সম্পূৰ্ণ তৈরী আম, জ্যৈষ্ঠের দুপুরের ঝলসানি হাওয়ায় একেবারে শেষ তৈরি হয়ে উঠে, থেকে থেকে মিষ্ট সুবাস ছড়াচ্ছিল। রামকালী বিরক্ত হচ্ছিলেন, আর বেহারাগুলো যেন অন্তর দিয়ে সেই সুবাসটুকুই লেহন করছিল। আর ভাবছিল ডাব চারটে পালকির বাঁকে বাঁকে নিলেই বা ক্ষতি কি ছিল? তবু তো কেষ্টর জীবের ভোগে লাগত।
অন্যমনস্ক হয়ে বোধ হয় ঝিমিয়ে এসেছিল তারা। হঠাৎ চমকে উঠল কর্তার হাঁকে।
পালকি থেকে মুখ বাড়িয়ে রামকালী হাঁকছেন, ওরে বাবা সকল, ঘুমিয়ে পড়িস নে, একটু পা চালা।
কথাটা শেষ করেই হঠাৎ সুর-ফের্তা ধরলেন। কবরেজ, এই দাঁড়া দাঁড়া, আস্তে কর, পেছনে হঠাৎ যেন আর একটা পালকির শব্দ পাচ্ছি।
চার বেহারিার আটখানা পা থমকে দাঁড়াল।
হ্যাঁ, শব্দ একটা আসছে বটে। পিছন থেকে। হঠাৎই আসছে। হুম, হুম আওয়াজটা ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে।
প্রধান বেহারা গদাই ভূইমালী পালকির বাঁক থেকে ঘাড় সরিয়ে পিছন সড়কের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে ওঠে, আজ্ঞে কৰ্তামশাই, নিয্যস বলেছেন বটে! পালকিই একটা আসছে, মনে নিচ্ছে কোন বিয়ের বর আসছে!
বিয়ের বর!
রামকালী পালকি থেকে গলাটা আরও একটু বাড়িয়ে এবং সে গলার স্বরটাকে অনেকখানি বাড়িয়ে বলেন, বিয়ের বর এ খবরটা আবার চট করে কে দিয়ে গেল তোকে?
গদাই ভূইমালী মাথা চুলকে বলে, পালকির কপাটে হলুদ ছোগানো ন্যাকড়া ঝুলছে দেখতে পাচ্ছি কর্তা, ব্যায়রাগুলোর পরনে লালছোপ খেটে!
খেটোটা হচ্ছে ধুতির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। আরও অনেক শ্রমজীবীদের মত পালকি-বেহারাদের পুরো ধুতি পরা চলে না। জোটেই বা কই? ছালার মত মোটা সাতহাতি খেটেই তাদের জাতীয় পোশাক। লোকের বাড়ি কাজে-কর্মে বিয়ে-পৈতেয় লাল রঙে ছোপানো ওই ধুতি মাঝে মাঝে তাদের জোটে। এতে সুবিধেটা খুব। মাস তিন-চার ক্ষার না কোচে চালানো হয়।
লাল হলুদ রঙটাই শুধু নয়, ক্রমশ মানুষগুলোও স্পষ্ট হচ্ছে। গদাই আরও একটা উৎফুল্ল আবিষ্কার করে, পশ্চাতে গো-গাড়িও আসছে কত্তা, বলদের গলার ঘন্টি শুনতে পাচ্ছি। এ আর বরযাভীর না হয়ে যায় না। ইন্দিকেই কোথাও বে। উই পাশের গার সড়ক দিয়ে বেরিয়েছে।
পালকি নামা! গম্ভীর কণ্ঠে হুকুম করেন। রামকালী।
দেখা দরকার প্রকৃত ঘটনা গদাইয়ের আন্দাজ অনুযায়ী। কিনা। আর এও জানা দরকার যদি সত্যিই তাই হয়, কে এমন দুর্কিনীত আছে তার গ্রামে, যে ব্যক্তি মেয়ের বিয়ে দিতে বসেছে, অথচ রামকালীকে জানায় নি! আর এ গ্রামের যদি নাও হয়, খোঁজ নেওয়াও চাই, গ্রামের ওপর দিয়ে বারযাত্রী নিয়ে যাচ্ছে কোথায়!
রামকালীর মনে যাই থাক, বেহারাগুলো একটুখানির জন্যেও বাঁচল। একটা পাকুড় গাছতলায় পালকি নামিয়ে, খানিক তফাতে গিয়ে কাঁধের গামছা ঘুরিয়ে বাতাস খেতে লাগল।
কত্তামশায়ের চোখের সামনে তো আর বাতাস খাওয়া চলে না!
কিছুক্ষণ পরেই দূরবতী পালকি অদূরবতী এবং ক্রমশ নিকটবর্তী হল।
রামকালী বেরিয়ে পড়ে কাঁধের মটকার চাদরখানা গুছিয়ে কাঁধে ফেলে রাজ্যোচিত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে জলদগম্ভীর কণ্ঠে হাঁক দিলেন, কে যায়?
পালকি থামল। না থেমে এগিয়ে যাবার সাধ্য কার আছে, এই কণ্ঠকে উপেক্ষা করে?
পালকি থামল।
বর আর বরকর্তা এতে সমাসীন। বরকর্তার সঙ্গে সঙ্গে কিশোর বরটিও সভয়ে একটু মুখ বাডাল।
ওই দীর্ঘকায় গৌরকান্তি পুরুষ মাটিতে নেমে দাঁড়িয়ে, অতএব কে পালকি চড়ে বসে থাকতে পারে তার সামনে?
সে পালকি থেকেও নামলেন। বরকর্তা।
করজোড়ে বললেন, আপনি আজ্ঞে?
রামকালীর কিন্তু তখন ভুরু কুঁচকেছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টির শরসন্ধান চলছে পালকির মধ্যে। অভ্যাবসশতই দুই হাত তুলে প্রতি-নমস্কারের ভঙ্গীতে বললেন, আমি রামকালী চাটুয্যে।
রামকালী চাটুয্যে!
ভদ্রসন্তান বিহ্বল হয়ে—না আত্মগত, না প্ৰশ্নসূচক, কেমন যেন আলগা ভাবে উচ্চারণ করলেন, কবরেজ!
হ্যাঁ। ছেলেটির কপালে চন্দন দেখলাম মনে হল, বিবাহ নাকি!
সে ভদ্রলোক রামকালীর চাইতে ছোট না হলেও বিনয়ে কীটানুকীটের মত ছোট হয়ে পায়ের ধুলো নিয়ে বলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। ওঃ, কী পরম ভাগ্য আমার যে এই শুভযাত্রায় আপনার দর্শন পেলাম।
আহাহা! আপনাকে চেনে না। এ তল্লাটে এমন অভাগা কে আছে? তবে নাকি চাক্ষ্মষ দর্শনের সৌভাগ্য ইতিপূর্বে হয় নি। রাজু, বেরিয়ে এসে পায়ের ধুলো নাও!
থাক থাক, বিয়ের বর! রামকালী স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, আপনার পুত্ৰ? আজ্ঞে না, ভ্রাতুষ্পপুত্র। পুত্র আমার কনিষ্ঠ সহোদরের। সে আছে পেছনে গো-যানে। আরও সব আত্মকুটুম্ব আসছেন তো!
হুঁ, কন্যাটি কোথাকার?
আজ্ঞে এই যে পাটমহলের। পাটমহলের লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যের পৌত্রী—
লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়িয্যের পৌত্রী? রামকালী যেন সহসা সচেতন হলেন, তাই নাকি? আপনারা কোথাকার? আপনার ঠাকুরের নাম?
আমরা বলাগাড়ের। ঠাকুরে নাম ঈশ্বর গঙ্গাধর মুখোঁপাধ্যায়, পিতামহের নাম ঈশ্বর গুণধর মুখোঁপাধ্যায়, আমার নাম-
থাক, আপনার নামে প্রয়োজন নেই। তা হলে আপনারা মুখুটি কুলীন? তা হাবভাব এমন যজমেনে ভট্টচায্যের মতন কেন? কিন্তু সে যাক, দুটো কথা আছে আপনার সঙ্গে। বর নিয়ে বেরিয়েছেন কখন?
যজমেনে ভট্টচার্য শব্দটায় ঈষৎ ক্ষুব্ধ হয়ে পাত্রের জেঠা গভীরভাবে বলেন, আভ্যুদায়িক শ্ৰাদ্ধের পর।