থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বেচারা।
এলোকেশী অবশেষে রায় দেন, ছেলের বে দিচ্ছে দাও, তোড়জোড় করে মেয়ের পাত্তর খোজো, যাতে এক যজ্ঞিতে কাজ হয়। পাঁচজনে না ধিঙ্গি আইবুড়ো মেয়ে দেখে পাঁচকথা বলতে পারে।
মুক্তকেশী মহোৎসাহে বলেন, এ মেয়ের পাত্তরের অভাব হবে না সইমা, রূপের ডালি মেয়ে। আজ বললে কাল হবে। আমি দেখছি।
কিন্তু ঠিক এইখানে হঠাৎ এক বজ্রপাত হয়।
সুবর্ণ ঝট করে বলে ওঠে, ইস্, এক্ষুনি বিয়ে হলেই হল! মা তাহলে বাবাকে মেরে ফেলবে না? আমি বলে এখন নতুন কেলাসে
কথা শেষ হল না।
তীব্র তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ যেন ঝড়ের বেগ নিয়ে আছড়ে পড়ল সুবর্ণর ওপর।
কী বললি? কী বললি? মা বাবাকে মেরে ফেলবে? ওরে নবা, একথা শোনার আগে আমার কেন মরণ হল না রে? ওরে ইস্কুলে পড়িয়ে এই বিদ্যে করছিস তোর মেয়ের? অ মুক্ত, এক ঘটি জল এনে আমার মাথায় থাবড়া। নইলে ‘বেম্মতেলো’ ফেটে মরে যাব। কোন কামরুপ কামিখ্যের ডাইনির হাতে আমার একটা মাত্তর সন্তানকে সঁপে দিয়ে বসে আছি, তুই দেখ মুক্ত!
মার এই আক্ষেপোক্তিতে দিশেহারা নবকুমার হঠাৎ আর কিছু না পেয়ে মেয়েটার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয়।
৪৭. ছেলের বিয়ের জন্য
ছেলের বিয়ের জন্য মনটা প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু প্রস্তুত করে ফেলার পর হঠাৎ অনুভব করল সত্য, খুব খুশি-খুশি লাগছে।
ছেলের ওই পুলক গোপন করা লাজুক মুখটা ভারী কৌতুকজনক, মাঝে মাঝে বিয়ে সংক্রান্ত এক-একটা কথা ফেলে সেই পুলকটা দেখে নিচ্ছে আর মনে মনে মুখ টিপে হাসছে সত্য।
সত্যর মনের উপরে যে অনেকগুলো বয়সের ভার জমে উঠেছিল, তার থেকে কি কতকগুলো বছর ঝরে পড়ে গেল। তার ইদানীংয়ের স্তিমিত আর তিক্তস্বাদ দিনগুলো যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে। মধুর এক কৌতুকরসে চঞ্চল হয়ে উঠছে দিনের চেহারা রাতের চিন্তা।
বিয়ের গোছের সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ভাবতে শুরু করেছে সত্য, সম্পর্কে এমন কাউকে দেখতে পাচ্ছি না যে ওদের ফুলশয্যের ঘরে আড়ি পাতবে। সত্যর সঙ্গে সম্পর্কটা যে বড়ই সাংঘাতিক, একেবারে “মা” বলে কথা। তবু ভাবতে থাকে সত্য, তাদের বারুইপুরের বাড়ির যে ঘরটায় বরকনের ফুলশয্যে হবে, সেই ঘরের জানলা-দরজায় কোথাও একটা ছ্যাদা করে রাখতে হবে। কেউ কি আর সেটা কাজে লাগাতে পারবে না? সত্যর বাপের বাড়ির অনেকেই তো আসবে। এই চিন্তাটাতেই মনটা যেন উৎসাহে উদ্বেল হয়ে উঠেছে। প্রথম সন্তান যদি মেয়ে হত, হয়েও তো ছিল, থাকল না তাই, যদি থাকতো কোন কালে তার বিয়ে-থাওয়া হয়ে যেত, শাশুড়ী হয়ে যেত সত্য।
কিন্তু সে ঘটনাটা ঘটে উঠতে পায় নি। এতখানি বয়সে সত্যর এই প্রথম কাজ। আর সে কাজ কন্যাদায় উদ্ধার নয়, ছেলের বিয়ে। ছেলের মামার বাড়ি থেকে সবাইকে না এনে ছাড়বে নাকি সত্য? কারুর কোনো ওজর-আপত্তি শুনবে না।
নবকুমার যে আবার ঠিক এই সময়ে চলে গেল, তা নইলে এখনই তাকে দিয়ে নেমন্তন্ন পত্তর লিখিয়ে ফেলতো সত্য। দিন স্থির করে পাকাঁপাকি নেমন্তন্ন করবার আগে একখানা জানান, চিঠি দিতে হবে বৈকি। জানানো কোথায় বিয়ে হচ্ছে, কী বৃত্তান্ত, তাছাড়া তাদের একটু প্রস্তুত করেও রাখা। ছেলের বিয়ে বলে ব্যাপার, অন্তত পাঁচ-সাতদিন তা থাকতেই হবে সবাইকে।
সারদাকে তো অবিশ্যিই আসতে হবে, বড়দার দ্বিতীয় পক্ষকেও আসতে না বললে ভাল দেখাবে। রাসুর আরো সব ভাইদেরও বিয়ে হয়েছে, তাদেরও বলা দরকার। নতুন ঠাকুমা এখনো রয়েছে সিথেয় সিঁদুর নিয়ে “ভাগ্যবানি এয়োরাণী”! কিছু না পারুন, বসে বসে এয়োলক্ষণগুলো করতে পারবেন তিনি।
মায়ের জন্যে একটা নিঃশ্বাস পড়ল সত্যর। ওঁদের থেকে কত ছোট ছিলেন মা, অথচ কতকাল হল হারিয়ে গেছেন! আজ যদি মা থাকতেন?
একটুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আবার মনে মনে তালিকা গড়তে লাগল সত্য। ছেলেপুলের সংখ্যা যে এখন তার বাপের বাড়িতে কটি, কার কতগুলি, সে সব সঠিক জানে না ভেবে মনে মনে লজ্জিত হল, ভাবলো এমন কৌশল করে লিখতে হবে যাতে কেউ না সত্যর সে অজ্ঞতাটি টের পায়।
তুড়ুর সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশার সম্পর্কের আছে অবিশ্যি একজন। সে-জন হচ্ছে বড়দার বড় ছেলের বন্ধুর বৌ। যার বিয়ের সময় সত্যকে নিয়ে যাবার জন্যে অনেক বলাকওয়া করেছিল রাসু।
কিন্তু সত্যর তখন অবস্থা শোচনীয়।
সুবর্ণ জন্মাবার পরের অবস্থা সেটা। প্রায় শয্যাগত সত্য বিয়েবাড়ি যাবার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারে নি। তাছাড়া মনেও সে উৎসাহ ছিল না। বড়দা বড়বৌ অবিশ্যিই সত্যর সে ত্রুটি ধরবে না। সত্যকে সত্যিকার ভালবাসে, ওরা।
একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা মনে পড়ে যাওয়ায় একা-একাই হেসে উঠল সত্য। মনে পড়ে গেল, সেই সারদার ঘরে শেকল তুলে দিয়ে জব্দ করার কথা।
সত্যি, কী হাঁদাই ছিল সত্য তখন!
পরে একদিন সে কথা তুলে হাসি-ঠাট্টা করেছিল সারদা। যেবার সত্য প্রথম সন্তান হতে বাপের বাড়ি গিয়ে অনেকদিন ছিল। তখন আর সারদা বয়সের পার্থক্য ধরত না, ননদ-ভাজ সম্পর্কটা দেখত। সারদার কাছে অনেক ধরনের সাংসারিক গল্প শুনেছে তখন সত্য, মাঝে মাঝে তর্ক তুলেছে, মাঝে মাঝে প্রতিবাদ। সারদা বলেছে, আচ্ছা বাবা, দেখবো পরে! তোমার এই একবগগা বুনোমি কেমন বজায় রাখতে পারো! সংসার এমন জাঁতা না, মুগ মুসুর অড়র ছোলা সব এক করে পিষে ছাড়ে!