গালমন্দ-বিহীন লবণ?
সে ওরা কল্পনাও করতে পারে না।
তবে সত্য আগে আগে চরণ মুদির দোকান থেকে বেশ খানিকটা সংগ্রহ করে আনতে পারত, কিন্তু ইদানীং অর্থাৎ বড় হয়ে ইস্তক মুদির দোকানে ভিক্ষে করতে যেতে লজ্জা করে। বড় জোর দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নিতান্ত একটা শিশুকে লেলিয়ে দেয়।
কবরেজের মেয়ে বলে সমাজে সত্যর কিছুটা প্ৰতিষ্ঠা আছে।
সে প্রতিষ্ঠার মর্যাদাটাও তো রাখতে হয়?
আজি দুপুরে আমবাগান-পর্বে সত্য ছিল, তার পর কখন একসময় যেন বাড়ি চলে গিয়েছিল।
খেঁদি একটু কল্পনা-প্রবণ, তাই সে বলে, সত্যর শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আসে নি তো?
দূর! শ্বশুরবাড়ি থেকে আবার শুধু শুধু কেউ আসবে কেন? আর আসেও যদি, সত্যর সঙ্গে কি? যে আসবে সে তো চণ্ডীমণ্ডপে বসবে।
সহসা পুঁটি চেঁচিয়ে ওঠে, আসছে আসছে!
আসছে! বাবা, ধড়ে পেরাণ পাই।
এত দেরি কেন রে সত্য? আমরা সেই কখন থেকে জল ঠাণ্ডা করছি!
সত্য বিনাবাক্যে গম্ভীর ভাবে ঘাটের পৈঠের ভাঙাচোরা বাঁচিয়ে জলে নামে।
কি রে সত্য, মুখে কথা নেই যে? বাবা, আজ এত পায়া-ভারী কেন রে তোর?
সত্যি একমুখ জল নিয়ে কুলকুচো করে ঠোঁট বাকিয়ে বলে পায়া-ভারী আবার কী! মনিষ্যির রীত-চরিত্তির দেখে ঘেন্না ধরে গেছে!
ওমা, কেন রে? কাকে দেখে? কার কথা বলছিস?
সত্য জ্বলন্ত স্বরে বলে, বলছি আমাদের জটাদার বৌয়ের কথা। গলায় দড়ি! গলায় দড়ি! গলায় দড়ি মেয়েজাতের কলঙ্ক!
সত্যের বয়েস ন বছর, অতএব সত্যর পক্ষে এ ধরনের বাক্যবিন্যাস অসম্ভব, এমন কথা ভাববার হেতু নেই। শুধু সত্য কেন-নেহাৎ ন্যাকাহারা মেয়ে ছাড়া, সে আমলে আট-ন বছরের মেয়েরা এ ধরনের বাক্যবিন্যাসে পোক্তই হত! না হবে কেন? চার বছর বয়স থেকেই যে তাকে পরের বাড়ি যাওয়ার তালিম দেওয়া হত, আর বয়স্কদের মহলেই বিচরণের ক্ষেত্র নির্বাচন করা হত। সে ক্ষেত্রে শিশু বলে কোন কথাই বাদ দেওয়া হত না তাদের সামনে।
কাজেই সত্য যদি কারো উপর খাপাপা হয়ে তাকে মেয়েজাতের কলঙ্ক বলে অভিহিত করে। থাকে, আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
পুণ্যি তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করে ওঠে, কোন রে, কি হয়েছে?
যম জানে! বলে প্রথমটা খানিকক্ষণ যমের উপর ভার ফেলে রেখে, অতঃপর সত্য মুখ খোলে, জন্মে আর ওর মুখ দেখছি না! ছি:। ছি! গেছলাম! বলি আহা, সোয়ামীর শাউড়ীর ভয়ে রোগের ওষুধ টুকু পর্যন্ত খেতে পায় না, যাই একবার দেখে আসি কেমন আছে। সেজপিসী তারকেশ্বর গেছে শুনেছি, মনটা তাতেই আরও খোলসা ছিল। ওমা, গিয়ে ঘেন্নায় মরে যাই, কী দুষপিবিত্তি, কী দুষপিবিত্তি!
এরা শঙ্কিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে, না জানি কোন ভয়ঙ্কর কাহিনী উদঘাটন করে বসে সত্য।
শুধু পুণ্য ভয়ে ভয়ে বলে, কি দেখলি রে?
কি দেখলাম? বললে পেত্যয় করবি? দেখি কিনা ঘরে জটাদা বসে, আর বৌ। কিনা তাকে পান সেজে দিচ্ছে, আর হাসি-মস্করা করছে।
জটাদা?
খেঁদি পুঁটি সকলে একযোগে বলে ওঠে, ও হরি! এতেই তোর এত রাগ! শাউড়ী বাড়ি নেই, তাতেই বুকের পাটাটা বেড়েছে আর কি।
বুকের পাটা বেড়েছে বলে পান। সেজে খাওয়াবে? হাসি-মস্করা করবে? সত্য যেন ফুলতে থাকে।
পুণ্যি আরও ভয়ে বলে, তা পরপুরুষ তো আর নয়? নিজের সোয়ামী—
নিজের সোয়ামী! সত্য ঝট্পট্ বার-দুই কুলকুচো করে বলে, খ্যাংরা মারো অমন সোয়ামীর মুখে! যে সোয়ামী লাথি মেরে যমের দক্ষিণ দোরে পাঠায় তার সঙ্গে আবার হাসি-গপপ? গলায় দিতে দড়ি জোটে না? আবার আমায় কি বলেছে জানিস? আমার সোয়ামী আমায় মেরেছে, তোমায় তো মারতে যায় নি। ঠাকুরঝি? তোমার এত গায়ে জ্বালা কেন যে ছড়া বেঁধে গালমন্দ করতে আস? এর পর আবার আমি ওর মুখ দেখব?
আঁচলটাকে গা থেকে খুলে জোরে জোরে জলের ওপর আছড়াতে থাকে সত্য।
সখীবাহিনী কিঞ্চিৎ বিপদে পড়ে।
ওরা অভিযুক্ত আসামিনীকে খুব একটা দোষ দিতে পারে না, কারণ স্বামী একদা একদিন বেদম মেরেছে বলে যে জন্মে আর সে স্বামীকে পান সেজে খাওয়ানো চলবে না, এতটা কঠোর ক্ষমাহীন মনোভাব তাদের পক্ষে আয়ত্ত করা শক্ত। অথচ সত্যর কথার প্রতিবাদ চলে না, সত্যর কথায় সমর্থন না করলে চলে না।
কিন্তু ও কি! ও কি! ও কিসের শব্দ!
হঠাৎ বুঝি ওদের বিপদে রক্ষা করলেন মধুসূদন। পুকুরপাড়ের রাস্তায় তালগাছের সারির ওদিকে যেন অশ্বক্ষুরধ্বনি ধ্বনিত হল।
ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ না?
ঘোড়ায় চড়ে কে আসে?
পুণ্যি তড়বড় করে ঘাটে উঠে এগিয়ে দেখে পড়ি তো মারি করে ছুটে আসে, এই সত্য, মেজদা!
মেজদা!
অর্থাৎ রামকালী!
সত্য অবিশ্বাসের হাসি হেসে মুখ ভোঙিয়ে বলে ওঠে, স্বপ্ন দেখছিস নাকি? বাবা না জিরেটে গেছে?
আহা, তা সেখেনে তো আর বাস করতে যায় নি? আসবে না?
ইত্যবসরে ক্ষুরধ্বনি একবার কিছুটা নিকটবর্তী হয়েই ক্রমশ দূরবতী হয়ে যায়।
সত্য গলা বাড়িয়ে একবার দেখতে চেষ্টা করে, তারপর নির্লিপ্তভাবে বলে, যেমন তোমার বুদ্ধি! বাবা বুঝি ঘোড়ায় চড়ে জিরেটে গেছল? নাকি পালকিটা মাঝরাস্তায় ঘোড়া হয়ে গেল!
পালকি! তাও তো বটে! পুণ্যি দ্বিধাযুক্ত স্বরে বলে, আমি কিন্তু সদ্য দেখলাম মেজদা আর মেজদার ঘোড়াটা। বাড়ির দিকেই তো গেল।
তা গেল বটে। তবে কি হঠাৎ জীরেটের সেই রুগীর নেয়-দেয় অবস্থা ঘটেছে! তাই হঠাৎ কোন মোক্ষম ওষুধের দরকার পড়েছে? যার জন্যে পালকি রেখে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে আসতে হয়েছে চিকিৎসক রামকালীকে?