নিজেকে এই পর্যায়ে তুলেছে সত্য? স্নেহহীন সরসতাহীন পাতাঝরা গাছের মত? হঠাৎ কি যে হল, ভিতরটা মোচড় দিয়ে হু হু করে একরাশ জল উপচে পড়ল সত্যর জোড়া ভুরুর নীচে বড় বড় গভীর কালো চোখ দুটির কোল বেয়ে।
সুবৰ্ণ অপ্রতিভ হয়ে গিয়ে তাকিয়ে থাকে সেইদিকে। সন্দেহ থাকে না তার মা’র সেই বড় মেয়ের জন্যে মন-কেমন করছে।
মুহূর্তেই অবশ্য নিজেকে সামলে নেয় সত্য। কান্নাঝরা মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে, ওই সুহাস দত্ত কেমন পড়ায় রে?
সুবর্ণ লাজুক-লাজুক মুখে বলে, আমাদের তো পড়ান না, উঁচু কেলাসের মেয়েদের পড়ান।
উঁচু ক্লাসের মেয়েদের পড়ায় সুহাস!
বিধবা শঙ্করীর অবৈধ সন্তান সুহাস এত উঁচুতে তুলতে পেরেছে নিজেকে! কিসের জোরে? শিক্ষা, সাহস? শঙ্করীর নিজের এ জোর থাকলে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হত না তাকে।
সত্য কি নিজের সহিষ্ণুতা অসহিষ্ণুতাকে একটা সমস্যা করে তুলে তার মেয়ের এই উন্নতির পথকে কণ্টকিত করে তুলবে? এই কচি মেয়েটাকে নিতান্তই বাপ-ভাইয়ের কাছে ফেলে রেখে দিয়ে সত্য নিজে কাশীযাত্রা করবে মন বদলাতে? মনের স্বাস্থ্য ফেরাতে?
সে বদল কি এখানে থেকে একেবারেই অসম্ভব? মনের ওপর কি সেটুকু হাত নেই সত্যর? ইচ্ছে করলে কি সত্য আবার সেই অনেকদিনের আগের সত্যর মূর্তিতে ফিরে যেতে পারে না? যে সত্য হাসতে জানে, কৌতুক করতে জানে, নতুন নতুন রান্না করে আর খাবার করে স্বামী-পুত্রকে খাওয়াতে জানে! যে সত্য এই কিছুদিন আগেও মেয়েকে কত স্তব স্তোত্র পদ্য মুখস্থ করিয়েছে, তার পড়া ধরেছে।
কতকাল সংসারের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখে নি সত্য। এই ছোট্ট সংসারের গণ্ডিটুকুর বাইরে চোখ ফেলতে গিয়ে চোখে তা শুধু জ্বালাই ধরেছে তার। সত্যর ছোট ছেলের কথাই কি তবে ঠিক? সে যে বলে, জগতে যেমন কোটি কোটি মানুষ, তেমনি কোটি কোটি অন্যায়, সব দিকে তাকাতে গেলে যে চোখে ধাঁধা লেগে যাবে তোমার মা। নিজে তুমি কোন অন্যায় করছ কিনা সেটুকু দেখ ভাল করে।
সেটা তা হলে ঠিকই বলে?
নবকুমার যে সত্যর আদর্শের অনুযায়ী নয়, সে সত্যর ভাগ্য। আর হয়তো সেটা আশা করাও ভুল। নিজের গর্ভজাত সন্তান, নিজের হাতেগড়া পুতুল, তাই বা নিজের আদর্শ অনুযায়ী হয় কই? বড় ছেলেটা তো ঠিক তার বাপের ধারাতেই চলে যাচ্ছে।
সত্যর জীবন যদি এমন ঘঁচে-ঢালা সাধারণ না হয়ে খুব উল্টোফাল্টা অদ্ভুত কিছু হত! সুহাসের মত, শঙ্করীর দুর্গা দুর্গা বলে শিউরে উঠল সত্য।
আর তার চোখের সামনে হঠাৎ ভুবনেশ্বরীর মুখটা ভেসে উঠল। ঘোমটায় ঘেরা কপালে বড় বড় করে সিঁদুরের টিপ আঁকা-ভীরু নরম মুখ।
ভুবনেশ্বরী কোনদিন জগতের কোথায় কি অন্যায় ঘটছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে যায় নি, তাল ঠুকে লড়তে যায় নি। ভুবনেশ্বরীর মুখটা ভেসে উঠল। ঘোমটায় ঘেরা কপালে বড় বড় করে সিঁদুরের টিপ আঁকা-ভীরু নরম মুখ।
ভুবনেশ্বরীর কোনদিন জগতের কোথায় কি অন্যায় ঘটছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে যায় নি, তা ঠুকে লড়তে যায় নি। ভুবনেশ্বরী সবাইকে ভয় করেছে, সবাইকে ভালবেসেছে।
মায়ের মুখটা মনে পড়তেই হঠাৎ বাবার ওপর একটা ক্ষুব্ধ অভিমানের জ্বালা অনুভব করল সত্য। যেন মায়ের ওই অকালমৃত্যুর সঙ্গে বাবার কোনো অবিচার জড়িত আছে। সাহস করে একটা দিন একটা কথা বলতে পায় নি ভুবনেশ্বরী স্বামীর মুখের ওপর।
নিতান্ত আক্ষেপের সঙ্গে মনে এল সত্যর, ভুবনেশ্বরীর মেয়ে তার শোধ তুলেছে।
সত্য কি তবে জীবনকে নতুন মোড়ে বাঁক নেওয়াবে? সত্য শুধু তার সংসার-জীবনে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলবে? সত্য সুখী হবার চেষ্টা করবে?
মেয়েটাকে নিতান্ত কাছে টেনে নিয়ে সত্য তার মাথার ওপর মুখ রেখে বলে, আমি কাশী চলে গেলে তুই কাঁদবি সুবর্ণ?
তুমি চলে গেলে?
সুবৰ্ণ মার স্নেহস্পর্শ থেকে ঠিকরে উঠে বলে, আমি যাবো না বুঝি?
তুই? সত্য হতবুদ্ধি। তুই যাবি কি? তুই কি করে যাবি?
যে করে তুমি যাবে! আমি যাবো না তো কে যাবে?
দেখ মুশকিল! আমার সঙ্গে তোর তুলনা? আমার ইস্কুল আছে? সেই ইস্কুল কামাই করে যাচ্ছি আমি?
সুবর্ণ গোঁভরে বলে, কামাই করলে কী হয়? বাবা তো বলে, ছোট মেয়েরা ঢের কামাই করে
বলেন বুঝি? ভাল! কিন্তু তোর বাপের মত কামাই করাকে ভাল বলি না। ইস্কুল কামাই করা চলবে না।
সুবর্ণ দৃপ্তস্বরে বলে, দেখো চলে কিনা! আমায় ফেলে রেখে চলে গেলে কী করি আমি দেখো!
সত্য আর রাগ করবে না।
সত্য হেসে ফেলে বলে, চলে গেলে আর দেখবো কি করে? তার থেকে বরং যাওয়া বন্ধ দিয়ে তুই কি করিস তাই দেখি বসে বসে!
ওমা, ওমা মাগো– সুবর্ণ মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে, তুমি কী লক্ষ্মী!
ঠিক এই মিলন-মুহূর্তে নবকুমার এসে দাঁড়ায়, পিছনে এক দীর্ঘাকৃতি উত্তর ভারতীয়। সাজসজ্জা দেখে চিনতে ভুল হয় না, পাণ্ডাজাতীয়।
এই!
এই নবকুমারের ভেঁজে নেওয়া মতলব। কদিন আগে শুনেছিল তার অফিসের এক ভদ্রলোকের মা পিসি ইত্যাদি জনা ষোলো মহিলা দল বেঁধে গয়া কাশী মথুরা বৃন্দাবন যাচ্ছেন, পথ-সঙ্গী এই পাণ্ডাঠাকুর। তাই এঁকে নিয়ে এসেছে।
সত্যবতী মাথায় ঘোমটা টেনে গলায় আঁচলটা জড়িয়ে দূর থেকে একটি প্রণাম করে। আর নবকুমার উদাত্ত গলায় বলে, এই যে, এঁকে নিয়ে এলাম। কাশীর বিখ্যাত মানুষ ইনি–শ্রীরামেশ্বর পাণ্ডা। আমার এক বন্ধুর মা যাচ্ছেন এর সঙ্গে, তাই বলতে বলেছিলাম দয়া করে যদি তোমাকেও সঙ্গে নেন। তারপর তোমার বাবার ঠিকানায় ছেড়ে দেবেন তোমাকে। ইনি তাতে রাজী হয়েছেন। সামনের পূর্ণিমায় যাত্রা