না, নাম কেউ জানে না, জানিবার চেষ্টাও করে না—জটার বৌ এই তার একমাত্র পরিচয়, এরপর শেষ পরিচয় হবে অমুকের মা। তবে আর নামে দরকার কী? নামে দরকার নেই, কিন্তু তার কথায় সকলেরই দরকার আছে। সেই দরকারী কথাগুলোর মধ্যে হঠাৎ জ্ঞাতি খুড়শাশুড়ী বলে উঠলেন, আমাদের বাপের বাড়ির দেশ হলেও বৌকে আর ঘরে উঠতে হত না, ওই গোয়ালে কি টেকশেলে জীবন কাটাতে হত!
দুএকজন মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন, জীবন নিয়ে বিচারটা কেন?
খুড়শাশুড়ী ফের রায় দেন, একে তো তুলসীতলায় বার করা, তাপর আবার কত বড় অনাচার ভাবো, মামাশ্বশুরের ছোঁয়াচ খাওয়া! কবরেজ মশাই যখন নির্ভরসায় নাড়ী টিপে ধরলেন, তখনই তো আমি হ্যাঁ। অবিশ্যি উনি ভেবেছিলেন মরেই গেছে। আর মারে গেলে সৎকারের আগে দেহশুদ্ধি তো একটা করতেই হত। কিন্তু এ যে একেবারে জলজ্যান্ত জীইয়ে উঠল! প্ৰচিত্তির না করলে কি করে চলবে?
বহু গবেষণান্তে স্থির হল, মামাশ্বশুর-স্পর্শের পাতকস্বরূপ একটা প্ৰায়শ্চিত্ত জটার বৌকে করতেই হবে, তা ছাড়া মরে বাঁচার পাতকে আর একটা। নইলে জটার মাকে পতিত থাকতে হবে।
বেচারা অপরাধিনী তো অচৈতন্য। জটার মাও জটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কাজেই একতরফা ডিক্রী হয়ে যায়।
কিন্তু সত্যবতী এসবের কিছুই জানে না। ও এক অদ্ভুত গৌরবের আনন্দে ছলছল করতে করতে বাবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফেরে।
উঃ, রাগ করে বাবা কি উল্টো কথা বলছিলেন! বলছিলেন। কিনা চিকিচ্ছে-টিকিচ্ছে কিছু জানি না। —সাধে কি আর সত্য অত দুঃসাহস করে বাবাকে হাতে ধরে বলেছিল একটু ওষুধ দিতে, তাই না বেচারী বেঁটা বাঁচল! আহা সত্য যখন শ্বশুরবাড়ি যাবে, তখন যদি সত্যর বর (মুখে অলক্ষ্যে একটু হাসি ফুটে ওঠে) আমনি মেরে সত্যকে মেরে ফেলে বেশ হয়। বাবা খবর পেয়ে গিয়ে একটিমাত্রা স্বর্ণসিঁদুর মধু দিয়ে মেড়ে খাইয়ে দেবেন, আর একটু পরেই সত্য চোখ খুলে সবাইকে দেখে তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে ফেলবে।
উঃ, কী মজাই হবে তা হলো!
দেশসুদ্ধ লোকের তাক লেগে যাবে সত্যর বাবা রামকালী কবরেজের গুণের মহিমায়। বাপ রে বাপ, সোজা বাবা তার! গায়ের আর কোন মেয়েটার এমন বাপ আছে?
হাসির কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সশব্দে হেসে ফেলা সত্যর বরাবরের রোগ।
রামকালী চমকে প্রশ্ন করলেন, কী হল? হাসলি যে?
সত্য কষ্টে সামলে নিয়ে ঢোক গিলে বলল, এমনি।
তোর ওই এমনি হাসিটা একটু কমা দিকি, প্ৰায় সহাস্যেই বলেন রামকালী, নইলে এর পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওই জটার বৌয়ের দশা হবে তোর!
মনটা বড় প্রসন্ন রয়েছে, এই সামনে রাত, না-হক্ কতগুলো ঝঞ্ঝাট-ঝামেলায় পড়তে হত, জটার বৌ তার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। বাপের মনের প্রসন্নতার কারণটা অনুমান করতে না পারলেও প্ৰসন্নতাটুকু অনুধাবন করতে পারে সত্যবতী এবং তারই সাহসে প্রায় উচ্ছ্বসিত ভাবে বলে, ওই জন্যেই হাসলাম! আমি মরে গেলে তুমি বেশ গিয়ে বাঁচিয়ে দেবে!
হুঁ, বটে! বলেন স্বল্পভাষী রামকালী।
রামকালী নিঃশব্দে হন।হন করে খানিকটা অগ্রসর হয়ে যান এবং সত্যবতী বাপের সঙ্গে তাল রাখতে প্ৰায় ছুটতে থাকে।
হঠাৎ একসময় থেমে রামকালী বলেন, মরে গেলে স্বয়ং ভগবান এসেও কিছু করতে পারেন না, বুঝলি? জটার বৌ মরে নি।
মরে নি! সত্য একটু আনমনা হয়ে যায়, মরাটা তা হলে আর কোন রকম? হঠাৎ চিন্তার গতি বদলায়, সত্য সোৎসুকে বলে, কিন্তু বাবা, তুমি গিয়ে নাড়ি দেখে স্বর্ণসিঁদুর না কি না খাওয়ালে ওই রকম মর্যা-মরা হয়েই তো থাকত জটাদার বৌ! আর সবাই মিলে বাশ বেঁধে নিয়ে গিয়ে পাকুড়তলার শশানে পুড়িয়ে দিয়ে আসত!
রামকালী একটু চমকালেন।
আশ্চর্য! এতটুকু মেয়ে, এত তলিয়ে ভাবে কি করে? আহা মেয়েমানুষ তাই সবই বৃথা। এ মগজটা যদি নেড়ুটার হত! তা হল না–আট বছরের হাতী এখনও অ আ ইতে দাগা বুলোচ্ছে। নেড়ু রামকালীর দাদা কুঞ্জর শেষ কুড়োত্তি। তেরোটা ছেলেমেয়ে মানুষ করার পর চৌদ্দটার বেলায় রাশ একেবারে শিথিল হয়ে গেছে কুঞ্জ আর তার পরিবারের। ছেলেটা বামুনের গরু হবে। আর কি!
কিন্তু মেয়ে-সন্তানের বোধ করি এত বেশী তলিয়ে ভাবতে শেখাও ভাল নয়, তাই রামকালী ঈষৎ ধমকের সুরে বলেন, থাম থাম, মেলা বকিস নি, পা চালিয়ে চল! গহীন অন্ধকার হয়ে গেছে দেখছিস!
অন্ধকার? হুঁ! সত্যবতী স-তাচ্ছিল্যে বলে, অন্ধকারকে আমি ভয় করি নাকি? এর চাইতে আরও অনেক অনেক অন্ধকারে বাগানে গিয়ে পেচার চোখ গুনি না!
অন্ধকারে কী করিস? চমকে ওঠেন। রামকালী।
সত্য থমমত খেয়ে বলে, ইয়ে আমি একলা নয়, নেড়ু আর পুণ্যপিসীও থাকে। পেঁচার চোখ শুনি।
হঠাৎ রামকালী হা-হা করে হেসে ওঠেন।
অনেকক্ষণ ধরে দরাজ গলায়। এই মেয়েকে আবার ধমকবেন কি, শাসন করবেন কি!
নির্জন পথে অন্ধকারের গায়ে সেই গম্ভীর গলায় দরাজ হাসি যেন স্তরে স্তরে ধ্বনিত হতে থাকে।
বাঁড়ুয্যেদের চণ্ডীপণ্ডপ থেকে উৎকীর্ণ হয়ে ওঠেন দু-একটি গ্রাম্য প্রৌঢ়।
গুনি।
একলা কি আর! নিশ্চয় ধিঙ্গী মেয়েটা সঙ্গে আছে। নইলে আর–
ওই এক মেয়ে তৈরি করছেন রামকালী। ও মেয়ে নিয়ে কপালে দুঃখু আছে।
আর দুঃখু! টাকার ছালা ঘরে, ওর আবার দুঃখু! শুনছি। নাকি বর্ধমানের রাজার কাছ থেকে লোক এসেছিল কাল, রাজার সভা-কবরেজ হবার জন্যে সাধতো!