সেই থেকে সাবধান হয়ে গেছেন মোক্ষদা। টেকির গড়ের কাছে কাউকে একটু বসানো ছাড়া আর সব একা করেন।
দুর্গাপূজোর রোদে পোড়া তো শুধুই তিলের নাড়ু নয়, বাড়ি বাড়ি নেমন্তন্নর কথা বলতে যাওয়া, গুরুপুরুতের বাড়ি সিধে দিতে যাওয়া সে সবও তো মোক্ষদার ডিউটির মধ্যেই। কারণ তিনি ঝিউড়ি মেয়ে। কাশীশ্বরীও কতকটা করেছেন আগে আগে, কিন্তু ইদানীং তিনি রোগে কেমন জবুথবু হয়ে গেছেন। মাঠঘাট ভেঙে রোদে রোদে ঘুরে কাজ উদ্ধার করার সামর্থ্য নেই। মোক্ষদাই সব করেন, আর দিনে অন্তত বার চোদ্দ-পনেরো স্নান করেন।
কেন কে জানে, আজ রোদের কথাটাই বার বার মনে পড়ছে মোক্ষদার। মনে হল পূজোর ঝঞ্ঝাট কাটতে না-কাটতেই তো বড়ির মরসুম। বছরে বারো-চোদ্দ মণ বড়ি লাগে। আশা-নিরামিষ দুদিকের প্রয়োজনের দায়টা পোহানো হয় এই দিকেই, কারণ বড়িও তো আম-কাসুন্দির মতই শুদ্ধাচারের বস্তু। আর শুদ্ধাচারের ব্যাপারে কাকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবেন মোক্ষদা নিজেকে ছাড়া?
বড়ি দিতে দিতে মোক্ষদার হত্তেল রঙ কালসিটে মেরে যায়। তবে জিনিস যা হয় তাক লাগাবার মত। ডাকসাইটের হাত। সাবধানীও খুব মোক্ষদা, কাউকে ছুতেই দেন না। সাধ্যপক্ষে, বড় বড় তিজেলে ভরে সরাচাপা দিয়ে সাঙায় তুলে রাখেন, সময়মত বার করে দেন। কত তার স্বাদ। কুমড়ো বড়ি, খাস্তা বড়ি, পোস্ত বড়ি, তিলের বড়ি, জিরের বড়ি, ঝালমশলার বড়ি, টকে-সুক্তয় দিতে মটর-খেসারির বড়ি—ব্যবহার অনেক।
ওরই মধ্যে মূলোর বড়িটা আবার আলাদা রাখতে হয়, মাঘ মাসে পাছে ভুলে খাওয়া হয়ে যায়। মাঘ মাসে মূলো খাওয়া আর গোমাংস খাওয়ায় তো তফাৎ কিছু নেই। … খুঁটির রোদটা সরে গেছে, পিঠটা আবার চিনচিন করছে। মনটাও যেন চিনচিন করছে।
বড়িপর্ব সারা হতেই আসে কুল, আসে তেঁতুল।
কবে তবে রোদে পোড়ার ছুটি?
সারা বছর ধরে এই রোদে পোড়ার দায়িত্ব মোক্ষদাকে দিয়েছে কে, এ কথা কে বলবে? তবে মোক্ষদা জানেন এটা তাঁরই দায়িত্ব।
আমতেল মাখা একটা সময়সাপেক্ষ কাজ। চটকে চটকে তেলে-আমে। মিশোতে হবে তো? হয়েছে এতক্ষণে, এবার রাইসরষের মিহিগুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে ক্ৰমাগত রোদ খাওয়ানো।
কোমরটা টান করে উঠে পড়লেন মোক্ষদা, পিঠের জ্বালা-কয়ার জায়গাটা নড়াচড়া পেয়ে আর একবার হু-হু করে উঠলো। কিন্তু কী আশ্চর্য, সরষে গুঁড়োবার জন্যে রান্নাঘরে এসে ঢুকতেই মনটা হুঁ-হুঁ করে উঠলো কেন?
ঘরে ঢুকেই হঠাৎ কেমন বোকার মত দাঁড়িয়ে পড়লেন মোক্ষদা। ঘরটা আজ এত বড় দেখাচ্ছে কেন? কই, এমন তো কোন দিন দেখায় না! বরং ভাত বাড়ার সময় পরস্পরের গা বাঁচিয়ে ব্যবধান রেখে ঠাঁই করতে তো জায়গার অকুলানই লাগে।
ঘরের মধ্যে তো রোদ নেই, তবু এই ছায়াশীতল প্ৰকাণ্ড লম্বা ঘরখানা যেন ওই রোদে খা খাঁ প্ৰকাণ্ড উঠোনটার মতই বা ঝা খা খা করছে। আর সেই খা খা করা ঘরের এক প্রান্তে বড় বড় দুটো উনুন তাদের মাজাঘষা নিকোনো চুকোনো চেহারা নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে বহু অকথিত শূন্যতার প্রতীকের মত।
উনুন দুটোকে আজ আগুনের দাহ সহ্য করতে হবে না। ওরা হয়তো এই নিরালা ঘরে স্তব্ধ হয়ে বসে নিজেদের শূন্যতার পরিমাপ করবার অবকাশ পাবে।
আজ ওদের ছুটি। আজ এদের একাদশী।
মোক্ষদার ছুটি নেই কেন?
ঘরের নর্দমার কাছবরাবর একটা জলভর্তি ঘড়া বসানো থাকে-নেহাৎ সময়-অসময়ের জন্যে। মোক্ষাদাই শেষবারের মানের পর এনে রেখে দেন।
তেল-তেল হাতটা ঘড়া কাত করে ধুয়ে নিয়ে মোক্ষদা। হঠাৎ আছড়া আছড়া জল নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে লাগলেন, পিঠের রোদে চিনচিনে জায়গাটার জুলুনি একটু ঠাণ্ডা হোক। দূর ছাই, হাত ধুয়ে পুকুরে গেলেই হত, তবু একবার গা-মাথা ভিজিয়ে আসা যেত। গায়ের চামড়াটা খানিক ভিজলেও যেন ভেতরের তেষ্টাটা খানিক কমে।
একাদশীর দিন তেষ্টা কথাটা মনে আনাও পাপ। এ কি আর জানেন না মোক্ষদা? তায় আবার তার মত বয়স-ভাটিয়ে-যাওয়া শক্তিপোক্ত মজবুত বিধবার! কিন্তু মনে করব না বললেও মনে যদি এসে যায়, সে পাপকে তাড়ানো যায় কোন অস্ত্ৰে?
রোদ লাগলে বোশেখ-জষ্টির দুপুরে তেষ্টাটা জানান দেয় বেশী। কিন্তু উপায় কি? আজকেই যে যত রাজ্যের বাড়তি কাজ করবার পরম দিন। আজকের মতন এমন অখণ্ড অবসর আর কদিন জোটে।
রাইসরষের সন্ধানে কুলুঙ্গীতে তুলে রাখা রঙিন ফুলকাটা ছোট ছোট ছোবা হাঁড়ির একটা পাড়লেন মোক্ষদা। সব হাঁড়িতে একেবারে সম্বৎসরের মশলা ঝেড়ে বেছে তুলে রাখা হয়, আর নিত্য প্রয়োজনে দুটি দুটি বার করে কাঁচা ন্যাকড়ার কোণে কোণে পুঁটুলি বেঁধে রাখা হয। শুধু এরকম অনিত্য প্রয়োজনেই মূল ভাঁড়ারে হাত পড়ে।
একটা পাথরবাটিতে আন্দাজমত সরষে ঢেলে নিয়ে শিল পেতে বসতে যাচ্ছিলেন মোক্ষদা, হঠাৎ দরজার কাছে শিবজায়ার গলা বেজে উঠল, কালে কালে কি হল গো, এ যে কলির চারপো পুরল দেখছি! আমাদের ধিঙ্গ অবতার মেয়ের আস্পদ্দার কথাটা শুনেছ ছোটঠাকুরঝি?
ধিঙ্গী অবতার মেয়ের আস্পদ্দার ইতিহাস শোনার আগেই ভাজের আসপদ্দায় রে-রে করে ওঠেন। মোক্ষদা, উঠোনের পায়ে তুমি দাওয়ায় উঠলে সেজবৌ? আর ওইখানেই আমার আচারের খোরা! বলি তোমরা সুদ্ধ যদি এরকম যবন হও—
শিবজায়া ঈষৎ রুষ্টভাবে বললেন, তোমার এক কথা ছোটঠাকুরবি, উঠোনের পায়ে দাওয়ায় উঠে আসব আমি অমনি আমনি! এই দেখা পায়ে গোবর লেগে। হাতে করে একনাদ এনে পৈঠের নীচেয় ফেলে সেই গোবর দুপায়ে মাড়িয়ে তবেই না উঠেছি!