চাটুয্যে-পুকুরের জল তোল মাটি ঘোল করছিল পুণ্য টেঁপি পুঁটি খেঁদি প্রমুখ নবীনারা। সত্য কেন এখনো এসে হাজির হয়নি। তাই ভাবছে ওরা আর অনুপস্থিত সত্যর সন্তোষ বিধানের জন্যেই বোধকরি জল শেতল করার অভিযানটা এত জোর কদমে চালাচ্ছে। সত্য ওদের প্রাণপুতুল।
সত্য কি শুধুই তাদের দলনেত্রী?
ভগবান জানেন কোন গুণে সত্য সকলের হৃদয়নেত্রীও। সত্য-বিহীন খেলা ওদের শিবহীন দক্ষযজ্ঞেরই সামিল। পুকুরে ঝাপাই ঝোড়ার ব্যাপারে সত্যই রোজ অগ্রণী, তাই ওরা বার বার ফুটন্ত জলকে তলা-ওপর করতে করতে এ ওকে প্রশ্ন করছিল, সত্যর কি হল রে? ঘরে তো দেখলাম না? বলেছিল তো ঠিক সময়ে দেখা হবে। বাগানে কোথাও আছে নাকি এখনো? দূর, একা এক কি আর বাগানে ঘুরবে? বেওলা মেয়ে, ভয় নেই পরাণে? ভয়! সত্যুর আবার ভয়! দেখিস ও শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শাউড়ী পিসশাউড়ীকেও ভয় করবে না। তা আশ্চয্যি নেই, ও যা মেয়ে!
সত্য যে তার সমস্ত সখী-সঙ্গিনীদের প্রাণের দেবতা তার প্রধান কারণ বোধ হয় সত্যর এই নিভীকতা। নিজের মধ্যে যে গুণ নেই, যে সাহস নেই, সে গুণ সে সাহস অন্যের মধ্যে দেখতে পেলে মোহিত হওয়া মানুষের স্বভাবধর্ম। নিভীকতা ব্যতীত ও আরও কত গুণ আছে সত্যর। খেলাধূলোর ব্যাপারে সত্যর উদ্ভাবনী শক্তির জুড়ি নেই, বল আর কৌশল দুই-ই তার অন্যের চাইতে বেশি একশ গুণ। মোটাসোটা একটা গাছের কাটা গুড়িকে দড়ি বেঁধে একা আনা সত্যবতীর পক্ষে আদৌ অসম্ভব নয়, আবার সেই গাছের গুড়িকে গড়িয়ে পুকুরের জলে ফেলে ডিঙি বানানোও সত্যর কৌশলেই সম্ভব।
এর ওপর আবার পয়ার বাঁধা!
পয়ার বাঁধার পর থেকে পাড়ার সমস্ত ছোট ছেলে-মেয়েই তো সত্যর পায়ে বাঁধা পড়েছে।
সেই সত্যর জন্য জল শেতল করছে ওরা এ আর বেশী কথা কী! কিন্তু সত্যর এত দেরি কেন? এদিকে যে এদের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। ঠাকুমা-পিসিমা একবার চৈতন্য পেয়ে খোঁজ করলেই তো হয়ে গেল!
নেহাৎ নাকি ঠিক এই সময়টুকুই অভিভাবিকদলের কিঞ্চিৎ দিবানিদ্রার সময়, তাই এদের এই অবাধ স্বাধীনতা। হ্যাঁ, এই পড়ন্ত বেলাতেই গিন্নীরা একটু গড়িয়ে পড়েন। সারা বছর তো নয়, (মেয়েমানুষের দিবানিদ্রার মত অলুক্ষ্মণে ব্যাপার আর কি আছে সংসারে?) নেহাৎ এই আমের সময়টা।
আমের যে একটা নেশা আছে।
গিন্নীরা বলেন, আমের মদ।
আম খাও বা না খাও, এ সময়ে শরীর টিস টিস করবেই। অবশ্য না খাওয়ার প্রশ্ন ওঠেই না। আম-কাটাল আবার কে না খায়? হরু ভট্টচায্যের মার মত কে আর আম-হেন বস্তুকে জগন্নাথের নামে উৎসর্গ করতে পারে? হরু ভট্টচায্যের মা সেবার শ্ৰীক্ষেত্তর গিয়ে এই কাণ্ড করে এসেছেন, ক্ষেত্তর করার পর জগন্নাথকে ফল দিতে হয় বলে আম ফলটি দিয়ে এসেছেন। মনের আক্ষেপে সেবার হরু ভট্টচায। আমবাগান বেচে দিতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, মার ভোগেই যদি না লাগল। তো, আমবাগানে আমার দরকার? তা ভট্টচায্যের মা ছেলেকে হাতে ধরে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করেছিলেন, বলেছিলেন, বাবা, আজন্মকাল তো খেয়ে এলাম। তবু খাওয়ার লালসা ঘোচে না, তাই বলি যে দব্যিতে এত আসক্তি, সেই দিব্যিই জগন্নাথকে উছুগু্য করব। তাই বলে তুই বাগান নষ্ট করবি? ছেলে।পুলে খাবে না?
ছেলেপুলে বুড়ো যুবো। আমের ভক্ত সবাই। আমের মরশুমে দিনে এককুড়ি দেড়কুড়ি আম খাওয়া তো কিছুই না
অবশ্য সব আমি সবাই খায় না।
অর্থাৎ পায় না।
সংসারের সদস্যদের শ্রেণী হিসেবেই আমের শ্রেণী হিসেব করে ভাগ হয়। কর্তাদের নৈবেদ্যে লাগে জোর কলম গোলাপখাস, ক্ষীরসাপাতি, নবাব পছন্দ, বাদশা ভোগ, ঢাউশ ফজলী ইত্যাদি, গিন্নীদের জন্যে সরানো থাকে। পেয়ারাফুলি, বেলসুবাসী, কাশীর ছিনি, সিঁদুরে মেঘ।
আর বৌ ঝি ছেলেপুলেদের ভাগ্যে জোটে রাশির আম। তা রাশি রাশি না পেলে যাদের আশ মিটবে না। তাদের জন্যে রাশির বরাদ্দ ছাড়া আর কি বরাদ্দ হতে পারে? বাড়ির ঝুঁড়ি-ঝুড়িতেই কি ওদের আশা মেটে? দু বেলাই জলখাবার ঝুড়ি ঝুড়ি তো পায়, কারণ গিন্নীরা প্রকৃতির এই দাক্ষিণ্যের সময় মুড়ি ভাজা পর্বটি থেকে কিঞ্চিৎ রেহাই নেন। কিন্তু হলে কি হবে, বাড়ি থেকে মধুকুলকুলি আমের পাহাড় শেষ করেই ওরা তক্ষুণি ছোটে হয়তো বা বৌ পালানে কি বাঁদর ভ্যাবা-চ্যাঁকা আমের বাগানে। বাঘা তেঁতুলের বাবা জাতীয় সেই আমগুলি পার করার সহায় হচ্ছে মুঠো মুঠো নুন অবশ্যি তুচ্ছ হলেও বস্তুটা সংগ্ৰহ করতে বালক-বাহিনীকে বিশেষ বেগ পেতে হয়, কারণ ওর আশ্রয়স্থল যে একেবারে রান্না-ভাঁড়ারে। যা নাকি সম্পূর্ণ গিন্নীদের এলাকা। আর যে গিন্নীরা হচ্ছেন একেবারে সহানুভূতিহীনতার প্রতীক। ছেলেপুলেদের সব কিছুতেই তো তাঁরা খড়গহস্ত। নুন একটু চাইতে গেলেই প্রথমটা একেবারে তেড়ে মারতে আসবেন জানা কথা! তবে নাকি ছেলেগুলোর খুব ভাগ্যের জোর যে প্রায় সব সময়ই ওরা ওনাদের অস্পৃশ্য। কাজেই মারতে আসলেও মারতে পারেন না। তার পর বহুবিধ কাকুতি-মিনতির পর যদি বা দেবেন। তো, সে একেবারে সোনার ওজনে। দেবেন। আর সঙ্গে সঙ্গে বলবেন যাচ্ছিস তো টক বিষ আমগুলো গিলতে? ঘরে এত খায়। তবু আশ মেটে না গা! কী রাক্ষুসে পেট গো, কী লক্ষ্মীছাড়া দিশে! মরবি মরবি, রক্ত-আমাশা হয়ে মরবি। সবগুলো একসঙ্গে মনসাতলায় যাবি। যত সব পাপগুলো একত্তর জুটেছে।