সত্যর মাথার ঘোমটা নড়ে না, কিন্তু সত্যর গলা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বৃথা পাণ্ডাজীকে কষ্ট দিলে, আমি এখন আর যাচ্ছি না।
এখন আর যাচ্ছ না?
না।
নবকুমার ঈষৎ উষ্ণস্বরে বলে, তা আবার যখন হঠাৎ যাবার বাসনা চাপবে তখন এঁকে পাচ্ছো কোথায়?
না, ওঁকে আর কোথায় পাবো! সত্য মৃদু স্বরে বলে, তুমিই নয় কষ্ট করবে তখন!
ওঃ চালাকি! তা সেটা আগে বললেই হত। এভাবে ধাষ্টামো করতাম না… পাণ্ডাজী আপনাকে মিছে কষ্ট দিলাম, ইনি যাবেন না।
পাণ্ডাজী অবশ্য এই সামান্য বাধায় চট করে টলেন না, কাশীধামের মহিমা সম্পর্কে অবহিত করিয়ে দেবার জন্যে বহুবিদ বাক্যব্যয় করেন। কিন্তু সত্য বিনীত উত্তর দেয়, বাবা টানেন নি বুঝতেই পারছি। যখন টানবেন তখন না গিয়ে উপায় থাকবে না।
নবকুমার ক্রুদ্ধ প্রশ্ন করে, হঠাৎ মত বদলাবার হেতু?
সত্য এবারও বিনীত উত্তর দেয়, সুবর্ণটা হয়তো ছাড়বে না, সঙ্গে যেতে চাইবে, তাতে অনেক ইস্কুল কামাই হবে।
নবকুমার তো চিরদিনই বিরহে কাতর, তবে হঠাৎ উল্টো সুরে গান ধরে কেন? সত্য কাশী যাবে না শুনেই তো হাঁফ ছেড়ে বাচবার কথা তার, তবে চটে ওঠে কেন?
তা নবকুমারেরও “মন” বলে একটা বস্তু আছে বৈকি, আর সে মনের তত্ত্বও আছে। সত্য কিছুদিন কাশী ঘুরে আসতে যাচ্ছে, এই ঘটনাটাকে সে মনের মধ্যে বেশ একটু খাপ খাইয়ে নিয়ে বিরহকালীন অবস্থাটা ছকে নিয়েছিল, তার মধ্যে প্রধান কাজ ছিল মাকে কিছুদিনের জন্য কলকাতায় এনে রাখা।
মনের মধ্যে কোথায় যেন একটু অপরাধ-বোধের কাঁটা বিঁধে আছে নবকুমারের বাপ মারা গিয়ে পর্যন্ত। মা আসতে চান নি সত্য, কিন্তু একেবারের জন্যেও অন্তত মাকে মহাতীর্থ কালীঘাট দর্শন করানো কর্তব্য ছিল বৈকি। যে কলকাতায় এতগুলো বছর কেটে গেল নবকুমারের, সেখানে একবারও তার মা এল না!
আগে এ চিন্তাটা এত প্রবল ছিল না, হয়েছে কিছুদিন আগে অফিসের এক বন্ধুর ধিক্কারে।
বন্ধু শুনে অবাক হয়ে গেছে নবকুমারের মা কখনো কলকাতায় তার বাসায় আসেন নি শুনে। নবকুমারকে স্ত্রৈনী বলে ধিক্কার দিয়েছে বন্ধু। সেই অবধি ওই চিন্তাটা পাক খাচ্ছিল মাথায়। আর এ কথাও পাক খাচ্ছিল, মাকে এনে স্বাধীনভাবে রাখতে হবে, বৌয়ের হাত-তোলায় নয়। তা ছাড়াও আছে কিছু কিছু মতলব।
যে সব আচার-আচরণগুলো মোটেই দোষণীয় নয়, অথচ সত্যর চোখে দোষণীয়, সে রকম কিছু কিছু করে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। সত্য থেকে গেলে তাও হয় না তাহলে। যেমন গড়গড়া খাওয়া। জগত্ৰহ্মাণ্ডে সবাই গড়গড়া খায়, শুধু সত্যর বরের খাওয়া চলবে না। এ কী জুলুম!
সত্যর অসাক্ষাতে অভ্যাসটা পাকা করে ফেলে যদি বলা যায় কবরেজ বলেছিল খেতে, আর এখন না খেলে পেটের মধ্যে গণ্ডগোল শুরু হয়, তা হলে ওটা কায়েম হয়ে যায়! নবকুমারের একান্ত বাসনার একান্ত কামনার ওই নেশাটি।
আরও একটা আছে।
পয়সার বাজী ধরে তাস খেলা।
তাকিয়ে ঠেসান দিয়ে শুধু ওই খেলা খেলে কত লোক কত রোজগার করে নিচ্ছে, অথচ নবকুমারের ওপর খাড়া উঁচিয়ে আছে সত্যর মাথার দিব্যি!
এত বাধা-বন্ধর মধ্যে থাকতে প্রাণ হাঁপিয়ে আসে।
আচ্ছা সত্য যখন বারুইপুরে ছিল তখন তো নবকুমার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতায় ছিল! তখন কেন এসব সাধ মেটায় নি?
তা সেটাও মনস্তত্ত্ব।
তখন নবকুমারের মনোভাবটা অন্য রকম ছিল। তখন সদাসর্বদা বিরহের যন্ত্রণাটাই প্রাণকে খাঁ খাঁ করে তুলত। সত্যর অনভিপ্রেত কিছু করার ইচ্ছা হত না।
কিন্তু এখন নবকুমারের মন পাল্টেছে। সেই পুলিসের ঘটনা থেকেই পাল্টেছে। নবকুমার দেখছে সত্য যেন দিন দিন শুষ্ক কাঠ হয়ে যাচ্ছে।
এখন সে যেন দেখতে পাচ্ছে, পুরুষ হয়েও সে চিরদিন পরাধীন। সত্যর ইচ্ছে-অনিচ্ছে, সত্যর রুচি-অরুচি, সত্যর ভ্রুকুটির ভয় নবকুমারকে যেন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। কেন রে বাবা, কেউ তো এমন বন্ধন-দশাগ্রস্ত নয়!
ওই যে মুখুজ্যে মশাই!
কত তাঁর বায়নাক্কা, কী তার মেজাজ! সদুদি বুড়ো বয়সে ঘর করতে এসেও সব কিছুর ঠেলা সামলাচ্ছে, তোয়াজ করে চলেছে। মুখুজ্যে মশাইয়ের বাড়িতেই তো তাসের জমজমাটি আসর।
সদুদি ডাবর ডাবর পান সেজে সেই আড্ডায় যোগান দিচ্ছে…কই, রাগ তো করছে না? নবকুমার ওসব ভাবতে পারে? পারে না।
এখন নবকুমারের তাই মুক্তির বাসনা জাগছিল। সত্যর আড়ালে শুরুটা করে ফেলে দেখাবে বিদ্রোহ, সে-গুড়ে বালি দিল সত্য।
তাও কারণটা কি?
না, সুবর্ণর ইস্কুল কামাই হবে!
এর চাইতে গাত্রদাহকারী কথা আর কী আছে?
পাণ্ডা চলে যেতে আর একবার মেজাজটা প্রকাশ করল নবকুমার। বলল, বন্ধুর কাছে মুখ থাকবে না তার। কারণটা শুনলে গায়ে ধুলো দেবে তারা।
সত্য হাসলো। বললো ধুলো ঝেড়ে ফেলতে জানলে লেগে থাকে না!
তারপর নবকুমার আসল কথায় এল।
বলি মেয়েকে বিদ্যেবতী করে হবেটা কী? তোমার ওপর আরো দশকাঠি বাড়া হবে, এই তো? গাঁয়ের পাঠশালা পড়েই যদি মায়ের এই মেজাজ হয়ে থাকে, কলকাতা শহরে ফ্যাসানি ইস্কুলে পড়ে মেয়ের কী হবে সে তো দিব্যচক্ষে দেখতেই পাচ্ছি!
সত্য তবুও হাসিমুখে বলল, তোমার যে এমন একজোড়া দিব্যচক্ষু আছে, তা তো জানতাম না! তা হ্যাঁগো, ওই চক্ষুতে আরো কি কি দেখতে পাচ্ছ বল তো? আচ্ছা আমি কবে মরব বল দিকি!
সব কথা তামাশা করে উড়িয়ে দিলেই হয় না! বলে রাগ করে উঠে যায় নবকুমার।