শুনতে পেলেন খাজে খাজে। হাসি ছড়ানো সেই ছড়া—
জটাদাদা পা গোদা
যেন ভোঁদা হাতী,
বৌ-ঠেঙানো, দাদার পিঠে
ব্যাঙে মারে লাথি।
জটা জটা পেট মোটা–
দেখিব মজা কেমন সাজা
যাও না শ্বশুরবাড়ি।
বলতে বলতে চলে গেল ওরা।
মোক্ষদা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
না, ভাইপোর মেয়ের কবিত্বশক্তির পরিচয়ে অভিভূত হয়ে নয়, স্তম্ভিত হলেন এ মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে। একে তিনি শাসন করতে এসেছেন! এর পরে আর একে শাসন করে শায়েস্তা করবার সাধ তাঁর নেই; শুধু এইটে মনে মনে অনুধাবন করলেন—একে নিয়ে চিরকাল জ্বলে-পুড়ে মরতে হবে তাদেরই, কারণ শ্বশুরবাড়ি থেকে তো মারতে মারতে খেঁদিয়ে দেবেই!
কাগজের চিলতেয় মোড়া গোটাকতক ওষুধে বড়ি আঁচলের গিট থেকে খুলতে খুলতে সত্য তার শানানো গলাটাকে কিঞ্চিৎ নামিয়ে বলল, এই নাও বৌ, কি যেন বটিকা! বাবা বলে দিলেন সকাল সন্ধ্যে একটা করে বটিকা পানের রস দিয়ে খেতে, গায়ে বল পাবে।
আর গায়ে বল!
মনের বল তো সমুদ্রের তলায়। ভয়ে বুক কেঁপে থর-থর। জটার বৌ কাতর করুণ কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, হেই ঠাকুরঝি, তোমার পায়ে ধরি, ওষুধ তুমি নিয়ে যাও। ওষুধ খাচ্ছি। দেখলে ঠাকরুণ। আর আমাকে আস্ত রাখবেন না!
সত্য গিনির মত গালে হাত দিয়ে বলে, ওমা, শোনো বিত্তান্ত! দেহ দুব্বল হয়েছে, মিনিমাগনায় ওষুধ পাচ্ছ, খেলে শাউড়ী তোমায় মেরে ফেলবে? তুমি যে তাজ্জব করলে গা!
দোহাই গো ঠাকুরঝি, একটু আস্তে— প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে বলে জটার বৌ, তোমার দুটি পায়ে পড়ছি, ঠাকরুণের কানে গেলে পুকুরে ড়ুবে মরা ছাড়া আর গতি থাকবে না। আমার।
সত্য এবার একটু গুছিয়ে বসে, বসে অবাক গলায় আস্তে আস্তে বলে, কী শুনলে গো?
ওই যে মেরে ফেলার কথা বললে! জানো তো ভাই সমস্ত? মামাঠাকুর ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছেন, আর সেই ওষুধ আমি খাচ্ছি! ওরে ব্যাপারে! এই দেখা ঠাকুরঝি, আমার বুকের ভেতর কেমনতর ঢেঁকির পাড় পড়ছে!
জটার বৌয়ের ওই ব্যাধের তাড়া খাওয়া হরিণের চোখের মত চোখ আর ঘুটের ছাইয়ের মত। পাশুট-রঙা মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ কেমন চিন্তাশীল দেখায় সত্যবতীকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ওষুধগুলো ফের আঁচলে বাঁধতে বাধতে বলে, আচ্ছা তা হলে ফেরত নে যাই।
ফেরত!
মামা ঠাকুরের কাছে!
আর এক ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে জটার বৌয়ের। আর এবার আর কাঁদো কাঁদো নয়, ভ্যাক করে কেঁদেই ফেলে। ও সত্য ঠাকুরঝি, তোমার পা-ধোওয়া জল খাই, তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকি, ও বড়ি মামাঠাকুরকে ফেরত দিতে যেও না!
ফেরত দিতে যেও না!
হঠাৎ সত্য তার নিজের স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে ওঠে, এই সেরেছে! ব্যায়রামে পড়ে দেখছি তোমার ভীমরতি ধরেছে বৌ! শাউড়ীর ভয়ে ওষুধ খাবে না, আবার ফেরতও দেবে না, তবে বড়িগুলো কি আমি খেয়ে নেব? দাও, তা হলে একখোরা পানের রস করে দাও, সবগুলো একসঙ্গে গুলে গিলে ফেলি।
জটার বৌ এবার মনের কথা খুলে বলে। শাশুড়ীর অসাক্ষাতে ওষুধ খাবার সাহস তার নেই, বলে কয়ে সাক্ষাতে খাবার তো আরোই নেই, অতএব–
অতএব পুকুরের জলে!
পুকুরে?
সত্যর চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। বাবার দেওয়া বড়ি স্বয়ং ধন্বন্তরী, তা জান? এ বাড়ির অপমান করলে, ধন্বন্তরীর অপমান তা জান?
তবে আমি কী করি?
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে জটার বৌ।
সত্য ওর অবস্থা দেখে কাতর না হয়ে পারে না, একটু ভেবেচিন্তে বলে, তা হলে নয় এক কাজ করি, পিসীকেই দিয়ে যাই, বলি বাবা পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাবা অবিশ্যি বলেছিলেন পিসীকে দিস না, তা হলে খেতে দেবে না, ফেলে দেবে। তুতিয়েপাতিয়ে কাকুতি-মিনতি করে বলে যাই।
উঠে দাঁড়ায় সত্য, আর সঙ্গে সঙ্গে ওর কাপড়ের একটা খুঁট ধরে হুমড়ে প্রায় ওর পায়ে পড়ে জটার বৌ, ও ঠাকুরঝি, তার চাইতে তুমি আমার গলায় পা দিয়ে মেরে রেখে যাও, আঁশবিটি দে কেটে রেখে যাও আমায়।
সত্য আবার বসে পড়ে।
একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা বৌ, তোমাদের এত ভয় কিসের বলতে পার?
০৬. শুধু হাঁটু পর্যন্ত
হুম্ হুম্ হুম্!
শুধু হাঁটু পর্যন্ত আটফাটা পা-গুলোর নয়, জিভে-মুখেও ধুলো বেতে যাচ্ছে বেহারাগুলোর। জ্যৈষ্ঠের দুপুর আর দুরন্ত মেঠো রাস্তা। খানিক খানিক পথ তো একেবারে ধু-ধু প্ৰান্তর, গাছ নেই ছায়া নেই। পথ সংক্ষেপের জন্য মাঝে মাঝে মোঠ ভাঙতে হচ্ছে বলেই লোকগুলো যেন আরও একেবারে জেরবার হয়ে যাচ্ছে। চারটে লোক পালা করে কাঁধ বদলে ছুটছে, তবু থেকে থেকে ঝিমিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু রামকালীরও তো আর এখন পালকি-বোহারাগুলোর ওপর দরদ দেখাবার উপায় নেই। আজ চার দিন গা ছাড়া, তো ধর মো ধর না হলেও হাতে কটা রুগী ছিল, কে জানে কেমন আছে সে কটা!
গিয়েছিলেন জীরেটের জমিদারবাড়িতে রুগী দেখতে। শুধু তো এক-আধখানা গাঁয়ে নয়, দশখানা গাঁ অবধি নামডাক বদ্যি চাটুয্যের।
রাজার আদরে রেখেছিল ওরা, আর পায়ে ধরে সাধছিল আরও দুটো দিন থেকে যাবার জন্যে। রাজী হন নি। রামকালী। বলে এসেছেন, প্রয়োজন নেই, যে ওষুধ দিয়ে গেলাম এতেই রুগী তিন দিনে উঠে বসবে। তবে পথ্যাপথ্যের যা ব্যবস্থা দিয়ে যাচ্ছি সেটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা চাই।
কবিরাজ মশাই পথে খাবেন বলে ওরা একঝুড়ি কলমের আম ওঁর পালকির মধ্যে তুলে দিয়েছে, আপওি শোনে নি। পা ছড়াতে অনবরত ঝুড়িটা পায়ে ঠেকছে আর বিরক্তি বোধ করছেন রামকালী। এই এক আপদ! পথে তিনি কিছু খান না, একথা ওরা মানতে চাইল না। স্বয়ং জমিদার মশাই দাঁড়িয়ে তুলিয়ে দিলেন। তবু মুখ কাটা ডাব গোটাচারেক পালকিতে তুলতে দেন নি। রামকালী, বলেছিলেন, ব্যায়রাগুলো তা হলে আপনার বাগানের এই ফলটলগুলোই বয়ে নিয়ে যাক রায়মশাই, আমি পদব্ৰজেই যাই!