খেঁদি বলে, যাই হোক বাপু সত্য, তুই বাড়ি যা। কবরেজ জ্যাঠা ভিন্ন এ গোরামে ঘোড়াতেই না চড়বে কে?
এ কথাও খাঁটি।
ঘোড়া আর আছেই বা কার? এ অঞ্চলে কালেকস্মিনে বর্ধমান রাজের কোন কর্মচারী কি কোম্পানির কোন লোক ঘোড়ার পিঠে চড়ে আসে, নইলে ঘোড়া কে কোথায় পাচ্ছে?
ঘাট থেকে উঠে পড়ে সত্য-বাহিনী।
এখন প্রথমটা সকলেরই সত্য-ভবনে অভিযান। কারণ ঘোড়া-রহস্য ভেদ না করে কে স্থির থাকতে পারবে?
ভিজে কাপড়ে জল সপৃসপিয়ে আর মিলের গোছা বাজিয়ে ওরা রওনা হল, কিন্তু এ কী তাজ্জব! এ যে একেবারে রূপকথার গল্পর মত!
সত্যদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতে না পৌঁছতে হাঁ হয়ে দেখে ওরা রামকালী ফের ফিরে যাচ্ছেন ঘোড়া হাঁকিয়ে, শুধু এবারে বাড়তির মধ্যে তাঁর পিছনে পিঠ আঁকড়ে আর একজন বসে।
সে জনটি হচ্ছে, সত্যর বড়দা।
রামকালী চাটুয্যের বৈমাত্র ভাই কুঞ্জবেহারীর বড় ছেলে রাসবিহারী।
পুণ্যির কথাই সত্যি বটে। অশ্বারোহী ব্যক্তি রামকালীই। কিন্তু এ নিয়ে এখন আর বাহাদুরি ফলায় না পুণ্যি, শুধু হাঁ করে অনেকক্ষণ ঘোড়ার পায়ের দাপটে ঠিকরে ওঠা ধুলোর ঝড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ব্যাপার কি বল তো?
আমিও তো তাই ইনতাম করছি। সত্য অবাক ভাবে বলে, ওষুধ নিতে আসবে। যদি বাবা, তো বড়দাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে যাবে কেন?
সেই তো কথা!
প্ৰচণ্ড গরম, তবু সপ্তসাপে ভিজে কাপড়ের ওপর হাওয়ার ডানা বুলিয়ে যাওয়ার দরুন গা-টা কেমন সিরসির করে এল। সত্য এবার হা করে ভাব করে বিচক্ষণের সুরে বলে, নে নে চল, দোরে দাঁড়িয়ে গুলতুনি করে আর কি হবে? বাড়ি গেলেই টের পাব, কি হয়েছে! তোরা যা, ভিজে কাপড় ছেড়ে আয়। আমি দেখি গিয়ে কি হয়েছে!
কি হয়েছে!
যা হয়েছে তা একেবারে সত্যর হিসেবের বাইরে। শুধু সত্যর কেন, সকলেরই হিসেবের।ংরে। ঘোড়ায় চড়ে ঝড়ের বেগে এসে সমগ্র সংসারটার উপর যেন প্ৰকাণ্ড একখানা পাথর ছুঁড়ে মেরে ফের ফিরে গেছেন রামকালী। সেই পাথরের আঘাত সহজে কেউ সামলাতে পারছে না।
সত্য ভেতরবাড়ির উঠোনে ঢুকে দেখল, উঠোনের মাঝখানে বসানো মরাই দুটোর মাঝখানে যে সরু জমিটুকু, সেইখানে দাঁড়িয়ে আছে বড়জেঠী, ঠিক যেন কাঠের পুতুলটি, আর দাওয়ায় পৈঠেয় গলে হাত দিয়ে কাঠ হয়ে বসে তার ঠাকুমা। এবং দাওয়ার ওপর জটলা বেঁধে বাড়ির আর সবাই। শুধু যা পিসঠাকুমাই অনুপস্থিত।
অবশ্য সেটাই। স্বাভাবিক, কারণ তিনি এই যবনাচারী দাওয়ায় কখনো পা ঠেকান না। এ দাওয়ায় রাস্তা-বেড়ানো ছেলেপুলে ওঠে, কর্তাদের খড়ম ওঠে।
পিসঠাকুমা না থাক, আর সবাই তো জটলা করছে। কেন করছে? অথচ কারো মুখে বাক্যি নেই কেন? ফিসফিস কথা, ঘোমটার ভেতর হাত-মুখ নাড়ানাড়ি। সত্য ঠাকুমার যতটা সম্ভব গা বাঁচিয়ে গা ঘেঁসে বসে পড়ে সাবধানে ইশারায় প্রশ্ন করে, কি হয়েছে গো ঠাক্মা?
দীনতারিণী নীরব।
অতঃপর সত্য সরব।
ও ঠাকমা, বাবা আমন করে ছুটে এসেই আবার কোথায় গেল?
কী গেরো! কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন গো? ও ঠাকমা, বাবা জীরেট থেকে আমন হাঁপাতে হাঁপাতে ঘোড়া ছুটিয়ে এলই বা কেন, আবার ছুটিলই বা কেন? অ ঠাকমা, বলি তোমাদের সব বাক্যি হরে গেল কেন?
একবারও দীনতারিণীর ঠোঁট নড়ে না, তবে ঠোঁট নাড়েন তাঁর সেজজা শিবজায়া। শুধু ঠোঁট নয়, সহসা পা মুখ সব নড়িয়ে তিনি বলে ওঠেন, বাক্যি হরে যাবার মতন কাণ্ড ঘটলে আর হরবে না? তোর বাবা যা অভাবনী কাণ্ড করে গেল?
বাবা বাবা, খুলেই বল না। স্পষ্ট করে! বাবা জীরেট থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেই তক্ষুনি আবার কোথায় গেল?
অ, তবে তো দেখেইছিল। তবে আর ন্যাকা সাজছিল কেন? রাসুকে নে গেল তোর বাবা বে দিতে।
বে দিতে! ধ্যেৎ! সত্য পরিস্থিতির মর্যাদা ভুলে হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে আহা, আমায় যেন ন্যাক পেয়েছে। সেজঠাকুমা, তাই পাগল বোঝাচ্ছে। বড়দার বুঝি বে দিতে বাকি আছে? বলে ছেলের বাবাই হয়ে গেল বড়দা!
গেল তায় কি? এবার হঠাৎ দীনতারিণী মৌন ভঙ্গ করে নাতনীকে ধমকে ওঠেন, বড্ড তো দেখছি ট্যাকটেকে কথা হয়েছে তোর? ছেলের বাবা হলে আর বে করতে নেই? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?
সত্য উত্তর দেবার আগে শিবজায়াই সাংসারিক মাৎস্যন্যায় ভুলে ফস করে বড়জায়ের মুখের ওপর বলে বসেন, মহাভারত অশুদ্ধর কথা হচ্ছে না দিদি, তবে এও বলি রামকালী যে একেবারে কাউকে চোখে কানে দেখতে দিলে না, চিলের মত ছোঁ। মেরে নে গেল ছেলেটাকে, বালস-পোয়াতি বেঁটা, যাত্রাকালে সোয়ামীকে একবার দূর থেকে চোখের দেখাটুকু পর্যন্ত দেখতে পেল না, এটা কি ভাল হল?
কখন যে ইতিমধ্যে মোক্ষদা এসে দাঁড়িয়েছেন এপাশের বেড়ার দরজা দিয়ে, এবং আলোচনার শেষাংশটুকু শুনে নিয়েছেন, সে আর কেউ টের পায় নি। মোক্ষদার থান ধুতি গুটিয়ে হাঁটুর ওপর তোলা, কাঁধে গামছা অর্থাৎ স্নানে যাচ্ছেন মোক্ষদা। অবিশ্যি স্নানে যাচ্ছেন বলেই যে এই ভেতর বাড়ির অর্থাৎ শয়নবাড়ির উঠোনে তিনি পা দিতেন তা নয়, তবে আজকের কথা স্বতন্ত্র। আজকের উত্তেজনায় অত মরণ-বাচন জ্ঞান রাখলে চলে না, আজ নয় ঘাটে দু-দশটা ড়ুব দিয়ে ফের দীঘিতে ড়ুব দিতে যাবেন, তবে এদের মজলিশে যোগ দেওয়াটা দরকার।
মোক্ষদা সেজভাজের কথাটুকু শুনতে পেয়েছেন, এবং তাতেই সমগ্ৰ নাটকটি অনুধাবন করে ফেলেছেন। তাই তিনি তিন আঙুলে হেঁটে খানিকটা এগিয়ে এসে গলা বাড়িয়ে বলে ওঠেন, কী বললে সেজবৌ, কী বললে? আর একবার বল তো শুনি?