তই নাকি? কই শুনি নি তো? তা হলে গায়ের মায়া কাটাল এবার চাটুয্যে!
না না, শুনছি। যাবে না।
বটে! তবু ভাল। তোমায় বললে কে?
কুঞ্জর বড় ছেলেটা বলছিল।
হুঁ ভালই, এ বয়সে আবার বিদেশে গিয়ে রাজদরবারে চাকরি! তবে রামকালীর মতিগতি বড় বড় অত বড় বিসি মেয়েকে এতটা বাড় বাড়তে দেওয়া উচিত হয় না, পাড়ার ছেলেগুলো ওর খেলুড়ি!
হ্যাঁ, গাছে চড়তে, সাতার কাটতে, মাছ ধরতে বেটা ছেলের দশগুণ ওপরে যায়।
এটা একটা গৌরবের কথা নয় খুড়ো। যতই হোক মেয়েছেলে, তায় আবার একটা মান্যিমান ঘরের বৌ হয়েছে। তারা টের পেলে ও বেঁকে ঘরে নিতে বেঁকে বসবে না!
একটা কলঙ্ক রটিয়ে দিতেই বা কতক্ষণ?
বদ্যি চাটুয্যের ও তার ধিঙ্গি মেয়ের আলোচনায় চণ্ডীমণ্ডপ ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। যাকে সামনে সমীহ করতে বাধ্য হতে হয়, তাকে আড়ালে নিন্দে করতে না পেলে বাঁচবে কেমন করে মানুষ!
এইসব সমালোচনার প্রধানা পাত্রী তখন বাবার পিছন পিছন ছুটছে আর মনে মনে আকুল প্রার্থনা করছে, হেই ভগবান, আমার পা-টা বাবার মতন লম্বা করে দাও নাগো, তা হলে বাবার মতন হাঁটি, হেরে যাই না!
হেরে যেতে একান্ত আপত্তি সত্যবতীর।
কোন ক্ষেত্রে কোথাও হার মানবে না। এই পণ।
এই পুণ্যি, ছড়া বাঁধতে পারিস?
চিলেকোঠার ছাদের ওপর সত্যবতীর খেলাঘর। প্রধান খেলুড়ি রামকালীর জ্ঞাতি খুড়োর মেয়ে পুণ্যবতী। সত্য তাকে পাঁচজনের সামনে সভ্যতা করে পুণ্যিপিসী বললেও, নিজের এলাকায় পুণ্যিই বলে।
বাবুই পাখীর বাসা আনতে পারিস? অথবা কাচপোকা ধরতে পারিস? কিংবা সঁতরে তিনবার বড় দীঘি পারাপার হতে পারিস? এ ধরনের পরীক্ষামূলক প্রশ্ন প্রায়ই করে সত্য, কিন্তু ছড়া বাধতে পারিস কিনা, এহেন প্রশ্ন একেবারে আনকোরা নতুন!
পুণ্য বিমূঢ়ভাবে বলে, ছড়া! কিসের ছড়া?
জটাদার নামে ছড়া, বুঝলি? ছড়া বেঁধে গা-সুদ্ধ সব ছেলেমেয়েকে শিখিয়ে দেবী, জটাদাকে দেখলেই তারা হাততালি দিয়ে ছড়া কাটবে।
হি হি হি!
জটাধরের দুর্দশার চিত্র কল্পনা করে দুজন দুলে দুলে হাসতে থাকে।
অতঃপর পুণ্যবতী একটা পাল্টা প্রশ্ন করে, খুব তো বললি, বলি মেয়েমানুষকে আবার ছড়া বাধতে আছে নাকি?
বাঁধতে নেই? সহসা অগ্নিমূর্তি ধরে সত্য, কে বলেছে তোকে নেই? মেয়েমানুষ! মেয়েমানুষ! মেয়েমানুষ যেন মায়ের পেটে জনায় না, বানের জলে ভেসে আসে! অত যদি মেয়েমানুষ-মেয়েমানুষ করবি তো আমার সঙ্গে খেলতে আসিস নে।
পুণ্যি মুচকি হেসে বলে, আহা, মশাই রে! আর তোর বর যখন বলবে?
কি বলবো?
ওই মেয়েমানুষ!
ইস, বলবে বৈকি! দেখিয়ে দেব না! আমি ওই জটাধার বৌয়ের মত হব ভেবেছিস? কক্ষনো না। দেখ না, ছড়া বেঁধে জটাদাকে কী উৎপাত করি!
পুণ্যি ঈষৎ সমীহভাবে বলে, কিন্তু কি করে বাঁধবি?
কি করে আবার কথক ঠাকুর। যেমন আখর দেন তেমনি করে। একটুখানি তো বেঁধেছি, শুনিবি?
বেঁধেছিস! অ্যাঁ! বল না ভাই, বল না।
সত্য আত্মস্থভাবে চেখে চেখে তেঁতুল খাওয়ার ভঙ্গীতে বলে—
জটাদাদা, পা গোদা
যেন ভোঁদা হাতী,
বৌ-ঠেঙানো দাদার পিঠে
ব্যাঙে মারুক লাথি।
ওরে সত্য? পুণ্যি সহসা ড়ুকরে ওঠে সত্যকে জড়িয়ে ধরে, তুই কী রে! এরপর তো তুই পয়ার বাধতে শিখবি রে?
সেটাও যেন সত্যর কাছে কিছু নয় এমন ভাবে বলে, সে যখন শিখব, তখন শিখব, এখন এটা যে-যেখানে আছে সবাইকে শিখোতে হবে, বুঝলি? আর জটাদাকে দেখলেই—হি হি হি হি!
০৫. রোদে পিঠটা চিনচিন করছে
রোদে পিঠটা চিনচিন করছে অনেকক্ষণ থেকে, হঠাৎ যেন হু-হু করে জ্বলে উঠল। ওঃ, বকুলগাছের ছায়াটা দাওয়া থেকে সরে গেছে! বেলা তা হলে কম হয় নি! বিপদে পড়লেন মোক্ষদা, দু হাত জোড়া, অথচ পিঠের কাপড়টা সরে গিয়ে সরাসরি রোদটা পিঠের চামড়ায় লাগছে। নিজে দেখতে পাচ্ছেন না মোক্ষদা, আর কেউ কাছে থাকলে দেখতে পেত মোক্ষদার হত্তেল-রঙা পিঠটার কতকাংশ ফোস্কাপড়ার মত লাল হয়ে উঠেছে।
নাঃ, তসর থানখানা না পরে ভিজে থানখানা পরে আমতেল মাখতে বসলেই হত। ভিজে কাপড়ে যেন দেহের দাহ অনেকটা নিবারণ হয়। কানাউঁচু ভারী ভারী পাথরের খোরা দুখানা খানিকটা টেনে নিয়ে গিয়ে সরে দাওয়ার খুঁটির ছায়াটুকুতে পৃষ্ঠরক্ষা করতে গেলেন মোক্ষদা।
সমুদ্রে তৃণখণ্ড। তাছাড়া রোদ এখন দৌড়চ্ছে, এখুনি খুটির ছায়া সরবে।
হঠাৎ মোক্ষদা একটা সত্য আবিষ্কার করে বসলেন। সারা বছরটাই রোদে পুড়ে পুড়ে মরেন তিনি। এই তো কচি আমের আমতেল, এর পরই বাখড়া বাধা আমের গুড়-আম, মসলা-আম, তার পরেই পড়ে যাবে আমসত্ত্বর মরসুম। আর সে মরসুমকে সামলে তোলা তো সোজা নয়। আমসত্ত্বর পালা চুকতে চুকতেই অবশ্য বর্ষা নামে, সেই দু-তিনটে মাসই শুধু রোদে পোড়ার ছুটি, বর্ষা শেষ হতেই দুর্গোৎসবের সুর ওঠে। দুর্গোৎসবের আগে সারা ভাড়ারটাতেই তো ঝাড়া বাছা রোদে দেওয়ার ধুম চলে, তারপর পড়ে তিলের নাড়ুর ধূম।
বদ্যি চাটুয্যের বাড়ির দুর্গোৎসবের তিলের নাড়ু একটা বিখ্যাত ব্যাপার, হাতে বাগিয়ে ধরে কামড় দিতে পারা যায় না। এত বড় নাড়ু! পক্কান্ন আনন্দ নাড়ু মুড়কির মোয়া সবই কবরেজ-বাড়ির বিখ্যাত, কিন্তু সে সব তো তবু পাঁচহাতের ব্যাপার, নিতান্ত প্ৰতিমার ভোগের উপর্যুক্ত সেরকতক জিনিস গঙ্গাজলে ভোগের ঘরে তৈরী হলেও বিরাট অংশটায় অনেকে হাত লাগায়। কিন্তু তিলের নাড়ুটি সম্পূর্ণ মোক্ষদার ডিপার্টমেন্ট। কারণ তিলের নাড়ুর অমন হাত নাকি —শুধু এ গ্রামে কেন—এ তল্লাটে নেই। তা সেই নাম কি আর আমনি হয়েছে, আগাগোড়া নিজের হাতে রাখেন বলেই না এদিক ওদিক হতে পায় না! বস্তা বস্তা তিল তো এসে হাজির হল, তার পর? সেই তিল ঝাড়া-বাছা, নিখুঁত করে ধুয়ে নিপাট করে রোদে শুকিয়ে ঝুনো করা, ঢেকিতে কোটা, প্ৰকাণ্ড পেতলের সরা চড়িয়ে গুড় জ্বাল দিয়ে দিয়ে নিটুট নিশ্চিছদির ধামায় সেই তিলচুর মেখে মেখে তাড়াতাড়ি গরম থাকতে থাকতে নাড়ু পাকিয়ে ফেলা, এর কোনটা নিজের হাতে না করলে চলে? একবার বুঝি তিলটা কুটেছিল। সেজবৌতে আর বড়বৌমাতে, সেবার তো নাড়ু দিয়ে মজল। আগাগোড়া খোসায় ভর্তি। রঙও হল তেমনি কেলে-কিষ্টি। রামকালী নাড়ু দেখে হেসেছিলেন, প্রশ্ন করেছিলেন, এ নাড়ু কার তৈরী?