঠাকুরদের একটা মেলা বসে গিয়েছিল। মাছের অভাব পূরণ করতে দুই ক্ষীর ছানার পায়েসের নদী সমুদ্র বইয়ে দিয়েছিলেন রামকালী, মিষ্টির পাহাড় বানিয়েছিলেন।
যজ্ঞি ভাবতে গেলেই সেই সব দৃশ্য চোখের উপর ভেসে ওঠে। উৎসব মনে করতে গেলেই সেই সেকালটার ছবি ফুটে ওঠে।
তেমন ধরনের না করতে পারলে মন উঠবে না সত্যর।
একটু-আধটু কথা তুলতে গিয়েছিল সত্য, নবকুমার ভয়ে চোখ কপালে তুলেছে। বলেছে, পয়সাকড়ির জন্য বলছি না, ভগবানের ইচ্ছেয় পয়সাকুড়ির কথা ভাবি না, কিন্তু করবে কে? লোকবল কোথা? কথায় বলে-ধনবল জনবল আর মনোবল। তিনটেই দরকার। আছে তোমার তা?
এ ধরনের কথা যে শুনতে হবে, সে আন্দাজ সত্যর ছিল, তাই তার প্রস্তুতিও ছিল। অতএব সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিয়েছিল সত্য, ধনবলই জনবলকে ডেকে আনে, আর মনোবল ওই দুটোকেই চালায়, তা সে বস্তু তোমার না থাক আমার আছে।