সে তো বুঝলাম, কিন্তু সেটা কত বেলায়?
এই এক প্রহরটিাক আগে হবে।
হুঁ! পাত্রের কপালের ঐ চন্দন রেখা কি সেই তখনকারই নাকি?
চন্দন রেখা!
এ আবার কেমন প্রশ্ন!
পাত্রের জেঠা নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, কিন্তু পাত্রের কপালের চন্দনরেখাঙ্কনের কালনির্ণয়ের মত এমন অদ্ভুত প্রশ্নের জন্য নিশ্চয় প্রস্তুত ছিলেন না। তাই অবোধের মত বলেন, কি বলছেন?
বলছি, ছেলের কপালে এই যে চন্দন পরানো হয়েছে, ওটা কি সেই যাত্রাকালেই?
আজ্ঞে হ্যাঁ, তা তো নিশ্চয়ই। পাত্রের জেঠা সোৎসাহে বলেন, যাত্রাকালে মেয়েরা যেমন পরিয়ে দেয় তেমনি দেওয়া হয়েছে, আমাদের বাড়ির মেয়েদের বুঝলেন। কিনা এসন ব্যাপার খুব নামডাক আছে। পাড়া থেকে ডাকতে আসে পিঁড়ি আলপনা দিতে, শ্ৰী গড়তে, বর কনে সাজাতে—
রামকালী ওই পালকির দিকে তাকাতে তাকাতে আবার কেমন অন্যমনা হয়ে পড়েছিলেন, ইত্যবসরে পশ্চাৎবর্তী গোরুর গাড়ি দুখানা এসে পড়েছে। পালকি নামানো এবং অপর এক পালকির আরোহীর সঙ্গে বাক্যবিন্যাসের ব্যাপার দেখে ঈষৎ ঘাবড়ে গিয়ে বরের বাপিও নেমে এসে দাঁড়িয়েছেন।
অন্যমনা রামকালী একটা দীর্ঘঃনিশ্বাস ফেলে গাঢ় স্বরে বলেন, আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করছি মুখুজ্যে মশাই, আপনি যাত্ৰা স্থগিত করুন।
যাত্রা স্থগিত করুন!
বিবাহযাত্ৰা! হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন বরের জেঠা আর বরের বাপ। লোকটা পাগল না। শয়তান! না কনের বাড়ির সঙ্গে গভীরতম কোন শক্ৰতা আছে?
ওদিকে ঘুম ছুটে যাচ্ছে বেহারাদের, রোদুরটা অসহনীয় হয় উঠেছে। দু পালকির বেহারারা অদূরে দাঁড়িয়ে পরস্পর বাক্যবিনিময় করে ব্যাপারটা অনুধাবন করার চেষ্টা করতে ঘন ঘন এদিকে তাকাচ্ছে কখন পালকি তোলার ডাক পড়ে।
ব্যাপারটা যে একটা কিছু হচ্ছে, এ অনুমান করে ইত্যবসরে গরুর গাড়ি থেকে এক ব্যক্তি লাফিয়ে নেমে পড়েছেন, যিনি হচ্ছেন বরের পিসে; গাড়ির ছাঁইয়ের মধ্যে গলদঘর্ম হয়ে আসতে আসতে এমনিতেই মেজাজ তার চড়ে উঠেছিল, নেমেই যাত্ৰা স্থগিতের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, কে মশাই আপনি? ভাঙচি দেবার আর জায়গা খুঁজে পান নি? যাত্রা করে বর বেরিয়েছে, পথের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে ভাঙচি দিচ্ছেন?
মুখুজ্যে ভ্রাতৃদ্বয় ভগ্নীপতির এ হেন দুর্বিনয়ে বিচলিত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, আঃ গাঙ্গুলী মশাই, কাকে কি বলছেন? ইনি কে তা জানেন?
জানতে চাইনে মুখুয্যে, থামো তুমি। যে ব্যক্তি এ হেন অর্বাচীনের ন্যায় কথা কয়—
চোপরাও! হঠাৎ যেন ঘুমন্ত বাঘ জেগে উঠে গর্জে উঠল, চোপরাও বামুনের ঘরের কুষ্মাণ্ড!
মুখুজ্যে! চেঁচিয়ে উঠল বাঘের পর খেকশিয়াল, দাঁড়িয়ে অপমানিত হবার জন্যে তোমার ছেলের বিয়ের বরযাত্তর হয়ে আসিনি। ইটি বোধ হয় তোমার কোন বড় কুটুম্ব? তা একে নিয়েই ৰিয়ে দেওয়াও গে, আমি চললাম।
আহাহা, করেন কি গাঙ্গুলী মশাই! ইনি হচ্ছেন আমাদের সাতখানা গায়ের মাথা কবিরাজ চাটুয্যে মশাই। অবশ্যই অনিবাৰ্য কোন কারণে ইনি যাত্ৰা স্থগিতের আদেশ-
কবরেজ চাটুয্যে! অ্যাঁ!
গাঙ্গুলীর কাছার কাপড় আলগা হয়ে পড়ে, তিনি সহসা আধাবিঘৎটাক জিভ বার করে সে জিভে দাঁতে কেটে, দু হাতে দু কান মলে বয়সের মর্যাদা ভুলে প্ৰণাম করে বসেন।
রামকালী প্ৰণামরতের প্রতি দৃকপাত মাত্র না করে সমান স্থৈ্যুর্যের সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ, অনিবার্য কারণেই বলছি মুখুয্যে মশাই, যাত্রা স্থগিত রাখুন! নইলে অকারণ আপনাদের পুত্রের বিবাহযাত্রা স্থগিত রাখতে বলব, এমন অর্বাচীন সত্যিই আমি নই।
বড় মুখুয্যে দুহাত কচলে বলেন, আজ্ঞে তা আর বলতে! মানে ইয়ে লক্ষ্মীকান্তবাবুর বংশে কোন দোষ-
আঃ মুখুয্যে মশাই, অনুগ্রহ করে আমাকে অন্ত ইতর ভাববেন না। আমি বলছি পুত্রের বিয়ে দিতে গিয়ে আপনি বিপদে পড়বেন। আপনার পুত্ৰ অসুস্থ।
পুত্ৰ অসুস্থ! এ আবার কি প্যাঁচের কথা!
এ যে দেখছি সমুদ্রের দিক থেকে পাথর ছুটে আসা! এ পাথরের আশঙ্কা তো ছিল না! কন্যাপক্ষে কোন গোলমাল আছে, এবং ইনি অবশ্যই কন্যাপক্ষের কোন বিশেষ হিতৈষী, এইটাই ভাবছিলেন মুখুয্যেরা। যেটা স্বাভাবিক। তা নয়, পথের মাঝখানে আটকে এ কী উলটো চাপ।
পুত্ৰ অসুস্থ! বলেন কি কবিরাজ মশাই? এ যে একটা অসম্ভব কথা বলছেন। অমন সুস্থ সহজ পুত্র আমার। উপবাসে ও মধ্যাহ্নকালের উত্তাপে বোধ করি ঈষৎ শুষ্ক দেখাচ্ছে! ছোট মুখুয্যে কাতরভাবে বলেন।
না, শুষ্ক দেখাচ্ছে না। রামকালী জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, বরং বিপরীত। রীতিমত রসস্থই দেখাচ্ছে, লক্ষ্য করলেই টের পাবেন। আমি গোড়াতেই লক্ষ্য করেছিলাম,এবং আপনাকে নিবৃত্ত করবার সংকল্প নিয়েই আটকেছি। ছেলেটির চেহারায় আমি শিরঃশূলী-সান্নিপাতিকের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। বিবাহসভায় নিয়ে গিয়ে সঙ্কটে পড়বেন। বাড়ি ফিরে যান, কন্যার বাড়িতে সংবাদ দিন।
বরের পিসে পূর্ব বিনয় ভুলে গিয়ে রুখে ওঠেন, ভ্যালা ঝামেলা করলে তা দেখছি। আজ বিবাহ, রাত্রির প্রথম প্রহরে লগ্ন, এখন ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাব, আর কন্যাপক্ষকে সংবাদ দেব পাত্ৰ অসুস্থ? এ কি ছেলের হাতের মোয়া নাকি? বুঝতে পারছি আপনি কন্যাপক্ষের একজন মস্ত হিতৈষী!
রামকালীর গৌর মুখ রোদের তাতে এমনিতেই লাল টকটকে হয়ে উঠেছিল, এবার আগুনের মত গানগনে দেখাল।