কানা অন্ধ! নবকুমার আকাশ থেকে পড়ে।
সত্য দৃঢ়স্বরে উত্তর দেয়, তা বৈ আর কি! ক-অক্ষর যে না চিনল সে অন্ধেরই সামিল! চোখ থাকতে অন্ধ!
সত্যর এই রায় দেওয়ার পর খুব একটা ঝড় ওঠে বাড়িতে। রাগের সঙ্গে হাসিরও। সত্যর ওই ‘অন্ধ’ কথাটার ব্যাখ্যাটা সবাইকে ডেকে ডেকে শোনায় নবকুমার এবং নিতাই ও নিতায়ের বৌ, মুখুয্যে মশাই, তার জীইয়ে-ওঠা ছোট গিন্নী, তার বড় মেয়ে, সবাই এই নতুন ব্যাখ্যার রসে মশগুল হয়ে হাসি-তামাশা করে।
শুধু সদুই হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়।
আর একসময় নিঃশ্বাস ফেলে বলে, কথাটা বৌ মিথ্যে বলে নি নবু, চোখ থাকতেই অন্ধ! এই তোর সদুদিরই যদি একখানা পত্তর লেখবার জ্ঞান থাকত, তা হলে হয়তো সারাজীবনটা তার বরবাদ হয়ে যেত না!
অতঃপর সদুই আশ্বাস দেয়, কলকাতা শহরে ইস্কুলে-পাঠশালায় পড়া মেয়ে পাওয়া অসম্ভব হবে না মনে হয়! বলে, আমি অন্য ঘটকি ধরছি!
অর্থাৎ ভাইপোর বিবাহ-তরণীর হাল সে এবার ধরবেই। দেখছে কাণ্ডারী বিহনে নৌকা বানচাল।
তুড়ুর কানেও অবশ্য এ আশ্বাস ঢোকে। এবং অবশ্যই সে আশার স্বপ্ন দেখতে থাকে। কারণ তার সহপাঠীদের সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে, দু-একজন তো ছেলের বাপ হয়ে বসে আছে। তার বিয়ের কথা উঠছে না কেন, এ কথা সে ভেবেছে মাঝে মাঝে।
তবে খোকা এক অসমসাহসিক কথা বলে বসেছে। বলেছে অবশ্য পিসির কাছে। দাদার হচ্ছে হোক, আমায় নিয়ে টানাটানি কোর না বাবা, আমি ওসবের মধ্যে নেই।
নেই? তুই তবে সন্নিসী হবি নাকি? ঝঙ্কার দিয়ে বলেছিল সদু।
খোকা সহাস্যে বলেছিল, কী যে হবো তা জানি না! সাপও হতে পারি, ব্যাঙও হতে পারি, তবে গলায় গন্ধমাদন নিয়ে যে কিছুই হওয়া যায় না এটা দেখে দেখে শিখেছি!
এত তুই দেখলি কোথায়? রাতদিন তো বই মুখে পড়ে থাকিস!
ওই ওর মধ্যে থেকেই সব দেখেছি!
সদু অবশ্য এ কথা গ্রাহ্য করে না
সদু ভেবে নেয়, একসঙ্গে তাড়াহুড়োর দরকার নেই, দুটো তো মাত্তর ছেলে। দুবারই ঘটা হবে, দাদার বিয়েটা হোক, রাঙা টুকটুকে বৌ আসুক, দেখব কেমন সন্নিসী হবার সাধ বজায় থাকে!
অতএব সেই রাঙা টুকটুকের সাধনাই করতে থাকে সদু। তবে ছেলের বয়েস গড়িয়ে গেছে, যেটের তেইশ বছরেরটি হয়েছে, ও ছেলের যুগ্যি মেয়ে নিতে হলে কোন্ না বারো! অত বড় বাড়ী মেয়ে সোন্দর পাওয়া শক্ত! সোন্দর মেয়ে কি পড়ে থাকে? তবু চেষ্টা করতে থাকে সদু।
.
তা চেষ্টায় বাঘের দুধ মেলে, সাধনায় ভগবান মেলে।
পাঁচটা দেখতে দেখতে তুড়ুর বৌও মিলল।
বারো বছর বয়েস, দেখতে ভাল, আবার লিখতে-পড়তেও জানে, মেমের ইস্কুলে পড়েছে তিন তিনটে বছর।
এরপর আর সত্য আপত্তি করবে কোন পথ দিয়ে?
না, সত্য আপত্তি করল না, সত্য তার বড় ছেলের মন বুঝেছে। কিন্তু আপত্তি এল অন্য দিক থেকে। আপত্তি করলেন এলোকেশী।
বড় ছেলের বিয়ে ভিটে থেকেই হওয়া উচিত, এ কথা সবাই জানে। সেই সব ব্যবস্থা করতে দিন দশেকের ছুটি নিয়ে নবকুমার দেশের বাড়িতে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল সুবর্ণকে। সুবর্ণই বায়না ধরলো, ওর গরমের ছুটি পড়েছে।
সত্যর ইচ্ছে হচ্ছিল না এতদিন মেয়েটা কাছছাড়া হয়, তা ছাড়া ছুটির মধ্যে পড়া তো তাহলে গাছে উঠল! এই দশ দিন এমনি কাটবে, তারপরই ভাইয়ের বিয়ে!
তবু না করাও শক্ত।
নবকুমার হয়তো বলে বসবে, হিংসে করে তুমি ওকে একবারও ঠাকুমার কাছে যেতে দাও না!
কাজেই হেসে মেয়েকে বলল, যা তবে, গাছের আম খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে আয়। দাদার বিয়েয় খাটতে হবে মনে রাখিস।
নবকুমার বলে, দেখ তোমার মেয়ের ওই ঘাগরা-টাগরাগুলো দিও না, ও থাক। কাপড়-চোপড় যা আছে তাই দাও সঙ্গে।
সত্য বুঝল পরামর্শটা সমীচীন।
নাতনীর পরনে ঘাগরা দেখলে এলোকেশী রসাতল করবেন। অতএব মায়ের দরুন একখানি পুরনো নীলাম্বর জামদানী পরে আর নিজের শাড়ির সম্বলগুলি নিয়ে মহোৎসাহে বাপের সঙ্গে রওনা দিল সুবর্ণ। আর সেটাই বোধ করি “কাল” হল।
ভিটেয় পা দিতে না দিতেই ঘটলো বিপত্তি। এলোকেশী সেই শাড়ি জড়ানো নাতনী দেখে হৈ হৈ করে বলে উঠলেন, বেটার বে’র তো তোড়জোড় করছিস নবা, বলি এত বড় ধিঙ্গি ধাড়ী মেয়ে ঘরে পুষে কেউ বেটার বে দেয়?
আর একটি মহিলা সভা উজ্জ্বল করে বসেছিলেন, তাঁকে চিনি চিনি করেও চিনতে পারে না নবকুমার। তিনিও বলে ওঠেন, কী ঘেন্নার কথা, এত বড় মেয়ে নবুর! ওমা, আর নবু ছেলের বিয়ের ভাবনা ভাবছে?
এলোকেশী অতঃপর তার ছেলের বৌয়ের যথেচ্ছার এবং ছেলের বৌয়ের পড়ুয়া অবস্থা নিয়ে সব আলোচনা করে বলেন, আমি এই তোকে বলে রাখছি মুক্ত, ওই বৌয়ের বুদ্ধির যোগেই এ বংশের চৌদ্দপুরুষ নরকস্থ হবে!
নবকুমার মৃদুকণ্ঠে বোঝতে চেষ্টা করে, মেয়েটার বয়স আর কত, আট বৈ তো নয়, পড়নট। ওর মার মত বাড়ন্ত বলেই–ছেলেরই বরং বয়স গড়িয়ে গেছে!
দুই মহিলার প্রবল কণ্ঠ-প্রতাপে সে কথা দাঁড়ায় না। ওঁরা বলেন, ওই মেয়ে আট? কেউ তো আর ঘাসের বীচি খায় না! আশ্চর্যের কথা, এলোকেশীও নাতনির জন্মকাল বিস্মৃত হন। আর নাতির বয়স তেইশ হল, সে কথা মানতে চান না!
কিছুক্ষণের পর নবকুমার টের পায়, মহিলাটি নবকুমারের ‘সইমা’র কন্যা মুক্তকেশী। দিন কয়েকের জন্যে তিনি তার সইমার কাছে এসে অবস্থান করছেন।
বেচারী সুবর্ণ ভেবেছিল, এসেই পেয়ারা গাছে উঠবে, পুকুরে ছুটবে, পাড়া বেড়াবে, ফুল তুলবে, সে জায়গায় কিনা এইসব আলোচনা!