সেই রাগ-রাগ ভাবটাই বজায় থাকে।
সত্য যখন প্রতিজ্ঞা করেছে আর সে রাগের ঠাকুর থাকবে না, তখন সত্যর বর উল্টো প্রতিজ্ঞা করে বসে।
এই রাগের পালা কতদিন চলত কে জানে, হঠাৎ একদিন অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা ঘটলো। সন্ধ্যের সময় সদু এক ঘটকি নিয়ে এসে হাজির। নাচতে নাচতে বললেই হয়।
ছেলের বিয়ে দিবি বৌ?
সত্য আকাশ থেকে পড়ল না।
সত্য প্রতিক্ষণ এই আক্রমণের আশঙ্কায় কাঁটা হয়েই আছে। কখন না-জানি কথা ওঠে! তাই সাবধানে বলল, পড়া-লেখাটা শেষ হলেই হবে ঠাকুরঝি।
সদু বিরক্ত কণ্ঠে বলে, তোর ছেলেদের লেখাপড়া যে কোনো কালে শেষ হবে বৌ, এ বিশ্বাস তো রাখি নে! বিয়ের বয়স তো গড়িয়ে গেল ছেলেদের। বড়টা তিন-তিনটে পাস করে বেরোলো, হাঁফ ফেলতে না ফেলতে দিলি ওকালতি পড়তে। ছোটটাও তিনটে পাসের একজামিন দিচ্ছে, বেরোতে না বেরোতে আবার কিসে ঢুকিয়ে দিবি তুই-ই জানিস! তা মাথার চুল পাকিয়ে ফেলে টোপর মাথায় দেবে নাকি ছেলেরা?
সত্য মৃদু হেসে বলে, ঠাকুরঝি বড্ড রেগেছ মনে হচ্ছে! কিন্তু ভেবে বল, একটা আয়-উপায়ের পথ না দেখে বিয়ে দেওয়াই কি ন্যায্য?
সদু আকাশ থেকে পড়ে।
সদু ধিক্কার দিয়ে বলে, নবকুমারের ঘরে কি ভাতের এমনি অভাব যে ছেলে উপায়ী না হলে আর ছেলের বৌ দুটো ভাত পাবে না? বলে, মা হয়ে এমন নির্লজ্জ কথা বললো কি করে সত্য? তার পর জোর করে বলে, ওসব মেমিয়ানা ছাড় বৌ, এই ঘটকি ঠাকরুণ এসেছেন, মন দিয়ে শোন ওঁর কথা। দুটি মেয়েই ওঁর হাতে আছে, সৎ বংশ, দেবে-থোবে ভাল, মেয়েরা দেখতে সুন্দর, একসঙ্গে লাগিয়ে দে।…আর আমার মামীবুড়ীর কথাটাও ভাব। বুড়ীর জন্মের শোধ একটা সাদ মিটুক।
নবকুমার আর ঘরের মধ্যে বসে থাকতে পারে না। বেরিয়ে আসে। এবং সঙ্গে সঙ্গে উদাত্ত কণ্ঠে বলে, পাগলের অনুমতি নিয়ে কাজ করতে গেলে তো জগতের সব কাজ-কারবারই বন্ধ থাকে সদুদি! তুমি ঘটকি ঠাকরুণকে বল মেয়ের বিবরণ দিতে। মেয়ে আমরা দেখব।
সত্যর প্রতিজ্ঞা, আর সে “রাদের ঠাকুর” থাকবে না। তাই হেসে মাথার কাপড়টা একটু টেনে গলাটা একটু খাটো করে বলে, তা হলে তো হয়েই গেল ঠাকুরঝি! স্বয়ং বাড়ির কর্তা যখন ভার নিলেন!
সদুর সামনে দুজনে মুখোমুখি কথা বলা শোভা পায় না, অতএব সদুর মাধ্যমে।
নবকুমার বলে, হাসি-তামাশার কথা নয় সদুদি, ছেলের বিয়ে আমি শীঘ্রই দেব। বিয়ের বয়েস হওয়া কি, বিয়ের বয়স গড়িয়ে গেল। আর সদুদি জিজ্ঞেস কর তোমাদের বৌকে, ছেলেরা যে বুড়ো হাতী হয়েও এখনো এক পয়সা ঘরে আনছে না সে কি ছেলেদের দোষ? ওদের গর্ভধারিণী দিয়েছে ওদের চাকরি করতে? আমি হতভাগা যতবার চাকরির সন্ধান এনে দিয়েছি, ততবারই অগ্রাহ্য করে ঠেলে দিয়েছে। তোমাদের বৌয়ের ছেলেরা জজ ম্যাজিস্ট্রেট উকিল ব্যারিস্টার হবে গো!
সদু আপসের সুরে বলে, তা হবে না কেন রে নবু? ভাগ্যে থাকলে ঠিকই হবে। ওসব মানুষের ছেলেরা হয় বৈ আর কিছু আকাশ থেকে পড়ে না তারা। কিন্তু তার জন্য বিয়েয় বাধা কি? আমি ঘটকি ঠাকরুণকে বলছি তাহলে বৌ!
সত্য নির্লিপ্ত স্বরে বলে, তোমার ওপর আর আমি কি কথা বলব ঠাকুরঝি!
আহা তুই মা, তুই বলবি না?
সত্য মুখ তুলে বলে, আমার কথাটাই যদি জিজ্ঞেস করছ ঠাকুরঝি, আমার ইচ্ছে পাসটা হয়ে গেলে
এবার ঘটকি খনখনিয়ে ওঠে, ওমা তোমার বেটার বৌ এসে কি বেটার বই কাগজ ছিঁড়ে দেবে? যেমন তেমন ঘর নিয়ে কাজ আমি করি না! এরা হল ঘাটালের মুখুজ্যেগুষ্টি। কত বড় বনেদী ঘর, চন্দরসূয্যি এদের ঘরের ঝি-বৌয়ের মুখ দেখতে পায় না। এ হচ্ছে জ্ঞেয়াতি বোন।
চন্দর-সূয্যি মুখ দেখতে পায় না!
সত্য একটু হেসে ফেলে বলে, ঠাকুরঝি, ঘটক ঠাকরুণকে বল, ওঁদের মেয়েদের জন্যে আরো মস্ত বনেদী ঘরের পাত্তর পাবেন, আমরা ওঁদের যুগ্যি নই! চন্দর-সূয্যির মুখ দেখেছে এমন মেয়েই আমার প্রার্থনা!
ভাই-বোন দুজনে একসঙ্গে চমকে উঠে বলে, তার মানে?
মানে তবে স্পষ্ট করেই বলি! একটু লেখাপড়া জানা মেয়ে আনার ইচ্ছে। ইস্কুলে পড়ে এমন মেয়ের সন্ধান যদি থাকে–
কী, কী বললে?
নবকুমার ঠিকরে উঠে বলে, শুধু মেয়েকে বিদ্যেবতী করে সাধ মিটছে না, আবার বৌ আনতে হবে তাই? কেন, বৌ এসে তোমার ছেলের পড়া বলে দেবে?
ঘটক ঠাকরুণ একটু টেপা-হাসি হেসে বলেন, আহা, সে তো দেবেই গো! পরিবারের কাছে পড়া মুখস্থ না করে আজকের বাজারে কোন পুরুষমানুষটা আর উতরাচ্ছে? একালে পরিবারই মাস্টার। সেই মাস্টারের শিক্ষেই শিরোধার্য। তবে আমার হাতে তেমন মাস্টার মেয়ের সন্ধান নেই। এ হল একেবারে নবাবী আমলের বনেদী বংশ। এদের শিক্ষে-দীক্ষেই আলাদা। তা হলে আর কি করা! উঠি দিদি?
ঘটকির সঙ্গে সঙ্গে সদুও বিদায় নেয়।
কারণ যদিও একটা গলিপথ পার হওয়া নিয়ে কথা, তবু সন্ধ্যের পর একা যাওয়া চলে না। আবার তবে নবুকে কি ছেলেদের পৌঁছতে যেতে হয়। থাক।
ওরা চলে যেতে নবকুমার ফেটে পড়ে, বাড়িটাকে কী বানাতে চাও তুমি? বিদ্যের বিন্দাবন? ছেলেদের এত বিদ্যেয় হবে না, আবার বৌয়েরও চাই?
সত্য আস্তে বলে, চেঁচামেচিতে কাজ কি, ওরা ঘরে পড়া করছে, গলা তো তোমার দোতলা কোঠায় গিয়ে পৌঁছচ্ছে। তবে এই কথাটাই বলি–আমার মতামত ইচ্ছে-বাসনার কথা যদি শুধোও তো বলব–কানা অন্ধ বৌ আমার ইচ্ছে নয়!