তবু আজ রাতটা এখানেই থাকতে হচ্ছে অতনুকে। এঁরা অনুরোধ করেছেন। যে অনুরোধ অবহেলা করবার শক্তি হয় নি অতনুর। এঁরা অতনুকে ভালবাসেন, বিশ্বাস করেন। অতনুকে এঁদের ঘরের ছেলের মত মনে করেন।
ঘরের ছেলের মত মনে করেন বলেই তো ঘরের মেয়েকে তার হাতে তুলে দেবার কথা ভাবেন নি কেউ।
অতনুও কি শুধু সেই ঘরের ছেলের ভূমিকা অভিনয় করবার লোভে বিনা প্রতিবাদে নির্লিপ্ত হয়ে দেখল বসে বসে তার সম্পত্তি নীলেম হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু তাই কি? অতনু তখন কোন ভরসায় দাবী করবে? কী তখন আছে অতনুর? মা বাপ মরা ছেলে, দাদা বৌদির সংসারে থেকে লেখাপড়াটা করেছে মাত্র। ডাক্তারী পাশ করেছে? করেছে তো কী মাথা কিনেছে? অমন কত পাশকরা ডাক্তার গড়াগড়ি যাচ্ছে।
অমিতা এঁদের দামী মেয়ে না? রূপে গুণে আলো করা মেয়ে!
দামী আর সেরা বর খুঁজছেন না এঁরা মেয়ের জন্যে? অতনুর পাগলামী শুনলে হেসে উঠতেন না এঁরা?
এই জগন্ময়, যিনি এই একটু আগে কাতর হয়ে অতনুর হাত ধরে বলেছিলেন, তুমি থাকলে একটু ভরসা পাই বাবা! আর এখন সেই ভরসার জোরে পরম নিশ্চিন্ত চিত্তে গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছেন অতনুর থেকে গজখানেক তফাতে। কি বলতেন তিনি সেদিন?
যদি পাড়ার ছেলে অতনু তার দামী মেয়েটিকে চেয়ে বসত।
অতনু যদি আস্তে আস্তে উঠে চলে যায় এখান থেকে? এ ঘর থেকে? এ বাড়ি থেকে, এ দেশ থেকে? আজকের এই সৃষ্টিছাড়া জটিল পরিস্থিতিটা কি তাহলে সহজ হয়ে যাবে?
ঘুমের ওষুধ খাওয়া গাঢ় ঘুম থেকে উঠে আবার সহজ আর শান্ত হয়ে যাবে ওই ক্ষেপে যাওয়া মেয়েটা?
কিন্তু অতনুকে কি বলবে সবাই?
না, যা হোক একটা কিছু করে ফেলবার সামর্থ্য অতনুর নেই। কোনদিনই ছিল না। অতনু স্বাভাবিক। অমিতাও তো স্বাভাবিক ছিল। হঠাৎ এ কী হল?
অমিতা যদি পাগল হল তো এতদিন পরে কেন হল? সেই অনেকদিন আগে হল না কেন? যেদিন বিজয় আর জগন্ময় অমিতার জন্যে পাত্র দেখে এসে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন?
সেদিন কেন অমিতা আজকের মত পাগল হয়ে গিয়ে ভুল বকল না, কেন বলে ওঠেনি আমায় ছেড়ে দাও, আমার ছেড়ে দাও। আমি ওকে বিয়ে করব না! তোমরা আমায় মেরে ফেলছ, আমায় শেষ করে দিচ্ছ।
না, সেদিন পাগল হয় নি অমিতা।
হয়তো জীবনকে আর জীবনের নিয়মকে মেনে নিতে চেয়েছিল সে।
কিন্তু আশ্চর্য! এতদিন পরে এই মুহূর্তে সেই মেনে নেওয়ার ইচ্ছেকে বিসর্জন দিল অমিতা?
এই ঘণ্টাকয়েক আগেও দীপক বলেছে যা কিছু ছোড়দি! যা অসম্ভব খাটছে ছোড়দি! বিজয় তখন মিষ্টি মিষ্টি রবে হাঁক পেড়ে বলতে বলতে ছুটেছিলেন, আঃ এই চাবিটা বৌদির নিজের আঁচলে বাঁধবার যে কী দরকার ছিল! অমির কাছে থাকলে কোনও এদিক ওদিক হত না।
শুনে শুনে একটু আশ্চর্য হচ্ছিল বইকি অতনু।
কই আগে তো এমন ভারসই কর্মিষ্ঠি মেয়ে ছিল না অমিতা। বরং জয়াবতীর মুখে যখন তখন এই আক্ষেপই শোনা গেছে অমিটা কোনও কর্মের হল না। নমিতার আমার কত গোছ, কত ব্যবস্থা! না, তখন নমিতা মারা যায় নি।
কিন্তু নমিতা কি মৃত্যুকালে তার সব কর্মক্ষমতা অমিতাকে দান করে দিয়েছিল? তাই অকর্মা অমিতা এমন কাজের মেয়ে উঠল যে, সারা সংসার নাকি অমিতাই মাথায় করে রাখে।
মাথার যন্ত্রণাটা প্রবল হয়ে উঠেছে। ওষুধের ব্যাগটা কেন অতনু দীপকের ঘরে রেখে দিল? যদি নিজের কাছে রাখত, খেয়ে নিত একটু ঘুমের ওষুধ।
বোকামী করেছে। সারা জীবনই বোকামী করে এল অতনু।
মুখের উপর পাখা ঘুরছে। তবু শুয়ে পড়ে থাকা শক্ত হচ্ছে।
জগন্ময়ের নাকের গর্জন যেন একটা অশ্লীলতার মত চেতনায় এসে এসে বিঁধছে! তার চেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে ওই খোলা বারান্দাটায় গিয়ে একটু দাঁড়ানো ভাল। পায়চারি করবার জায়গা নেই, বারান্দার দুটো কোণই বোকই। ঘরে জায়গা বার করবার জন্যে এটা ওটা আজেবাজে বার করে জড় করে রাখা হয়েছে এখানে।
তবু ভাল, ওই তেঠেঙে বেতের চেয়ারটার ওপরই একটু বসা চলে। ধরানো চলে একটা সিগারেট।
কে ভেবেছিল অতনুর কোনও একটা রাত এ বাড়িতে কাটবে?
বাড়ির ছেলের মত হলেও রাত কাটাবার প্রশ্ন উঠবে কি ভাবে? ওর বাড়ি যে কাছেই। নমিতার বিয়ের রাত্রে, বিজয়ের বৌভাতের রাত্রে, মনে আছে অতনুর অনেক রাত পর্যন্ত এ বাড়িতে হইহুল্লোড় করে পান খেয়ে সিল্কের পাঞ্জাবিতে পানের রস ফেলে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ও বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়েছিল।
একথা কেউ ভাবে নি, আহা এখানেই থাকুক না!
আজ জগন্ময় বললেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ক্রমশই দূরত্ব এসেছিল। অতনুর বৌদিই তার কিছুটা কারণ। তিনিই প্রথম প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন অলক্ষিত জগতে কোথাও একটি হৃদয়ঘটিত ব্যাপার রয়েছে।
সেই অনুক্ত অনুচ্চারিত বস্তুকে যখন তখন তিনি বক্রোক্তির সুতীক্ষ্ম কৌশলে উচ্চারণ করে বসতেন। আর প্রশ্ন করতেন, অতবড় মেয়ে ওদের ঘরে, এই সব পাড়ার ছেলেদের দিব্য অবারিত দ্বার করে রেখেছে?
অথবা আরও সুকোমল প্রশ্নে বলতেন, কিসের আশায় নিত্য ধরণা দাও ভাই ওরা কি তোমার মত সস্তা ছেলের হাতে মেয়ে দেবে?
হোপসেল! অসহ্য! এমনি ছোটখাটো মন্তব্যে বৌদির স্থূল রসিকতাগুলোকে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করত অতনু, কিন্তু কুণ্ঠাকে উড়িয়ে দিতে পারত না। ধীরে ধীরে আপনিই নিয়ন্ত্রিত হয় গিয়েছিল গতিবিধি।