নিতান্তপক্ষে পুকুরে নেমে পা ধুয়ে আসা যদি অসম্ভব হয়, তা হলে অনুকল্প হিসেবে এই ব্যবস্থা দিয়ে রেখেছেন মোক্ষদা। তবু সেজবৌয়ের আশ্বাসবাণীতে তেমন নিশ্চিন্ত হলেন না। সন্দিগ্ধ সুরে বললেন, বলি গোবরটা নিজেদের তো? নাকি আর কারুদের ঘরের এটোকাটা খাওয়া গরুর?
শোন কথা— জেরা থামানোর চেষ্টায় বলে ওঠেন শিবজায়া, তোমাদের উঠোনে আবার অপরের গরুর গোবর আসবে কোথা থেকে?
কিন্তু থামাতে চাইলেই কি সব জিনিস থামে? মোক্ষদার জেরাও থামল না। তিনি একটু কটুহাস্যে বলে উঠলেন, ও মা লো! আমাদের উঠোনে অন্যের গরুর গোবর আসবে কোথা থেকে? তোমার কথা শুনে মাঝে মাঝে মনে হয়। সেজবৌ, তুমি যেন এইমাত্তর মায়ের পেট থেকে পড়লে!
শিবজায়া ননদকে খুব ভয় করলেও, তবু ছোট ননদ। তাই বিরক্ত সুরে বলে ফেলেন, নাও বাবা, তোমার কাছে আসাই দেখছি ঝকমারি! গোবিন্দবাড়ি থেকে ফিরতে পথে আমাদের কীর্তিমান মেয়ের কীর্তির কথা শুনে হা হয়ে গেলাম, তাই, থাক গে—
মোক্ষদা এতক্ষণে একটু নরম হন। প্রায় সন্ধির সুরেই বলেন, কেন, কী আবার করল কে? সত্য বুঝি?
তবে আবার কে! শিবজায়া ঔদাসীন্য ত্যাগ করে। মহোৎসাহে পুরনো সুর ধরেন, সত্য ছাড়া আর কার এত বুকের পাটা হবে? হারামজাদী নাকি জটার নামে ছড়া বেঁধে পাড়ার গুষ্টিসুদ্ধ ছেলেমেয়েকে শিখিয়ে দিয়েছে, আর গাসুদ্ধ ছেলেপিলে জটাকে কি জটার মাকে দেখলেই ঝোপেবাড়ের আড়াল থেকে শুনিয়ে শুনিয়ে তাই আওড়াচ্ছে। জটার মা তো রেগে গাল দিয়ে শাপশাপান্ত করে একাকার!
শেষ পর্যন্ত সবটুকু শোনবার জন্যে ধৈর্য ধরে চুপ করে তাকিয়েছিলেন মোক্ষদা, এবার ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণস্বরে বলে ওঠেন, ছড়া বেঁধেছে মানে কি?
মানে কি, তাই কি আমিই আগে বুঝতে পেরেছিলাম? মেয়েমানুষ যে আবার ছড়া বাধে বাপের জন্মেও শুনি নি। তাপর পথে আসতে আসতে দেখি একপাল ছোঁড়া হি হি করে হাসতে হাসতে বলছে, জটা মোটা পা গোদা— ভেঙচি কেটে আরও সব কত কি পয়ার ছন্দ বলতে বলতে যাচ্ছে!
মোক্ষদা আরও ভুরু কুঁচকে বলেন, ছড়া বেঁধেছে সত্য?
তবে আর বলছি কি!
ওই মেয়ে হতেই এ বংশের মুখে চুনকালি পড়বে— মোক্ষদা এবার শিলটা পাততে পাততে বলেন, রামকালী চন্দর এখন বুঝছেন না, এর পর টের পাবেন, যখন শ্বশুরঘর থেকে ফেরত দিয়ে যাবে। ভেঙচি-কাটা ছড়া বোধ হয়। জটা বৌ ঠেঙিয়েছিল বলে!
তবে না তো কি? বলি পরিবারকে আবার না মারে কোন মন্দ? ঢলানি বৌ আমনি তিলকে তাল করে দাঁতকপাটি লাগিয়ে পাড়ায় লোক-জানাজানি করে ছাড়লেন। জটার মা বলছে, ছোঁড়াগুলোর জুলায় নাকি জটা বেচারা ঘরের বার হতে পারছে না, কি গেরো বল দেখি!
মোক্ষদা ঘাস ঘাস করে শিলে সরষে রাগড়াতে রাগড়াতে বলেন, হাতের কাজটা মিটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমি বৌমার কাছে। ভাল করে সমঝে দিয়ে আসছি। মায়ের আসকারা না থাকলে মেয়ে কখনও এত বড় বেয়াড়া হয়? পাড়ার ছোঁড়াদের সঙ্গেই বা রাতদিন এত মস্করা কিসের? একটা কলঙ্ক রটে গেলে তখন রামকালীর মুখটা থাকবে কোথায়? পয়সাওলা বলে তো সমাজ রেয়াৎ করবে না!
শিবজায়ার কাজ কিছুটা সিদ্ধ হল।
বড় জায়ের নাতনীর বিরুদ্ধে ছোট ননদকে কিছুটা তাতাতে পেরেছেন। শেষবেশ বলেন, তুমি যাই আছ ছোট ঠাকুরঝি, তাই এখনও সংসারে একটা হক কথা হয়, নইলে আমরা তো ভয়ে কাটা!
ভয় আবার কিসের?
মোক্ষদা দুম করে শিলটা তুলে ফেলে বলেন, ভয় করব ভূতকে, ভয় করব। ভগবানকে। মানুষকে ভয় করতে যাব কেন? বিধবা পিসিকে ভাত দিয়ে পুষিছে বলে যে হক কথা শুনতে হবে না রামকালীকে, এ তুমি ভেবো না। সেজবৌ! সে যাক, জটার বোর প্রাচিত্তিরের কিছু ব্যবস্থা হয়েছে?
ওমা, তুমি শোন নি সে কথা? প্ৰচিত্তির তো করবে না!
করবে না?
না। রামকালী নাকি ভটাচাৰ্যকে শাসিয়েছে, প্ৰচিত্তিরের বিধান দিলে তাকে গাঁ-ছাড়া করবে!
তার মানে? আকাশ থেকে পড়লেন মোক্ষদা।
মানে বোঝ! অহমিকা আর কি! আমি গায়ের মাথা, আমি যা খুশি তাই করব!
হুঁ।
মোক্ষদা সরষে-গুঁড়ো-ছড়ানো আচারের খোরা দুটো দুম করে ঘরে তুলে ঘরের কপাটটা টেনে : তুলে দিয়ে বলেন, যাচ্ছি, দেখছি পয়সার বাড় কত বেড়েছে রামকালীর! সত্য আছে বাড়ি?
বাড়ি! দুপুরবেলা বাড়ি থার্কবারই মেয়ে বটে সে! কোথায় আগানে-বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে! বেওলা মেয়ের এত বুকের পাটা, এতখানি বয়সে দেখি নি কখনও।
তসরখানা গুছিয়ে পরে উঠোন পার হয়ে খরা খর পায়ে বেড়ার দরজা খুলে পথে পড়লেন মোক্ষদা। ফিরে তো স্নান করতেই হবে, একবার কেন—কতবার, কিন্তু এসবের একটা হেস্তনেস্ত দরকার।
জগতের কোথাও কোনও অনাচার ঘটবে, এ মোক্ষদা বরদাস্ত করতে পারবেন না।
কিন্তু ও কী?
একটু এগোতেই থমকে দাঁড়াতে হল।
বজ্রাহতের মতই থমকানি।
দেখলেন একখানা তেপেড়ে শাড়িতে গাছকোমর বেঁধে, একরাশ রুক্ষ চুল উড়িয়ে একহাঁটু ধুলো মেখে একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমবাগানের মাঝখান দিয়ে চলেছে সত্য হি-হি করতে করতে আর সমস্বরে কি যেন একটা ছড়ার মতই আওড়াতে আওড়াতে।
দাঁতে দাঁত চেপে আরও একটু এগিয়ে গেলেন। মোক্ষদা, দলের পিছন দিকে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটা শুনতে চেষ্টা করলেন। হি-হি হাসির চোটে সব শোনা যায় ছাই! তবু বালককণ্ঠের শানানো সুর, আর বার বার উচ্চারণ করছে, কাজেই ক্রমশ সবটাই কর্ণগোচর থেকে মৰ্মগোচর হয়ে যায়।