তবু উত্তেজিত হলেন না।
স-তাচ্ছিল্যে গাঙ্গুলির প্রতি একটা কটাক্ষপাত করে বললেন, হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, বিশেষ হিতৈষী। লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যে মশাই আমার মাতুলের সতীর্থ পিতৃতুল্য। তাঁর পৌত্রীটি যে বিবাহরাত্রেই বিধবা হয় এটা আমার অভিপ্রেত হতে পারে না।
নির্মল নির্মেঘ আকাশ থেকে যেন বজ্রপাত ঘটল।
এ কী সর্বনেশে অলক্ষণের কথা!
এ কী অভিশাপ, না অপ্রকৃতিস্থ মস্তিষ্কের প্রলাপ? মুখুয্যে গলার পৈতে হাতে জড়িয়ে হাঁ হাঁ করে উঠলেন।
রামকালী নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখা, —কঠিনহৃদয় বিচারক অপরাধীর প্রতি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েও যেমন স্থির থাকে, তেমনি অচল অটল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
অভিশাপ দেওয়া হল না, পৈতে হাত থেকে ছেড়ে মুখুয্যেরা কেঁদে উঠলেন, এ কী বলছেন কবরেজ মশাই?
কি করব বলুন, আমি মুখের উপর স্পষ্ট বলতে চাই নি, আপনারাই বললেন। শুনুন, যদি হিত চান, এখনও পুত্রকে তার জননীর কাছে নিয়ে যান। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি স্বয়ং কাল ওর শিয়রে দাঁড়িয়ে। আর বেশী বাক্যব্যয়ে সময়ের অপচয় করবেন না, তাছাড়া আপনারা উচাটন হলে পুত্ৰ বিহ্বল হবে।
কিন্তু মুখুয্যেরাও তো রক্তমাংসের মানুষ। ওদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস দিয়ে তৈরী মন। যে ছেলে পালকির মধ্যে দিব্যি বসে রয়েছে, মাঝ-মাঝে মুখ বাড়িয়ে দেখেও নিচ্ছে কী হচ্ছে এখানে, যার কপালে এখনও চন্দনের রেখা জ্বলজ্বল করছে, আর গলার মালা থেকে সুগন্ধ বিকীরণ করছে, সামান্য একটা মানুষের কথায় বিশ্বাস করে বসবেন যে সে ছেলের শিয়রে শমন দাঁড়িয়ে! আর সেই কথায় বিশ্বাস করে একটা নিরীহ ভদ্রলোককে মরণান্তক সর্বনাশের গহবরে নিক্ষেপ করে মূঢ়ের মত যাত্ৰা-করা বর নিয়ে ফিরে যাবেন! বাঁড়িয্যেদের হবে কি? কন্যা ভ্ৰষ্টালগ্ন হওয়া মৃত্যুর চাইতে কি কিছু কম?
না, এ অসম্ভব! নিশ্চয় এ কোন চক্রান্ত!
হয় এই চাটুয্যের সঙ্গে লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যের ঘোরতর কোন শত্রুতা আছে, নচেৎ এই লোকটা আদৌ চাটুয্যেই নয়! কোন ক্ষ্যাপাটে বামুন! তবু এই ব্যক্তিত্বের প্রভাবের সামনে কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আর সন্তানের সম্পর্কে অত বড় অভিশাপ-সদৃশ্য বাণী!
ছোটমুখুয্যে একবার অদূরবতী পালকির দিকে তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাস-বক্ষে বলেন, আমি তো রোগের কোন লক্ষণ দেখছি না। কবরেজ মশাই!
রামকালী একটু বিষাদব্যঞ্জক হাসি হাসেন, তা দেখতে পেলে তো আমার সঙ্গে আপনার কোন প্রভেদ থাকত না মুখুজ্যে মশাই। আসুন, এদিকে সরে আসুন। দেখছেন তাকিয়ে ছেলের ললাটে ওই চন্দনরেখা দেখা? সদ্য চন্দনের মত আৰ্দ! অথচ বলছেন এক প্রহরকাল আগে চন্দন পরানো হয়েছে! তাহলে সে চন্দন এতক্ষণে শুকিয়ে খড়ি হয়ে যাবার কথা। হয় নি। কারণ চোরা সান্নিপাতিকে সর্বশরীর রসস্থ হয়ে উঠেছে—
এই কথা! হঠাৎ পাত্রের জেঠা হেসে ওঠেন, কবিরাজ মশাই, খুব সম্ভব পথশ্রমে আপনি কিছু অধিক ক্লান্ত, তাই লক্ষণ নির্ণয়ে ভুল করছেন। গ্ৰীষ্মকালে ঘাম-নিৰ্গমের দরুন চন্দন শুকিয়ে ওঠবার অবকাশ পায় নি, এই তো কথা! ওহে বেয়ারারা, চল চল। পালকি ওঠাও। শুভযাত্রায় এ কী বিপত্তি!
লক্ষণ নির্ণয়ে ভুল করেছেন রামকালী! রামকালীর নিজেরই মাথার শিরা ফেটে যাবে নাকি!
একবার নিজের পালকির দিকে অগ্রসর হতে উদ্যত হলেন রামকালী, কিন্তু আবার কি ভেবে থমকে দাঁড়িয়ে আরও ভারী গলায় বললেন, শুনুন মুখুয্যে মশাই, রামকালী চাটুয্যের লক্ষণ নির্ণয়ে ভুল হয়েছে, এ কথা যদি অন্য কোন ক্ষেত্রে উচ্চারণ করতেন, সে ঔদ্ধত্যের সমুচিত উত্তর পেতেন। কিন্তু এখন আপনার সঙ্কট সময়, ওদিকে বাঁড়ুয্যেরাও বিপন্ন, তাই মার্জনা পেয়ে গেলেন। লক্ষ্মীকান্ত লাড়ুয্যের বাড়ি এখনই সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন, এবং সে কাজ আমাকেই করতে হবে। প্রয়োজন হলে পালকি ছেড়ে দিয়ে ঘোড়া নিতে হবে। তবে আপনাকে শেষ সাবধান কথা জানিয়ে যাচ্ছি, ছেলেটির মাথার শিরা ছিঁড়ে ভিতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে, চোখের শিরার রং এবং রাগের শিরার স্ফীতির দিকে লক্ষ্য করলে আপনিও ধরতে পারবেন। মনে হচ্ছে খানিক বাদেই বিকার শুরু হবে। জানানো আমার কর্তব্য বলেই জানিয়ে দিলাম। বলছিলেন না লক্ষণনির্ণয়ে ভুল! ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, রামকালী কবরেজের বিচারে যেন ভুলই হয়ে থাকে। রোদের ঘামকে কালঘাম ভাবার ভ্রান্তিই তার হয়েছে, এই যেন হয়। আর কি বলব! আচ্ছা নমস্কার। …ওরে গদাই, তোল পালকি। পা চালিয়ে একবার বসিরের ওখানে চল দিকি, ঘোড়াটাকে নিতে হবে।
পালকি চলতে শুরু করেছে। হঠাৎ ছুটে এলেন ছোট মুখুয্যে, প্রায় ড়ুকরে কেঁদে চীৎকার করে উঠলেন, কবরেজ মশাই, এত বড় সর্বনাশের কথা বললেন যদি তো একটু ওষুধ দিলেন না?
রামকালী গম্ভীর বিষণ্ণ ভাবে হাতটা একটু নেড়ে সে হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, দেবার হলে আপনাকে বলতে হত না, আমি নিজেই দিতাম। কিন্তু এখন আর স্বয়ং ধন্বন্তরীর বাবারও সাধ্য নেই।
ও পালকিতে তখন বড় মুখুয্যে উঠে পড়ে বিরক্তভাবে বলে ওঠেন, দুৰ্গা দুর্গা, যত সব বিঘ্ন! কালে কার মুখ দেখে বেরোনো হয়েছিল! কোথা থেকে এক উৎপাত জুটে, —এই রাজু, অমন ঢলছিল কেন? গরমে কষ্ট হচ্ছে?
রাজু রক্তবর্ণ দুটি চোখ মেলে বলে, না জেঠামশাই, শুধু বড্ড শীত করছে।
০৭. আঁচল ডুবিয়ে নাড়া
আঁচল ডুবিয়ে নাড়া দিয়ে দিয়ে তলার জল ওপরে আর ওপরের জল তলায় করছিল ওরা তপ্ত জল শেতল করতে। বেলা পড়ে এসেছে, তবু পুকুরের জল টগবগিয়ে ফুটছে, এ জলে নেমে ঝাপাই বুড়িলে গা ঠাণ্ডা হবার বদলে দাহই হয়, তবু জলের আকর্ষণ তাই বেলা পড়তেই জলে পড়া চাই পাড়ার নবীনাকুলের।