- বইয়ের নামঃ দোলনা
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. কুমারী মেয়ে
দোলনা — উপন্যাস– আশাপূর্ণা দেবী
কুমারী মেয়ের পক্ষে এহেন কাজ শুধু যে অস্বাভাবিকই তা নয়, রীতিমত গর্হিতও। অথচ সুমনা সেই গর্হিত আর অস্বাভাবিক কাজটাই করে বসেছে। আর তার জের চালিয়ে যাবার জন্যে মরণপণ করেছে।
মাথায় হাত দিয়ে পড়েছে বাড়ির সবাই। ভেবে পাচ্ছে না কী উপায়ে ওকে এই বিপজ্জনক খেয়াল থেকে মুক্ত করা যাবে। শুধু খেয়াল বললেও বোধহয় ঠিক হয় না। এ তো একেবারে পাগলামি। পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে নাকি আছে একথা, সাময়িকভাবে কখনও কখনও কাউকে উন্মাদরোগ আশ্রয় করে, কিন্তু সুমনাদের সংসার কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি তাদের সবচেয়ে দামি মেয়েটাই তেমন একটা আশ্রয়স্থল হবে।
.
সুমনার মা সুজাতা প্রথমটা তো সুমনার এই অসম সাহসিক কীর্তিতে হইচই, রইরই করে উঠেছিল, আর সুমনার বাবা কান্তিকুমার ভ্রূকুটি করে বলেছিলেন, পাগল নাকি?
কিন্তু অতঃপর যখন দেখা গেল পাগলের আচরণই করছে সুমনা, তখন কান্তিকুমার ধরলেন ধমক, আর সুজাতা সদুপদেশ।
প্রথমে রঙ্গমঞ্চে ছিল মাত্র ওই দুটি কুশীলব। কারণ এখানে সাঁওতাল পরগনার এই স্বাস্থ্যের জন্যে বিখ্যাত গ্রামটিতে মাত্র তিনজনই এসেছিলেন ওঁরা। মা বাপ আর মেয়ে।
কলকাতায় একান্নবর্তী বড় পরিবার, সেখানে বাকি ছেলেমেয়েদের রেখে আসতে অসুবিধে হয়নি। সুমনার জন্যে আসা। কিছুদিন যাবৎ লিভার-দোষে ভুগছিল সুমনা। তাই বি. এ. পরীক্ষাটা শেষ হতেই মেয়ে নিয়ে স্বাস্থ্যোদ্বারে এসেছিলেন কান্তিকুমার। কে জানত শারীরিক স্বাস্থ্য-অর্জন করে ফেরার মুখে সে হঠাৎ এমন মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
ব্যাধিগ্রস্ত ছাড়া আর কী!
হিতাহিতজ্ঞান হারানো মানেই ব্যাধি।
সুজাতা বলে, সুমি, একবার খোলা বুদ্ধি আর ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখ, তুই যা করতে চাইছিস, সেটা সঙ্গত কিনা। আমি কিছু বলছি না, তুই নিজেই ভেবে দেখ। ওই জীবটার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে, সেন্টিমেন্টকে সরিয়ে রেখে চিন্তা কর। কলকাতার বাড়িটা আর সেখানের সকলের মুখ মনে কর, তারপর ভাব তুই কী করতে চাইছিস।
সুমনা নিচু করে রাখা মাথাটা উঁচু করে বলে, ভেবেছি, অনেক ভেবেছি।
ভেবেছিস! ভেবে তুই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিস!সুজাতা ক্ষোভ আর হতাশাজড়িত কণ্ঠে বলে, তা হলে তোর বাপ যা বলেছে, তাই ঠিক। তুই পাগলই হয়ে গেছিস।
সুমনা উত্তর দেয় না, জানলার পথে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কান্তিকুমার গম্ভীরমুখে বলেন,তুমি কি চাও সমাজে আর আমাদের মুখ তুলে দাঁড়াবার উপায় না থাকে?
সুমনার চোখটা ছলছল করে আসে।
বাবার কাছে এমন বকুনি খাওয়াটা বোধহয় তার এই প্রথম। নিষ্ঠুর কঠিন বকুনি। বাবার কাছে বকুনি খাওয়ার বিষয়বস্তুটা প্রায়শই থাকে স্বাস্থ্য-বিধি মেনে না চলা।
সুমি, ওষুধ খাসনি?…সুমি, এই জোলো হাওয়ায় ওই পাতলা জামা পরে বেড়াচ্ছিস?… সুমি, তোমার মার কাছে শুনলাম তুমি নাকি ফলের রস খেতে চাও না! সাধারণত এই হচ্ছে বাবার বকুনির ভাষা।
কিন্তু সুমনার এই দুঃসহ জেদের নির্লজ্জতায় কান্তিকুমারের সেই স্নেহপ্রবাহ শুকিয়ে গেছে। আজ তিনি মেয়ের মুখ শুকনোর কথা ভাবছেন না, সমাজে নিজের মুখ না থাকার কথা ভাবছেন।
বাবার কথায় সুমনার চোখে জল এলেও কষ্টে সে জল চোখে আটকে রেখে বলে সুমনা, এতে আর তোমাদের দোষ কী? তোমাদের কেন–
কান্তিকুমার ভুরু কুঁচকে বলেন,তুমি শিশু নও সুমনা! আমাদের কেন, সেটুকু বোঝবার ক্ষমতা তোমার আছে। তোমার অসুস্থতা নিয়ে আমরা দুমাসের জন্যে চেঞ্জে এসেছি, এটাই সকলের জানা, হঠাৎ যদি এরকম একটা ব্যাপার নিয়ে ফেরা হয়, তা হলে
চুপ করে যান কান্তিকুমার।
আর বেশি বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় বলেই চুপ করে যান, কিন্তু আর বেশি বলার কি দরকারই ছিল? যথেষ্ট কি বলা হয়নি?
সুমনার গলা বুজে আসে।
যে তর্ক মায়ের সঙ্গে করেছে, সে তর্ক বাবার সঙ্গে চালাতে পারে না। বাষ্পভরা কণ্ঠে বলে, বেশ, আমার জন্যে যদি তোমাদের মুখ নিচু হয়, তোকসমাজে অপমানিত হতে হয়, আমাকে তোমরা ত্যাগ করো।
কান্তিকুমার স্তব্ধ।
কান্তিকুমার বিমূঢ়।
অনেকক্ষণ পরে নিশ্বাস ফেলে বলেন, আমরা তোমায় ত্যাগ করব!
তা ছাড়া যখন উপায় নেই
সুমনা গলাটা পরিষ্কার করে নেয়।
তা ছাড়া উপায় নেই? চমৎকার!কান্তিকুমার ক্ষুব্ধ বেদনার্ত কণ্ঠে বলেন, এ ছাড়া সমাধানের আর কোনও পথ তোমার মাথায় এল না, কেমন? আশ্চর্য!
সুমনা কথা বলে না। সুমনা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুমনা কি ওই আকাশের কাছে আশ্রয় খোঁজে? সুমনা কি আকাশের কাছে শক্তি খোঁজে?
কান্তিকুমার উত্তর সম্পর্কে একটু অপেক্ষা করে তারপর আবার বলেন, তোমার পক্ষে ওটাকে ত্যাগ করা সম্ভব নয় তা হলে। তার বদলে বরং আমাদেরও ত্যাগ করতে প্রস্তুত? সুমনা, আমি কি তা হলে সত্যিই বিশ্বাস করব, তুমি পাগল হয়ে গেছ?
সুমনা মাথা নিচু করে বলে, বাবা! বুঝতে পারছি তোমাদের খুব একটা বিপদে আমি ফেলছি। তাই ওকথা বলতে পেরেছি। কিন্তু সত্যি এও ভাবছি, এটা মেনে নেওয়া কি এতই অসম্ভব তোমাদের পক্ষে? ইচ্ছে করলে কি
হয় না সুমি, হয় না,কান্তিকুমার আবেগভরে বলেন, তা যদি সম্ভব হত, তোমাকে এত করে বলতে হত না। তোমার বোধশক্তি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে বলেই বুঝতে পারছ না এটা কতখানি অসম্ভব।
কিন্তু বাবা
বলতে গিয়ে থেমে যায় সুমনা।
যা বলতে যায়, পারে না।
কান্তিকুমার মেয়ের ওই রুদ্ধ অভিমানে ভরা যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন, মনটা পীড়িত হয়, বিগলিত হয় না। না, কেউ যদি আপন দুর্মতিতে কষ্ট পায়, সে যতই স্নেহভাজন হোক, তার জন্যে মন গলে না। তাই স্থির স্বরে বলেন, বলো, কী বলতে চাও। থামবার দরকার নেই।
বাবা!
জলভরা দু চোখ বাবার মুখের দিকে তুলে সুমনাও স্থির স্বরে বলে, আমায় তোমরা ক্ষমা করো। আমাকে নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নিতে দাও। মাঝে মাঝে তোমাদের আদর করে উপহার দেওয়া টাকা তো অনেকগুলো জমেছে আমার, আর কতগুলো গয়নাও রয়েছে–
ধৈর্যের বাঁধ আর থাকে না।
কান্তিকুমার সংযত সভ্য মার্জিত। কান্তিকুমার পরিজনের কাউকে কখনও উঁচু কথাটি বলেন না। তবু কান্তিকুমার রক্তমাংসের মানুষ। তাই মেয়েকে কথা শেষ করতে দেন না। প্রচণ্ড একটা ধমকে থামিয়ে দেন তাকে। সেই ধমকের চেহারাটা এই, সুমনা, ধৃষ্টতারও একটা সীমা থাকে। আমি তোমার এই বিদঘুটে খেয়ালকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেব না। ভেবেছিলাম, বুঝিয়ে সুঝিয়ে তোমার স্বাভাবিক বুদ্ধি ফিরিয়ে আনতে পারব। দেখছি তা হচ্ছে না। ঠিক আছে, জোরই খাটাতে হবে। কালই তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে। আর একলাই যাবে।
সুমনা বোধ করি ধমক খেয়েই কঠিন হয়ে যায়। সেই জলভরা চোখ শুকিয়ে ওঠে মুহূর্তে। বলে, আর ও?
ওর যা উপযুক্ত ব্যবস্থা, আমি যে করে পারি করব।
সুমনা বাপকে আঘাত করবে বলেই কি আঘাত করে? না, এ তার অসতর্কতা? কিন্তু চোখের কোণে তার আগুন ঝলসে ওঠে, ওর পক্ষে যা সবচেয়ে উপযুক্ত সেটাই তো সব চেয়ে সোজা বাবা! তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের একটা ছুরি সুমনার অমন নরম গড়নের ঠোঁটের রেখায় উঁকি মারে, সেটাই বোধ করি ভেবে ঠিক করে রেখেছ?
কান্তিকুমার স্তব্ধ হয়ে যান।
ওই আগুন ছিটকানো চোখ, আর ওই ব্যঙ্গের ছুরি উঁচনো ঠোঁট, এ কি বুদ্ধিভ্রংশের? সুমনা পাগল হয়ে গেছে, এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দেবার পথ আছে?
না।
মনকে সান্ত্বনা দেবার নেই।
তাই মনকে স্থির করে ফেলেন কান্তিকুমার। স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলেন,ঠিক আছে। একথা যখন বলতে পারলে তখন তোমার স্বেচ্ছাচারিতায় আর বাধা দেব না। যা কিছু ঘটতে থাকবে, অবশ্যম্ভাবী বলেই মেনে নেবার জন্যে মনকে প্রস্তুত করে নেব। একটু আগে পর্যন্তও মনে হচ্ছিল, তুমি আমাদের সম্পত্তি, তুমি আমাদের সেই ছোট্ট সুমনা। বুঝতে না পেরে একটা ভুল করতে চাইছ, তাই চেষ্টা করছিলাম বোঝাতে। নিজেই বুঝতে পারছিলাম না তুমি আস্ত একটা মানুষ। বুঝতে পেরেছি। আর ভুল হবে না।
স্ত্রীর কাছে এসে বলেন, ও যা করতে চাইছে করতে দাও। তারপর দেখা যাবে ভাগ্য কী বলে।
ও যা করতে চাচ্ছে তাই করতে দেব? সুজাতা ঝংকার দিয়ে ওঠে, জীবনভর মেয়ের যথেচ্ছাচার আর যাবতীয় আবদারকে প্রশ্রয় দিয়ে এইটি করে তুলেছ। আরও তিনটে ছেলেমেয়ে আছে তোমার, কই, তাদের তো এত আদর দাও না!
কান্তিকুমার এত দুঃখেও একটু হাসেন।
বলেন,ঠিক এই কথাটা আমিও তোমাকে বলতে পারতাম, কিন্তু বলব না। পুরুষ জাতটা যতই অত্যাচারী হোক, নিষ্ঠুর নয়। সুমনা আমাদের প্রথম সন্তান, আর অনেকদিন পর্যন্ত একটিমাত্রই সন্তান ছিল, সেই থাকার সুযোগ ও শুধু আমার কাছ থেকেই নয়, বাড়িসুষ্ঠু সকলের কাছ থেকেই পেয়েছে। সেই অতিরিক্ত পাওয়াটা যদি ওকে বিকৃত করে থাকে, জেদি করে তুলে থাকে, সকলকেই তার ফল ভোগ করতে হবে। কাল যাবার ব্যবস্থা করো।
ওই আঁস্তাকুড়টাকে নিয়েই?
হ্যাঁ!
কান্তিকুমারের ফেরবার কথা ছিল আরও কিছুদিন পরে। কিন্তু পরিস্থিতিটা এমন অদ্ভুত ঘোরালো হয়ে উঠেছে যে, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যা ভাবছিলেন তা হল না।
ভেবেছিলেন, এখান থেকে পালাতে পারলেই সুমনার মনকে ঠিক করে ফেলতে পারবেন। সহসা যাতে বিভ্রান্তি এসেছে সুমনার, সেটা থেকে সরে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু সুমনা সব ভেস্তে দিচ্ছে।
অতএব
কান্তিকুমার বলেন, আমার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে চলার পথে কোনওদিন তো ঠেক খাইনি, সুমসৃণ বাঁধা রাস্তায় জীবনের রথ চালিয়ে নিয়ে চলেছি, কোনওদিন পথ আড়াল করে দাঁড়ায়নি ভাগ্যের প্রতিকূলতা, দুঃখ দুশ্চিন্তার ঝড়। এখন যদি আসেই সে সব, সইতে হবে। রাগ করলে চলবে কেন? অসহিষ্ণু হলে চলবে কেন? জীবনের প্রাপ্য পাওনা বলে মেনে নিতে হবে।
অতএব
চলুক সুমনার সঙ্গে তার সাধের শৃঙ্খল।
অতএব কলকাতায় ছোট ভাইকে টেলিগ্রাম করে দিলেন কান্তিকুমার, আমাদের মেয়াদের আগেই ফিরে যাচ্ছি। হয়তো একরকম বাধ্য হয়েই। আমাদের সঙ্গে আরও একটি প্রাণী যাচ্ছে। তার জন্যে হয়তো সংসারে কিছু সংঘর্ষ উঠবে, কিন্তু উপায় নেই।
সুজাতা তবু হাল ছাড়ে না।
আবার আসে মেয়ের কাছে।
তার দুর্বলতার জায়গাটা নাড়া দেয়। বলে, তুই যে এম. এ. পড়বার জন্যে এত উৎসাহ করছিলি, জলাঞ্জলি দিবি তাতে?
সুমনা ফিকে হাসি হেসে বলে, বি, এর রেজাল্টই বেরোক আগে।
এটা অবশ্য উত্তর নয়, উত্তর এড়ানো। সুজাতা বলেন, রেজাল্ট বেরোবেই না, না পাস করবি না, কোনটা ভাবছিস?
কোনও কিছুই এখন ভাবছি না মা আমি। ভাবতে পারছি না।
তা পারবি কী করে?সুজাতা তীব্র স্বরে বলে, ভূতে আশ্রয় করলে কি আর চিন্তাশক্তি থাকে? ভূত যে সেইখানেই আশ্রয় করে। কিন্তু সুমি, আমি তোর মা, আমার কথা শোনা উচিত, এই ভেবেই শোন। বুদ্ধি একটু ঠিক করে, দৃষ্টিশক্তি একটু পরিষ্কার করে ভেবে দেখ, মেয়েমানুষ তুই, অকারণ যেচে একটা নিন্দে কলঙ্ক মাথায় তুলে নিবি কেন?
সুমনা মায়ের মুখের দিকে তাকায়, মার প্রত্যাশাপূর্ণ কাতর মুখের দিকে। দেখে মায়াও হয়। বুঝতে পারে, তার অল্পবুদ্ধি ভালমানুষ মা মনে করছে, এই অস্ত্রে মেয়েকে কাবু করে ফেলতে পেরেছে, তাই মুখে ওই প্রত্যাশার ছাপ।
কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণের উপায় সুমনার হাতে নেই। তাই সুমনা মার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, কিন্তু আমি শুধু মেয়েমানুষইনই মা, মানুষও। মানুষের ধর্মে মানুষের নীতিতে যদি মেয়েমানুষের নীতি-ধর্মে সংঘর্ষ হয়, মানুষের নীতিটাই গ্রহণ করতে হবে।
সুজাতা স্বামীর মতো মেয়ের মতো অত ভাল ভাল কথা বলতে জানে না। সোজা কথাই সতেজে বলে, তা রাজ্যিসুদু মানুষ তোর মতো করছে?
সকলের জীবনে একই সমস্যা এসে পড়ে না মা!
সুজাতা এইবার নিজের চিন্তার কথাই খোলাখুলি বলে, সংসারটি তো শুধু আমার নয় সুমি যে, সেখানে মানুষের ধর্ম, দয়া ধর্ম, সব কিছু চালাতে বসব? পাঁচজনে যখন পাঁচ কথা বলবে?
কথা তো একটা অদৃশ্য পদার্থ মা! সুমনা হেসে ওঠে,ওকে বস্তু মনে করে কষ্ট না পেলেই হল। বলুক না পাঁচজনে পাঁচশো কথা!
সুজাতা তীব্র স্বরে বলে, বাতাসও একটা অদৃশ্য পদার্থ সুমি! কিন্তু সেই অদৃশ্যটা যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন সেটা ঝড়, তাকে আর অদৃশ্য বলে অগ্রাহ্য করা যায় না, বুঝলি?
সুমনা এক মিনিট চুপ করে থেকে বলে,আমি তো বাবাকে বলছি মা, আমায় তোমরা ত্যাগ করো!
বাবাকে বলছি, আমায় ত্যাগ করো!
সুজাতা স্তম্ভিত হয়ে বলে, এই কথা বলেছিস তুই ওঁকে?
তা আর যখন পথ দেখছি না। সংসারের পাঁচজনের কাছে মুখ থাকাটাই যখন তোমাদের কাছে প্রধান প্রশ্ন, তখন
বুঝেছি! তাই মানুষটা অমন কাঠ হয়ে গেছে। দয়া ধর্মের কথা বলছিস সুমি, ওঁর মুখের উপর ওই কথাটা বলতে তোর দয়া ধর্মে বাধল না?
সুমনা চুপ করে থাকে।
সুজাতা গম্ভীর ভাবে বলে, এতবড় কথাটাই যখন বলতে পেরেছিস সুমি, তখন আমিও বলি, ত্যাগ করলে তোর ওই ওটাকে নিয়ে এত আদর আদিখ্যেতা চলবে কীসের উপর?
ভাবছি ভাগ্যটাকে একবার দেখি না?
ও! তা সেটা দেখবি একটা পথে-পড়ে-থাকা হতভাগার সঙ্গে ভাগ্যকে জুড়ে?ভালমানুষ হলেও, সরল হলেও, মরিয়া বলে একটা কথা আছে। সুজাতা মরিয়া হয়ে উঠেছে বলেই ওর মুখে তীব্র ব্যঙ্গের ভাষা ফোটে। তার ভাগ্য তো চোখের উপরই দেখলে? সেই অবস্থাটা নিজেরও চাও? তোমার মতন বয়েসের একটা মেয়ে ওইরকম একটা বোঝা কাঁধে নিয়ে, ঘরবাড়ি মা বাপের আশ্রয় ত্যাগ করলে, তার বি. এ., এম. এ. পাস খুব বেশি কাজে লাগে না সুমি! পথ থেকে রসাতলের পথে যেতে হয়।
তা বুঝব, সেটাও ভাগ্য!
তবু নিজের গোঁ ছাড়বি না? লক্ষ্মীছাড়া মুখ মেয়ে।
গালাগাল দিচ্ছ? সুমনা হেসে ওঠে, তা দাও, মস্ত একটা লাভও আমার হচ্ছে মা। অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। ধরতে পারছি, স্নেহ কী, ভালবাসা কী, কোথায় তার শিকড়, কী তার মূল্য।
অদ্ভুত কঠিন দেখায় সুমনার ওই হাসিমাখা মুখটা।
সুজাতা মেয়ের ওই পরিচিত কঠিন মুখটার দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে উঠে যায়।
মা চলে যেতে সুমনাও আস্তে আস্তে ঘরের কোণের দিকে সরে আসে। দেখে, যে প্রাণীটাকে নিয়ে এত সমস্যা, এত সংঘর্ষ, এত হৃদয়-দ্বন্দ্ব, সে ঘুমিয়ে আছে অঘোরে; পৃথিবীর সমস্ত ধূলি মালিন্যের অতীত দেবতার মতো মুখখানি নিয়ে।
আশ্চর্য!
মানুষ কী ছোট!
বুদ্ধি পাণ্ডিত্য শিক্ষা সভ্যতা, দয়া ধর্ম মনুষ্যত্ব, কত কিছুরই বড়াই তার!
তবু কী ছোট!
এত ছোট যে, এতটুকু এটুকু ছোট্ট জিনিস সহ্য করে নেবার শক্তি নেই তার।
.
সুজাতা এই দেড় মাসের পাতানো সংসারটাকে গুটিয়ে তুলতে তুলতে চোখের জলে ভাসছিল।
কী কুক্ষণেই এসেছিল সে এই শিমুলতলিতে মেয়ের শরীর সারাতে। বলতে গেলে একরকম জোর করেই এসেছিল।
ছোট মেয়ে অঞ্জনার স্কুল পরীক্ষা সামনে, অভীক অজীন দুই দুরন্ত ছেলে, তাদের দায়িত্ব জা-শাশুড়ির ওপর চাপিয়ে চলে আসতে চাওয়ায় খুব একটা প্রসন্নও ছিল না কেউ; কান্তিকুমারও বলেছিলেন,ওদের রেখে যাওয়া–তার চাইতে সুমিকে নিয়ে আমিই বরং একা কোথাও।
সুজাতা ঝংকার দিয়ে বলেছিল, তুমি একা কোথায় নিয়ে যাবে শুনি? যেখানেই যাও, উঠবে তো সেই হোটেলে? সেখানের রান্না ওর সহ্য হবে? রোগ ধরার মূল কারণটিই তো ওই। ভুলে যাচ্ছ বুঝি?
ভুলেই গিয়েছিলেন।
মনে পড়ল কান্তিকুমারের।
গত পুজোর সময় দুই মেয়ে আর দুই ভাইঝিকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্যে রাঁচি বেড়াতে গিয়েছিলেন। অতএব হোটেল ছাড়া আর গতি কী।
তা সেই হোটেলের ঝালমসলা সংযুক্ত রান্না আর শক্ত ভাতই নাকি সুমনার স্বাস্থ্যভঙ্গের কারণ। অন্তত সুজাতার তাই ধারণা। কান্তিকুমার অতএব চুপ।
সুজাতা নিজের স্বপক্ষে আরও যুক্তি খাড়া করেছিল, ছেলেমেয়ে তিনটিকে রেখে যেতে তোমার তো ভাবনার শেষ নেই, একান্নবর্তীতে থাকার আর সুখটা কী তা হলে? আমাকে বারোমাস অন্যের দায় পোহাতে হচ্ছে না? এই যে ছোটবউ যখন-তখন বাপের বাড়ি চলে যায়, থাকে না ওর মেয়ে? স্কুলের ছুটি-অছুটি বাছে ছোটবউ? দিদি যে সমস্ত পালা পার্বণে গুরু আশ্রমে যাচ্ছেন, থাকে না ওঁর ছেলেটি?
কান্তিকুমার এত খোলাখুলি এইসব স্কুল কথা আদৌ সহ্য করতে পারেন না, অথচ সুজাতার কথার এই-ই ধরন।
ও স্বামীর কাছে যা বলে স্পষ্ট বলে।
আর সত্যি, সকলের কাছেই তো রেখে ঢেকে কথা বলতে হয়, স্বামীর কাছেও যদি মনের কথা খুলে না বলতে পারে, বাঁচবে কী করে?
আসলে শাশুড়ি জায়েদের অপছন্দ ভাবটাই সুজাতার জেদকে উসকে দিয়েছিল। কেন যাবে না সে? যাবার জন্যে উপযুক্ত একটা কারণ যখন উপস্থিত হয়েছে। স্বামীর এত রোজগার, ইচ্ছে করলে কত কীই তো করতে পারে সুজাতা। কিন্তু কে কী ভাববে ভেবে করতে পারে না।
এবার মনের জোর করে এসেছিল।
কিন্তু ভগবান এমন বাদী যে, সেই কে কী ভাবারই মস্ত একটা কারণ নিয়ে ফিরতে হচ্ছে তাকে।
এই যদি শুধু স্বাস্থ্যে টলমল মেয়েকে নিয়ে ফিরতে পারত সে, সবাইকে তো বড় মুখ করে দেখাতে পারত! বলতে পারত, পাঁচজনের মুখ না চেয়ে, জোর করে চলে গেলাম বলেই না এইটি হল।
এই একমাসেই তো যথেষ্ট কাজ হয়েছিল। সেরে উঠেছিল সুমনা। মুখের সেই পাণ্ডুর ভাব, শরীরের সেই ক্লান্ত ঢিলে ভাব, সব দূর হয়ে গিয়েছিল। ইদানীং কতখানি করে হাঁটতে পারছিল।
হাঁটতে পারছিল!
অনেকখানি করেই পারছিল।
ভাবতে গিয়ে থমকে গেল সুজাতা।
যেন হোঁচট খেল।
অতটা না পারলেই বুঝি ভাল ছিল। যদি না পারত, তা হলে তো চলে যেত না না সেই সাঁওতাল বস্তি ছাড়িয়ে জঙ্গলের ধারে।
অবাক হয়ে যাচ্ছে সুজাতা, কদিন ধরেই ভাবছে আর অবাক হচ্ছে, সুজাতার ভাগ্যেই ঠিক সেই সময়, ঠিক সুমনার চলার পথের ধারে, পড়ে থাকতে হয় সুজাতার শাস্তির শনি?
একদিনই তো মাত্র অতটা হেঁটে গিয়েছিল সুমনা।
সুজাতা কেন একা ছেড়েছিল মেয়েকে?
ভাবল সুজাতা। মনের কপালে করাঘাত করল। সুজাতা যদি সঙ্গে থাকত, তা হলে কি সুমনা এই অঘটনটা ঘটিয়ে তুলতে পারত? পারত না, ছুঁতেই দিত না সুজাতা।
এখানেও একবার হোঁচট খেতে হল সুজাতাকে। দিত না! সে জোর কি আছে সুজাতার? ছোট থেকে কখনও পেরেছে মেয়ের কোনও খেয়ালকে নিবৃত্ত করতে? সেই কোন ছোটবেলা থেকে পথের জিনিস কুড়িয়ে কুড়িয়ে ঘরে এনে তোলেনি সুমনা!
মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো রাস্তার কুকুরছানা নিয়ে এসেছে তিন-তিনবার। যখন-তখন কোথা থেকে না কোথা থেকে এনেছে কুচি কুচি বেড়ালছানা।
সবাই ঘিন ঘিন করেছে, ছি ছি করেছে, সুজাতা পর্যন্ত ছাড়েনি দুর দুর করতে, কিন্তু সুমনাকে টলাতে পারা যায়নি। তাদের বুকে করে বসে থেকেছে, নিজের দুধ থেকে দুধ খাইয়েছে, নিজের জামা ফ্রক পেতে শুইয়েছে। তাদের মানুষ করে তুলতে জীবন পণ করেছে।
আজও রাস্তার জিনিস কুড়িয়ে এনে ঘরে তুলেছে সুমনা। শুধু এটা কুকুর বেড়ালের ছানা নয়, মানুষ ছানা। কিন্তু কুকুর বেড়ালের চাইতে কি উচ্চ পদ দেবে কেউ তাকে? মানুষ বলে গণ্য করবে?
সুজাতা নিজেই কি তা করছে?
করছে না।
সুজাতা সবসময় সিটিয়ে আছে। আর ভাবছে, ওই জঙ্গলের ধারে, শেয়াল কুকুরের মুখ থেকে রক্ষা পেল কী করে জীবটা? নিদেনপক্ষে সাঁওতালিরাও তো নিয়ে যেতে পারত।
তা নয়, সুজাতার সংসারের শান্তি নষ্ট করতে সমস্ত কিছুর চোখ এড়িয়ে বেঁচে রইল হতভাগাটা।
রাক্ষস! রাহু! শনি!
কুকুর বেড়ালের মতোই ঘৃণ্য, অথচ তাদের মতো সমস্যাহীন নয়।
ডাস্টবিনের কুকুরকেও কেউ অপবিত্র বলে না। তাদের জন্মের শুচিতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সাবান দিয়ে ধুয়ে তুলে নিয়েই বিছানায় বসায়, কোলে বসায়।
হঠাৎ স্বামীর ওপর রাগে সর্বশরীর জ্বালা করে উঠল সুজাতার। হাতের কাজ ফেলে বসে পড়ল সে। উনি, ওই উনিই এর কারণ। ছোটবেলায় যখন মেয়ে পথ থেকে কুকুর বেড়ালের ছানা কুড়িয়ে এনেছে, বাড়ির সবাই মারমুখী হয়ে দুর দুর করেছে, কান্তিকুমারই মেয়েকে আহ্লাদ দিয়ে বলেছেন,আহা থাক না! কচি মনের মায়াটাকে অমন করে মরিয়ে দিও না।
এখন?
এখন নিজেই কেন অমন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন কান্তিকুমার? কই, মেয়ের কোমল মায়াটুকুকে তো আদর করে আহা বলতে পারছেন না? গুম হয়ে গেছেন কেন?
সুজাতা ভাবল, জীবনে মানুষ বহু যন্ত্রণা সহ্য করে নেয়। অনিবার্য বলেই নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু যা অনিবার্য নয়, সম্পূর্ণ উড়ো আপদ, তাকে মেনে নেওয়া যায় কী করে? মন যে বিদ্রোহী হয়েই থাকে। না না, সুমনার খেয়ালে সৃষ্ট এই বিপদের যন্ত্রণা সহ্য করে নেওয়া হবে না।
উঃ, সেদিনটাকে যদি স্লেটের লেখার মতো হাত দিয়ে মুছে দিতে পারত সুজাতা।
সেই ক্রুর কুটিল দিনটাকে।
অথচ সেদিনটা তার দুমিনিট আগে পর্যন্তও ভারী মনোরম একটি চেহারা নিয়েই প্রকাশিত ছিল। বড় সংসারের অন্তরালে বড় রোজগেরে স্বামীকে তো চক্ষে দেখতেই পায় না সুজাতা। অথচ কোন ফাঁকে যে বেড়ে গেল বয়েস, চল্লিশে পা ফেলল!
পুজোয় কোর্ট অনেকদিন করে বন্ধ থাকে, অনেকদিন ধরেই তো বেড়িয়ে বেড়াতে পারে সুজাতা নিজের ছেলেমেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে। কিন্তু তা হয় না। বাড়ির আরও অনেক সমস্যাকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে, অনেক সমারোহ করে হয়তো বারোটা পনেরোটা দিন বেড়িয়ে আসেন কান্তিকুমার। পনেরো দিনেই টাকার ঘন্ট হয়ে যায়।
হয়তো বা এমনও হয়, সুজাতাই সে যাত্রায় নেই। সংসারে অসুবিধে, মায়ের শরীর খারাপ, ছোটবউ বাপের বাড়ি, এসব নানা প্রতিবন্ধকে বড়রা থেকে গেল, কান্তিকুমার ছেলেমেয়ে ভাইপো ভাইঝি ভাগ্নে ভাগ্নীর একটি শোভাযাত্রা করে বেড়াতে গেলেন।
বাড়িতে মেয়েদের মধ্যে সুমনাই বড়।
আর সুমনাই ভরসাই।
সুমনার ভরসাতেই ওইসব কুচোকাঁচাও যাত্রার পারমিট পায়। আর এ যাবৎ সুমনার ভিতরকার ওই মাতৃস্নেহটুকু সুমনার সদ্গুণ বলেই কীর্তিত হয়েছে।
কিন্তু সবেরই তো একটা সীমা আছে।
সেদিন তাই স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সুজাতা। সুমনার সীমাহীন সাহসিকতায়।
যখন সুমনা বুকের কাছে ওটাকে জাপটে ধরে সামনে এসে দাঁড়াল, সুজাতা তখন নিজে হাতে রাত্রের রান্না করছিল। মেয়ে যেটি ভালবাসে। স্বামী যেটি ভালবাসে। মনটা খুশিতে ভরা।
এতদিনে মেয়ের খিদে হয়েছে, রুচি হয়েছে, সুজাতা যেদিন যেটি রাঁধছে, মহোৎসাহে খাচ্ছে। এমনকী চির উদাসীন স্বামী পর্যন্ত মাঝে মাঝে বলে ফেলেন, তা এইসব ভাল ভাল রান্নাগুলো কলকাতার বাড়ির ঠাকুরকে শিখিয়ে দিতে পারো না? এতসব জানো৷
সুজাতা মুখে বলে, হ্যাঁ, শেখালেই শিখছে যে! যে আসে সেই তো নিজেকে মস্ত একটি পাকা রাঁধুনি বলে জাহির করে। যে খুন্তি ধরতে জানে না, সেই বলে, সায়েব বাড়ি কাজ করে এসেছি।
কিন্তু মনে মনে বলে, সেই বারো ভূতের বাড়িতে এইসব শৌখিন রান্না! আর জানো না তো ফৈজৎ কত। তোমার মায়ের এক আতপ চালের হেঁসেল, তোমার বোষ্টম দাদা বউদির এক পিয়াজ মাংস বর্জিত আমিষ হেঁসেল, আবার অমেধ্য ভোজনকারীদের আর এক হেঁসেল। আর তারাই তো জাতিচ্যুত। যারা মাংস খায় তারা তো পতিত। তাদের জন্যে বরাদ্দর ব্যবস্থাও নগণ্য।
মনের কথা মুখ ফুটে বললে কান্তিকুমার বিরক্ত হবেন, সেকথা হাড়ে হাড়ে জানা সুজাতার। কখনও কখনও অন্য বিষয়ে বলে ফেলে, কিন্তু খাওয়াদাওয়ার ব্যপারে নৈব নৈব চ। কে জানে বা স্বামী কী মেজাজে ঝপ করে বলে বসবেন, এসব খেয়ে আর সহ্য হচ্ছে না আমার।
সুজাতার নিজের হাতে গড়া এই দেড় মাসের সংসারটিই এখন সুজাতার জীবনের অক্ষয় সঞ্চয়।
সুমনা অবশ্য মাঝে মাঝে বলে, বাবাঃ সারাদিন কী এত কাজ! এত খাটতেই পারো তুমি মা।
কিন্তু সুজাতা সেকথা হেসে ওড়ায়। এইটুকু সংসারের কাজ আবার কাজ! কলকাতার সেই মস্ত সংসারের শুধু দুধ জলখাবারও যে এ খাটুনির চতুগুণ! নাঃ! এবার থেকে জোর করেই প্রত্যেক বছর বেরিয়ে পড়বে সুজাতা!
সেই সেদিন রান্না করতে করতে এই কথাই ভাবছিল সুজাতা। যে দিনটাকে এখন তার স্লেটের লেখার মতো মুছে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
সুমনা এসে দাঁড়িয়েছিল।
সুজাতা চমকে আর শিউরে বলে উঠেছিল, ও কী?
সুমনা দ্রুত ব্যস্ততায় বলে উঠেছিল, একটা বাচ্চা! রাস্তায় পড়ে ছিল। শিগগির একটু গরম দুধ আর অনেকটা ঘেঁড়া ন্যাকড়া আনো না মা, দেরি করলে নিশ্চয় মরে যাবে।
সুজাতা কিন্তু নির্দেশ পালনের লক্ষণ দেখায়নি। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কটু কণ্ঠে বলেছিল, মানুষের বাচ্চা না কুকুর বেড়ালের?
বলেছিল অবশ্য সত্য নির্ণয়ের জন্যে নয়, বাচ্চাটা যে মানুষের, তা তার দেখা হয়ে গিয়েছিল। এটা নিতান্তই মেয়ের নির্বোধ দুঃসাহসকে ধিক্কার।
সুমনা আরও দ্রুততায় বলেছিল, কী আশ্চর্য! দেখতে পাচ্ছ না? দোহাই তোমার মা, রাগটা পরে দেখিও, আগে একটা ছেঁড়া শাড়ি কি চাদর দাও। এর গায়ে জড়ানো ন্যাকড়াগুলো বড় বড় কাঠপিঁপড়েয় ভর্তি।
সুজাতা তবু কঠিন মুখে বলেছিল,ছেলেকে যারা কাঠপিঁপড়ের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে চলে যায়, তারা কী, তা অবশ্য বোঝবার বয়েস হয়েছে তোমার? সেইটা তুমি নিজে হাতে করে কুড়িয়ে আনলে?
বাঃ নিজের হাত ছাড়া পরের হাত তখন পাচ্ছি কোথাও বেড়াতে বেড়াতে সেই কোথায় চলে গিয়েছিলাম জানো? যাকগে তুমি আগে দুধ আর ন্যাকড়া দাও বাবা, মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষে পাক এটা। তারপর যত পারো বোকো। জলদি জলদি মা।
বাধ্য হয়েই সুজাতাকে তখন মেয়ের আদেশ পালন করতে হয়েছিল। যেরকম করছিল সুমনা, ভয় হচ্ছিল সত্যি না ওর বুকের মধ্যেই মরেটরে যায় বাচ্চাটা। ফরসা দুখানা শাড়ি, আর একটু গরম দুধ এনেছিল সুজাতা।
কিন্তু সুমনা যখন বাচ্চাটার গায়ে কাপড়-চোপড়গুলো ফেলে দিয়ে পিঁপড়ে ঝেড়ে মায়ের সেই পুরনো শাড়ি দুখানা দিয়ে জড়িয়ে বাগিয়ে ধরে মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দুধটা তো বাপু তোমাকেই খাইয়ে দিতে হবে। আমার সাহস হচ্ছে না–
তখন আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না সুজাতা। তীব্র স্বরে বলে উঠল,আমি খাইয়ে দেব? এই সন্ধেবেলা রাঁধতে রাঁধতে ছোঁব ওকে?
ছোঁবে না!
ছোঁব? বললি কী বলে?
বাঃ এখানে তো আর ঠাকুমা জেঠিমা নেই—
ঠিক এই কথাটাই সুজাতা কেবলই বলেছে মেয়েকে।
এখানে আর মুরগির ডিম সেদ্ধ করে দেব না কেন? এখানে তো আর তোর ঠাকুমা জেঠিমা নেই। কিন্তু এখন সেই সুযোগের উল্লেখে জ্বলে উঠে বলে, তা না হয় নেই। তা বলে আমিই কি একেবারে হাড়ি ডোম? একে তো ওটি কী নিধি তার ঠিক নেই, তা ছাড়া আঁতুড়ে ছেলে তো বটে–
থাক, তবে থাক! সুমনা বিরক্ত কণ্ঠে বলেছিল, সব সমান! একটা প্রাণী মরছে, সে কথা চুলোয় গেল, ছোঁয়া, নাওয়া এইটাই বড় হল। বেশ, ঠিক আছে, আমিই যা পারি করছি। দুধটা দেবে তো, না কি ও কী নিধি তার বিচার করতে বসবে?
হ্যাঁ, সেদিন এইরকম ঝংকারই দিয়েছিল সুমনা। যা তার চিরকালের স্বভাব। বাড়িসুদ্ধ সকলের আদরের মেয়ে, কথাবার্তায় একটু বেপরোয়া বরাবরই। এখন সে সুমনা বদলে গেছে।
কিন্তু তখনও বদলায়নি।
তাই মাকে বেশ দুকথা শুনিয়ে দিয়ে রাগ করে দুধটা আর পলতেটা নিয়ে সরে গিয়েছিল সে। যা পারে মায়ের আড়ালেই করবে।
সুজাতা মিনিট গুনছিল কখন কান্তিকুমার আসেন।
কিন্তু কান্তিকুমার এসেই বা কী করতে পারলেন? বলতে পারলেন কি দূর করে ফেলে দে ওটাকে? তখনই যদি বলতেন, হয়তো কাজ হত।
এখন ওর মায়া পড়ে গেছে।
এখন শেকড় বসে গেছে।
এখন সুমনা বলছে, তোমরা বরং আমাকে ত্যাগ করো, আমি ওকে ফেলতে পারব না।
হ্যাঁ, সেদিন কান্তিকুমার ছিলেন না।
কান্তিকুমার ফিরে এসে শুনেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।
তারপর বলেছিলেন, কাজটা ভাল করোনি সুমনা!
বলেছিলেন, তবু কি সেই অখাদ্যটার জন্যে ডাক্তারবাড়ি যেতে কসুর করেছিলেন?
কসুর করেননি, হয়তো হঠাৎ বাড়িতে একটা জীবহত্যে ঘটে গেলে বিপদ আসবে বলেই হয়তো বা সুমনার নির্বেদে।
কান্তিকুমারের দিক থেকে ভাবতে গেলে প্রথমটাই।
মেয়ের কীর্তিতে বিচলিত কান্তিকুমার ভেবেছিলেন ডাক্তারের কাছে যাওয়াই ভাল। এই বেলা সবিশেষ বলে লোকটাকে সাক্ষী রাখতে। বাচ্চাটা মরে গেলে, মানে মরে তো যাবেই, তখন অনেক। ফ্যাসাদে পড়তে হবে।
গিয়েছিলেন। পরিচিত ডাক্তার।
এখানে এসেই তো সর্বপ্রথম কাজ হয়েছিল ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
ডাক্তার শুনে বললেন, বলেন কী? কোথায়?
জানি না কোন দিকে বেড়াতে গিয়েছিল। ভাল করে জিজ্ঞেস করা হয়নি। বলল তো জঙ্গলের ধারে।
একা বেড়াতে গিয়েছিল নাকি? ওষুধপত্র গোছাতে গোছাতে ডাক্তার বলেন, আপনারা সঙ্গে যাননি?
না। আমি একটু স্টেশনের দিকে গিয়েছিলাম। ও বলল, ডাক্তারবাবু আমায় হাঁটতে বলেছেন।
ডাক্তার একটু হাসেন।
হ্যাঁ, তা বলেছিলাম বটে। নিন, এখন কী মুশকিল বাধালো দেখি। অনেকদিন আগে আর একবার এধরনের একটা কেস হয়েছিল এখানে। নইলে এই ঘুমন্ত গ্রামে চাঞ্চল্যকর কিছু তো কখনও ঘটে না মশাই। বড়জোর একটা নেকড়ে বেরোল তো ঢের। ছুটিছাটায় চেঞ্জাররা আসে, স্থায়ী কোনও রোগী থাকলে বাড়িভাড়া করে থাকে কেউ কেউ। এখানকার সস্তা হাঁস মুরগি কিছু ধ্বংস করে চলে যায়। ঘুমন্ত দেশ আবার ঘুমোয়।
পথে চলতে চলতে কান্তিকুমার বলেন, সেই যে এরকম একটা কেসের কথা বলছিলেন, কী হল তার?
ডাক্তার বলেন, হল আর কী। একটা কেলেঙ্কারিই হল। সে এমনই এক চেঞ্জার ভদ্রলোক বললেন তাঁর বোন একটা বাচ্চা কুড়িয়ে পেয়েছেন, এখন কী হয়, কেষ্টর জীব! আমরা আর কী করব মশাই, বললাম, দেওঘরে একটা অনাথ আশ্রম আছে, দিয়ে দেবার চেষ্টা করুন। ভদ্রলোক হাত পা ছেড়ে দিয়ে বললেন, খোঁজ করেছিলাম, তারা বলেছে অত ছোট্ট বাচ্চা নেয় না। তারপর মশাই বোনের নির্বুদ্ধিতার কথা বলে অনেক হাত পা ছুঁড়লেন, অনেক গালিগালাজ করলেন, বললেন, রাস্তা থেকে ছেলে কুড়িয়ে আনল কী বলে! একেই বলে স্ত্রী বুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী। শেষে মশাই লজ্জার কথা কী বলব, প্রকাশ হয়ে গেল, বোনেরই ব্যাপার! বিধবা বোন।
চলতে চলতে থেমে পড়লেন কান্তিকুমার। তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন, এ কাহিনীটা আমাকে শোনানোর আপনার কোনও উদ্দেশ্য আছে ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার থতমত খেলেন।
বললেন, না না, সে কী কথা! কী আশ্চর্য! আপনি তো মশাই সাংঘাতিক লোক!
.
এ তো দেখছি রীতিমত হেলদি চাইল্ড! ডাক্তার মন্তব্য করেন, কে বললে মশাই, এক্ষুনি মারা যাবে? মারা যাবার কোনও লক্ষণই দেখছি না–হাসলেন ডাক্তার, বুঝতেই পারছেন ঝড় খেয়ে বেঁচে ওঠা চারা। সতেজ বেশি। পৃথিবীর আলো দেখবার আগে থেকেই ওকে পৃথিবী থেকে সরাবার কী ষড়যন্ত্র না চলেছিল! শেষ অবধি ফেলিওর হয়েই
সমাজের অধঃপতন সম্পর্কে বেশ খানিকটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন ডাক্তারবাবু। বাচ্চাটা সম্পর্কে নির্দেশ দিলেন কিছু কিছু ওষুধ দিলেন এবং জানিয়ে গেলেন, অনাথ আশ্রমে দিতে গেলে অনেক ঝামেলা, পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়, তার থেকে সবচেয়ে ভাল যদি স্বেচ্ছায় কেউ পালন করতে চায়। বললেন, সাঁওতাল মাগীফাগিগুলো কেউ কেউ আছে–ছেলে ক্যাঙলা। সন্ধানে থাকব, নিতেও পারে। সেই ভদ্রলোকের বোনেরটিকে তো ওই একটা সাঁওতালনি এসেই মহোৎসাহে তুলে নিয়ে গেল।
ডাক্তারকে হ্যারিকেন ধরে পৌঁছে দিয়ে আসে এদের চাকর।
সেই সন্ধ্যার কথাটা আবার মনের মধ্যে তোলাপাড়া করতে থাকে সুজাতা।
মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেনি, কিন্তু নিজে সে লক্ষ করেছিল, ডাক্তার বারবার কেমন কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল সুমনার দিকে। কেমন একটা গূঢ় মর্মভেদী লক্ষ্যে। অথচ ওই ডাক্তারই দেখেছে এতদিন সুমনাকে। তবু, মানুষের স্বধর্ম! সন্দেহ বস্তুটাই তার মজ্জাগত।
ডাক্তারের সেই দৃষ্টি দেখতে পাচ্ছে সুজাতা, তার জায়েদের চোখে, দেওর-ভাশুরের চোখে, শাশুড়ি-ননদের চোখে, নিজের ভাই ভাজ বোন ভগ্নীপতির চোখে, আত্মীয় অনাত্মী; পাড়া-প্রতিবেশী ঘর পর সকলের চোখে।
গূঢ় মর্মভেদী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
সেই দৃষ্টির শরশয্যার মধ্যে গিয়ে পড়তে হবে তাকে।
আর অকারণ।
শখের খেয়ালে মায়ের জন্যে এই শরশয্যা পাততে চাইছে সুমনা।
চাইছে কেন, পাতলই তো।
.
সুজাতার চালে ভুল ছিল।
সুজাতা যদি ওই অসহায় জীবটাকে কেবলমাত্র বিপদ বলে গণ্য না করত, যদি ওটাকে বিদেয় করে দিয়ে বিপদ-মুক্ত হবার জন্যে অত হইহই না করত, যদি কেষ্টর জীব বলে একটু করুণা করত, তা হলে হয়তো সুমনা বাঘিনীর শাবক আগলাবার মতো অমন করে আগলাত না সেটাকে। আর হয়তো বা অত মায়াও পড়ত না ওর।
অপটু হাতে দুধ খাইয়ে অসাব্যস্ত হাতে নাইয়ে পটু আর সাব্যস্ত হয়ে উঠল সুমনা। বুকে তার সত্যকার সুধাঁধারা সঞ্চিত হয়ে না উঠুক, স্নেহের সুধা জমে উঠল বুকভরে।
আর সকলের উপর আরও একটা জিনিস তীব্র হয়ে উঠল, সেটা হচ্ছে জেদ।
জেদ আর মমতা।
কঠিন আর কোমল।
এই দুটো হৃদয়বৃত্তি সুমনাকে অন্ধ করে রেখেছে। কাজেই কান্তিকুমার যে ভাবছিলেন হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা কিছু পরিবর্তন হবে, তা আর হয় না। যথানিয়মে বাক্স-বিছানা গোছানো হয়। এখানকার লেনদেন চোকানো হয়, ট্রেনের টিকিট কাটা হয়।
হয় না শুধু একটা কাজ।
সুজাতার বাজার করা হয় না।
এখানকার লোহার বাসন সস্তা, এখানকার বঁটি কাটারি ভাল, তাই সুজাতা মনে মনে সংকল্প করে রেখেছিল যাবার আগে একপ্রস্থ ঘর-সংসারী বাসন কিনে নেবে। না, তাদের সেই বৃহৎ গুষ্ঠির উপযুক্ত বিরাট বাসন-কোসন নয়। ছোট্ট সংসারের মতো। সেই সরঞ্জামগুলি নিয়ে বছরে বছরে বেড়াতে বেরোবে সুজাতা। সব ছেলেমেয়ে কটিকে সঙ্গে নেবে, এখানে সেখানে ডেরা বাঁধবে আর মনের মতো করে, মনের সাধ মিটিয়ে যত্ন করবে তাদের।
কিন্তু আর কী দরকার দোকানে বাজারে? ভবিষ্যতের সেই উজ্জ্বল ছবি তো কালি ধেবড়ে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে।
তবু কান্তিকুমার একবার বললেন, তুমি যে সেই একদিন কীসব কিনবে টিনবে বলেছিলে?
সুজাতা রুদ্ধ কণ্ঠ আর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে বলেছিল, ঠাট্টা করছ?
ঠাট্টা!
তা ছাড়া আর কী? ভেবেছিলাম আবার যদি কখনও–তা আর আমি কখনও কোথাও বেরোব?
আহা তা একেবারে অত হতাশ্বাস হবার কী আছে? সংসারে কত ভাঙাগড়া হয়, কত বদল হয়–
এরপর যা বদল হবে, দুঃখের দিকে যন্ত্রণার দিকে, বেশ বুঝতে পারছি।
অতটা ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক নয়। যাবে তো চলো।
নাঃ। আমার আর মন নেই। সুমির দুর্মতি আমার মন ভেঙে দিয়েছে।
তবে থাক। কী করছে সে?
কী আবার? সেই কুড়নো মানিক বুকে করে বসে আছে! আশ্চয্যি আমার কপাল! জগতে এত মেয়ে আছে, কারও জীবনে কোনও সমস্যা নেই।
কান্তিকুমার তর্ক করলেন না।
বললেন না, এ তোমার ভুল ধারণা সুজাতা, সমস্যা অনন্ত। সবাইয়ের ভাগ্যেই কিছু না-কিছু এসে জোটে।
বললেন না, কারণ তাঁর নিজের মনও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। তিনিও এই বিদঘুটে সমস্যাটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না। লোকনিন্দের ভয়ে নয়, সে ভয়কে কান্তিকুমার মনের জোর দিয়ে কাটিয়ে উঠছিলেন; কিন্তু সুমনা যে বদলে গেল। সুমনা যে হারিয়ে গেল।
কান্তিকুমারের একান্ত আদরের একান্ত আশার সুমনার মৃত্যু ঘটেছে। সেই শোকস্তব্ধ করে দিয়েছে কান্তিকুমারকে।
আর কি কোনওদিন বেঁচে উঠবে সুমনা?
আগেকার সেই হাসিতে উজ্জ্বল, খুশিতে উচ্ছল মুখর মূর্তি নিয়ে?
.
শোকাচ্ছন্ন তিনটি মূর্তি নিঃশব্দে তাদের এই কয়েক সপ্তাহের বাসস্থান ছেড়ে ট্রেনে গিয়ে ওঠে।
কান্তিকুমার শুধু বলেন,মেঘ করেছে, বৃষ্টি আসতে পারে।
আর কিছু না।
যেন এই খবরটা খুব জরুরি। সুজাতা বলে, স্টেশনে বাড়ি থেকে গাড়ি আসবে কিনা কে জানে। জানে নিশ্চিত আসবে, তবু বলে।
সুমনা কিছু বলে না।
.
ট্রেন চলতে থাকে।
সুজাতা জানলায় মুখ রেখে বসে থাকে নির্বাক। কান্তিকুমার একখানা বইয়ের মধ্যে ডুবে গেছেন ট্রেন চলার সঙ্গে সঙ্গে।
সুমনা বসে আছে নিষ্পলক নেত্রে চেয়ে। অনেক দুঃখ, অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যেও একটা প্রসন্ন কৌতূহলের দীপ্তি মুখে মেখে।
জানলা দিয়ে এসে পড়া আলোর দিকে নীল কাঁচের মতো চোখ দুটিতে কী অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেটা! অন্য আর সব শিশুর মতোই তো ওরও সমস্ত চেতনায় আলোর পিপাসা।
দু হাতের মুঠি পাকিয়ে অত লড়ালড়িই বা কেন ওর? যতক্ষণ জেগে আছে ততক্ষণ আর ওই লড়াইয়ের আস্ফালনের শেষ নেই!.. মনে মনে হাসে সুমনা।
ভাবে, এটা কি শিশুমাত্রেরই স্বভাব?
পৃথিবীতে এসে যে সব-কিছুর জন্যেই লড়ালড়ি করতে হবে, তা শিখে এসেছে বলেই তার মহলা দিচ্ছে?
না কি শুধু এই ছেলেটাই?
ও বুঝে ফেলেছে ওকে লড়াইয়ের জোরে জায়গা করে নিতে হবে।
এর আগে কি সুমনা এত ছোট শিশু দেখেনি আর কোথাও? তাই জানে না তারা কোন বয়েসে কী কী করে!
কোন বয়েস!
কী জানি এর কত বয়েস।
ডাক্তার পরে বোধ করি সন্দেহটা ঝেড়ে ফেলেছিল। হয়তো ভেবেছিল সন্দেহটা পোষণ করতে হলে তো তার নিজের বিদ্যাটাই মিথ্যে হয়ে দাঁড়ায়। এতদিন ধরে দেখছে সে সুমনাকে। তাই আবার স্বেচ্ছায় এসেছিল। বলেছিল, সদ্যোজাত নয়, কয়েকদিনের। সেই কয়েকদিনটা কদিন? এই কুসুমসুকুমার অসহায় শিশুটার ওপর মায়া পড়বার উপযুক্ত সময় নয় সেটা? সুমনা কদিন দেখছে? মাত্র নদিন। এই ন দিনেই তো সে ভাবতে পারছে না এটাকে অনিশ্চিত অন্ধকারে ফেলে দেওয়া যায়। কী পেলব-কোমল মুঠি দুটি! কী অদ্ভুত রকমের নরম ভঙ্গিমাময় ঠোঁট! কী উজ্জ্বল নীল চোখ।
ওই চোখ দিয়ে ও হয়তো সুমনার দিকে তাকিয়ে দেখছে। দেখছে সেখানে আশ্রয় আছে, না, স্বার্থপরতা আছে।
লোকে বলে শিশু নাকি অন্তর্যামী!
.
আর সুজাতা ভাবছিল অনেকদিন আগের কথা; তখনও অঞ্জনা জন্মায়নি, জন্মায়নি অভীক, অজীন। সুজাতা তার দিদির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল হাজারিবাগে।
ট্রেনে চেপে সুজাতা জানলা থেকে নড়েনি, পাছে এককণাও সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। কান্তিকুমার অমনি বইয়ের মধ্যে ডুবে বসে ছিলেন, আর সুমনা একটা বড় ডলকে কোলে বসিয়ে সারাক্ষণ একা একা বকবক করতে করতে চলেছিল।
সেই বকুনিটা অবশ্য তার খুকুর প্রতি। মাতৃজনোচিত সমস্ত বকুনিগুলিই সেই শৈশবেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেছিল সুমনা।
এমনকী তার খুকু চোখে কয়লার গুঁড়ো লেগে কেঁদে ওঠায় বকতে কসুর করেনি–একটু কয়লার গুঁড়ো লেগেছে তো কী হয়েছে? কাঁদবার কিছু নেই এতে। রেলে চড়বার শখ কেন তা হলে? রেলে তো কয়লার গুঁড়ো থাকবেই।
তার একটু পরেই কিন্তু সুজাতাকে উঠতে হয়েছিল সুমনার চোখে জলের ঝাঁপটা দিতে, আর তাকে কোলে নিয়ে ভোলাতে।
আজ আর সুমনা পাখির মতো কলকাকলি তুলছে না। আজ সুজাতাকে উঠতে হবে না সুমনাকে ভোলাতে।
জিজ্ঞেস করাও চলবে না, হ্যাঁ রে চোখে জল পড়ছে কেন? কয়লার গুঁড়ো পড়েছে?
অথচ লাল লাল চোখটা বারবার জানলার দিকে ফেরাচ্ছে সুমনা।
গত দুদিন থেকে মার সঙ্গে কথা বন্ধ।
সুজাতার অপরাধ, ও শেষ মুহূর্তে শেষ চেষ্টা হিসেবে ওখানকার বাসন-মাজা দাইটার সঙ্গে পরামর্শ করে এবং মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে সাঁওতালদেরই একটা বাঁজা মেয়েকে আনিয়েছিল। মনে করেছিল বন্ধ্যার দুঃখ বর্ণনা করে, আর বন্ধ্যার হৃদয়ের আকুলতা আকুতির কথা তুলে, মন গলিয়ে ফেলবে সুমনার। কিন্তু ঝিয়ের সামনে অপদস্থ করেছে সুমনা সুজাতাকে। দেয়নি।
ঘরে এসে বলেছে, মা, আর যাই করো করো, ছোটোমি কোরো না।
সুজাতা ছোটোমি করেছে!
এই কথা বলেছে তার পেটের মেয়ে!
সুমনা!
যে মেয়েকে সে রক্ষণশীল বাড়ির মধ্যে থেকেও সংগ্রাম করে করে সমস্ত আধুনিকতা আর উদারতার সুযোগ দিয়ে মানুষ করেছে!
তবে আর কথা বলবে কেন সুজাতা।
.
ঝনাৎ করে থেমে গেল গাড়ি।
এসে পড়েছে বর্ধমান। কী আশ্চর্য, কখন চলে গেছে সময়, কখন বাংলার মাটিতে এসে ঢুকেছে অজগর গাড়িটা?
দিনের গাড়ি!
অতএব নিভৃত শান্তির আশা বাতুলতা। তবু যে এতক্ষণ ছিল সে শান্তি, এই আশ্চর্য!
হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লেন এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা, আর তাঁর সঙ্গে একটি তরুণী বউ। বউটির কোলে কাঁথায় মোড়া একটি পুঁটুলি।
কাঁথায় মোড়া পুঁটুলি নিয়ে কমবয়েসী মেয়ে বউদের তো কতই গাড়িতে উঠতে দেখেছে, তবু কেন যেন দেখে বুকটা কেঁপে ওঠে সুজাতার।
ওই একবার মাত্র দৃকপাত করেই ও আবার জানলার বাইরে মুখ ফেরাল।
কিন্তু সেটাই তো ভুল। কেন তাকিয়ে রইল না তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে?
বারেবারে এই ভুলের বোকামিই করে বসছে সুজাতা।
বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, যখন একসময় অন্যমনস্কতার অতলে তলিয়ে গেছে ও, তখন হঠাৎ কানে আসে সেই কর্ণবিদারী প্রশ্ন।
যে প্রশ্নের ভয়ে তখন বুক কেঁপে উঠেছিল তার।
এইটি বুঝি প্রথম?
নিজের ভুল বুঝতে পারে সুজাতা। বুঝতে পারে নিজেই ঘাঁটি আগলে বসা উচিত ছিল তার। এমন কথাও তো বলতে পারত, শিশুটা সুজাতারই। প্রথম নয়, শেষ। হতে পারে না সুজাতার?
চল্লিশ বছর বয়সে কি এমন ঘটনা ঘটে না কোনও মেয়ের?
হ্যাঁ, তাই বলতে পারত! বলত–শেষ কুড়োনো বলেই অগ্রাহ্য করে আর তাকিয়ে দেখি না। তাই বড় মেয়েই দেখেশোনে ওকে। এ সবই বলতে পারত সুজাতা।
কিন্তু এখন আর হয় না।
এখন সেই প্রশ্নটি উচ্চারিত হয়ে গেছে! সুজাতার কানে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে সে শব্দ।
এইটি বুঝি প্রথম?
সুজাতা তাকিয়ে দেখে তীক্ষ্ণ কঠোর দৃষ্টিতে।
ওদের দিকে নয়, মেয়ের দিকে।
সুমনা দেখতে পায় না সে দৃষ্টি।
তাই সুমনা মৃদু হেসে বলে, কী যে বলেন! এটা হচ্ছে কুড়িয়ে পাওয়া!
প্রশ্নকর্তী অবশ্য এ উত্তরকে রহস্য ভেবেই হেসে ওঠে। বলে, কোথায়? বনে জঙ্গলে?
হাঁসুমনা বলে, বেড়াতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি জঙ্গলের ধারে পড়ে পড়ে কাঁদছে।
সুজাতা তীব্র দৃষ্টিতে কান্তিকুমারের দিকে তাকায়।
বইয়ের মধ্যে কি সত্যি সমাধিস্থ হয়ে গেছে লোকটা। একটা কিছু করুক। একটা কিছু বলে উঠুক! এ প্রসঙ্গটা যাতে বন্ধ হয়, তার ব্যবস্থা করুক! কিন্তু লোকটা কিছুই করে না।
সত্যি শুনতে পাচ্ছে না, না, শুনতে না পাওয়ার ভান করছে?
বউটি কিন্তু সেটাও পরিহাস ভেবে ইত্যবসরে নিজের কথা শুরু করে দিয়েছে!
তাই তো দেয় লোকে।
নিজের কথা কইতেই তো ভালবাসে। নিজের কথা কইবে বলেই বৃথা দু-একটা প্রশ্ন করে পরকে।
ওটা হচ্ছে কথা তোলার ঘর!
ওই ঘরের পিঠে ঘর তুলে তুলে বুনে তুলবে নিজের মহিমা, নিজের পরিচয়।
সে যা কষ্ট পেয়েছি ভাই! ওই যে সঙ্গে আমার শাশুড়ি রয়েছেন। খুব ভাল। কী যত্নই করেছেন আমায়! আমি বলি, বাবাঃ, এত কষ্ট! এই কাণ্ডকারখানা করে এক-একটা মানুষ পৃথিবীতে আসে? তবু পৃথিবীতে এত কোটি কোটি লোক!… ভাবলে আশ্চয্যি লাগে না ভাই? যাই বলুন ভগবান খুব একচোখা, তাই না? যত যন্ত্রণা মেয়েদের ভাগে। ভগবান নিজে পুরুষ বলে,..বলুন? সত্যি বলছি। কিনা?
সুজাতার মুখে আসে,ওগো বাছা, একটু সভ্যতা-ভব্যতা বজায় রেখে কথা বলো, গাড়িতে একটা পুরুষ বসে রয়েছে
কিন্তু পারে না।
বলতে গিয়ে থেমে যায়।
কে বলতে পারে সেই কথাটুকু থেকেই বচসা হয়ে যাবে কিনা। যে মেয়ে বিগলিত আনন্দে হেসে হেসে কথা বলছে, সে এক্ষুনি সাপিনীর মতো ফোঁস করে উঠবে কি না।
অতএব কিছু না বলাই ভাল। মেয়েটা কথার গাড়ি চালিয়েই যায়।
.
ওমা, ও কী, শাড়ি পেতে শুইয়েছেন কেন? কাঁথা করতে পারেন না? অবিশ্যি প্রথমবার আর নিজে কে করে, তা নয়। পাঁচজনেই করে দেয়। তবে বেশি সভ্যরা আবার কাঁথা করে না, তোয়ালেয় শোয়ায়। যাই বলুন, কিন্তু শাড়িতে!..ইস আমি কি বোকা! সব বোধহয় বাক্সে তুলে ফেলেছেন। শুধু ট্রেনের মধ্যে যা হোক করে! কিন্তু ভাই ছোটদের তোয়ালের থেকে কাঁথাই মানায়, তাই না? বেশ আদর আদর ভাব থাকে।
মেয়েটি বহু কারুকার্য করা একখানি কাঁথা বিছিয়ে টানটান করে ঘুমন্ত শিশুটির গায়ে ঢেকে দেয়। ঢাকা দিয়ে অপরিসীম তৃপ্ততা নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেই ঘুমন্ত মুখের দিকে।
সুমনার কোলের কাছে শুয়ে থাকা জীবটাও এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আলোর তৃষ্ণায় আকুলতা করবার ক্ষমতা আর এখন নেই।
কিন্তু সুমনাও কি ঘুমিয়ে পড়বে?
ওইরকম সবকিছু থেকে নির্লিপ্ত হয়ে, নিশ্চিন্ত শান্তিতে! ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে তার শরীর। না কি প্রশ্নোত্তরের কাঁটাবনের হাত থেকে রক্ষা পেতেই তার শোয়ার আকুলতা?
কে জানে কী জন্যে, গুটিগুটি হয়ে শুয়েই পড়ে সুমনা। শিশুটাকে হাতের আড়ালে আগলে। বালিশ নেই, কাঁথা নেই, যদি পড়ে যায়।
অতঃপর শাশুড়ি বউয়ের মধ্যে নিম্নস্বরে কথা হতে থাকে।
কী ফ্যাশানই হয়েছে আজকাল! এয়োস্ত্রী মানুষ, কোলে কচি ছেলে, মাথায় একটু সিঁদুর নেই, হাতে নোয়া নেই, ছিঃ!
বউ বলে, কতজনই তো পরে না। ওই হয়েছে এখন।
ছিঃ, দেখে ঘেন্না করে।
শ্রীরামপুরে নেমে গেল ওরা।
আর হঠাৎ সেই সময় বই থেকে মুখ তুললেন কান্তিকুমার। বললেন, সুজাতা, তুমি অনায়াসে জানলার কাছ থেকে সরে এসে এদিকে বসতে পারতে!
.
আগে থেকে খবর দিয়ে এসেছিলেন কান্তিকুমার। স্টেশনে গাড়ি ছিল।
ড্রাইভার সেলাম করে দাঁড়িয়েই, হতচকিত হয়ে তাকাল সুমনার দিকে।
সুমনার মুখ অন্যদিকে ফেরানো।
সুমনার বুকের কাছে আঁকড়ানো শাড়ি দিয়ে মোড়া একটা রহস্যময় বস্তু।
ড্রাইভার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেবার অবসরে কান্তিকুমার আর একবার বলেন, সুজাতা, ওটাকে তোমার কাছে রাখা কি একেবারেই অসম্ভব?
সুমনা চমকে তাকায়।
আর সুজাতা চাপা আক্রোশের গলায় বলে ওঠে, অসম্ভব তো নিশ্চয়! কাছে নিয়ে যদি আমি গলা টিপে দিই।
অদ্ভুত!
সুমনাকে উপলক্ষ করেও এমন বিষাক্ত কথা বলতে পারছে সুজাতা! কান্তিকুমার চুপ করে যান।
ড্রাইভারটা কী ভেবে কোনও প্রশ্ন করল না।
.
এরা এসে পড়ায় হইহই পড়া উচিত ছিল। কিন্তু কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল সবাই! দিদি দিদিকরে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল না কেউ। সভয়ে সরে সরে বেড়াতে লাগল সুমনার নিজের ভাইবোনেরা, খুড়তুতো ভাইবোনেরা।
আর সুমনা?
সেও তো কেমন নিথর হয়ে গেছে। আগের সুমনা তো আর নেই। তার কথার সমুদ্র শুকিয়ে গেছে। যেন।
ধীরে ধীরে গিয়ে নিজের খাটের একপাশে শুইয়ে দেয় শাড়ি-জড়ানো বস্তুটাকে। বসে থাকে ঘরের মধ্যে।
অনেকক্ষণ পরে ছোটখুড়ির মেয়ে অরুণা এসে ডাকে,দিদি, মা বললে, হাতমুখ ধোও। চা হয়ে গেছে।
হাতমুখ ধুতে গিয়ে জলের কলটা খুলে দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে অনেকক্ষণ কিছু না ভেবে দাঁড়িয়ে রইল সুমনা।
তারপর ভাবল, আমি এমন বোকার মতো চুপ করে আছি কেন। এমন অপরাধী-অপরাধী ভাবের কী দরকার? তারপর ভাবল, ওদের অনুচ্চারিত প্রশ্নভরা চোখই আমার বল হরণ করছে। ওরা চিৎকার করে প্রশ্ন করুক না! বলুক না–সুমনা, এ কী?
তখন সুমনা তর্ক করবে, প্রশ্ন করবে, মানুষের সংজ্ঞা কী, তা জানতে চাইবে।
কিন্তু ওরা কথা বলছে না।
বললও না!
শুধু সুমনা যখন চা খেয়ে উঠে যাচ্ছে, তখন জেঠি জপের মালা হাতে করে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, তোর মা তো চিঠিতে লিখেছিল শরীর বেশ সারছে, তা কই? দেখছি না তো কিছু?
অনেকক্ষণ–না না, অনেকদিন যেন কথা কয়নি সুমনা; তাই সুমনার গলার স্বর বুজে আছে। তাই খোলা গলায় কথার উত্তর দিতে পারে না সে।
শুধু অস্ফুটে বলে, ভালই তো আছি।
কী জানি বাছা, ভাল থাকার তো কিছু দেখছি না। জেঠি মন্তব্য করেন, গাল দুটো তো চড়িয়ে ভাঙা, চোখের কোলে কালি।
যতটা নয় তার বেশি করে বলেন জেঠি।
.
ভাল আছি, ভালই আছি–এ কথা কে শুনতে চায়? চায় না। তাই ভাল থাকা–দেখলে ভাল লাগে না। আর অন্যের আপন নিভৃতির ভাললাগাটুকুকে টেনে হিঁচড়ে উপড়ে ফেলতে পারলেই বুঝি বাঁচে মানুষ!
তাই সুমনার একটা কুড়িয়ে পাওয়া পুতুল নিয়ে খেলার ভাললাগাটুকু কেটে ছিঁড়ে তছনছ করে দিতে চায় সবাই।
.
অজস্র কৌতূহলের মন সজাগ হয়ে উঠেছে কান্তিকুমারদের বাড়ির নতুন খবরে। আশে-পাশে ধারে কাছে যেসব মন ও-বাড়ি সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে বসে থাকত, সেইসব মন।
কিন্তু যারা ধারে কাছের নয়? যারা কান্তিকুমারদের নিজের বাড়ির?
সেখানেও সেই স্তব্ধতাই রয়ে গেল নাকি?
চুপ হয়েই থাকল সবাই?
কেউ কোনও প্রশ্ন নয়?
কেউ কোনও প্রতিবাদ নয়!
যেমন প্রথম মুহূর্তে করেছিল। প্রশ্নহীন অবাক দৃষ্টি নিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকা।
না, তাই কি হয়?
অপ্রতিবাদে কেউ এতটুকু এদিক ওদিক মেনে নেয় না, আর এ তো একটা বিরাট অনাচার। সুমনার কাছে পুতুলের মতো বলেই তো আর সেই ভয়ংকর জিনিসটা পুতুল হয়ে গেল না?
অতএব গুমোট ভেঙে ঝড় ওঠে।
প্রশ্নে আর প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে সংসার। কেন…কেন..কী বলে…কোন্ সাহসে…?
.
ব্যাপারটা নিতান্ত গুরুতর, তাই প্রথম নান্দীপাঠ করেন কান্তিকুমারের দাদা শান্তিকুমার। খুব গম্ভীর আর ভারী গলায় বলেন, মেয়েরা অনেক বিষয়েই শৈশব অতিক্রম করে না। জানা কথা! কিন্তু তুমি? তোমার বিবেচনা বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল কী করে বলে দিকি কান্তি?
বৈষ্ণবচরণাশ্রিত ভক্তিমান্ মানুষ, কখনও চেঁচিয়ে কথা বলেন না, তুমি ছাড়া কাউকে তুই বলেন না।
কান্তি ক্লান্তকণ্ঠে বলেন, কী করব, এমন জেদ ধরল।
জেদ ধরল বলে যথেচ্ছাচারের প্রশ্রয় দেওয়া যায় না কান্তি, শান্তিকুমার বলেন, স্নেহে অন্ধ হলে উভয় পক্ষের কারও মঙ্গল নেই।
কান্তিকুমার খুব স্থির স্বরে বলেন,বেশ, আমি তোমায় সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিচ্ছি দাদা, তুমি এ বিষয়ে যা পারো করো।
শান্তিকুমার ভুরু কুঁচকে বলেন, আমি কী করব?
বোঝাও ওকে। তোমাকে ভয় করে, ভক্তি করে।
শান্তিকুমার কিছু বলার আগেই জেঠি রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন। বলে ওঠেন, এখন আবার বোঝানোর কথা! গোড়া কেটে আগায় জল! বলছ তো, কুড়িয়ে এনেছে। বেশ,বলি–তক্ষুনি দূর দূর করে ফেলিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে চান করিয়ে ঘরে তোলালে তবে না হত। এ এখন পরের পাপ ঘরে তুলে ফেলেছ। এখন কিছু করা শক্ত।
কান্তিকুমার গম্ভীর ভাবে বলেন, গোড়াতেই গোড়া শক্ত থাকে, এমন প্রকৃতিরও অভাব নেই সংসারে। সুমিকে তো তোমরা জানোই।
জানি বলেই তো জানি মেজ ঠাকুরপো, বলতে যাওয়া মুখমি। কথা থাকবে না। তবে এই ঠাকুর দেবতার বাড়িতে অতবড় একটা অনাচার সহ্য করাও তো শক্ত।
কান্তিকুমার এবার একটু হাসেন, তা এ অনাচার তো তোমার ঠাকুর দেবতার গায়ে গিয়ে লাগছে না বউদি।
লাগছে না–তাই বা বলি কী করে বলো? বাতাসেই অনাচার। রাস্তায় যারা ছেলে ফেলে দিয়ে যায়, তারা নিজেরা কী, আর তাদের ছেলে কী, তা তো আর তোমাকে বোঝাতে হবে না!
নাঃ, তা হবে না বটে।
আর একটু হাসির মতো করে চুপ করে যান কান্তিকুমার।
শান্তি আর একবার বলেন, যাই হোক, তোমাকে একটু মনে করিয়ে দিলাম কান্তি, জয়েন্ট ফ্যামিলিতে স্বেচ্ছাচার চলে না। সকলের মুখই চাইতে হয়।
হ্যাঁ, সকলের মুখ চাইতে হয়।
এ দাবি ছোটভাই জয়ন্তীকুমারও তোলে। সেও এসে জানতে চায় ওই বিদঘুটে জীবটাকে কোথায় চালান করবে ঠিক করেছে মেজদা।
বলা বাহুল্য, সদুত্তর মেলে না।
উত্তরের বদলে প্রশ্নই করেন কান্তিকুমার, ঠিক আর করলাম কই?
জয়ন্তীকুমার ক্ষুব্ধ হাস্যে বলে,সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে আমার মতে ওখানেই কোনও অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসা উচিত ছিল তোমাদের। পাঁচজনের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে, তারপর ব্যবস্থা করতে যাওয়াটা বোকামি।
কান্তিকুমার এই ছোট ভাইটির সঙ্গে কখনওই কোনও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন না, কারণ বড় বেশি উত্তেজনাপ্রবণ জয়ন্তী, কথার পিঠে কথা কইতে হলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
কিন্তু এখন আর আলোচনা করার প্রশ্ন কান্তিকুমারের দিক থেকে নয়, এখন সে নিজেই আলোচনার সূত্র তুলেছে। অথবা সে অপর পক্ষীয় উকিল, আর কান্তিকুমার অভিযুক্ত আসামি।
হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট কান্তিকুমার সেন।
তাই কান্তিকুমার গম্ভীর হাস্যে বলেন, সন্দেহটা কীসের?
কীসের, তা বিশদ করে বোঝাতে হবে ভাবিনি।
ঠিক আছে। কিন্তু সন্দেহটা বাইরের পাঁচজনের মধ্যেই ধূমায়িত হচ্ছে, না নিজেদের ঘরও জ্বালাচ্ছে?
জয়ন্তীকুমার উত্তেজিত ভাবে বলে, কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেসব জানি না। তবে যেটা স্বাভাবিক সেটাই বোঝাতে এসেছি তোমাকে।
বোঝাতে এসেছে।
জয়ন্তী কান্তিকুমারকে!
হ্যাঁ, এমনিই হয়।
হাতি দিয়ে পড়েছে দেখলে ব্যাঙের পা নিসপিস করে।
অবাক হবার কিছু নেই কান্তিকুমারের।
অবাক হনও না।
মনুষ্য চরিত্রের বিচিত্র রহস্য দেখাই তো পেশা তাঁর।
তিন ভাইয়ের মধ্যে কান্তিকুমারই সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত, কান্তিকুমারই সকলের থেকে বেশি রোজগারি। কান্তিকুমার স্বভাবে রাশভারী, অথচ সদাপ্রসন্ন শান্ত স্নেহশীল। তাই কান্তিকুমার বাড়িতে সকলেরই একটু বিশেষ সমীহের বস্তু।
কান্তিকুমার সকলের সব সুবিধে অসুবিধে অভাব অভিযোগের দায় পোহান, তাই কান্তিকুমার সকলের কৃতজ্ঞতার পাত্র।
কিন্তু অবিরত সমীহ করতে করতে আর কৃতজ্ঞ হতে হতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে না মানুষ?
পড়ে।
তাই সেই উচ্চস্তরের মানুষটার কোথাও কোনওখানে দুর্বলতা ধরা পড়লে আহ্লাদের আর সীমা থাকে না লোকের। খানিকটা ক্লান্তি দূর করে বাঁচে।
কান্তিকুমারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারা গেছে এ একটা ভারী মজার ব্যাপার। তাই কারণটাকে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বিরাট থেকে বিরাটতর করে তুলছে সবাই।
কিন্তু অপরপক্ষে যে একেবারেই কেউ নেই, তাও বলা যায় না। আছে। যে আছে, সে হচ্ছে ছোটবউ মালবিকা। মালবিকা অবশ্য বরাবর মুখরা বলেই খ্যাত, তাই যা বলে স্পষ্ট প্রখর।
বলে শাশুড়ি আর বড় জায়ের মুখের উপরেই।
বাবাঃ! শুনে শুনে আর না বলে পারছি না। কদিন ধরে কি তিলকে তাল করছেন আপনারা! একটা সদ্যোজাত শিশু, তার জাত আছে না ধর্ম আছে? না সে নিজে কোনও পাপের পাপী? তাকে একটু আশ্রয় দিলে জাত ধর্ম সব রসাতলে যাবে? এতবড় বাড়িতে এত ছেলে-পুলে মানুষ হল, হচ্ছে, আর ওই একমুঠো ফুলের মতন ছেলেটা, এত ভার লাগছে আপনাদের? কুড়োনো ছেলে বলে একটা কথা তো আছেও জগতে!
শাশুড়ি যোগমায়া বিরক্ত কণ্ঠে বলেন,তোমার বুদ্ধিকে বলিহারি দিই ছোটবউমা! বাড়িতে এত ছেলে মানুষ হচ্ছে, তার সঙ্গে তুলনা করছ? আমাদের ঘরের ছেলে আর ওইটা? কোন্ পাণ্ডির পাপের ফল তার ঠিক নেই।
মালবিকা ঝংকার দিয়ে বলে ওঠে, এই আমাদের বাড়ির মতো পুণ্যবতীদের বাড়িরই কোনও পাষণ্ডির বোধহয়। ওই ছোট্ট বাচ্চাটার পাপ-নিশ্বাসে পাছে সেই পুণ্যবতীদের পুণ্যের ভরা উপে যায় তাই ওটাকে শেয়াল কুকুরের মুখে ফেলে দিয়ে, নিজেরা গঙ্গাস্নান করে পুজোর চন্দন ঘষতে গেছে।
তুই থাম ছোটবউ! বড় জা স্বর্ণপ্রভা হাতের মালাগাছটা থলিতে ঢুকিয়ে বলেন,যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে বসিস তুই, বুদ্ধি তো আর পাকবে না কোনওকালে?গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলেন, ওই কুড়িয়ে পাওয়াটা গল্পকথা কিনা কে জানে!
গল্পকথা!
তা আশ্চয্যি কী! ওই সাঁওতালদের দেশে অমন ফুলের মতন ছেলে আসবে কোথা থেকে রে?
মালবিকা ঠোঁট উলটে বলে, আসতে আবার বাধা কী। কোনও সাহেবসুবোর দয়ার দান হতে পারে।
সংসার-অভিজ্ঞ স্বর্ণপ্রভা আরও ফিসফিস করে বলেন, বকিস কেন, বুনো মুনোরা অমন ফেলে ছড়ে দেয় না। দেবেই বা কেন। ধর্ম সমাজ এসবের তো আর বালাই নেই তাদের, সাহেব ছেলেয় নিলেও নেই। ওদের নয়। আরও নিচু গলায় কী একটু বলেন তিনি।
কিন্তু নতুন কিছু কি বলেন?
সুজাতা কি এই ফিসফিস সম্বন্ধে ধারণা করেনি? দেখেনি কি সবই তার প্রতিকূল? রাঁচি থেকে ফেরা অবধি এই সাত আট মাস ভুগছে না সুমনা জ্বর বমি হজমের গোলমালে? খিদে আর খাদ্যে রুচি নষ্ট হয়ে যায়নি তার? তার ওপরেই কষ্ট করে পরীক্ষার পড়া তৈরি আর পরীক্ষা দেওয়ার চাপে চোখমুখ বসে যায়নি বেচারার? আর পরীক্ষার পর একেবারে ঘরের কোণে বিছানা আশ্রয় করে পড়েনি?
সেইজন্যেই না সুজাতা মেয়ে নিয়ে অমন অস্থির হয়ে চেঞ্জে গিয়েছিল।
হায় ভগবান, যদি না যেত!
যদি ঠিক সেই সময় ভয়ানক একটা প্রতিবন্ধকতা আসত। যদি এই দেড় দেড়টা মাস এদের চোখের বাইরে না কাটাত।
যে ঘটনাগুলো নিতান্ত সহজ চেহারায় ছিল, সে ঘটনাগুলোই যেন এখন দাঁত খিঁচিয়ে উঠছে।
সুমনার যে অসুখটা এতদিন বাড়িসুষ্ঠু সকলের দুশ্চিন্তার ব্যাপার ছিল, সেটাই কুৎসিত সন্দেহের কালিতে কালো হয়ে উঠছে।
সুজাতা আসছিল কী একটা দরকারে ছোট জার কাছাকাছিবড় জার ফিসফিস দেখে সরে যায়।
সরে যায়, কিন্তু চলে যায় না।
চলে যায় না, সে কি কৌতূহলের বশে? না হাত পা বুক বড্ড বেশি কেঁপে ওঠার দরুন অক্ষমতায়?
কে জানে কী!
তবু দাঁড়িয়ে তো পড়ে।
আর দাঁড়িয়ে পড়ে বলেই মৃত্যুদণ্ডাদেশটা স্বকর্ণেই শুনতে পায়।
শুনে ছিটকে ওঠে না। নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মালবিকা কিন্তু ছিটকে ওঠে।
বলে,ছি ছি দিদি! আপনার হাতে না জপের মালা!
জপের মালা তার কী–সদর্পে বলেন স্বর্ণপ্রভা, হ কথা বলব, গুরুর চরণ ছুঁয়ে বলব। মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে দেখিস দিকিনি।
না দিদি, এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না।
না পারলে আর কী করব। পরে সবই টের পাবি। এতবড় কাণ্ড কি আর লুকোনো থাকে! এই মতলব এঁটেই হাওয়া বদলের ছুতো। নইলে জগৎ সংসারে এত লোক হাওয়া খেতে যায়, কে কবে জঙ্গলের ধারে খোকা কুড়িয়ে পায় রে?
মেয়ের কাছে এসে আপসে পড়ে সুজাতা।
যে সর্বনাশের আশঙ্কা করছিল সেই সর্বনাশই যে ঘটল, সেই কথাই ব্যক্ত করে বলল, তবু বলব, তোর জেঠিকে আমি দোষ দিতে পারিনে। অন্যের হলে হয়তো আমরাও এই সন্দেহ করতাম।
করতে?
অদ্ভুত একটা বিদ্যুৎ ঝলসানো মুখে বলে সুমনা।
করতাম বইকী! কেন করব না? জগতে এমন কি ঘটে না? কতই ঘটছে। আমরা না হয় তাকে জানি, লোকে তো–
না, তোমরা আমার কিছুই জানো না। সুমনা স্থির স্বরে বলে, জানলে এখনও চেষ্টা করতে না আমার মন ফেরাবার। জেনে রেখো মা, আমি যে অসহায় প্রাণীটাকে আশ্রয় দিয়েছি, তাকে রক্ষা করবার জন্যে পৃথিবীর সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করব। তোমরা যদি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাও, সে শাস্তিও মাথা পেতে নেব।
প্রতিকূলতাই শক্তির জন্মদাতা।
প্রতিকূলতা না এলে হয়তো এত জেদের শক্তি সঞ্চয় হত না সুমনার। অপরপক্ষের শিবিরে রণসজ্জা হচ্ছে অনুমান করে ও নিজের তূণে বাণ ভরে।
আর যতই ভাবতে থাকে এই এক মুঠো হাড়মাংস, এই এক কণা প্রাণ, এর বিরুদ্ধেই ওদের শিবিরে এত সজ্জা, ততই ভয়ংকরী হয়ে ওঠে সন্দেহে, অবিশ্বাসে, ঘৃণায়।
বড়রা কেউ কোনও দরকারে একবার ওর ঘরে ঢুকলে, বিদ্যুদ্বেগে গিয়ে ছেলেটাকে বিছানা থেকে তুলে কোলে চেপে নেয়, ঘোটরা এসে দাঁড়ালে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে তাদের গতিবিধির দিকে।
যদি বড়রা কিছু শিখিয়ে দিয়ে থাকে।
যদি এমনই কৌতূহলের বশে কোলে তুলতে গিয়ে ফেলে দেয়!
ঘর থেকে বেরোনো প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। নিতান্ত স্নান আহারের সময় ব্যতীত ঘর থেকে নড়ে না সুমনা। আর সেই সময়টুকু, এখনও জগতে যাকে এক কণা বিশ্বাস করে, সেই মানুষটাকে বসিয়ে রেখে যায়।
মানুষ বলেই যদি গণ্য করা যায় তাকে।
সে হচ্ছে তার সব ছোটভাই অজীন।
প্রথম দিন একমাত্র অজীনই দিদির ঘরে এসে অসীম কৌতূহলে ছোট্ট ছেলেটার রক্তাভ হাতের মুঠি আর পায়ের পাতা দুটিতে আলতো হাত রেখে প্রশ্ন করেছিল, রাস্তায় পড়ে ছিল?
সুমনা ছোটভাইয়ের গালে হাত বুলিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ রে, একেবারে জঙ্গলের ধারে। ওঁয়া ওঁয়া করে কান্না কোথা থেকে আসে, বলে ছুটে গিয়ে দেখি এই কাণ্ড! গায়ে কাঠপিঁপড়ে ধরেছে, তাই কাঁদছে।
অজীন বোধ করি তার কোনও একটি জানা গল্পের কাহিনী স্মরণ করে বলেছিল,নিশ্চয় ওকে নেকড়ে বাঘে চুরি করে এনেছিল। তাই না দিদি?
সুমনা অন্যমনা হয়ে বলেছিল, নেকড়ে বাঘে চুরি করে এনেছিল, না নেকড়ে বাঘেই ফেলে দিয়ে গিয়েছিল কে জানে!
বাঃ, ওরা মানুষখেকো কোথায় পাবে? তবে চুরি করে নিয়ে গিয়ে, খেয়ে না ফেলে মানুষ করে ওরা। তুমি যদি তুলে নিয়ে না আসতে, ও নিশ্চয় নেকড়ে-মানুষ হয়ে যেত দিদি।
ছেলেটা বালক।
তার উপযুক্ত উত্তরটা নয়।
তবু উত্তরে বলেছিল সুমনা, তা হোক, তা হলেই ভাল হত। পৃথিবীতে তো অনেক মানুষ-নেকড়ে আছে, দু-একটা নেকড়ে-মানুষ থাকলই বা!
অজীন বলে ওঠে, বাঃ তুমি তা হলে কী পুষতে?
সুমনা চমৎকৃত হয়ে বলে, আমি এটা পুষছি, একথা তোকে কে বললে রে অজি?
অজীন বলে ওঠে, বাঃ, ঠাকুমা বলেছিল না বুঝি বাবাকে?
বলেছিল! কী বলেছিল?
বলেছিল, হ্যাঁ রে কান্তি, তোর মেয়ে তা হলে ওই রাস্তা থেকে একটা ছেলে কুড়িয়ে এনে পুষবে!
বাবা বললে, হ্যাঁ, এতকাল কুকুর বেড়ালের ছানা কুড়িয়ে এনে পুষেছে, এইবার মানুষের ছানা এনেছে। তা ঠাকুমা বলল কী, বিদেয় করে দে। বিদেয় করে দে। কুকুরছানা পুষলে তো আর খাজনা লাগে না। মানুষের ছানা পুষতে যে খাজনা লাগে।–হ্যাঁ দিদি, সত্যি?
সত্যি বইকী অজু! ঠাকুমা কি আর ভুল বলেছেন?
মনে মনে বলে, ভুল? বোধ করি এর চাইতে বড় সত্য আর নেই, কিন্তু সুমনা একবার দেখবে কত অঙ্ক সেই খাজনার।
অজীন ততক্ষণে অন্য প্রসঙ্গে এসে পড়েছে।
দিদি, এর নাম কী?
নাম!
সুমনা ভাবে, কই, এর তো কোনও নাম ঠিক হয়নি এখনও! সুমনা মনে মনে, নিতান্ত নিভৃতে কত অজস্র নামে ডাকে, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সেই বিশেষণ কোথায়, যা দিয়ে তাকে বিশ্বসংসারে অভিহিত করা যাবে?
দরকার পড়েনি।
ওর সম্পর্কে কারও কোনও কথা তো হয় না। তর্কের সময়, উপদেশের সময়, সকলেই বলে ওটা, ও!
সুমনা হেসে বলে, ওর মা বাপ তো ওকে নাম দেয়নি, তুই দে না একটা নাম।
আমি?
মহোৎসাহে প্রায় ফুটখানেক উঁচু হয়ে ওঠে অজীন, আমার নাম তুমি নেবে?
ওমা কেন নেব না? তুই বেশ ভাল দেখে–
আচ্ছা দাঁড়াও, রোসো রোসো, আমি ওর নাম দিলাম অচিনকুমার।
সুমনা বিস্মিতকণ্ঠে বলে,ওরে বাবা, এত সুন্দর নাম, তুই কোথায় পেলি রে? আগে ভেবে রেখেছিলি বুঝি?
কক্ষনো না! আমি তো এইমাত্তর বানালাম।
সত্যি!
সত্যি সত্যি সত্যি। এই তিন সত্যি। আমি তো ওর মামা হই, তাই আমি ভাবলাম আমি অজীনকুমার, ও অচিনকুমার।
সুমনা নিষ্পলকে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,তুই ওর মামা হোস, একথা কে বললে?
বাঃ বলবে আবার কে! আমার বুঝি বুদ্ধি নেই? আমি তো তোমার ভাই হই। তোমার পোষা ছেলের আমি মামা হব না তা হলে?
সুমনা শান্তহাসি হেসে বলে, তা হলে শুধু মামা নয়, পোষা মামা!
পোষা মামা? তাই বলে ডাকবে ও আমাকে?
ডাকতেও পারে। যদি জগতের লোক ওকে কথা বলতে দেয়।
বলতে দেবে? কী করে বলতে দেবে?অজীন একটু ধাঁধায় পড়ে বলে,ও তো এতটুকু, ও কি কথা বলতে পারে? আগে কথা বলতে শিখুক।
হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো সত্যি!
সুমনা মনে মনে লজ্জিত হয়।
ছোট্ট ছেলেটার কাছে অসতর্ক কথা বলে ফেলার জন্যে।
অবশ্য অজীন আর একবার প্রসঙ্গ বদলেছে ততক্ষণে, দিদি, ওর দোলনা নেই?
নাঃ! শুনছিস রাস্তায় পড়ে ছিল। আবার দোলনা!
তা এখন তো আর রাস্তায় পড়ে নেই, অজীন বিজ্ঞভাবে বলে, এখন তো সব কিনতে হবে। দিদি, ও আর একটু বড় হলে আমি গাড়ি ঠেলব ওকে।
সুমনার চোখে জল এসে যায়।
শিশুর সরলতায়।
শিশুর পবিত্রতায়।
ইস! কী লাল পা!
অজীন সেই লাল পা-টি তুলে ধরে টিপে টিপে আহ্লাদে বিগলিত হয়। চুলে হাত বুলোয়, আঙুলগুলি তুলে তুলে দেখে মোহিত হয়, তারপর সহসা বলে ওঠে, ইঃ এর মার কী কষ্ট! হারিয়ে ফেলে কত কাঁদছে হয়তো!
.
ছোট ছেলের নির্মল মনের এই সহজ চিন্তার কথাটা সেদিন অনেকক্ষণ ধরে ভেবেছিল সুমনা।
ইস্ এর মার কী কষ্ট!
কত কাঁদছে হয়তো।
ঠিক ঠিক!
ছোট শিশুই সত্য নির্ণয় করতে পারে।
যাকে মনে মনে এ-যাবৎ সুমনা নিষ্ঠুর জঘন্য রাক্ষসী পিশাচী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে এসেছে, অদেখা সেই মায়ের উপর হঠাৎ সহানুভূতিতে মন ভরে যায় তার।
মনে পড়ে যায় রেলগাড়ির সেই বউটার কথা, বাবাঃ যা কষ্ট! ভাবলে অবাক লাগে এত কাণ্ডকারখানায় এক-একটা মানুষের পৃথিবীতে আসা
সেই কষ্টের ধন!
সেই দুঃখের নিধি!
তাকে ফেলে দিয়ে যেতে কত কান্না কেঁদেছে সে। তবু ফেলে দিয়ে যেতে হয়েছে। তাদের পরম পবিত্র মহৎ সংসারে ওইটুকুর জায়গা হবে না বলে।
ওই কাচ কাচ চোখ, কী লাল হাত-পাওলা ছেলেটার দুরন্ত হাত-পা নাড়া দেখতে দেখতে বহুবার ভেবেছে সুমনা, উঃ কোন্ প্রাণে ফেলে দিয়ে গেছে!
আজ ভাবল, আহা কোন্ প্রাণেই ফেলে দিয়ে গেছে।
অজীনই একমাত্র।
অজীনকেই হয়তো কেউ এখনও জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ায়নি।
তাই ও যখন-তখন এ ঘরে ছুটে আসে, পোষা-ভাগ্নের অলৌকিক খেলাটুকু দেখতে।
২. চুলের মুঠি
সুমনা যখন ঘরের অন্য কাজ করে, তখন অজীন চিৎকার করে ওঠে, ও দিদি দিদি, নিজের চুলের মুঠি নিজে ধরছে! ও দিদি, নিজে নিজে কান মলছে!
সুমনা এসে হেসে হাত ছাড়িয়ে নেয়। জানে, এক্ষুনি কেঁদে উঠবে।
ওরকম করে কেন দিদি?
সুমনা হেসে বলে, বোধহয় নিজেকে নিজে শাস্তি দেয়। বলে,ওরে বোকা গাধা ছেলে কেন তুই তবুও বেঁচে থাকলি! কেন বাঘের পেটে শেয়ালের পেটে গেলি না।
যাঃ ও বুঝি কিছু বুঝতে পারে?
পারে। সব পারে। ছোট্ট বাচ্চারা যে ভগবান, জানিস না?
ভগবান!
ছোট্ট বাচ্চারা ভগবান!
অজীন খেলতে চলে যাবার পর সেদিন সুমনা ভেবেছিল, জগতে কত ছোঁদো কথাই না চলে আসছে।
কথার সেই অদ্ভুত অসার ছেঁদোত্ব নিয়ে কেউ কোনওদিন হাসাহাসি করে না। বলে না, হায় শিশুরূপী ভগবান! মানুষের দেওয়া সামান্য একটু পরিচয়পত্রের অভাবে তো তোমার ভগবানত্বের রসাতল প্রাপ্তি।
আজ সুজাতা কেঁদে চলে যাবার পর আর একবার ভাবল সুমনা, স্নেহ ভালবাসা বিশ্বাস! এ শব্দগুলোও তা হলে কত হেঁদো!
সুমনা!
যে নাকি এ বাড়ির সবচেয়ে আদরের আর সবচেয়ে গৌরবের মেয়ে!
রূপে গুণে বিদ্যায় হৃদয়বত্তায় যার নাকি জুড়ি খুঁজে পেতেন না জেঠিমা জেঠামশাই ঠাকুমা কাকা!
মুহূর্ত দ্বিধা হল না তাঁদের সুমনা সম্পর্কে এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে।
সম্ভাব্য অসম্ভাব্য যৌক্তিক অযৌক্তিকতারও বিচার মাত্র নেই, সুমনা যে ওঁদের একটা পৈশাচিক উল্লাসের জোগান দিতে পেরেছে এটাই পরম লাভ।
তা লাভ বইকী! পৈশাচিক আনন্দ উপভোগের সুযোগ কবেই বা আসে মানুষের।
ভিতরের পিশাচ সত্তা তো উপবাসী হয়ে পড়ে থাকে। তাই না সুযোগ পেলে তার একটি কণাও ছাড়তে চায় না মানুষ।
অথচ ইচ্ছে করলেই ওরা উদার হতে পারত, সহজ হতে পারত, এই ছোট্ট খেলনাটা নিয়ে কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়ি করে বাইরের আরও পাঁচজনের কাছে সমস্ত ব্যাপারটাই হালকা করে ফেলতে পারত।
সুমনার এই কুড়োনো ছেলেটা একমাত্র সুমনারই সম্পত্তি হয়ে থেকে সংসারে একটা পাষাণভারের সৃষ্টি করত না।
ওরা তখন এই নামহীনের একটা নাম দিত।
আর কৌতুক করে বলত সুমনার ছেলে। যেমন বলত ছেলেবেলায়, সুমনার ডল পুতুলটাকে।
কিন্তু না! সহজ কৌতুকে তেমন আনন্দ নেই লোকের, যেমন আনন্দ নিষ্ঠুর কৌতুকে।
.
চিন্তায় ছেদ পড়ল।
ঘরে ঢুকলেন কান্তিকুমার।
আদৌ যিনি আর ঢোকেন না এ ঘরে। তাকিয়ে দেখলেন, সুমনা নিবিষ্ট হয়ে কী একটা সেলাই করছে।
বাবাকে দেখে হাতের জিনিসটা রেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। হয়তো বা ইচ্ছে করেই তাকে একটু আড়াল করে দাঁড়াল, যাকে জগতের চোখ থেকে আড়াল করে রেখেছে নিজের সমস্ত প্রাণটুকু দিয়ে।
হাতের সেলাইটাকে কিন্তু আড়াল করতে পারল না। তাকিয়ে দেখলেন কান্তিকুমার।
কী ও?
সুনিপুণ এম্ব্রয়ডারির কাজের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে পড়ে আছে।
কাঁথা নাকি! তাই! তাই নিশ্চয়।
হতাশ দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকান কান্তিকুমার।
কিন্তু শুধু কি ওর ওই নির্বুদ্ধিতার প্রমাণটুকুকেই আড়াল করেছে সুমনা? আড়াল করেনি নিজেকে?
সুমনার ওই দৃঢ় কঠিন মুখের রেখার অন্তরালে সেই সুমনাকে কি আর কোনওদিন খুঁজে পাওয়া যাবে? যাকে কান্তিকুমার ঘরে এসেই বলতে পারতেন, আঃ ঘাড় পিঠে ব্যথা করে কী হচ্ছে ওসব? সবে এই একটু সেরেছিস। যাকে আগে আগে বলতেন, সুমি, তুই নাকি ফলের রস খেতে চাস না?…সুমি তুই এই ঠাণ্ডার সময় পাতলা জামা গায়ে দিয়ে বেড়াচ্ছিস যে!..
না, সে সুমনা ঢাকা পড়ে গেছে ওই কঠিন রেখাগুলোর অন্তরালে।
কষ্টে নিশ্বাসের গভীর শব্দটা চেপে কান্তিকুমার বলেন,তোমার আজ রেজাল্ট বেরোবার দিন, মনে নেই বোধহয়।
রেজাল্ট বেরোবার দিন!
এ ভাষা এখনও আছে জগতে।
সমস্ত চেতনার মধ্যে ভয়ানক একটা আলোড়ন ওঠে। বাবার নিষ্ঠুরতায় মাথার মধ্যে যেন ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে।
জানত না। মনে ছিল না।
তবু কষ্টে ঘাড় নাড়ে।
মনে আছে? যাক তবুও ভাল। বেলা চারটেয় টাঙিয়ে দেবে শুনছি। আমি তা হলে কোর্ট থেকে একটু সকাল সকাল আসছি–
হঠাৎ গলাটা ঝেড়ে পরিষ্কার গলায় বলে ওঠে সুমনা, তুমিই তো দেখে আসতে পারো বাবা!
আমি! আমি দেখে আসতে পারি। হ্যাঁ, পারব না কেন? দেখে আসব। তুমিই তা হলে পারছ না!
কী করে পারব? সুমনা ঘাড়টা ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,ওকে কি কেউ দেখে?
না দেখাই স্বাভাবিক। তুমি তো কাউকে বিশ্বাস করো না।
বাবা!
বলো।
চেতনায় সেই ক্ষণপূর্বের আলোড়ন এখনও রয়েছে। কলেজ, সহপাঠিনীরা, বাইরের পৃথিবী!…ঝলসে উঠছে চোখের সামনে! তবু গলা কাঁপতে দেবে না সুমনা।
বাবা, বিশ্বাস করবার আশ্বাস কি কেউ আমাকে দিয়েছে?
সুমনা! তুমি একটা ছোট জিনিস নিয়ে এত বেশি বাড়ালে যে, লোকে দিশেহারা হয়ে গেছে; আমি ভাবতে পারছি না সুমনা, তুমি তোমার সমস্ত কেরিয়ারকে নষ্ট করে, ক্রমশ ফসিল হতে থাকবে ওই জীবটার জন্যে! বাইরে বেরোনো তো দূরের কথা, ঘর থেকে বেরোনো পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছ। এ বাড়িতে কারও সঙ্গে যে তোমার কোনও সম্বন্ধ কখনও ছিল, মনে হয়, তা ভুলে গেছ। রেজাল্ট বেরোবার পর যে আর কোনও করণীয় আছে ভাবছও না সে কথা
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার কথা বলছ?
বলছি না কিছু। সেই রকম একটা কথা ছিল, সেইটুকুই মনে পড়িয়ে দিচ্ছি।
বাবা! আবার খাটের ওপর বসে পড়ে সুমনা। মুখে হাতচাপা দিয়ে বলে,তুমি আমাকে তাড়িয়েই দাও। আমি আর এই স্নেহহীন বাড়িতে থাকতে পারছি না।
কাঠিন্যের আড়ালে আজও তা হলে আছে সুমনা?
কান্তিকুমার কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে বলেন,স্নেহ তো তুমি নিজেই ইচ্ছে করে ফেলে দিচ্ছ সুমনা। শুনলাম তুমি শিমুলতলা থেকে এসে অবধি কারও সঙ্গে দেখা করোনি, প্রণাম করোনি, ভালভাবে কথা বলোনি। কেউ কথা বলতে এলে উদ্ধত ভাবে কথা বলেছ
কেউ তো আমার সঙ্গে বলতে আসছে না বাবা, আসছে উপদেশ দিতে।
তা তাতেই বা তুমি অসহিষ্ণু হচ্ছ কেন? তাঁরা তোমার কল্যাণকামী।
হ্যাঁ। দৃশ্যত তাই বটে।
বেশ তো, অদৃশ্য লোকের কথাটা নাই ভাবলে। গুরুজনের কথা ভাবে নেওয়াই তো ভাল। আগে তো কখনও তোমাকে এসব শিক্ষা দিতে হয়নি সুমনা! তোমার বুদ্ধিতে কী এসে আশ্রয় করল! হতাশ-নিশ্বাসের শব্দকে আর গোপন করতে পারেন না কান্তিকুমার।
সুমনা কী উত্তর দিত কে জানে!
ঠিক এই মুহূর্তে ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল ছেলেটা।
পরিত্রাহি কান্না।
যে কান্নাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ির লোকের কান আড়াল করে রাখবার চেষ্টা করে সুমনা।
কান্তিকুমার উঠে দাঁড়ান।
বলেন, তা হলে তোমার আর রেজাল্টের জন্যে যাবার সুবিধে হচ্ছে না?
সেই কান্নার দরজায় একটা হাত চাপা দিয়ে রেখে সুমনা বলে, না, যাব।
আচ্ছা!
বাবা!
কান্তিকুমার চলে যাচ্ছেন।
সুমনার ডাকটা পিছনে আছড়ে পড়ে।
ফিরে তাকান কান্তিকুমার।
তাকান প্রত্যাশার পাত্র হাতে। ভাবেন, হয়তো এই মুহূর্তে বলে উঠবে সুমনা, বাবা তুমি যা ভাল বোঝ করো।
কিন্তু না।
তা বলে না সুমনা। শুধু বলে, তুমি মাকে বোলো তখন এ-ঘরে একটু থাকতে।
ছেলেটাকে কোলে করে ভোলাতে ভোলাতেই বলছে সুমনা।
কান্তিকুমার একটু চুপ করে থেকে বলেন,বেশ। বলে দিচ্ছি। তোমার মার কাছে এটুকু বলার সাহসও তোমার হচ্ছে না, এটা অভিনব। তোমার এই কুণ্ঠাই অনেকের অনেক সন্দেহের উপকরণ জোগাচ্ছে। যাক সে কথা। কিন্তু সুমনা, ওই বাচ্চাটাকে কতদিন তুমি ঘরে আগলে রাখতে পারবে? ও তো ঘর থেকে বেরোবে। শিশুর স্বধর্ম যা, তা পালন করবে। তখন?
আমি পরের কথা কিছু ভাবতে পারছি না বাবা।
না ভাবাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বলি শোনো–আমি ওর জন্যে আয়া রেখে দেব। তুমি এম. এ. পড়বে।
কান্তিকুমার বেরিয়ে যান ঘর থেকে।
.
একটু পরে অনড় সুমনার কানে একটা হইচই শব্দ এসে পৌঁছয়। কে যেন এসেছে। কে এসেছে? পিসিমা। পিসিমা এলে তো দাদাও আসবে। যার আশায় দিন গুনছে সুমনা। এখনও যার ওপর একটু আশা রেখেছে। প্রতিদিন যার কথা মনে পড়েছে, একজন কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছে দাদা কবে আসবে, দাদা যেখানে গেছে তার ঠিকানা কী। পারেনি জিজ্ঞেস করতে।
হ্যাঁ পিসিমাই।
এসে পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি।
পুরী গিয়েছিলেন রথের রশি টানতে। থেকে গিয়েছিলেন তারপর মাস দেড়েক। তাঁর সঙ্গেই অলক গিয়েছিল।
দাদা? দাদা কোথায় রে? এসেই জিজ্ঞেস করেছিল সুমনা, কোনও একটা ছোট ছেলেকে।
শুনেছিল দাদা পিসিমার কাছে পুরী গেছে।
দাদা! জেঠিমার একমাত্র ছেলে। একান্নবর্তী পরিবারে জেঠতুতো খুড়তুতোর বিভেদ ছোটদের হৃদয়ে বিষগাছ রোপণ করে না। নিজের দাদা থাকলে সুমনা এই জেঠতুতো দাদার চাইতে কিছু বেশি ভালবাসত, এমন ধারণা তার অন্তত নেই।
তাই পিসিমার গলার শব্দে আশায় উদ্বেল হয়ে ওঠে সুমনা।
তবে দাদাও এসেছে।
কিন্তু
যদি দাদাও!
হ্যাঁ, যদি দাদাও ওদের মতো হয়ে যায়। যদি মুখটা কালো করে ঘরের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করে, ঘরের মধ্যে না তাকায়! যদি দাদাও ভাবে, ওই কুড়িয়ে পাওয়ার গল্পটা একটা বানানো গল্প মাত্র।
বেরোতে গিয়ে থেমে যায় সুমনা।
ফিরে আসে দরজার কাছ থেকে।
ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলে,আসুক আসুক, আরও ঝড় আসুক। দেখব আমার শক্তি।
দাদার গলার শব্দও ভেসে আসছে। ওর স্বভাবগত উচ্ছ্বাসে ঠাকুমার সঙ্গে কথা চালাচ্ছে। দাদার এই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠের ধ্বনির তরঙ্গে যেন ভেসে আসছে আরও একটা কণ্ঠধ্বনি।… বাইরে নয়, মনে।
আশ্চর্য!
কলকাতায় ফিরে আসার এই এতদিন পরে মনে পড়ল তাকে সুমনার। কান্তিকুমারের কথাই তা হলে ঠিক? সুমনাকে ভূতে পেয়েছে?
তাই সুমনা জামাকাঁথা ভিজে বিছানা ফিডিংবটল আর হাসি কান্নার মধ্যেই একেবারে সমাধিস্থ হয়ে গেছে।
সত্যিকার মা, নতুন মা, অনেক তো দেখেছে সুমনা, কই এমন অবস্থা তো হয় না তাদের। সারাক্ষণ শুধু চোখ পেতে বসে থাকতে তো দেখে না। বরং বাপরে মারেই করে কত সময়।
সুমনার হৃদয়েই কি মাতৃস্নেহ এত প্রবল যে, সমস্ত পৃথিবী বিস্মৃত করে দিচ্ছে সেই স্নেহপ্লাবন। অথচ যে মাতৃস্নেহ কৌতুককর!
সুমনা ভাবে, সত্যিকার মাদের কি সর্বদা এমন হারাই হারাই ভয় হয়? তাদের কি এককণা একটা প্রাণকে সারাক্ষণ পৃথিবীর অকরুণ আর হিংস্র দৃষ্টির আওতা থেকে রক্ষা করে ফিরতে হয়?
সুমনার মতো দুর্ভাগ্য কার?
কান্তিকুমার বলে গেলেন সুমনা গুরুজনের সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহার করেছে। অন্যায় সুমনার, ঘোরতর অন্যায়। কিন্তু গুরুজন যদি গুরুত্ব হারায়? তারা যদি স্নেহ সহানুভূতির কোঠা থেকে নেমে এসে মজা দেখার কোঠায় দাঁড়ায়?
সুমনা কী করেছে?
কী এমন গর্হিত কাজ।
একটা জীবন, হয়তো সেই মুহূর্তে বিনষ্ট হয়ে যেত, তাকে রক্ষা করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই তার অপরাধ।
কিন্তু কেউ তাকে বলেনি সত্যিই তো ঠিক করেছ।
অবশ্য তারপর কান্তিকুমার যা ব্যবস্থা করেছিলেন, হয়তো সেইটাই মেনে নেওয়া উচিত ছিল সুমনার।
পারেনি সুমনা।
কচি কোমল মাতৃদেহ স্পর্শাকাঙ্ক্ষী শিশু দেহখানি বুকে চেপে ধরে সুমনা। মনে মনে বলে, না পারিনি।
মনে হয়েছে ও যেন ওর ওই কাঁচের মতো চোখ দুটি তুলে সুমনার কাছে আশ্রয় চেয়েছে।
কিন্তু সুমনাকে কেউ সুবিচার করল না।
সুমনার প্রকৃতি কারও মনে পড়ল না।
মনে পড়ল না অনেকদিন আগে একটা পথ থেকে কুড়নো ঘেয়ো কুকুরছানাকে এমনই বুক দিয়ে আগলে থেকেছিল সুমনা। শত তিরস্কারেও ত্যাগ করেনি তাকে।
তারপর তো সে নিজেই মুক্তি দিয়ে গেল সুমনাকে।
একে নিয়ে তাই না এত উৎকণ্ঠা সুমনার। এতগুলো কুটির বিষ হজম করে ও কি বাঁচবে?
ভ্রূকুটি।
সবাইয়ের ভ্রূকুটি।
যাদের স্বার্থে এতটুকু আঁচড় লাগবে না, তারাও এসে কুটিল দৃষ্টিতে তাকায়।
না, এখন আর কেউ আসছে না, কিন্তু প্রথম প্রথম সবাই এসেছে এ-ঘরে। মেলার বাজারে পাঁচপেয়ে গোরু দেখতে যেমন আসে, তেমনই এসেছে খোকা কোলে সুমনাকে দেখতে।
সুমনা তাদের সঙ্গে উদ্ধত হয়ে কথা বলেছে। সে খবর পেয়েছেন কান্তিকুমার। কিন্তু খবর পেয়েছেন কি কীভাবে তারা কথা বলেছে?
কতটা ব্যঙ্গরসাশ্রিত।
কতটা ঘৃণা আর ধিক্কার মিশ্রিত!
ঠাকুমা!
যে ঠাকুমার চক্ষের নিধি সুমনা।
সুমনার যাত্রাকালে যিনি বাহান্ন দেবতার নির্মাল্য আর চরণামৃত এনে হাজির করেছিলেন, আর চোখের জল মুছে-মুছে আঁচলের কোণটা ভিজিয়েই ফেলেছিলেন।
সেই ঠাকুমা এসে গাল হাত দিয়ে ছি ছি করে উঠলেন, হ্যাঁ রে মনা, এই তোর বিদ্যেবুদ্ধি, এই তোর রুচি প্রবৃত্তি! রাস্তায় ফেলে দেওয়া জঞ্জাল কুড়িয়ে এনেছিস তুই! তোর বাবা অনাথ আশ্রমে দিতে চেয়েছিল, দিসনি!
তখনও মানুষের ওপর একটু আশা রাখত সুমনা। তখনও জানত না মানুষ সত্যি কত ক্ষুদ্র, কত দীনচিত্ত!
তাই সেই ফুলের মতো ছেলেটাকে দু হাত বিছিয়ে ধরে ঠাকুমার সামনে বাড়িয়ে বলেছিল, আচ্ছা দিদা, তাকিয়ে একবার দেখো তো, ডাস্টবিনের জঞ্জাল বলে মনে হচ্ছে?
ঠাকুমা সাত পা পিছিয়ে গিয়েছিলেন। হাঁ হাঁ করে বলে উঠেছিলেন, হচ্ছিল আর একটু হলে। এই অবেলায় নেয়ে মরতে হত।
নেয়ে মরতে তুমি একে ছুঁলে?
তা আমার এখনও পুজো পাঠ ছিষ্টি বাকি। না নাইলে? তোমার ওই সোনার কার্তিকটি কীসের ছেলে তা তো আর
হ্যাঁ, উদ্ধত হয়েছিল সুমনা।
বলেছিল, দিদা, খুব তো বড় বড় কথার বড়াই করো। খুব তত ভাগবত আর চৈতন্যচরিতের পাঠ শুনে এসে জীবে দয়ার গুণকীর্তন করো, ভেতরে ভেতরে মন এত ঘোট কেন?
ঠাকুমা রেগে উঠে বলেছিলেন, তা তোর মতন এত উঁচু মন যদি ভগবান না দিয়ে থাকে? বলি আইবুড়ো মেয়ে তুই, তোর এত ফড়ফড়ানি কেন রে? লোকলজ্জা নেই? ছেলে ছেলেকরে আদিখ্যেতা করলে লোকে বলবে কী?
দিদা! সংসারে যদি একটা মা-মরা ছেলে থাকত, তাকে মানুষ করলে আইবুড়ো মেয়ের নিন্দে হয়?
শোনো কথা! তাতে আর এতে! এর মা কি মরেছে? কে জানে কোন চুলোখাকি—
দিদা! এর কাছে তো এর মা মৃতই।
ঠাকুমা বিরক্তকণ্ঠে বলেছিলেন,অত কথা জানি নে মনা, ওসব অশুদ্ধ ছেলে ঘরে থাকলে সকলের সঙ্গে ছোঁয়া নাড়া হবে না? আর তুই ওর ঝি-গিরি করলে তোর হাতেই বা কে জল খাবে?
উদ্ধত হয়েছিল সুমনা।
বলেছিল, আমি কাউকে হাতের জল খাওয়াতে যাবও না দিদা। আর কেউ না খেলে দুঃখে মরেও যাব না। তবে তোমাদের ধর্ম পুণ্যি গীতা ভাগবত সব মর্ম জানা হয়ে গেছে আমার। তাই ভয়ও নেই।
.
এসেছিলেন জেঠি।
সকালবেলা স্নানের আগে।
ডিঙি মেরে ঘরের মধ্যে একটু পা বাড়িয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ রে সুমি, ঠাকুমাকে নাকি যাচ্ছেতাই করেছিস?
সুমনা উদ্ধত হয়েছিল।
কারণ, সুমনা তখন মানুষের ওপর থেকে আশা সরিয়ে নিচ্ছিল।
তাই বলেছিল, হ্যাঁ করেছি।
ওমা শোনো কথা। হ্যাঁ লা সুমি, তুই তো আগে এমন ছিলি না।
আজকাল ওইরকমই হয়েছি জেঠিমা। ভূতে পেয়েছে কিনা।
দেখ সুমি, তোর ঘরে আমি পা ধুতেও আসতাম না, এসেছি নেহাত দুটো সৎ উপদেশ দিতেই। তা অপমানটা করলি ভাল। তবে বলি, এ বাড়িতে তোর ওই ছেলে নিয়ে আদিখ্যেতা চলতে থাকলে আমাদের দু প্রাণীকে বাধ্য হয়েই আশ্রমে গিয়ে থাকতে হবে।
সুমনা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল।
বলেছিল,আহা! জেঠিমা, আমাকে তা হলে একদিন সন্দেশ খাইয়ে দিও। আমিই যখন তোমার উচ্চমার্গের পথপ্রদর্শক।
অতটা অহংকার ভাল নয় সুমি—
বলেছিলেন জেঠিমা।
যে জেঠিমা বাড়িতে কেউ এলেই শতমুখে সুখ্যাতি করতে বসতেন সুমনার। বলতেন, এমন গুণের মেয়ে এ-যুগে জন্মায় না। বলতেন,এত রূপ, এত গানের গলা, বাপের কত পয়সা, বছর বছর ক্লাসে ফাস্ট, অথচ এতটুকু চাল অহংকার নেই। মেয়ে তো নয়, সোনার মেয়ে।
সেই জেঠিমা বললেন, অত অহংকার ভাল নয় সুমি।
বলেছিলেন, বাপের পয়সায় ধরাকে সরা দেখছিস, মনে জানিস রাজপুত্তুর এসে বিয়ে করে নিয়ে যাবে, যাকে যা ইচ্ছে বলে নিতে পারি। কিন্তু ওই ছেলে পালতে বসলে বিয়ে হবে না, তা মনে রাখিস।
মনে রাখব।
বলেছিল সুমনা।
চলে গিয়েছিলেন জেঠি।
এসেছিলেন জেঠা।
অনেক জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিয়েছিলেন, আর বলেছিলেন, এখন আমার কথা তেতো লাগবে। কিন্তু দেখো পরে বলতে হবে, হ্যাঁ বলেছিল বটে জেঠামশাই।
উদ্ধত হয়েছিল সুমনা।
বিনয়ের ছদ্মবেশে যতটা ঔদ্ধত্য সম্ভব। বলেছিল, আপনার উপদেশ আমার মনে থাকবে জেঠামশাই।
পর পর তাসের মতো সাজিয়ে দেখছে সুমনা।
এসেছিলেন কাকা।
যাচ্ছেতাই গালাগাল করতে করতেই ঢুকেছিলেন। সুমনাকে নয়, সুমনার মা বাপকে।
আর বলেছিলেন, একান্নবর্তী পরিবারে কারও যা খুশি করবার স্বাধীনতা নেই। হতে পারেন মেজবাবু হাইকোর্টের উকিল, কিন্তু ছোটবাবু আইনের সাহায্য নিয়ে এই স্বেচ্ছাচার অনাচার বন্ধ করে দিতে পারেন। মেজবাবুকে বাধ্য করতে পারেন ওই ছেলেটাকে অনাথ আশ্রমে পাঠাতে।
মানুষের ওপর আশা আর তখন ছিল না সুমনার, তাই উদ্ধত হয়েছিল। বলেছিল, সেই চেষ্টাটাই বরং করা গে ছোটকাকা। তবু কিছু পরকালের কাজ হবে।
বাঘিনীর মতো দরজা পাহারা দিয়ে কথা বলেছিল ওদের সঙ্গে। পাছে কারও নজর লাগে।
কিন্তু ছোটখুড়ির সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহারের কোনও কারণ ছিল কী? ছোটখুড়ি তো ওদের বিপক্ষে। সুমনারই পক্ষে।
অর্থাৎ ওইটাই স্বধর্ম মালবিকার। প্রত্যেকে যা বলে, ও তার উলটো বলে। প্রত্যেকে যে ব্যাপারের বিপক্ষে রায় দেয়, ওর রায় সব সময় তার স্বপক্ষে। একবার একটা ঝি বাসন চুরি করে ধরা পড়েছিল। বাড়িসুষ্ঠু সকলে তাকে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করে তাড়িয়েছিল, মালবিকা সে চলে যাবার মুখে তাকে ঘরে ডেকে দশটা টাকা বকশিশ দিয়ে বলেছিল,অনেক লাঞ্ছনা খেয়েছিস। নে সন্দেশ খা।
কাজেই মালবিকা যে সুমনাকেই সমর্থন করবে, এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু মালবিকার সঙ্গেও নম্রতা করেনি সুমনা। সুমনা ধৈর্য হারিয়েছিল।
মালবিকা যখন ঘরে এসে বলেছিল, কই দেখি যশোদার গোপালকে!
তখন সুমনা ছেলে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল। মালবিকা বুঝতে পারেনি, কোলে করতে গিয়েছিল, সুমনা প্রায় হাত থেকে কেড়ে টেনে নিয়েছিল। বলেছিল, থাক ছোট খুড়িমা, বকুনি বরং সহ্য হয়ে যাচ্ছে, ব্যঙ্গটা হজম করতে পারব না।
মালবিকা বলেছিল,আমি তোকে ব্যঙ্গ করতে আসিনি সুমি! ভাল ভেবেই এসেছি।
সুমি বলেছিল,বিশ্বাস করা শক্ত ছোটখুড়িমা।
আহত হয়ে চলে গিয়েছিল খুড়ি।
তারপর রাগ আর বিরক্তি, অপছন্দ আর আক্রোশ ধোঁয়াতে ধোঁয়াতে আগুন দেখা দিয়েছে, সুমনাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে মালবিকাও।
জেঠি সকলকে চুপি চুপি বলে বেড়াচ্ছেন, মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে দেখো। রঙের সঙ্গে রং।
আশ্চর্য!
আশ্চর্য!
তবু দাদার কণ্ঠস্বরে বুকটা আশায় ভরে উঠতে চাইছে সুমনার।
মনে হচ্ছে দাদা ওদের মতো নয়।
এক হিসেবে সত্যিই নয়।
অন্তত তার মা-বাপের মতো তো নয়ই। মা-বাপের সম্পূর্ণ বিপরীত সে।
সস্ত্রীক শান্তিকুমার যেমন আচারনিষ্ঠ, দেবদ্বিজপরায়ণ, ধর্মে মতি ভক্তিবিগলিত, তাঁদের পুত্র অলক তেমনই ম্লেচ্ছচারী, দেবদ্বিজে মতিহীন, বেপরোয়া!
মা একটু চরণামৃত খাওয়াতে এলে বলে,দোহাই মা, ওই এক কোটি কলেরার বীজাণু হজম করি, এত গুরুবল আমার নেই।
গুরুদেব এলে বাপ যদি বলেন, এই যে বাবা এইটি আমার ছেলে। এই পড়ছে–অলক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাপের শত ইশারাতেও মাথা নোয়ায় না।
স্ফূর্তিবাজ বেপরোয়া।
এম. এ. পরীক্ষার আগের দিন গানের জলসায় সারারাত কাটিয়ে সকালে ফিরে বিছানায় লম্বা হয়ে বলে,আমায় ঠিক নটার সময় উঠিয়ে দিও তোমরা।
দাদা সুমনার প্রাণতুল্য।
সেই দাদাকে কতদিন দেখেনি সুমনা, সেই দাদার গলার স্বর শুনতে পাচ্ছে, তবু লাফিয়ে গিয়ে বলছে না–দাদা!
সুমনা সত্যিই তা হলে ভয়ানক একটা কিছু বদলে গেছে! সুমনা আর আগের সুমনা নেই।
আচ্ছা, ভূতে পাওয়া কথাটা কি সত্যি!
.
সুমনা গেল না।
দাদা এল।
লাফাতে লাফাতেই এল।
কী রে মনা, কী ব্যাপার!কী একখানা কাণ্ড পাকিয়ে বসেছিস? হাওড়া স্টেশন থেকে তো শুধু তোর গুণগরিমা শুনতে শুনতেই এলাম।
সুমনার চোখে কেন জল উপচে ওঠে?
অনেকদিন পরে স্বাভাবিক কথা শুনে? ফিকে একটু হেসে, সেই জলটাকে চাপা দেয় সুমনা।
তারপর বল তো শুনি প্রকৃত ঘটনা। জুত করে বসে অলক। খাটের ধারেই বসে। সুমনার অচিনকুমারের দিকে চোখ পড়ে যায়। ভোলা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে,আরে এ যে দেখছি ঘটনা সত্য! অ্যাঁ, এই সেই ফাঁসির আসামি! এর বিরুদ্ধেই এত ষড়যন্ত্র। ঠাকুমাতে, পিসিমাতে আর আমার মাতৃদেবীতে তো এখন গোল টেবিল বৈঠক বসে গেছে। পরামর্শপ্রার্থিনী জননী ও পিতামহী, পরামর্শদায়িনী পিতৃস্বসা। তা বেড়ে দেখতে তো! কাদের মাল বাবা! ছেলেটার গালে একটু টোকা দেয়, অল্প নিচু হয়ে ওর নাকে নাকটা ঠেকায়, তারপর বলে, তা হলটা কী?
হলটা কী, সে কথা কি বিশদ বলতে পারে সুমনা? সে ক্ষমতা কি ওর আছে? তাই মৃদু হেসে বলে, হাওড়া স্টেশন থেকেই তো শুনতে শুনতে আসছিস দাদা!
তা আসছি বটে! শুনে শুনে মোহিতও হয়েছি। শুনছি তোকে নাকি বেহ্মদত্যিতে পেয়েছে। তুই নাকি গুরু লঘু জ্ঞান করছিস না। হিতাহিতের মাথা খেয়ে বসে আছিস। বলেছিস নাকি রেজাল্ট দেখতে যেতে তোর দায় পড়েছে, এম. এ. নাকি শুধু পাগলেরা পড়ে।
সুমনা অনেকদিন পরে হেসে ওঠে।
হেসে ওঠে, বোধ করি খানিকটা বেঁচে ওঠে। যেমন বেঁচে ওঠে বোশেখ-জষ্টির রোদে নেতিয়ে থাকা কচি গাছ, প্রথম বর্ষার জল পেয়ে।
হেসে উঠে বলে, তবে তো প্রকৃত সত্য সবই জেনে ফেলেছিস।
হ্যাঁ, সত্যটা জানা হয়ে গেছে, এখন শুধু তত্ত্বটা জানতে বাকি! সিদ্ধার্থ আসে?
সুমনা মাথা নাড়ে।
হু! আমিও ওইরকম একটা কিছু অনুমান করছিলাম। তা সে হতভাগার আবার কী হল? তোর তো বেহ্মদত্যি, তার কি ব্ৰহ্মজ্ঞান? তাই আর এইসব ঐহিকের তুচ্ছতা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না? খোঁজ করিসনি তুই?
নাঃ!
নাঃ! নাঃ মানে?
মানে কিছু নেই। এমনি।
ছেলেটাকে তুলে নিয়ে হাঁটুতে বসিয়ে নাচাতে নাচাতে বলে অলক, নমস্কার বাবা, তোমাদের ক্ষুরে ক্ষুরে নমস্কার; সংসারে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে জানলে আমি সেই প্রভু জগড়নাথের চরণে লীন হয়ে পড়ে থাকতাম।
তোমার কী? সুমনা হাসে, তোমার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?
সম্পর্ক কী! চমৎকার! তুমি আমার বোন, এটা মানো তো?
একটু একটু।
যাক, ওই একটু একটু হলেই চলবে। যাক, আমি তার অর্থাৎ সে আমার বন্ধু, এটাও মানতে হয়। এই বোন আর বন্ধু এই দুটো বস্তুকে একত্রে মিশিয়ে মিক্সচার করে ফেলবার বাসনা আমার নেই বাল্যাবধি। আজ যদি সে বাসনায় ছাই পড়ে, দুজনের একজন যদি ব্রহ্মে আর অপরজন যদি ব্ৰহ্মদত্যিতে লীন হয়ে যায়, করবার আর রইল কী!
কিছু না!
বলে দুহাত উলটে হতাশার ভঙ্গি করে সুমনা।
ঠাট্টা রাখো। সিধুবাবুর সঙ্গে তা হলে দেখা হয়নি?
না। চমৎকার! ওঁরা দুজন–এই এই…এই সর্বনাশ করেছে। ওরে বাবা!…
ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি তুলে নেয় সুমনা অলকের কোল থেকে। হেসে ফেলে বলে, বাবাঃ! এমন করে চেঁচালি তুই। যেন কী না কি রাজ্য রসাতলে গেল।
অলক ভিজে পাজামাটা হাত দিয়ে ধরে আড়ষ্ট হয়ে ঘর থেকে যেতে যেতে বলে, তার চাইতে কিছু কমও নয়। ধোবার বাড়ির পাজামাটা গেল।…ইস…ইচ্ছে করে মানুষ এই জীব পোষে?
সুমনা ছেলেটার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করতে করতে মৃদু হেসে বলে,ত্রিসংসারের লোক তো তাই করছে।
ছুটে আসে অজীন।
দাদা, তুমি না খেয়ে-টেয়ে এসে দিদির সঙ্গে গল্প করছ? জেঠিমা রাগ করছেন।
আরে ব্রাদার রাখো তোমার জেঠিমা। দেখছ আমার অবস্থা?
দেখতে পায় অজীন। হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
সুমনা তাকে ডাকে।
বলে, শোন। পিসিমা চলে গেছেন?
ও বাবা চলে গেছেন কি? এখন তো চারদিন এখানে থাকবেন।অজীন গলা নামিয়ে বলে, জানো দিদি, পিসিমা বলেছে, এই অচিনকুমারটাকে বোর্ডিঙে না হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে ছাড়বে সে।
সুমনা ভুরু কুঁচকে তাকায়।
মুহূর্তে কঠিন হয়ে ওঠে ক্ষণপূর্বের হালকা হয়ে যাওয়া মনটা।…অলকের সঙ্গে কথার মধ্যে যে প্রসঙ্গটি প্রাণের মধ্যে হঠাৎ অনেক ভাবের তোলপাড় তুলেছিল, আনন্দ, অনুতাপ, অভিমান, মন কেমন, সেই ভাবের ওঠাপড়া থেমে গেল, ভুরু কুঁচকে কঠিন হয়ে বসে রইল।
বসে রইল যুদ্ধের বর্ম গায়ে এঁটে।
সিদ্ধার্থের কথা ভাবতে ভুলে।
অথচ আগে দিনান্তে সিদ্ধার্থের সঙ্গে একবারও দেখা হয়নি, এমন দিন ওদের খুব কমই হত।
সিদ্ধার্থ পাড়ার ছেলে।
সিদ্ধার্থ অলকের বন্ধু।
সিদ্ধার্থ তিলে তিলে সুমনারও বন্ধু হয়ে উঠেছিল।
চেঞ্জে যাবার আগে দেখা করতে গিয়েছিল সুমনা। গিয়েছিল সেই ওদের নির্দিষ্ট প্রিয় জায়গাটিতে। হ্যাঁ, দেখা করার একটা জায়গা ওদের নির্বাচন করা ছিল। আর দেখা করার দায়টা সুমনা সর্বদা নিজের ঘাড়েই রেখেছিল।
বাড়িতে কথা কওয়া শক্ত।
বাড়িতে কত লোক, কত চোখ, কত মন্তব্য।
দুমাসের জন্যে যাচ্ছে শুনে সিদ্ধার্থ বলে উঠেছিল, দুমাস! অসম্ভব। আমাকেও তা হলে চেঞ্জে যেতে হবে।
ওখানেই বোধহয়?
তবে না তো কী?
হ্যাঁ দেখব কত দৌড়। চলে গেলেই নিশ্চিন্দি হবে।
ধারণাটা উচ্চাঙ্গের। কিন্তু চিঠি এক-আধটা লিখলে এমনই বা কী দোষ ছিল? একেবারে কড়া নিষেধের
না না সেই ভাল।
ভাল?
হুঁ।
বেশ। তবে ধরো যদি শুধু পোসটোকাটেদু-এক ছত্র–সুমনা, আশা করি তোমার ওখানে গিয়ে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে অথবা সুমনা, তোমাদের রেজাল্ট বেরোবার আর বিলম্ব নেই–
আহা, তাতে লাভ?
লাভ অনেক। সে বোঝবার ক্ষমতা থাকলে তো।
না না থাক। দেখাই যাক না।
কী দেখা যাক না?
সুমনা মৃদু হেসে বলেছিল, বহর।
কিন্তু সুমনা নিজেই দেখাল শেষ পর্যন্ত।
সুমনা এ কী করেছে! ছি ছি!
সুমনার চিন্তায় ছেদ পড়ল।
পিসিমা ঘরে এলেন।
বেশ হইহই করতে করতে।
কই গো কানাইয়ের মা, তোমার কানাই দেখি।
সুমনা উঠে গিয়ে প্রণাম করল।
পিসিমা থাক থাক বলে একটি আশীর্বাদ সহযোগে বললেন, এসে তো শুনে অবাক। সবাই বলে, সুমি আমাদের না বিইয়ে কানাইয়ের মা হয়ে বসে আছে। হ্যাঁ রে তা লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিয়ে একটা ছানা নিয়ে এমন উন্মাদ হয়ে বসে আছিস কেন?
উন্মাদই হয়ে গেছি যে পিসিমা। এত খবর জানলে, আর সুমি পাগল হয়ে গেছে, এ খবরটুকু জানলে না?
ওমা! তোর কথাবার্তাও তো আর আগের মতন নেই দেখচি। ওরা তো ঠিকই বলেছে। পিসিমা গম্ভীর মুখে বলেন, ছোটবউ বলল, সরল মনে ছেলে নিতে গেলাম, নিতে দিলে না। ওর ধারণা ছেলেকে আমরা মেরে ফেলব।
তা ধারণাটায় আশ্চয্যি কি পিসিমা? যাকে নিয়ে সারা সংসারে অশান্তি
পিসিমা সহসা হৃদ্যতায় গলে গিয়ে বলেন,তা সেই কথাই তো বলছি বাছা। সংসারসুদ্ধ লোককে অশান্তি কেন দিচ্ছিস মা? কত লক্ষ্মী মেয়ে তুই, কত মায়া তোর শরীরে—
পিসিমা! ওই–ওইটাই সমস্যার মূল। মায়া জিনিসটার এমন দোষ, সে পাত্রপাত্র বাছতে ভুলে যায়।
হু! বুঝেছি। বাচ্চাটার ওপর মায়া পড়ে গেছে তাই বলছিস! তা অবিশ্যি পড়তেই পারে। পিসিমা আরও বিগলিত হয়ে বলেন, একটা পাখি পুষলেও মানুষের মায়া পড়ে, তা এ তো রক্তমাংসের জীব। তবে তোরা এত লেখাপড়া জানা, তোদের আর কী শেখাব, অপাত্রে মায়াটা তো কোনও কাজের কথা নয়! আজ বাদে কাল বাবা বিয়ের চেষ্টা করবে, তখন এই ছেলের কথা প্রকাশ পেয়ে গেলে কেলেঙ্কারির আর শেষ থাকবে? হয়তো কত জনে কত অকথা কুকথা ভাববে–
সুমনার মুখের রেখা তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। গলার শির নড়ে ওঠে ভয়ানক একটা কিছু বলবার তীব্র ইচ্ছায়। ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে পিসিমার এই ছদ্ম মমতার আবরণ। কিন্তু সংযত করে নেয় নিজেকে।
চুপ করে থাকে। চেষ্টা করে চুপ করে থাকে।
পিসিমার চোখে এই চেষ্টাটা ধরা পড়ে না।
তাই তিনি ওষুধে কাজ হচ্ছে ভেবে বলতে থাকেন, তার থেকে বলি শোন। খুব ভাল পরামর্শ, আমার বাড়ির ঘর ঝাড়া-মোছার ঝিটা দেখেছিস তো? নাম গৌরী। ভদ্রঘরের মতো চেহারা। স্বামী আছে, শাশুড়ি আছে। সে মাগী একটা ছেলে-ছেলে করে পাগল! কত মাদুলি কবচ পরে, কত ওষুধ পালা খায়, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এখন বলে একটা পথে কুড়োনো ছেলেও পাই তো পালি। ছেলেটাকে আমি নিয়ে গিয়ে তাকে পালতে দিই। কী বলিস? বরং ইচ্ছে হলে কিছু কিছু করে মাসোহারাও দিতে পারিস।…আর চোখের দেখা দেখতে ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে।
পিসিমা।
সেই তীব্র ইচ্ছার তীক্ষ্ণ প্রকাশটা আর চেষ্টা করে থামিয়ে রাখতে পারে না সুমনা। সে-ইচ্ছে ফেটে পড়ে, পিসিমা, দোহাই তোমাদের, আমার কথা তোমরা একটু কম ভেবো।
আর কারও সঙ্গে ঔদ্ধত্য করবে না ভেবেছিল।
সংকল্প বজায় রইল না।
পিসিমা চোখ ভুরু কুঁচকে চলে গেলেন।
সারাদিন আর কেউ সুমনার খোঁজ করল না।
বিকেল চারটেয় কান্তিকুমার এলেন। অঞ্জনাকে দিয়ে বলে পাঠালেন, দিদিকে ঠিক হয়ে নিতে বলো।
ঠিক হয়েই ছিল সুমনা।
বেরিয়ে এল।
সুজাতা ওর ঘরে গিয়ে বসেছে। ভারী ভারী মুখে বলেছে, কখন কী খাবে দেখিয়ে দিয়ে যাও। মাপটাপগুলো একটু বুঝিয়ে দাও।
বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে সুমনা।
আর তারপর? বাইরে বেরিয়ে সমস্ত বহিঃপ্রকৃতির দিকে চোখ বুলিয়ে দেখে দেখে নিজে বুঝতে পারছে না, কোথায় ছিল সে এতদিন?
সুমনা নামক জীবটা এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছিল না কি! কী জন্যে?
বাইরে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে মন, ঘরটা ঝাপসা হয়ে আসে, নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।…
এম. এ. না পড়লে কী হয়! সবাই কি এম. এ. পাস করে? এ চিন্তাটা ধূসর হয়ে ওঠে।
সহপাঠিনী বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হয়। সুমনা নামে যে মেয়েটা বলতে গেলে ওদের মধ্যমণি ছিল, তাকে দেখে সবাই কলকাকলিতে উচ্ছল হয়ে ওঠে। পরস্পরের মার্কশিটের স্তর-বিভেদ নিয়ে আলোচনায় তৎপর হয়।
তোর আর ভাবনা কী?
এই প্রশ্নে মুখর হয়ে উঠেছে বান্ধবীরা।
তুই তো ফার্স্টক্লাস পেয়েছিস
ত্যি, কী করে পেলাম রে তাই ভাবছি। একেবারে আশা করিনি। যা ভুগেছি তখন।
আগের সুরে আগের মতো করেই কথা বলে সুমনা। বলতে পারে।
আশ্চর্য, এই হালকা সুরটা এখনও তবে আছে সুমনার স্বরযন্ত্রে?
আরে রেখে দে। তুই তো পরীক্ষা না দিলেও পাস করতিস।…যা একখানা মাথা!..
ওরা সুমনার সেই ভয়ংকর নির্বুদ্ধিতার খবর রাখে না।
তাই উচ্ছ্বসিত উল্লাসে সুমনার যা একখানা মাথার তারিফ করছে।
ওরা জানে না।
তাই সুমনা ওদের কাছে সহজ হতে পারছে–পুরনো মূর্তিতে ঝলসে উঠতে পারছে।
কান্তিকুমার মার্কশিট দেখে নেবার পর বিচলিত আনন্দে তাড়াতাড়ি গিয়ে গাড়িতে বসে আছেন।
আর ভাবছেন, আগে হলে, আগের সুমনা আর আগের সংসার থাকলে সুমনার এই কৃতিত্বের খবর নিয়ে বাড়ি ঢুকতেন কী উল্লাসের সমারোহ নিয়ে!
এখন তা হবে না।
এখন হয়তো সুমনা বাড়ি ঢুকবে পাথরের মতো!
কান্তিকুমার ঢুকবেন অপরাধীর মতো।
.
কয়েকটা মেয়ে হইহই করতে করতে এগিয়ে এল কান্তিকুমারের কাছে।
মুখপাত্র সোমা।
সিদ্ধার্থের ভাগ্নী।
কিছুটা চেনা বলে মুখপাত্র হয়েছে। সবাই ঘটাঘট প্রণাম করে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
সন্দেশ কই? সন্দেশ কই? সুমনার পাসের সন্দেশ।
ইস্ শুধু সন্দেশে ছাড়ব নাকি? রীতিমত ভোজ চাই।
ভোজ ছাড়াও আমাদের ব্যাচকে সিনেমা দেখাতে হবে। হ্যাঁ ছাড়ব না। শেষ দাবিটা সোমার।
কান্তিকুমার তাকিয়ে দেখেন।
কান্তিকুমার যেন অবাক হয়ে যান। জগতে এখনও এত আনন্দ আছে, আলো আছে।
আর সুমনার মুখে।
সেখানেও যে এই আলোর আভা।
এই আনন্দের জগৎ থেকে সুমনা স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়েছে। অন্ধকার সেলে বন্দি করে রেখেছে নিজেকে!
এদের আনন্দোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে কান্তিকুমার বলেন, সবাই তো পাস করেছ? পালা করে সন্দেশ খেতে খেতে সন্দেশে তো অরুচি হয়ে যাবে।
বাঃ আমরা বুঝি সুমনার মতো? আমরা তো এলেবেলে! সুমনার স্পেশাল কেস।
হবে হবে। আসবে সবাই একদিন।
এই উচ্ছ্বাসের মুখে কান্তিকুমার বণ্ডে সই করে বসেন, তোমাদের বন্ধু নেমন্তন্ন করছে তোমাদের। কবে খাবে বলো?
কী মজা! কী মজা!
হইচইয়ের মধ্যে কবেটা হারিয়ে যায়।
গাড়ি গাড়ি।
গাড়ির শোভাযাত্রা।
যাদের গাড়ি আছে তারা তো গাড়ি নিয়ে এসেইছে। যাদের গাড়ি নেই তারাও আজ বন্ধু আত্মীয় প্রতিবেশী কারও না কারও গাড়ি চড়ে এসেছে। আবার বাসে ট্রামে পায়ে হেঁটেও এসেছে কেউ কেউ।
গাড়ির মিছিল।
মেয়ের মিছিল।
সুমনা তাকিয়ে দেখে।
গাড়িতে ওঠে।
অবাক হয়ে ভাবে, আশ্চর্য! এই এত মেয়ে, কারও জীবনে তার মতো সমস্যা আসেনি।
অবাক হয়ে ভাবে, কিছুদিন আগে পর্যন্তও আমি এদের মতো ছিলাম।
সোমাকে গাড়িতে তুলে নিতে চেয়েছিল।
সোমা বলেছে, না, এখন তো মামার বাড়ি যাচ্ছি না, আগে বাড়ি যাব। তারপর মামার বাড়ি! একেবারে মাকে নিয়ে।
সঙ্গে কে আছে?
ছোটমামা।
ছোটমামা!
সিদ্ধার্থ!
সিদ্ধার্থ এখানে ছিল।
দেখা হয়নি সুমনার সঙ্গে।
দেখা করেনি সিদ্ধার্থ। অভিমান!
সুমনা কি অভিমান ভেঙে নিজে যাবে?
প্রশ্নের উত্তর পেল না।
অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতার পর হঠাৎ মনে পড়ল, সে কৃতিত্বের সঙ্গে পরীক্ষায় পাস করে বাবার সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছে, সারা পথ চুপ করে। ভাবল, পাস করে সিদ্ধার্থর সঙ্গে দেখা করলাম না। সিদ্ধার্থও না।
তাকিয়ে দেখল বাইরের দিকে।
তেমনিই তো আছে সব।
সেই গোধূলিবেলার সোনালি আলো, সেই বৃষ্টিহীন শ্রাবণ দিনের ঈষৎ আর্দ্র মিষ্টি বাতাস, সেই রাস্তা বাড়ি দোকান। শুধু সুমনা আর সেই নেই।
এতক্ষণ বন্ধুদের দলে থেকে ভুলে গিয়েছিল, এখন মনে পড়ল।
বাবা গাড়ি চালাচ্ছেন।
ঘাড়টা দেখা যাচ্ছে। ঘাড় আর পিঠ।
কিন্তু সেইটুকুতেই যেন ধরা পড়ে যাচ্ছে কান্তিকুমার ক্লান্ত। কান্তিকুমার আনন্দহীন।
বাবাকে ডেকে কিছু একটা বলবার জন্যে মনটা আকুল হয়ে উঠল। কিন্তু কী বলবে? আগের মতো কি আছে সুমনা? আগে ইন্টারমিডিয়েটের সময় কৌতুকচ্ছলে বলেছিল, বাড়ি গিয়ে বলব, ফেল করেছি। তুমি যেন ফাঁস করে দিও না বাবা।
কান্তিকুমার মেয়ের এই ছেলেমানুষিতে হেসে উঠেছিলেন, বলেছিলেন, কেন? এমন অদ্ভুত খেয়াল কেন?
বাঃ, বেশ কেমন মজা হবে। সবাই বলবে, এরকম হবেই জানতাম। একেবারে পড়ে না!…ছোটকাকা বলবেন, আড্ডাটা একটু কমাও হে। পরীক্ষা জিনিসটা ছেলেখেলা নয়। পরীক্ষার সময় গান স্পোর্টস আড্ডা! হল তো?
হেসে কুটি কুটি হয়েছিল সুমনা, ছোটকাকার সুরের নকল করে।
আজ সুমনা বাবাকে ডাকতে পারছে না।
যেন সুমনা সত্যিই অশুচি।
এ অবস্থার কি প্রতিকার সম্ভব নয়?
অন্ধকার সেল থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের আলোয় বুদ্ধিকে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে পরিষ্কার করে নেয় সুমনা। বাবার কথাই শুনবে। এম. এ. পড়বে। সহজ হয়ে উঠবে। বাবাকে ডেকে সেই কথাই বলবে এক্ষুনি। আর বলবে, ওর জন্যে সেই যে কী আয়ার কথা বলেছিলে বাবা
হঠাৎ কান্তিকুমারের গম্ভীর মৃদুকণ্ঠ ধ্বনিত হল, বাড়ি গিয়ে সকলকে প্রণাম কোরো সুমনা।
চমকে উঠল সুমনা।
না, এই কণ্ঠের সামনে সহজ হওয়া সম্ভব নয়।
তবু একটু পরে আস্তে বলল, বাবা, ইউনিভার্সিটিতে শিগগির চেষ্টা করাই ভাল।
কান্তিকুমার একটু চুপ করে থেকে বলেন, তা হলে পড়বেই ঠিক করছ?
হ্যাঁ।
আর একটু চুপ করে গাড়ি চালাবার পর প্রায় বাড়ির দরজায় এসে উত্তর দেন, চেষ্টা করবার কিছু নেই। রেজাল্ট ভাল হয়েছে। সহজেই হবে।
কথাগুলো যেন যন্ত্র থেকে বার হচ্ছে। স্ক্রু ঢিলে শিথিল যন্ত্র।
বাবার ওপর কি করুণা করবে সুমনা?
বাবার সঙ্গে যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে, যেমন করে হোক সে ব্যবধান দূর করবে? বাবাকে—
বাড়ির দরজায় এসে গাড়ি থামল।
আর
বাড়ি ঢুকেই ব্যর্থ হয়ে গেল সমস্ত সংকল্প। টানটান করে বাঁধা তারের বাজনা ছিঁড়ে, ছড়িয়ে পড়ল খানখান হয়ে।
দরজায় পা দিয়েই শুনতে পেল শিশুকণ্ঠের করুণ আর্তনাদ। উপর উপর কেঁদেই চলেছে।
কান্তিকুমার সে কান্না সম্পর্কে কোনও ব্যস্ততা দেখালেন না। তিনি এখন গাড়িতে চাবি লাগাবেন। ধীরেসুস্থে বাড়ি ঢুকবেন। ঢুকে নীচতলার অফিসঘরে বসবেন। যেখানে মক্কেলের দল বসে আছে ভিড় করে।
সুমনা বিদ্যুৎগতিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়। আর শুনতে পায় এক তীক্ষ্ণ বিষাক্ত ভাষা। যে বিষের জ্বালায় মুহূর্তে এম. এ. পড়ার সংকল্প ত্যাগ করে সুমনা। ত্যাগ করে বাবার পয়সায় ঝি রেখে বাবার বাড়িতে থেকে ছেলে আর নিজে দুজনে মানুষ হয়ে ওঠবার বাসনা।
সুজাতা।
হ্যাঁ, সুজাতার গলাই শুনতে পেয়েছে প্রথমে সুমনা। সে গলা তীব্র অসহিষ্ণুতার সঙ্গে মন্তব্য করল, এই হয়েছে শিক্ষা! কান মলছি বাবা, আর যদি কোনওদিন স্বীকার পাই। এরপর থেকে সুমি যদি বেরোয় যেন ছেলে গলায় ঝুলিয়ে বেরোয়।
দোতলার বারান্দায় পা দিয়েই শুনতে পায় ঠাকুমার কথা, তুমি আর পাড়া জানিয়ে ছেলে ছেলে কোরো না বউমা। শুনলে ঘেন্না করে। সেদিন অমনিই কার সামনে যেন বলে বসলে, সুমি ছেলে নিয়ে ঘরে বসে আছে। ইচ্ছে করে আর পাঁক তুলে গায়ে মেশোনা বাছা।
তা ছেলে না বলে নাম একটা দিলেই হয়, হেসে ভেঙে পড়ছে ছোটখুড়ি, আমরা তো ওকে যিশু বলতে শুরু করেছি।
শিশুকণ্ঠের কান্না ছাপিয়ে ওর হাসিটা তরঙ্গে তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
মালবিকাও বদলে গেছে।
বোধ করি মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে।
অথবা সুমনার উগ্র প্রখর প্রবল মাতৃস্নেহের ভঙ্গি লক্ষ করে করে। ওইটাই তো বেশি সন্দেহজনক।
বুঝি ঝিটা পর্যন্ত বলে, আইবুড়ি মেয়েছেলের এত ছেলের আঁট! বাবার জন্মে দেখিনি বড়মা।
যন্ত্রণা ওদেরও কি কম?
জেঠি খুড়ি ঠাকুমা পিসি জেঠা কাকার? ওরা তো ভেবে ঠিক করতে পারছে না, কোন্টা বেশি অপবিত্র? মাতৃপরিত্যক্ত রাস্তার জঞ্জাল, না কুমারী কন্যার কলঙ্কচিহ্ন?
সন্দেহের ফল অবিরত ছোবল দিচ্ছে তাদের।
সুমনা দোতলায় পৌঁছে কেমন করে মায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ছেলেটাকে, আর কেমন করে তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই ধমাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, না, তার নিজেরই মনে পড়ছে না।
শুধু সুমনার স্পর্শমাত্র যে আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গেল ছেলেটা, এই এক আশ্চর্য অনুভূতি অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন করে রইল তাকে।
সে অনুভূতি পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকল সমস্ত পরিমণ্ডলে।
একে ভাসিয়ে দিয়ে নিজেকে আবার সহজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে তোলবার ইচ্ছে পোষণ করছিল বলে ধিক্কার দিল নিজেকে।…
ফিকে হয়ে গেল বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল সোনালি রং।
এই ঘরের বাইরের পৃথিবীকে আর মনে রাখতে পারল না সুমনা।
মনে রইল না বাবার নির্দেশ।
মনে পড়ল।
অনেকক্ষণ পরে মনে পড়ল।
যখন ফুড তৈরি করে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ফেলতে পারল ছেলেটাকে।
কিন্তু তখন কি আর ঘরের দরজা খুলে বাড়ির সবাইকে প্রণাম করতে যাবে সুমনা?
শুধু দেরি হয়ে যাওয়ার বাধা নয়, প্রধান বাধা দরজা বন্ধ করার সেই দুম শব্দটা!
হাতুড়ির ঘায়ের পর কি প্রণাম চলে?
.
কান্তিকুমার অনেক পরে ভিতরবাড়িতে ঢুকলেন। আশা করেছিলেন আজকের আবহাওয়া একটু অন্যরকম দেখবেন। আজ সুমনা কিঞ্চিৎ সহজ বুদ্ধিতে এসেছে, এভাবে নিজেকে একটা ভাবপ্রবণতার কাছে বিকিয়ে দেওয়া যে বোকামি তা বুঝতে পেরেছে, অতএব আজ অবশ্যই তার সেই উগ্র জেদের চেহারাটা বদলেছে।
আর তার পরীক্ষার এই সাফল্যের খবর নিশ্চয়ই বাড়ির অন্যান্য সদস্যকেও নরম করেছে। তাই নিজেই অনেকটা আগের মতো নরম আর প্রসন্ন মন নিয়ে বাড়ির মধ্যে এলেন কান্তিকুমার।
কিন্তু কই? কোথায় আবহাওয়ার উজ্জ্বলতা?
বাড়ির সর্বত্র জ্বলছে বটে চড়া পাওয়ারের আলো, কারণ কান্তিকুমার দেখতে পারেন না মিটমিটে ঘোলাটে আলো, তাই বাড়ির ভাঁড়ার ঘর পুজোর ঘর থেকে শুরু করে সিঁড়ির তলাটিতে পর্যন্ত চড়া পাওয়ারের বাল্ব লাগানো। তবু ভেতর দালানে পা দিয়েই মনে হল কান্তিকুমারের, সমস্ত আলোগুলো যেন ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। আর সমস্ত সংসারটা যেন ভয়ানক কোনও একটা আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
এ আঘাত কার হাত থেকে এল?
কান্তিকুমার পরিবেশটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। কর্তাপুরুষ বাইরে থেকে বাড়িতে ফিরলে যে চাঞ্চল্য বা স্বীকৃতি স্বাভাবিক নিয়মেই দেখা যায়, তার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না।
অবশ্য আগে কান্তিকুমারকে দেখলেই সকলের মধ্যে যে একটা তটস্থ ভাব দেখা যেত, সেটা কান্তিকুমারের মেয়ের অপরাধেই যেন ক্রমশ হারাচ্ছিলেন কান্তিকুমার, কিন্তু আজকের ধরনটা আরও শোচনীয়।
দালানের ও-কোণে ঠাকুরঘরের সামনে যোগমায়া হরিনামের মালাগাছটা হাতে করে বসে ছিলেন, যেমন ছিলেন তেমনিই রইলেন, শুধুমাত্র একটা উদাসীন দৃষ্টিপাত করলেন ছেলের দিকে।
স্বর্ণপ্রভা উজ্জ্বল আলোর নীচে বসে বইয়ের লেখা লাইনের তলায় আঙুল রেখে রেখে তাঁর গুরুগ্রন্থজীবে দয়া ও ঈশ্বরপ্রেম পাঠ করছিলেন, তিনি উদাসীন দৃষ্টিপাতটুকুও করলেন না। যেন দেখতেই পেলেন না দেবরকে। মালবিকা মাথা নিচু করে পান সাজছিল, পানই সাজতে লাগল। কান্তিকুমারের যে বিধবা ভাগ্নীটি বিধবা হয়ে ইস্তক এ বাড়িতে রয়েছে সে একখানা চটের আসনে ফুল তুলছিল, তুলতেই লাগল, শুধু ঘাড়টা আরও নিচু করল।
সাধারণত এই সান্ধ্য আসরে সুজাতা থাকেই। হয় বসে সুপুরি কুচোয়, নয় একতাল মাখা ময়দা নিয়ে লেচি কাটে বসে বসে, নিদেনপক্ষে পরদিন সকালের জন্যে কুটনো কোটে। কিন্তু আজ সুজাতা অনুপস্থিত।
বুড়ি ঝিটা পর্যন্ত নিশ্চুপ।
কই গো দাদাবাবু মেয়ের পাসের সন্দেশ কই? বলে ছুটে এল না। একপাশে পা ছড়িয়ে বসে নিজের পায়ে নিজেই তেল ডলছিল, শুধু পা-টা একটু গুটিয়ে বসল।
কান্তিকুমারের মেয়ের যে আজ মস্ত একটা সাফল্যের খবর ওরা জেনেছে, এটা ওদের মুখ দেখে বোঝা গেল না।
কিন্তু এত থমথমে অবস্থা অকারণও নয়। কান্তিকুমার এক মিনিট দাঁড়ালেন, তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন।
দেখলেন, দোতলার সামনেই মেয়েদের পড়ার ঘরে অঞ্জু অরুণা, জয়ন্তীকুমারের ছোট ছেলে দুটো আর ভাগ্নীর মেয়ে সবিতা নিঃশব্দে বসে লুডো খেলছে। অজীন অভীককে দেখতে পেলেন না।
কান্তিকুমারকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল দু-একজন। কান্তিকুমার বললেন,থাক থাক, তোমরা খেলো।
ছোটরা সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
অথচ এই শিশুদের রাজ্যে কান্তিকুমারের ছিল রাজাসন। আগে হলে কান্তিকুমার সহাস্যে ঘরে ঢুকে পড়ে বলতেন, কে জিতছে? কে হারছে?
ওরা হইহই করে জানাত হার-জিতের খবর। কান্তিকুমার বসে পড়ে বলতেন,আচ্ছা দেখি আমায় কে হারাতে পারে।
মহা কলরব পড়ে যেত ওদের মধ্যে। কে কান্তিকুমারের ঠিক পাশটিতে বসবে তাই নিয়ে প্রায় মারামারি লেগে যেত। আজ ওরা সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ওরাও বুঝে ফেলেছে বাড়ির অবস্থা আর স্বাভাবিক নেই।
ওরাও তাই ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে, নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। সংসারের সেই আনন্দ কোথায় গেল? সেই রং কোথায় গেল? কে যেন মুঠোয় করে চেপে উপড়ে নিয়েছে সে আনন্দ, হাতের তেলোয় মুছে নিয়েছে সে রং।
কে?
কে সে? কোন নিষ্ঠুর ব্যক্তি? ভাগ্য?
কিন্তু কান্তিকুমার কি ভাগ্যের সেই নিষ্ঠুরতাকে পরাজিত করতে পারেন না? নিজের জোরে আবার আনতে পারেন না সেই আনন্দ, সেই রং? আবার আগের মতো এই ছোটদের নিয়ে হইহই করে বেড়াতে যেতে পারেন না? সার্কাস দেখাবার কি একজিবিশন দেখাবার, গান শোনাতে নিয়ে যাবার কি খাবার-দাবার বেঁধে নিয়ে পিকনিক করতে যাবার হুজুগ তুলে ওদের মাতিয়ে দিতে পারেন না?
আর এখন ওদের কাছে গিয়ে বলতে পারেন না, কী? কে জিতছে? কে হারছে?
.
না, তা পারবেন না কান্তিকুমার।
গলায় সে সুর ফুটবে না। সুরহীন চেষ্টাকৃত ভাষা নেহাত বেখাপ্পা লাগবে।
নিজেকে নিজের মনের মতো ছাঁচে গড়তে চাইলেই কি গড়তে পাওয়া যায়? সংসারের মধ্যে সেই স্বয়ংসম্পূর্ণতার জায়গা কোথায়? পরিবেশের খাঁজে খাঁজে তো বসাতে হবে নিজেকে। অতএব পরিবেশই হচ্ছে গঠনকর্তা।
সেই পরিবেশ অহরহ নিত্য নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে, নিজেকে বিকৃত করছে, ছাঁচ বদলাচ্ছে। কে পারবে তবে জোর করে বলতে, আমি বদলাব না, আমি যা আছি তাই থাকব।
তা থাকলে, কোন খাঁজে বসাবে মানুষ নিজেকে? কোন খাপে খাপ খাওয়াবে? নেই কোথাও সেই নিজের গড়নের খাপ।
তবে আর কী করা?
বেমানান হবার ভয়ে বদলাতে হবে নিজেকেই। সেই বদলানো নিজেকেই বসিয়ে নিতে হবে বিকৃত সেই ছাঁচের খাঁজে খাঁজে।
তাই কান্তিকুমারকে শান্ত শিথিল গলায় বলতে হচ্ছে,থাক থাক, তোমরা বোসো৷ বলে চলে যাচ্ছিলেন, যেতে গিয়ে ফিরলেন। বললেন, অজি অভিকে দেখছি না?
অঞ্জনা মাথা নিচু করল।
অরুণা আর সবিতা উসখুস করল; আর ওদের ছোটকাকার ছোট ছেলেটা হি হি করে বলে উঠল, সেজদা নদা-কে মেজ জেঠিমা মেরে তুলো ধুনেছে।
কান্তিকুমার যেন হঠাৎ সামনে সাপ দেখলেন। বিচলিত হয়েও স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, কী করেছেন?
অরুণা ভাইকে আর কথা কইতে না দিয়ে তাড়াতাড়ি বলে, কী অসভ্য তুই। আঃ। না না, কিছু না। এমনি দুষ্টুমি করছিল তাই
কিন্তু কথা বলবার সুযোগ যে পেয়েছে সে কি আর ছাড়ে? তাই দিদিকে থামিয়ে বলে,দিদা যে বললে, মেরে তুলো ধুনে দাও অমন ছেলেদের। তুলো ধোনা মানে কী জানো মেজজেই? মানে হচ্ছে
.
কিন্তু মেজজেঠু ততক্ষণে চলে গিয়েছেন, সরে গিয়েছেন।
.
কিন্তু কোথায় সরবেন কান্তিকুমার?
কোথায় চলে যাবেন?
ছেলেদের গায়ে হাত তোলা কান্তিকুমারের চিরদিনের বিরক্তিকর। বাড়ির সকলেই মেনে চলত এ নির্দেশ। সুজাতা তো নিশ্চয়ই। কিন্তু আজ পালা বদলেছে। আজ সংসারে কান্তিকুমারের সেই গৌরবের আসন আর নেই। আজ তাঁর বিরক্তিকে কেউ ভয় করছেনা। আজ কান্তিকুমারের মা অনায়াসেই বলতে পারেন, ওদের মেরে তুলো ধুনে দে–আর কান্তিকুমারের স্ত্রী নির্ভয়ে তা করতে পারে।
ওরা বুঝে ফেলেছে কান্তিকুমারকে ভয় না করলেও চলে।
হয়তো এও এক সাংসারিক নিয়ম। হঠাৎ যদি কারও চোখে পড়ে যায়, অকারণ একটা ভয়ের কাছে কাঁটা হয়ে ছিলাম, অর্থহীন একটা আশঙ্কায় জড়সড় হয়ে থাকতাম, ওটা নিষ্প্রয়োজন, তা হলে ভয় ভাঙার নিষ্ঠুর খেলায় সবাই মেতে ওঠে।
সুজাতা বুঝে নিয়েছে কান্তিকুমার এই ছেলে মারা নিয়ে তীব্র তিরস্কার করতে পারবেন না সুজাতাকে। যদি করতে আসেন, সুজাতা মুখর হয়ে উঠবে। তার কত জ্বালা কত যন্ত্রণা শতমুখে তার ব্যাখ্যা করতে বসবে। সুজাতার সেই সাহস জোগান দিচ্ছে কান্তিকুমারের অবাধ্য মেয়ে।
যে কান্তিকুমার নিজের একটা অবাধ্য মেয়েকে শাসন করতে পারেন না, তিনি আবার অন্যকে শাসন করতে আসেন কোন মুখে? এই অভিযোগ লেখা রয়েছে সংসারের প্রত্যেকটি সদস্যের মুখের রেখায়। সুজাতাও তাদের ছাড়া নয়।
.
দুঃসহ একটা পাষাণভার নিয়ে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন কান্তিকুমার। যে ঘরটা দালানের একেবারে শেষ প্রান্তে। এই ঘরটাই নাকি বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ওঁচা, অন্তত সুজাতার তাই ধারণা; তবু একদা কান্তিকুমার এই ঘরটাই বেছে নিয়েছিলেন কোণের দিকে বলে। চলাচলের পথ নয় বলে।
ঘরের মধ্যে দিয়েই আর একটা ছোট ঘর। সেই ঘরে কান্তিকুমারের একক শয্যা। বড় ঘরটায় জোড়া খাটে সুজাতা শোয় দু ছেলে নিয়ে। মেয়েরা শোয় অন্যত্র। কান্তিকুমার দেখলেন সেই খাটের উপর সুজাতা বসে আছে একটা বই হাতে নিয়ে। আর ছেলে দুটো বিছানায় পড়ে আছে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে।
দুরন্ত ছেলে দুটোর এই দৃশ্য যেমন বিস্ময়কর তেমনি বিস্ময়কর সুজাতার হাতে বই। কান্তিকুমার একবার দুটো দৃশ্যের প্রতিই দৃষ্টিপাত করলেন। তারপর নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
কিন্তু সুজাতা এই নিঃশব্দ বেদনাকে সমীহ করবে না। সুজাতা প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে। তাই পরমুহূর্তেই বইটা ফেলে রেখে ও-ঘরের দরজায় গিয়ে বলে ওঠে, তুমি কী ঠিক করেছ? একটা কিছু বিহিত করবে, না আমি গলায় দড়ি দেব?
কান্তিকুমার ঈষৎ বিদ্রুপের স্বরে বলেন, ওকাজটা কি কেউ কারও অনুমতি নিয়ে করে?
তবু জানিয়ে রাখলাম। সংসারের এই অবস্থা চলতে থাকলে গলায় দড়িই দিতে হবে আমায়।
কান্তিকুমার আরও বিদ্রুপের সঙ্গে বলে ওঠেন,কেন, ছেলে ঠেঙিয়ে গায়ের জ্বালা কমিয়ে ফেলা যাচ্ছে না? জ্বালা কমাবার ওইটাই তো শ্রেষ্ঠ পন্থা তোমাদের।
ওঃ, সেটি ইতিমধ্যেই টের পাওয়া হয়েছে। শুধু টের পাও না রাতদিন কী অশান্তিতে আমি কাটাচ্ছি। ছেলে ঠেঙানোটাই দেখলে, কেন ঠেঙালাম সেটা একবার বুঝতে চাইছ?
ওটা বোঝবার ক্ষমতা আমার নেই।
তা থাকবে কোথা থেকে? নিজের সংসারটি কেমন তা তো আর জানলে না কোনওদিন।
জানাবার সাহসই যে এযাবৎ কোনওদিন হয়নি সুজাতার, সে কথা মনে পড়ল না তার। তার মনে হচ্ছে কান্তিকুমার একটু জোর করলেই সুমনা-ঘটিত ব্যাপারটার হেস্তনেস্ত একটা হত, ইচ্ছে করেই সে জোর-টুকু করছেন না কান্তিকুমার। তলে তলে মেয়ের প্রতি তাঁর প্রশ্রয় আছে।
মেয়েরা যখন সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, ভাবে আমার ভাগ্য। আমার প্রাপ্য পাওনা পাচ্ছি। যখন অসুবিধেয় পড়ে তখন স্বামী নামক জীবটাকে সমস্ত যন্ত্রণার কারণস্বরূপ ধরে নিয়ে তাকে ছোবল হেনে হেনে যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করে।
সুজাতাও মেয়ে।
কিন্তু আশ্চর্য!
সহসা সংসারটা এমন নিরাবরণ হয়ে গেল কী করে? কান্তিকুমার বলেন, এযাবৎ একান্নবর্তী পরিবারের যে মধুর স্বপ্ন দেখে এসেছেন তিনি, আর যার একটি সুষ্ঠু রূপ দিতে সমস্ত অর্থ আর সামর্থ্য ব্যয় করেছেন, সেটা তা হলে কিছুই না? এই নিরাবরণ নির্লজ্জতার জন্যেই উদগ্রীব হয়ে ছিল সবাই? একটা উপলক্ষ পেয়ে বেঁচে গেছে? সভ্য থাকবার দায়টা ঘুচিয়ে ফেলে উল্লসিত হয়ে উঠছে।
বন্য আদিবাসীদের থেকে সভ্যসমাজ নাকি অনেক দূরে সরে এসেছে। কান্তিকুমারের হঠাৎ মনে হল কথাটা। আর মনে হল, না। একতিলও সরে আসিনি। বন্যতা বর্বরতাই আমাদের মূল কাঠামো। তাই নগ্ননৃত্যেই আমাদের আনন্দ। উপরের খোলসটা খুলে ফেলবার সুযোগ এলেই তাই এমন খুশিতে উন্মাদ হয়ে উঠি।
ভাবলেন, কথায় কথা বাড়বে।
তাই সুজাতাকে আর কিছু না বলে ছেলেদের প্রশ্ন করলেন,অজি অভি, খাওয়া হয়েছে তোমাদের?১৯০
বলা বাহুল্য, উত্তর মিলল না।
শুধু উঠল একটা ক্রন্দনোচ্ছ্বাস। বুঝলেন খাওয়া হয়নি। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনার সাহসও হচ্ছে না। কে জানে কোন কেঁচোর নীচে কোন কেউটে ছোবল দেবার জন্যে অপেক্ষা করছে।
এড়ানোই ভাল। ওদের যা অবস্থা, ওরা খেতে পারবেও না।
কিন্তু এড়াবো বললেই কি এড়ানো যায়? শেষ পর্যন্ত কেউটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। কারণ সুজাতা আজ বদ্ধপরিকর হয়ে বসে আছে, আজকের ব্যাপার বলবে বলে। অথচ ব্যাপারের কারণটা নিতান্তই তুচ্ছ। পিঠোপিঠি দুই ভাই সাধারণ রীতিতেই কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া শুরু করেছিল, এবং যথানিয়মেই সেটা ক্রমশ মারামারির উচ্চগ্রামে উঠেছিল। কিন্তু অহরহ দেখা এই দৃশ্য দেখে সহসাই নাকি আজ যোগমায়া মন্তব্য করে বসেন, এমন অসভ্য ছেলে নাকি তিনি ভূভারতে দেখেননি, মা বাপের প্রশ্রয়েই নাকি মেজবউয়ের ছেলেমেয়েরা পাজির পা ঝাড়া হয়ে হয়ে তৈরি হচ্ছে। যোগমায়ার নিজের যদি এক্তার থাকত এইসব ব্যাদড়া পাজি ছেলেদের মেরে তুলো ধুনে শায়েস্তা করতেন।
এরপরেও ছেলেদের না মেরে চুপ করে থাকতে পারবে, এত ঠাণ্ডা রক্ত সুজাতার নয়। মেরেছিল, বেদমই মেরেছিল। আর তখন সুজাতার গুণের ধ্বজা মেয়ে দোতলা থেকে নেমে এসেছিলেন মাকে শাসন করতে! যে মেয়ের জন্যেই এত অপমান।
হ্যাঁ, মেয়েকে রেয়াত করেনি সুজাতা। সুমনা যখন তীব্র তিরস্কার করেছিল, মা, কী হচ্ছে কি? বাড়িটা যে ক্রমশ নরক করে তুলছ তোমরা!
তখন সুজাতা বলেছিল, সুমনার লজ্জা করে না একথা বলতে? নরকের পাপ ঘরে তুলে এনে সুমনাই তো সংসারকে ছারখার করল। সুজাতাদের এত অপমানিত অপদস্থ হয়ে থাকার কারণ কে? ইত্যাদি
সুমনা চুপ করে গিয়েছিল।
তারপর আস্তে আস্তে চলে যাবার সময় বলে গিয়েছিল,আচ্ছা, শিগগিরই তোমাদের মুক্তি দিয়ে যাব।
এখন সংসারের সবাই বলছে, সুমনা হয় বিষ খেয়ে, নয় গলায় দড়ি দিয়ে কেলেঙ্কারির চরম করবে, এবং তার জন্যে দায়ী সুজাতাই। বাড়ির ছোট ছেলেরা দুষ্টুমি করলে বড়রা বকেই থাকে, সেই রাগে সুজাতা যদি ছেলেদের খুন করতে বসে, আর অতবড় তেজি মেয়েকে গালমন্দ করে, তা হলে সংসার আলাদা করা ছাড়া পথ নেই। এবং বোঝা যাচ্ছে, সেটাই সুজাতার অভিপ্রেত।
তবে?
বলুন কান্তিকুমার সুজাতার করণীয় কী?
কান্তিকুমার গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, কথা বস্তুটাকে একটু ঝেড়ে ফেলতে শিখলেই সব জিনিসটা সহজ হয়ে যায়।
ঝেড়ে ফেলতে! তুমি পারো ওইরকম সব কথা ঝেড়ে ফেলতে?
কান্তিকুমার এক মিনিট তাকিয়ে থেকে বলেন, তবে কি তোমার ধারণা, কথার জ্বালায় অস্থির হয়ে ওই বাচ্চা দুটোকে পিটোতে বসতাম?
পুরুষের কানে সংসারের নীচ কথাগুলো তো সব ওঠে না—
কেন ওঠে না সেটাই বরং নির্ণয় করো।
তা হলে তুমি কোনও কিছুর প্রতিকার করবে না?
কীসের প্রতিকার?
সুমি এইভাবেই চালিয়ে যাবে?
উপায় কী? যদি কখনও ওর নিজের দিক থেকে সহজ হবার প্রেরণা আসে, যদি
আর যদি ও আত্মহত্যা করে বসে-বলেই হঠাৎ সুজাতা হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।
কান্তিকুমার ওর কান্নাকে একটু থামতে দিতে সময় দেন। তারপর ক্ষীণ একটু হেসে বলেন,সে ভয় কোরো না সুজাতা। যে বন্ধনের পাকে নিজেকে জড়িয়েছে ও, সে পাক থেকে মুক্ত হয়ে মরবারও ক্ষমতা নেই ওর।
.
না, কান্তিকুমারের হিসেবে ভুল নেই।
মরে অপমানের জ্বালা জুড়োবে, সে ক্ষমতা হয় না সুমনার। যদিও সেদিন রাগের মাথায় মনে হয়েছিল তার, মরে এদের জব্দ করতে পারি! ঠিক হয়।
কিন্তু ওই ছেলেটাকে ঠিক কোন অবস্থায় রেখে মরা চলে, সেটা ভাবতে ভাবতে মরার ইচ্ছেটা জুড়িয়ে গেল। এখন শুধু চিন্তা, কী করে সংসারকে মুক্তি দিয়ে চলে যাওয়া যায়।
তা সে চিন্তাই কি দানা বাঁধতে পারে? যতক্ষণ না ও একটু বড় হচ্ছে–
তাই মরাও হয় না, চলে যাওয়াও হয় না। শুধু আরও একটু গম্ভীর হয়ে ওঠে সুমনা, আরও মৌনী। আর সংসার থেকে আরও বিচ্ছিন্ন।
এমনি করে দিন যায়।
আর সংসারে এক-একদিন এক-একটা ঘটনা ঘটতে থাকে, যেটা ইচ্ছাকৃত।
আর দিনে দিনে
প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে প্রতি পলে পলে অনুভব করতে পারছে সুমনা কোন প্রাণে মা ফেলে দিয়ে যায় শিশুকে।
শুধু একটু মমতার দায়েই যদি জীবন এমন বিড়ম্বিত হয়ে ওঠে, মস্ত একটা ভুলের দায়ে কলঙ্কিত জীবনে তবে কত বিড়ম্বনা এসে জোটে।
একটা শিশু!
কতটুকু বা ওজন।
কিন্তু কী ভয়ানক তার ভার।
সে ভার কেবলমাত্র একা বহন করব, এ প্রতিজ্ঞা অবাস্তব।
তার খাওয়া চাই, পরা চাই, আশ্রয় চাই, আগলাবার লোক চাই।
সুমনা যদি নিজেকে ফসিল করে ফেলেও ওকে আগলে বসে থাকে, বাকি জিনিসগুলোর জন্যে তো মুখাপেক্ষী হতে হবে ওর প্রতি নিষ্করুণ এই সংসারের কাছে।
হচ্ছেই তো।
ওর যা প্রয়োজন তা নিয়মিত এসে পৌঁছয় সুমনার ঘরে।
ভালবাসার উপহার হিসেবে নয়।
হয়তো দয়ার দান হিসেবে, হয়তো দায়ের ঋণ শোধ হিসেবে। কান্তিকুমারের হুঁশ আছে।
অঞ্জনা অভীক অজীন কেউ না কেউ রেখে যায় ঘরে, কান্তিকুমারের হুঁশের পরিচয়।
সুমনা যদি ওই দয়ার দান না চায়, সুমনা যদি উপার্জন করতে নামে, কে একে আগলাবে? কী করে রেখে যাবে একে এই বিমুখ সংসারের কাছে?
আর যদি সুমনা এ আশ্রয় ত্যাগ করে?
ভেবে পায় না, ঠিক তার পরমুহূর্তটা কী হবে? কোথায় গিয়ে প্রথম দাঁড়াবে একটা বসতে পর্যন্ত না শেখা ছেলেকে নিয়ে?
আশ্রয় ত্যাগ করা সোজা নয়।
বহু লাঞ্ছনা সহ্য করে আশ্রয়টাকে আঁকড়ে থাকে মানুষ।
বিশেষ করে মেয়েমানুষ।
জগতের কোটি কোটি শিশুর রক্ষয়িত্ৰী আর পালয়িত্রী!
মা, আত্মীয়া, ঝি, নার্স, করুণাময়ী প্রতিবেশিনী, কাউকে না কাউকে চাই শিশুর, যতক্ষণ না সে শিশু পৃথিবীর মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়াতে শেখে।
সুমনার ছেলে কতদিনে দাঁড়াতে শিখবে?
আর কতদিনে শিখবে সত্যিকার নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে?
তবে তো ছুটি সুমনার!
৩. উপযাচক হয়ে
কান্তিকুমার অঞ্জনাকে দিয়ে বলে পাঠান। নিজে আর উপযাচক হয়ে মেয়ের কাছে এসে বক্তব্য নিবেদনের ইচ্ছে নেই। এ পর্যন্ত ওর বুদ্ধিহীনতার জন্যে বিরক্ত হলেও কিছুটা সহানুভূতি পোষণ করতেন। ও যে ওর হৃদয়-ধর্মের কাছে নিরুপায় হয়ে আছে, এটা তিনি অনুভব করতে পারছিলেন। কিন্তু ক্রমশই যেন একটা মৌন কাঠিন্য ঘিরে ধরছে তাঁকে।
তাই নিজে আসেননি।
অঞ্জনাকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছেন।
অঞ্জনা এসে দরজার কাছে দাঁড়ায়। কুণ্ঠিত মুখে বলে,দিদি, বাবা বললেন এগারোটার সময় তৈরি হয়ে থেকো, নিয়ে যাবেন।
কোথায় নিয়ে যাবেন, কোথায় যেতে হবে, সে কথা কি ভুলে গেছে সুমনা? তাই চমকে ওঠে, অবাক হয়ে যায়।
কোথায় নিয়ে যাবেন?
কোথায়! অঞ্জুও অবাক হয়ে যায়! কেন, ইউনিভার্সিটিতে যাবার কথা ছিল না?
ওঃ!
সুমনা একটু চুপ করে থেকে বলে, বাবাকে বলে দে অঞ্জু, দিদির ভুল হয়েছিল। দিদি এম. এ.তে ভর্তি হবে না।
ভর্তি হবে না?
নাঃ। সম্ভব নয়।
অঞ্জু একটা নিশ্বাস গোপন করে বলে,দিদি, মিথ্যে কেন এরকম করছ! বাড়ির মধ্যে তুমিই লেখাপড়ায় ভাল, তুমিই বাড়ির গৌরব, তুমি এরকম করলে বাবার কীরকম কষ্ট হয় বলো তো?
আমার ভাগ্য!
দিদি, আমি যদি ওকে রাখি?
কাতর বচনে বলে অঞ্জনা। দিদি বলে ডেকে কথা কইতে আজকাল আর তেমন পায় না বলেই হয়তো আজ মনের কথা বলে ফেলে।
হ্যাঁ, পায় না।
ঠাকুমার নিভৃত নির্দেশ, সবাই মিলে আদিখ্যেতা করতে হবে না। সবাই নিয়ে নাচানাচি করলে আরও পেয়ে বসবে। যাবি না, ঠুবি না।…আর ঠুবিই বা কেন? ডাস্টবিনের নোংরা।
কিন্তু সেই ঘৃণ্য বস্তুটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আর পলক পড়ে না অঞ্জনার।
চারখানা হাত পা ছুঁড়ে ঠুকে উছলে উছলে খেলা করছে। মুখে স্বর্গের দীপ্তি। শুধু শিশু নয়, সুন্দর শিশু, স্বাস্থ্যবান শিশু।
তাই হঠাৎ দানপত্রে স্বাক্ষর করে বসতে চায় অঞ্জু, দিদি, আমি ওকে রাখব।
দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেলে সুমনা।
বলে, তোর লেখাপড়া সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে?
আমার লেখাপড়া।
অঞ্জনা অগ্রাহ্যভরে বলে, হলেই বা কী আর না হলেই বা কী! যা না ব্রেন! দুদুবার ক্লাসে ফেল। আমি পড়তে না পেলে পৃথিবীর কোনও লোকসান হবে না দিদি।
দুর পাগল। যা, পাগলামি করিস না।
দিদি, আমি বাবাকে ওকথা বলতে পারব না।
বলতে পারবি না?
না। আমার কষ্ট হয়।
ঠিক আছে। আমিই বলে আসছি। আমি তো নিষ্ঠুরের রাজা। তুই একটু থাকবি তো এখানে?
অঞ্জু একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঘাড় নাড়ে। থাকব। তুমি দেরি করবে না তো?
না দেরি করব কেন? দেরি করবার কী আছে?
দেরি করবে না।
ছেলেটা হঠাৎ দুদিন থেকে উপুড় হতে শিখে খাট থেকে নামবার সাধনা করছে। একদণ্ড নড়বার জো নেই। অঞ্জুর কি সে সতর্কতা আছে?
.
কিন্তু দেরি করব না বলেও কোথায় হারিয়ে গেল সুমনা?
অঞ্জুর কেয়ারে থাকতে থাকতে দুরন্ত খেলার ক্লান্তিতে ঘুমিয়েই পড়ল ছেলেটা। অঞ্জু বসে আছে।
বসে আছে, তাকিয়ে আছে।
সবাই চুপিচুপি বলাবলি করে, দিদির মতো মুখ! কই, অঞ্জু তো তা বুঝতে পারছে না। এতটুকু ছেলের আবার মুখ বোঝা যায়? তবে কেন বলে! দিদি মানুষ করছে বলে দিদির মতো মুখ হয়ে যাবে?
কিশোরী মনের অস্ফুট আলো-আঁধারিতে কত কী ভাবে, কিছু বোঝে না, ভয় ভয় করে।
তারপর ভাবে–দুর! যতসব বাজে কথা!
কিন্তু দিদি এত দেরি করছে কেন?
বাবা কি রাগ করছেন?
দিদিকে কি বকছেন?
দিদি কি বসে বসে কাঁদছে?
কিন্তু বাবা কি কখনও এত বকতে পারেন, যাতে মানুষ কাঁদবে?
তা অঞ্জনা তো আর হাত গুনতে জানে না যে, জানতে পারবে আসলে বাবার সঙ্গে দেখাই হয়নি সুমনার!
অঞ্জুকে আদেশ দিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে গিয়েছিলেন কান্তিকুমার। সুমনা জানে না। সুমনা সোজা চলে গিয়েছিল বাবার অফিস ঘরে।
সেখানে বাবার চেয়ারটা শূন্য।
কিন্তু ওদিকে বইয়ের আলমারির কাছে ইজি-চেয়ারে বসে কে!
ওখানে বসে কী করছে?
ও কি এখানে আসে?
যেমন ভাবে নিশ্চিন্ত আরামে আধশোয়া হয়ে বসে বইটা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরেছে, তাতে মনে হচ্ছে না এটা দৈবাতের ঘটনা। দৈবাৎ একদিন একটা বই ভাল লেগে গেছে বলেই পড়ে শেষ করছে।
না। মনে হচ্ছে নিত্য অভ্যাসের ব্যাপার।
ও আবার ল বুক পড়ছে কেন!
সুমনা কি চলে যাবে?
চলে যাবে ভেবে ও হঠাৎ বলে উঠল, বাবা কই?
বলে উঠল না, কে যেন বলিয়ে দিল।
হাতের বইখানা মুড়ে অর্ধশায়িত মানুষটা সোজা হয়ে উঠে বসল।
বলে উঠল,আরে এসো এসো শ্রীমতী ম্যাডোনা। কী খবর?
বাবার শূন্য চেয়ারটায় বসে পড়ে সুমনা বলে, খবরটা তা হলে কানে উঠেছে?
কানে উঠেছে মানে? কানের পোকা বেরিয়ে যেতে বসেছে।
হাঁ! তা এতদিনের মধ্যে একদিন তোকই দেখা করতে এলে না?
দেখা করতে! ও বাবা! সাহস কোথা? সিদ্ধার্থ একটা বদ্ধগভীর দৃষ্টি ফেলে বলে,আর কি তুমি সেই সুমনা আছ? এখন যে ম্যাডোনা হয়ে গেছ।
ঠাট্টা করছ!
ঠাট্টা! অন্তত আমার পক্ষে ব্যাপারটা ঠিক ঠাট্টা নয়। লোকমুখে শুনছি, নির্জন আত্মকারাবাস, অহোরাত্র তোয়ালে কাঁথা ফিডিংবটলের মধ্যে নিমজ্জিত
এত শুনছ কোথা থেকে? নোক-মুখটা কোন লোকের?
বাঃ, আজকাল আমার পিসি যে তোমার জেঠিমার গুরু-ভগ্নী হয়েছেন। জানো না?
না। এমন গুরুতর সংবাদটা আমার কান এড়িয়ে গেছে। তা শুধু ওইটুকুই শুনেছ?
হঠাৎ ঠোঁটের কোণটা বিদ্রুপে বেঁকে যায় সুমনার। চোখের তারাটা জ্বলে ওঠে, আর কিছু শোনোনি?
আর কী?
এই আমি কত বড় একটা গল্প বানানেওয়ালি, আমার মা-বাপ কী চতুর কৌশলী।
সিদ্ধার্থ মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ, ওরকম একটা কথাও কানে এসেছিল বটে। বিশ্বাস করিনি।
কেন? সুমনা আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, সবাই তো বিশ্বাস করছে। মনে হচ্ছে ক্রমশ আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করব, তুমি করোনি কেন?
কেন করিনি জানো? সিদ্ধার্থ তেমনি করে একবার সুমনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, বিশ্বাস করতে অহমিকায় আঘাত লাগল। নিজের চেয়ে ভাগ্যবান আর কেউ আছে, এটা বড় মর্মবিদারী চিন্তা।
সুমনা কেঁপে ওঠে।
ওরা ভালবেসেছে, গল্প করেছে, হাসিগল্পে মশগুল হয়েছে, এবং অলিখিত চুক্তিপত্রে একরকম স্থির করে রেখেছে ওদের বিয়ে হবে। কিন্তু এমন খোলাখুলি এধরনের কথা কোনওদিন বলেনি সিদ্ধার্থ!
সুমনা তাই কেঁপে ওঠে।
কিন্তু কেঁপে উঠেও সামলে নেয় নিজেকে। বলে, শুধু ওই জন্যে? নইলে বিশ্বাস করতে বাধা ছিল?
সুমনা, পাগলামি কোরো না।
কিন্তু তুমি তো আসোওনি।
তা সত্যি! কিন্তু বিশ্বাস করো আসবার জন্যে অসম্ভব একটা ব্যাকুলতাকে রোধ করতে করতে, এই ক দিনে রোগা হয়ে গেলাম। মন একবার বলে যাই, একবার বলে থাক। একবার বলে দেখা হলেই সব সোজা হয়ে যাবে। একবার বলে,সোজা হলে আপনিই দেখা হবে। প্রায় মিছরির শরবতের মতো অবস্থা ঘটেছিল মনটার। এ গ্লাস থেকে ও গ্লাস। ইচ্ছের গ্লাস আর বিবেচনার গ্লাস। অতঃপর বিবেচনাই জয়ী হল।
বিবেচনা!
হ্যাঁ, বিবেচনা করে দেখলাম, তোমার এই অস্বাভাবিক মানসিকতার মাঝখানে আমার আবির্ভাবটা হয়তো আরও অস্বস্তিকর হবে। অপ্রীতিকরও হতে পারে। শুধু তুমি যদি কখনও শূন্যতা বোধ করে নিজেই
সুমনা নিজের মনকে তলিয়ে দেখে একবার। শূন্যতা বোধ কি হচ্ছিল? কই? কোনও বোধই বুঝি ছিল না সুমনার এতদিন। কিন্তু এখন! সিদ্ধার্থকে দেখে বুঝি বোধ ফিরছে। তাই প্রাণের মধ্যেটায় ভয়ানক একটা শূন্যতার হাহাকার অনুভব করে। ভুলে যায়, অঞ্জুকে বলে এসেছে এখনই আসছি। ভুলে যায়, কেন বাবার এই চেম্বারে এসেছিল সে।
শুধু অবাক হয়ে ভাবে, এতগুলো দিন সুমনা সিদ্ধার্থের কথা প্রায় ভুলে বসেছিল।
সিদ্ধার্থ মিনিটখানেক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, বাস্তবকে স্বীকার করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ সুমনা। পৃথিবী ভাবপ্রবণতার মূল্য দেয় না।
আর পৃথিবীর কাছে যদি আমি মূল্যের জন্যে হাত না পাতি? যদি কেবলমাত্র আমার আমিটাকে নিয়ে পড়ে থাকতে চাই?
তাও দিতে চায় না পৃথিবী। তোমার সেই তুমিটাকে নিভৃত কোণ থেকে টেনে এনে প্রশ্নে প্রশ্নে ক্ষত-বিক্ষত করতে চাইবে তুই কেন এমন উলটোপালটা রে? আমাদের হিসেবের সঙ্গে তোর হিসেবটা যে মিলছে না।
মিলোতেই হবে হিসেব?
পাগলা গারদে বা পর্বতগুহায় থাকতে না চাইলেই মিলোতে হবে। সেটাই নিয়ম।
সুমনা আস্তে বলে, আমার বিপদে তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, তবে তোমার জন্যে নয়, আমার জন্যে। কারণ বিপদটা তোমার চাইতে অনেক বেশি আমার।
তোমার!
তবে না তো কী। ভেবে রেখেছিলাম তোমার রেজাল্টটা বেরোলেই এতদিনের সুখস্বপ্নের কথাটা সম্বন্ধে আর্জি তুলব।
যাক, তুলতে হল না। কম খাটুনি বাঁচিয়ে দিলাম তোমার?
সুমনা!
সহসা খুব কাছাকাছি সরে আসে সিদ্ধার্থ। বলে, এটা কথা বলার সময় নয়, জায়গাও নয়, কিন্তু উপযুক্ত স্থান কাল এবং পাত্র একত্রে পাওয়ার আশা এখন দুরাশা। তাই খুব তাড়াতাড়ি বলছি কী ছেলেমানুষী হচ্ছে? ওসব পাগলামি ছেড়ে দাও। আমাদের যে জীবনকে আমরা এতদিন ধরে স্বপ্নে গড়েছি, তাকে ধূলিসাৎ কোরো না।
সুমনাকে ঈষৎ কঠিন দেখায়, আমাকে কী করতে বলো?
আমি কিছুই করতে বলব না সুমনা। শুধু একটু ভাবতে বলব তোমায়। ভেবে দেখতে বলব, তুমি নিজেকে কোথায় তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছ।
সুমনা স্পষ্ট কঠিন মুখে বলে,আচ্ছা তোমার অনুবোধ পালন করবার চেষ্টা করব। ভেবে দেখব।
সুমনা! কঠিন হোয়ো না। নির্বোধ হোয়ো না। একটা কানাকড়ির দামে জীবনটাকে বিকিয়ে দিও না।
সুমনা সেই কঠিন মুখেই একটু হেসে বলে, কোনটার কী দাম, সে কি চট করে অত সহজে কষে ঠিক করা যায় সিদ্ধার্থ? সময় লাগে।
ততদিনে যে সময় পার হয়ে যায় সুমনা। আমি বলছি, তুমি একটা তুচ্ছ সেন্টিমেন্টের বশে চলে নিজে কষ্ট পাচ্ছ, অন্য অনেককে কষ্ট দিচ্ছ। তোমার এই দুর্মতিতে তোমার বাবার কী অবস্থা হয়েছে দেখেছ?
সেটা আমার ভাগ্য সিদ্ধার্থ। ওঁরাও খুব একটা বুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছেন না। ওঁরাও সেই নিতান্ত তুচ্ছ ব্যাপারকে ফেনিয়ে বাড়িয়ে নিজেদের জীবনকেও জটিল করে তুলেছেন।
তুচ্ছই বা ভাবছ কেন? কেউ যখন তা ভাবছে না?
সেইটাই তো আমার কাছে এক অদ্ভুত রহস্য সিদ্ধার্থ। কেন তা ভাবছে না?
তা হয় না! সংসারী লোকদের হিসেব আলাদা।
থাক, তবে আর কী করা। কেমন ছিলে এতদিনে শুনি।
খুব ভাল।
শুনে খুশি হলাম।
সুমনা!
কী!
বাজে কথা, বৃথা অভিমান, থাক ওসব। চলো একদিন আমাদের জায়গায়।
জায়গায় জায়গা অবশ্য আর কিছুই নয়, ওদেরই পাড়ার লাইব্রেরি। সুভাষ পাঠাগার।
সিদ্ধার্থ যার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।
অলকও অবশ্য।
আর সুমনা লাইফ-মেম্বার।
ওইখানেই প্রায় রোজ একবার করে দেখা হয় ওদের।
সুমনার চোখে ভেসে ওঠে পাঠাগারের সেই দোতলার ঘরের সামনের বারান্দাটি। যেখানে তারা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে কাটিয়ে দেয়।
মানে কাটিয়ে দিত।
.
সুমনাদের পরিবার রক্ষণশীল।
মেয়েকে এম. এ., বি. এ. পড়তে দিলেও যথেচ্ছ গতিবিধির সুবিধে দিতে নারাজ তাঁরা। কলেজে যাচ্ছে যাক, তা বলে একা একা অর্থাৎ বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ভিন্ন যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবে, এত আহ্লাদ দেবার কিছু নেই। পড়তে দেওয়া হচ্ছে, এই ঢের।
কান্তিকুমার অবশ্য ঠিক এ মতাবলম্বী নন, কিন্তু পরিবার সম্পর্কে নিতান্ত মমতাশীল তিনি। যে কাজে মায়ের অসন্তোষ, দাদা বউদির বিরক্তি, ছোটভাইয়ের বিরুদ্ধতা, তেমন কাজ তিনি জোর করে করতে কুণ্ঠিত হন। তাই সুমনা স্কুলের গণ্ডি পার হলে বলেছিলেন, বেশ তো পড়ুক না, প্রাইভেট পড়ুক। মার যখন অমত–
সুজাতাই চারদিক থেকে বাঁধ দিয়ে দিয়ে ঠেকিয়েছে। কান্তিকুমারকে বুঝিয়েছে মার তো অন্য অমত কিছু নেই, শুধু বলছিলেন এবার বিয়ের চেষ্টা করতে। তা যতদিন না বিয়ের কিছু ঠিক হচ্ছে শুধু শুধু বসে থাকবে কেন? যেমন স্কুলে যাচ্ছিল তেমনি যাবে। বাড়ির গাড়িতে যাবে-আসবে–
আর শাশুড়ি-জা এবং তাঁদের মারফত ভাশুর দেওরকে বুঝিয়েছে, মেয়েটার একান্ত ঝোঁক, আর তার বাপেরও বড্ড ইচ্ছে যে, পড়াটা চালিয়ে যায়। শুধু বলতে সাহস পাচ্ছে না
শুধু বলতে সাহস পাচ্ছে না!
কান্তিকুমারের মতন মানী মানুষটা সংসারের এই লোকগুলোর কাছে নিজের ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে পারছে না! এটা বড় সন্তোষজন। এর জন্যে কিছুটা নরম হওয়া যায়।
অতএব ব্যবস্থা হয়ে গেল একরকম করে।
অবিশ্যি কলেজে পড়তে পড়তে নিয়মের কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল হয়ে এসেছিল। প্রফেসরের বাড়ি, সহপাঠিনীর বাড়ি, কি বইয়ের দোকানে আর পাড়ার লাইব্রেরিতে একা যাবার ছাড়পত্র মিলত, কিন্তু পাড়ার ছেলের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার সুযোগ পাওয়া কঠিন ছিল।
তাই একত্রিত হবার জায়গা ছিল ওই লাইব্রেরিটাই। এক ভদ্রলোক তাঁর বিরাট বাড়ির একাংশে দোতলার দুখানি ঘর ও একটু বারান্দা উৎসর্গ করেছিলেন পাঠাগারকে। ঘরে সকলের পা পড়ত, পিছনের বারান্দাটা থাকত নিরালা।
সুমনার জেঠি কণ্ঠে মধু ঢেলে বলতেন, সন্ধেভর কোথায় ছিলি সুমু? তোর ঠাকুমা কত ডাকাডাকি করছিলেন।
সুমনা হেসে উঠে বলত,কেন, দিদার আবার এ দুর্মতি কেন? ভগবানকে না ডেকে আমায় ডাকাডাকি!
জেঠি বলতেন, তুই নইলে এই কুচো কাঁচাগুলোর দস্যিবৃত্তি যে কেউ থামাতে পারে না বাছা। তাই ডাকাডাকি। তা ছিলি কোথায়?
সুমনা পাশ কাটাত। বলত, কোথায় আর, লাইব্রেরিতে তো। মাকে বলে গেলাম যে।
সুজাতা বলতো, বই কি ওখানে বসে বসে পড়িস, কেন, নিয়ে এসে পড়তে পারিস না?
সুমনা মিছিমিছি একটা ঝংকার দিয়ে বলত, আর বোলো না। যা না সব ছিরি! খোলবার কথা বিকেল পাঁচটায়, বাবুরা খোলেন গিয়ে ছটা সাতটা যখন খুশি। কী করব, তোমাদের যে আবার কড়া কানুন, নইলে ওই অখাদ্য পাড়ার লাইব্রেরিতে যায় কে? কলকাতা শহরে কত লাইব্রেরি। তা–সে তো–
সে তো যে কী, তা আর বলে শেষ করত না সুমনা, অন্য একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত হত।
ছোটকাকার চোখ পড়লে বলে উঠতেন, লাইব্রেরিতে গিয়ে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট না করে, সন্ধ্যাবেলাটা পড়াশুনো করলেই ভাল হয় না?
সুমনা আদরে গলে গিয়ে বলত, পড়াই তো করি ছোটকাকা। বাড়িতে নন্দি-সৃজিদের জ্বালায় মনই বসেনা। এ তবু সন্ধ্যাবেলা নিয়ম করে ঘন্টাখানেক কি ঘন্টা দেড়েক
ওঃ! তা পাঠ্যপুস্তক সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া হয় বুঝি?
আহা পুস্তক আবার কী! এই নোটের খাতা-টাতা–
আমাদের সুভাষ লাইব্রেরিতে আবার কাজের বই কিছু আছে নাকি? থাকবার মধ্যে তো দেখি চারটি বাজে নভেল আর
কী যে বলো ছোটকাকা! সব তুমি দেখেছ বুঝি?
এইভাবেই চালানো।
তবু চালিয়ে চলেছিল।
যে দিন দেরি হত, সিদ্ধার্থ বলত, মনে হচ্ছে লাঙ্গুলটি বড্ড বেশি স্ফীত হয়ে উঠছে দিনদিন।
সুমনা বলত, হওয়াই স্বাভাবিক। যেখানে এত বেশি স্বাগত, সেখানে অহংকার না এসে পারে?
ভাবছি এবার সন্ধ্যায় একটা টিউশনি ধরব।
আঃ কবে এ সুমতি ঘটবে তোমার? হলে আমি হরির লুট দেব।
হরির লুট দেবে?
না তো কী? রোজ এই যন্ত্রণার দায় থেকে রেহাই পাব, হাড় জুড়োবে।
সিদ্ধার্থ ভয়ংকরের ভূমিকা অভিনয় করে বলত, বটে নাকি? তা হলে তো নেওয়া হবে না।
নেওয়া হবে না!
উঁহু! শত্রুপক্ষকে কদাচ স্বস্তি দিতে নেই। শাস্ত্রে নিষেধ আছে।
আমি তোমার শত্রুপক্ষ?
আমি তো তাই মনে করি।
আবার দৈবাৎ কোনওদিন সিদ্ধার্থই হয়ত আটকা পড়ে যেত অন্য কাজে, দেরি হয়ে যেত তার। সেদিন সুমনা ছটফট করত, যাই যাই করত, এসেছিলাম। চলে যাচ্ছি। বলে চিরকুট লিখত অথচ চলে যেত না। আর সিদ্ধার্থ এলে একেবারে তাকে দেখতে না পাওয়ার ভান করে বইয়ের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে যেত।
তারপর পুড়ত অনেক কাঠখড়।
.
আমাদের জায়গা শুনেই সেই দিনগুলো চোখের উপর ভেসে ওঠে।
ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন, তবু অভিমান বড় দুর্ভেদ্য বর্ম।
তাই মুখে সে ব্যাকুলতা ফোটে না।
মুখে যা ফোটে তা এই: আমার সময় নেই।
জানি। কিন্তু তোমার সময় যে হরণ করে নিয়েছে, তাকে আমি অভিসম্পাত দিই এই কি তুমি চাও সুমনা?
সুমনা আবার কেঁপে ওঠে। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যে। তারপর পাথুরে মুখে একটু আগুনের হাসি হেসে বলে, অভিসম্পাত এত বেশি পাচ্ছে সে যে, তোমার টুকুতে আর বিশেষ কিছু হবে না। বোঝার ওপর শাকের আঁটি।
সুমনা! আমায় মাপ করো। আমি শুধু তোমায় রাগিয়ে দিতে চাইছিলাম, তাতিয়ে তুলতে চাইছিলাম। শোনো, তোমার পায়ে পড়ি, এসো আজ সন্ধ্যাবেলা।
বলেছি তো আমার সময় হবে না। সিদ্ধার্থ, তুমি আমার কথা ভুলে যাও।
চমৎকার! প্রায় একটি নাটকের নায়িকার উক্তি!
ব্যঙ্গ করে তুমি আমায় টলাতে পারবে না।
হাত জোড় করে?
তার উত্তরে হাত জোড় করব।
সুমনা, আমি বলছি তুমি সারাদিন ধরে ভাবো। আমি লাইব্রেরির বারান্দায় আছি। সমস্ত সন্ধ্যা।
দরজার কাছে কান্তিকুমার এসে দাঁড়ান।
বুঝি সুমনাকে সিদ্ধার্থের কাছে এসে কথা বলতে দেখে একটু প্রীত হন, প্রসন্ন হন। শান্ত গলায় বলেন, এই যে সুমি, তুই এখানেই রয়েছিস! অঞ্জু কি তোকে বলেছে, এগারোটার মধ্যেই বেরোব আমরা–
সুমনা মাথা নিচু করে বলে, হ্যাঁ বাবা, বলেছে। আমিও তাই নিজেই বলতে এলাম, আমার একটু ভুলই বলা হয়েছিল। এম. এ.-তে ভর্তি হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়!
.
আশা ছিল না।
তবু সমস্ত সন্ধ্যাটা লাইব্রেরির দোতলার সেই বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে থাকে সিদ্ধার্থ।
পাঠাগারের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। চাকরটা সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে সরে পড়ার তালে খানিকক্ষণ ঘুরঘুর করে কাছে এসে বলে,দাদাবাবু এখন থাকবেন নাকি?
সিদ্ধার্থ সচকিত হয়ে হাত তুলে ঘড়িটার দিকে তাকায়। লজ্জিত হয়ে বলে, না, তুমি দরজা বন্ধ করো।
আরও একটা জায়গায়ও তবে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। হয়তো চিরকালের মতো গেছে।
অনুভব করতে পারছে সিদ্ধার্থ। কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে বলেই হতাশ নিশ্বাস ফেলে চলে আসবে? দেখবে না যে তালাটা কতখানি মজবুত? আদৌ মজবুতই কিনা?
তালা যে লাগিয়েছে সে কি নিজেই জানে সে কথা?
সকালে দেখা কান্তিকুমারের মুখটা মনে পড়ে সিদ্ধার্থর। মনে পড়ে বাবাকে সুমনা কী ভালবাসত!
বাবা তো ভালবাসারই জিনিস, তবু সকলের ভাগ্যে কি জোটে অমন বন্ধুর মতো, গুরুর মতো, শ্রদ্ধা করবার মতো বাবা?
সুমনা অনুভব করত তার ভাগ্যের সেই পরম দান।
সুমনা সে কথা ভুলে গেল কী করে?
হঠাৎ মনে হল সিদ্ধার্থের, আগেকার আমলে বোধ করি একেই বলত ভূতে পাওয়া। জঙ্গলের ভূত এসে ঘাড়ে চেপেছে শিশুর মূর্তি ধরে! সেই হতভাগা ছেলেটা না জানি কেমন। না জানি বা কাদের।
.
কান্তিকুমারদের বাড়ি থেকে মিনিট কয়েকের রাস্তায় সিদ্ধার্থদের বাড়ি। তিন ভাইয়ের মধ্যে সিদ্ধার্থই ছোট, তাই মা বাপের কাছে তার কিছুটা প্রশ্রয় আছে। আর একটু বিশেষ প্রশ্রয় আছে বড়বউদি রমলার কাছে। কলকাতার এই বাড়িতে অবশ্য তিনিই একমেবাদ্বিতীয়াং। কারণ মেজদা মেজোবউদি থাকে রাজধানীতে। আসেন কদাচ।
সিদ্ধার্থ আর সুমনার হৃদয়ঘটিত ব্যাপারটির রমলাই পৃষ্ঠপোষিকা। রমলা দেওরকে আশ্বাস দিয়ে রেখেছে, নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে প্রেমবৃক্ষে জলসিঞ্চন করে যাও, অতঃপর আমি আছি।
সিদ্ধার্থ বলত, তুমি তো আছ তোমার শ্বশুরকুলের কর্ণধার হিসেবে। কিন্তু ও কুল যদি সহসা অকূলে ভাসায়?
ইস, ভাসালেই হল অমনি। নিরুপায়া বালিকার অশ্রু বিসর্জনের দিন এখনও আছে যে! বলি মশাই, তোমার প্রেয়সীর প্রেম কি এমনি অমজবুত যে অভিভাবকের একটু চোখ রাঙানির ধাক্কা খেলেই ধসে পড়বে?
বলা কি যায়? মেয়েদের ব্যাপার!
হু, ইতিমধ্যেই মেয়েদের যে বেশ চিনে নিয়েছ দেখছি! সুমনার ভালবাসার প্রতি আস্থাটা তা হলে জোরালো নয়?
আহা আমি আস্থা রাখলেও
থামো থামো! আর ন্যাকামি করতে হবে না। পৃথিবী উলটে গেলেও সুমনা বদলাবে না।
এত দুঃসাহসিক ভবিষ্যৎদ্বাণী?
নিশ্চয়। মেয়েদের তোমরা ভাবো কী? সুমনাকে আমি স্কুলে-পড়া মেয়ে থেকে দেখছি না?
তা সিদ্ধার্থই কি আর দেখছে না? না সিদ্ধার্থের আস্থা আর নিশ্চিন্ততায় কোনও ভেজাল আছে। ও শুধু বউদির সঙ্গে চালাকি করে। বলে, আমি এই একটা সস্তা মাল। আমি কি আর অ্যাডভোকেট কান্তিকুমারের ওই রূপে গুণে আলো করা মেয়ের উপযুক্ত? এ প্রস্তাব তুললে ভদ্রলোক আমায় কবিরাজি চিকিৎসার পরামর্শ দেবেন।
ভারী সাধ্যি! তবে তুমি যদি ভয় পেয়ে সরে আসো আলাদা কথা।
সিদ্ধার্থ হাসত।
ওদের দুজনের বিয়েটাকে চন্দ্ৰসূর্যের নিয়মের মতো নিশ্চিত ভেবে নিশ্চিন্ত আছে সে।
মাঝে মাঝে পিসির প্ররোচনায় মা একটু একটু টোকা দিয়ে দেখেছেন, বলেছেন, যতদূর দেখছি, তুই তো ওই কান্তি উকিলের মেয়ের পিত্যেশে হাঁ করে বসে আছিস। আর ও যদি ঝপ করে মেয়ের জন্যে মগডালের ফুল জোগাড় করে বসে?
সিদ্ধার্থ মাকে রাগাবার জন্যে বলত, কী আর করা যাবে! ভাবব ওই আমার বিধিলিপি। সংসার করা আমার কপালে নেই।
ঘেন্নার কথা বলিসনি সিধু। ওর বাপ ওর অন্য পাত্রে বিয়ে দেবে, আর তুই বৈরাগ্য নিবি?
সিদ্ধার্থ আরও হাসত।
বলত, তাতে যদি মান খাটোই হয়, না হয় দেখেশুনে অন্য একটা বিয়েই করে ফেলা যাবে। কিন্তু বাতাসের সঙ্গে লড়াই কেন? যদি নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন?
পিসি বলে উঠতেন, মাঝে মাঝে ওই সুমনার জেঠি যা লম্বা-চওড়া কথা কয়! বলে, ওদের ওই মেয়ে নাকি রাজপুত্তুরের যুগ্যি। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে। শুনলে গা জ্বলে যায়।
কী মুশকিল! গা জ্বলবার কী আছে? বরং তাতেই তো আরও মজা। যে মেয়ে রাজপুত্তুরের যুগ্যি, সে মেয়েকে তোমাদের এই হতভাগা ছেলেটা লুঠে আনবে, এতে গা জ্বলবার কথা তো ওদেরই।
তুই যতই নিশ্চিন্দি থাক সিধু-মা বলেন, আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত ওরা তোকে আমল দেবে না।
ওরা কে? সিদ্ধার্থ হেসে ওঠে, ওদের দেওয়া না দেওয়ার ওপর নির্ভর নাকি? তবে হ্যাঁ, স্বয়ং রাজকন্যাই যদি হঠাৎ
পিসি বলে উঠতেন, এখন এতসব ভাল ভাল সম্বন্ধ আসছে। কানে নেওয়া হচ্ছে না, পরে দেখবি
.
আজও রাত্রে বাড়ি এলে খেতে বসিয়ে সেই কথাই পড়েন সিদ্ধার্থের মা আর পিসি।
কান্তিবাবুর মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে, আর কোনও দিকে তো চোখ দিতে দিলি না এ যাবৎ। এবার বিবেচনা কর। ও মেয়ে তো শুনছি কাঠ কবুল, নাকি জগৎ ছাড়বে তবু ওই কুড়োনো ছেলেটাকে ছাড়বে না। জানি না বাবা ভিতরের রহস্য কী! তা সে যাই হোক ওর ভরসায় থাকবার আর দরকার কী?
সিদ্ধার্থ ভুরু কুঁচকে বলে, তা এখুনি তাড়াহুড়ো করে ভরসা ছাড়বারই বা দরকার কী?
দরকার কী, দুচার কথার শেষে কিছুক্ষণ পরেই প্রকাশ হয়। পিসিমার এক ভাগ্নে এসে ধরে পড়েছে মেয়ের জন্যে। সুন্দর মেয়ে, বি. এ. পাস, গানবাজনায় পটু ইত্যাদি ইত্যাদি
পিসিমা সতেজে বলেন, ও তোর সুমনার চেয়ে একশো গুণে ভাল।
সিদ্ধার্থ হেসে ওঠে, একশো গুণ বহন করা বড় শক্ত পিসিমা। ওসব চেষ্টা করতে যেয়ো না।
মা কুদ্ধকণ্ঠে বলেন, তুই কি এখনও ভাবছিস ওকে বিয়ে করবি?
ভাবছি বইকী মা।
ওই একটা ছেলেসন্ধু মেয়ে, রাগের সময় ভাষার শালীনতা হারান মা, ভগবান জানেন,কার ছেলে, কাদের ঘরের ছেলে।
ওটা খুব একটা বাধা নয়।
নয়?
আমি তো মনে করি, না।
তোর মাথার উপর বাপ, দাদা, তাদের কথা ভাবিস। উনি বলে দিয়েছেন, কান্তিবাবুর মেয়ের আশা তোমায় ত্যাগ করতে হবে।
রাগ করে উঠে যান মা।
সিদ্ধার্থের কাছে খুব একটা প্রতিবাদের ভাষা নেই। সে তো এই সমাজেই মানুষ। জানে তো সমাজ-মন।
উঃ সেই ছেলেটাকে ছিনিকেই নেওয়া যায় না সুমনার কাছ থেকে!
তা হলে হয়তো সুমনা সহজ হয়ে যায়।
.
মনের কথাটা বুঝি মুখে ধরা পড়ে।
রমলা এসে বলে ওঠে, যা দেখছি সহজে হবে না।
সিদ্ধার্থ চমকে উঠে বলে, কী সহজে হবে না?
চমকাচ্ছ কেন ভাই? আমি বলছি, তোমার প্রেয়সীটি পরিস্থিতি যেমন ঘোরালো করে তুলেছে, তাতে এ পক্ষের মত পাওয়া সহজ হবে না।
মত পাওয়ার আশা আর করছি না।
সে বুঝতেই পারছি। কিন্তু ঠাকুরপো
কী!
ও শুনছি ওই ছেলেটাকে উপলক্ষ করে ভীষণ জেদ ফলাচ্ছে, মা বাপ ঠাকুমা জ্যাঠা কারও কথা শুনছে না। তাই ভাবছি অত জেদি মেয়েকে নিয়ে।
আহা বউদি, সে তো পড়েই আছে কথা। জীবন মহানিশা। কিন্তু করা যাবে কী, ভাগ্য বলে কথা। এই যে তুমি–
সিদ্ধার্থ মৃদু হেসে থামে।
ওমা! আমি আবার কী?
আহা, মানে তুমি কিছু আর আমার দাদাটিকে আদর্শ পুরুষ বলে মনে করো না! তবু তো দাদাকে বহন করতে হচ্ছে তোমায়।
শোনো কথা। কীসে আর কীসে! আমার সঙ্গে তোমার তুলনা? বিয়ের পর ঘর করতে করতে দেখছি মানুষটার কতটুকু দোষ, কতখানি গুণ।
উঁহু, ঠিক হল না। বরং বলতে পারো কতখানি দোষ, কতটুকু গুণ।
রমলা হেসে ফেলে বলে, দাদা গুরুজন তা মনে রেখো!
অলওয়েজ মনে রাখি। তবে ধরে নিতে হবে কথাটা হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে। বিয়ের পর বলেই ভাগ্য বলে মেনে নিতে হবে, আর বিয়ের আগে হলেই ভাবতে হবে ভাগ্য হাতের মুঠোয়, তা হয় না। প্রেমে পড়াও একরকম নিরুপায়তা।
নাঃ, তোমার ওপর আর আশা নেই। বৃথাই মা আর পিসিমা আমাকে উকিল খাড়া করেছেন।
ওঃ! বটে, তাই নাকি। তাই ভাবছি তোমার কথার মধ্যে এমন বিজাতীয় বিজাতীয় গন্ধ কেন!
না না ঠাকুরপো! আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। আচ্ছা আমি একবার ওর কাছে যাব?
গিয়ে?
গিয়ে বুঝিয়ে বলব।
পাগল হয়েছ? আরও খেপে যাবে। তোমাকে আমার চর ভাববে।
তা হলে তোমার সিদ্ধান্তটা কী? কী করবে?
আপাতত ওর মনের গতি-প্রকৃতি লক্ষ করে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করব না।
এরপরে আর কনে জুটবে না।
রমলা বকে ওঠে।
তা আমার বাজারদর যে হঠাৎ এত পড়ে যাবে, তাই বা ধরে নিচ্ছ কেন? চুপচাপ থাকোই না বাবা একটু?
হুঁ, এদিকে তোমার দাদা রোজ শাসাচ্ছেন, আমি যেন কান্তিবাবুর মেয়ের দিকে না ঢলি। যেন তোমাকে সদুপদেশ দিয়ে দিয়ে।
সেরেছে। দাদা আবার এর মধ্যে কেন, আমার তো ধারণা, বিয়ে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ মহিলা মহলের এলাকা।
বাঃ, উনি হচ্ছেন বংশের মানী পুরুষ, বংশের মান মর্যাদা দেখবেন না? ওঁদের তো প্রায় ধারণা জন্মে গেছে
হঠাৎ চুপ করে যায় রমলা।
সিদ্ধার্থ বলে, কী ধারণা জন্মে গেছে?
নাঃ সে তোমায় বলা যাবে না। যতসব বাজে বিচ্ছিরি কথা।
সিদ্ধার্থ একটু হাসে। কথাটা বুঝতে দেরি হয় না। সকলের মনেই সন্দেহের প্যাঁচ।
তা হলে সুমনার সেই তীব্র ব্যঙ্গটা মিথ্যা নয়।
ও ঘর থেকে মা আর একবার এসে দাঁড়ালেন। গম্ভীর মুখ। বললেন, সিধু, উনি বলছেন তোমার পিসিমার সেই ভাগ্নের মেয়েটিকে আজই দেখতে যাবেন। আর পছন্দ হলে পাকা কথা দিয়ে আসবেন।
সিদ্ধার্থ হেসে বলে, তা তোমাদের এইসব পাকা কথাটথার ব্যাপার এই কাঁচা ছেলেটাকে শোনাতে এলে যে?
একটু শুনিয়ে রাখছি–
না। কোনও দরকার নেই। তোমরা যখন সবই পাকা করে তুলবার সাহস রাখছ, তখন বাকি দায়িত্বটাও নিয়ো। আমায় কেন জড়াচ্ছ বাবা!
তার মানে উনি কথা দিয়ে আসার পরও তুই ওঁর মুখ রাখবি না?
রাখা সম্ভব নয়।
আর আমি যদি তোকে হুকুম করি?
বলে একটি গর্বিত সাফল্যের দৃষ্টিতে তাকালেন মা।
হু বাবা! এইবার? কেমন প্যাঁচে ফেলেছি।
কিন্তু ধূলিসাৎ হল গর্ব।
সিদ্ধার্থ বলল, হুকুম তুমি করতে পারবেই না মা! হুকুম করবার আগে তো এ সাহস থাকা চাই যে, হুকুমটা রক্ষা হবেই।
বুকের উপর একটা হাতুড়ির ঘা বসিয়ে চলে গেল ছেলে! চোখের জল গোপন করতেই বুঝি আড়ালে সরে গেলেন সিদ্ধার্থের মা অনুপমা। আর সেই আড়ালে বসে ভাবতে লাগলেন, কী করে এমন বদলে যায় ছেলেরা? একদা যে মা থাকে সবচেয়ে ভালবাসার, সব বড় আশ্রয়, সেই মা এত তুচ্ছ হয়ে যায়? স্নেহ ভালবাসা শ্রদ্ধা সন্ত্ৰম কর্তব্য অকর্তব্য, ভাল দেখানো মন্দ দেখানো–সমস্ত কিছু পরাস্ত হয় যৌবনের উদগ্র বাসনার কাছে?
ভগবান, ছেলেরা কেন বড় হয়ে যায়। কেন যুবক হয়ে ওঠে? যদি তাই হয়, তবে এমন নিয়ম কেন নেই, ছেলেরা বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের প্রাণ থেকে ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তার জন্যে আকুলতা, তার প্রতি আশা। পশুপক্ষী কীট-পতঙ্গ জীবজগতের সকলের যা নিয়ম, সে নিয়ম কেন মানুষের মধ্যেও রইল না? ছেলেদের মধ্যে তো জীবজগতের রীতিনীতি। শুধু এই অবুঝ অজ্ঞান মা-গুলোর মধ্যেই
এই তো বড় ছেলে অমিতাভ!
বিয়ের আগে পর্যন্ত কী ন্যাওটাই ছিল মার। ছোট থেকে সবাই বলত মায়ের ছায়া।
সিদ্ধার্থটাই বরং চিরকেলে ডাকাবুকো।
কিন্তু সেই মা-ন্যাওটা বড় ছেলে কী বদলেই গেছে! মা বলে প্রাণীটার প্রতি সেই একান্ত নির্ভরতার ভাব তো চুলোয় গেছেই, উলটে উঠতে বসতে ছুতো খুঁজে বেড়ায় কী করে মার একটু দোষ আবিষ্কার করবে।
কেন?
সে এক রহস্য।
আগে বুঝতে পারতেন না, অবিরত শুধু অবাক হতেন, আর কেন কেন করে অন্ধকারে মাথা খুঁড়তেন। ক্রমশ রহস্যভেদ হয়েছে। ভাবতে ভাবতে কারণটা আবিষ্কার করতে পেরেছেন।
আর কিছু নয়। মায়ের ত্রুটি ধরা পড়লে বউয়ের ত্রুটির ওজনটা খানিকটা হালকা হয়ে যায়। বউয়ের যে প্রতি পদেই ত্রুটি, সেটা চোখ বুজে অস্বীকার করতে চাইলেও, মনের অগোচর তো চিন্তা নেই।
বড় ছেলেকে তাই অনুপমা খরচের খাতায় লিখে রেখেছিলেন। সেজো মেজো বিদেশে। ডাকাবুকো ছেলে সিধুটাই ছিল ভরসা। মনে করতেন ও ওরকম করবে না। যেমন মানুষ প্রতিনিয়তই মৃত্যু দেখেও ধারণা করতে শেখে না, আমার প্রিয়জনেরও মৃত্যু হবে। যে কোনও মুহূর্তেই সে ঘটনা ঘটতে পারে।
ওর গেছে, তা বলে কি আমার যাবে?
একজন মন্দ হয়েছে, তা বলে কি আর একজনও মন্দ হবে?
কিন্তু সিদ্ধার্থ বুকে হাতুড়ি মেরে সেই অবোধ ভুল ভেঙে দিয়ে গেল। অনুপমা অনুভব করলেন সিদ্ধার্থ আর তাঁর নেই।
জয় হয়েছে যৌবনের।
তৃষ্ণার জলের চাইতে নেশার মদের আকর্ষণ অনেক প্রবল, প্রমাণ হয়ে গেছে একথা। তবে আর কী করবার আছে?
.
বড় বউ রমলাকে কিন্তু অনুপমা যত স্বার্থপর আর মমতাহীন ভাবেন, সে তা নয়। অনুপমার মনের গতিবিধির খবর সে রাখে, চেষ্টা করে সেই ক্ষুব্ধ চিত্তে সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে। কিন্তু চেষ্টাটা কার্যকরী হয় না। যেখানে ছেলে দূরে সরে যেতে চায়, সেখানে বউয়ের সাধ্য কি যোগাযোগের সেতু রচনা করে?
তবু সে অমিতাভর কাছে গিয়ে অভিযোগ করে, বেশ তো নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছ, ওদিকে মা তো কান্নাকাটি করছেন।
কেন? হঠাৎ কান্নাকাটির কী হল?
আর কি? তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতার ব্যাপার। কান্তিবাবুর মেয়ে ব্যতীত তার জীবন অচল, ওদিকে মা–
তা এসবের মধ্যে আমি কে? আমি তো আগেই রায় দিয়ে রেখেছি।
শুধু রায় দিলেই হয় না। ভাইকে বোঝাতে পারো না? বলতে পারো না যাতে সংসারে অশান্তি
.
ওহে মহীয়সী মহিলা, হলে অবধান করুন। আমের মধ্যে যেমন আঁঠি, সংসারের মধ্যে তেমনি অশান্তি। মানে ওই অশান্তিটুকুকে অবলম্বন করেই সংসার নামক মাকাল ফলের গঠন। ওই অশান্তির আঁঠিটুকুকে আঁকড়ে ধরেই তার যা কিছু রং রস স্বাদ গন্ধ। অশান্তিকে বিতাড়ন করতে চাও তো আগে সংসারকে খণ্ড বিচ্ছিন্ন করো।
হয়েছে। খুব ব্যাখ্যা হয়েছে। সত্যি কী মুশকিল কাণ্ড বলো! আগে ভাবতাম, কান্তিবাবুর অমন দামি মেয়ে, তাকে কি আর ঠাকুরপোর হাতে দেবে? নিশ্চয় আসমান থেকে বর আসবে তার। শুধু মেয়েটার মতিগতিটুকুই ভরসাস্থল ছিল। আর এখন এ পক্ষই রিজেক্ট করতে চাইছে
ওই তো! ওই তো ভবের খেলা। এই তো দেখোনা, তোমার বাবা কত না সাধ্য-সাধনা করে আমা হেন জামাই জোগাড় করলেন। আর এখন? শ্বশুর ঠাকুরের সেই কন্যাকে সাধ্যসাধনা করতে করতেই আমার
তাই তো! খুব বক্তৃতা হয়েছে। তোমার দ্বারা যে কিছু হবে না সে আমার জানাই ছিল। যাক আমিই দেখি–
তুমি দেখতে গেলে ফল উলটো হওয়ার চান্সই শতকরা একশো দশ।
তার মানে?
মানে পরিষ্কার। যেখানে প্রেম, সেখানেই তোমার সহানুভূতি।
তাই নাকি? আমাকে তো তা হলে চিনেই ফেলেছ দেখছি।
না, একেবারে ফেলেছি তা বলতে পারি না, তবে কিছু কিঞ্চিৎ চেষ্টা করছি।
বউ হেসে চলে যায়।
.
তা সিদ্ধার্থও কথায় তার দাদার চেয়ে বেশি বই কম নয়। বউদিকে সে কথার ঘায়েই উড়িয়ে দেয়। সেও বলে, বলল কী বউদি, সংসারে যাতে অশান্তি না আসে তার সাধনা করতে লেগেছ তুমি? তাজ্জব!
কেন, আমি বুঝি তোমাদের সংসারে কেবল অশান্তিই সৃষ্টি করি?
আহা-হা তা বলছি না। মানে, আমি বলতে চাইছি–মেয়েরা তো চিরদিনই একটু টক ঝাল নুন মশলার ভক্ত। আর তুমিও নিশ্চয় মেয়ে ছাড়া আর কিছু নও? অতএব নির্বিদ আলু-ভাতে অভিরুচি না হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই একটু আধটু অশান্তির চাষ
দুটি ভাই সমান! খালি বাক্য। পষ্ট কথা বলি শোনোসুমনার বিরুদ্ধে তো সবাই লড়তে শুরু করেছে। আমারও যুক্তিটুক্তি তেমন আসছে না। তা ওকেই বিয়ে করবে এটাই একেবারে স্থির?
সে যদি করে।
সেই তো কথা। কিন্তু এ সন্দেহ নিয়ে–?
তা যেখানেই আশা সেখানেই সন্দেহ।
কিন্তু ওর সম্বন্ধে তো এ পক্ষে একেবারে
তাতেই তো আরও মজা পাচ্ছি।
মজা পাচ্ছ।
হ্যাঁ। তাই! নিজেকে বেশ বীরপুরুষ বীরপুরুষ মনে হচ্ছে।
ওকে না হলে তা হলে চলবেই না তোমার?
আপাতত তো তাই মনে হচ্ছে।
মা তো কান্না জুড়েছেন।
কাঁদুনে বাচ্চারা যেমন কাঁদে, তেমনি সহজে ভোলে।
অতঃপর হঠাৎ কেমন করে যেন আলোচনার নৌকো উলটো দিকে বয়, এবং বউদিই পরামর্শ দিয়ে বসেন–তার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়াই হল ঠিক ব্যবস্থা। তাতে প্রথমটা সবাই একটু বিচলিত হলেও কালে ভবিষ্যতে সেটাই ভাল হবে। মনে কোরো না আমি একলা একেশ্বরী হয়ে থাকতে চাই বলেই এ কথা বলছি। আমি শুধু বলতে চাইছি বিয়ে করবার সময় যে শপথ মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়, তাতে বারবার বলা হয়–তোমাকে সুখে রাখব, সম্মানে রাখব…ইত্যাদি!তা ভাই সে সব শপথ আর কজন রাখে বলো? রাখে না তার কারণ এই একান্নবর্তী পরিবার। এর জাঁতার চাপে ছোট বড় কারও জীবনের বিকাশ নেই। প্রত্যেকের পর্বতপ্রমাণ অসন্তোষ। বড়রা ভাবে ছোটরা অকৃতজ্ঞ, ছোটরা ভাবে বড়রা অবিচারক।
ওরে বাবা, তুমি যে দেখছি অনেকদূর অবধি ভেবে ফেলেছ। যাক–তোমার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাব।
রমলা দুষ্টু হাসি হেসে বলে, কিন্তু ঠাকুরপো, তোমার পড়শিনী কি সত্যিই তোমায় ভালবাসে? না কি এতদিন শুধু তোমায় নিয়ে খেলিয়েছে?
সিদ্ধার্থ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রমলার দিকে।
বলে, কী করে বুঝব বলো? দেবা ন জানন্তি বলে একটা কথা আছে। তবে তোমরা জানলেও জানতে পারো। স্বজাতির হৃদয়রহস্য ভেদ করা হয়তো সম্ভব হতেও পারে। খেলানো ব্যাপারটার রীতিপদ্ধতি তোমরাই—
আহা-হা! আমাদের সঙ্গে তুলনা! আমরা আবার মানুষ নাকি? বাবা গোরুখখাঁজা করে একটি জামাই খুঁজে বার করে মেয়েকে তার গোয়ালে সমর্পণ করে দিয়ে গেছেন, সেই গোয়ালে পড়ে আছি আর সেই পরম গোরুর চরণে জীবন যৌবন উৎসর্গ করে ধন্য হচ্ছি। আমরা আবার খেলাবার রীতি পদ্ধতির খবর রাখতে যাব।
ইস বেচারা! বাবার অবিমৃষ্যকারিতায় জীবনটাই বরবাদ।
তা প্রায় তাই। তবে কি জানো ভাই,জীবনটাকে নিজের এক্তারে পেলেই যে কী হত সে কথা বলা শক্ত। হয়তো বাঁদরের হাতে খোন্তা হত। এই যে সুমনা, আসলে রহস্যটা যে কী বোঝাই তো শক্ত। আমি তো আগে কিছুতেই বিশ্বাস করিনি, কিন্তু পিসিমা-টিসিমা যা সব অকাট্য যুক্তি দিচ্ছেন
সহসা গম্ভীর হয়ে যায় সিদ্ধার্থ।
বলে,ছিঃ বউদি! তোমার কাছে অন্তত এ ধরনের কথা শুনব আশা করিনি।
কী, জানি ভাই, এমন সব বলছেন এঁরা– বলে অপ্রতিভ হয়ে সরে যায় রমলা।
সিদ্ধার্থও বেরিয়ে পড়ে।
দুর ছাই!
অকারণে জীবনটা কী এক অদ্ভুত জটিলতার জালেই জড়িয়ে গেল! এ জাল থেকে মুক্ত হবার যে কী উপায়!
.
এই যে শ্রীমান অচিনকুমার
অলক লা ল লা লা লা করতে করতে সুমনার ঘরে ঢুকে বলে, আরে আরে এটা মাটিতে পড়ে কেন?
কাছেই বসে আছে সুমনা।
তাকিয়ে দেখে বলে, এত দুষ্টু হয়েছে যে এক মিনিট খাটে রাখতে পারা যাচ্ছে না। এই দেখো না কাল পড়ে কপাল ফুলিয়েছে।
তা দোলায় তুলে রাখলেই তো হয়–
ছেলেটাকে টপাস করে তুলে নিয়ে নাচাতে নাচাতে বলে অলক, দোলা থেকে ট্যাঁ ফোঁটি করতে পারে না।
দোলা। দোলনা।
কত সাধ সুমনার!
কত স্বপ্ন!
দোলনায় শুইয়ে দোলা দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াবে তার অচিনকে, খোকনকে, মানিককে। কিন্তু সে সাধের কথা বলবে কাকে?
কান্তিকুমার জামা তোয়ালে বিছানা অয়েলক্লথ ফুড় ফিডিংবটল এসব জুগিয়ে আসছেন, তা বলে দোলার কথা তাঁর মনে পড়বার কথা নয়।
ফিকে একটু হাসে সুমনা। বলে দোলনা কই?
দোলনা নেই! অলক এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, ইস! পুওর বেবি! ঠিক আছে, আমিই ওকে একটা দোলনা প্রেজেন্ট করব!
থাক দাদা। আর গোলমাল বাড়াসনে। ভিখিরিদের ঘরের ছেলে ভিখিরির মতনই মানুষ হোক।
ভিখিরির ঘরের? কে বলে?অলক সেই মোমের পুতুলটাকে যত লোফালুফি করে ততই খিলখিল হাসিতে ঘর ভরিয়ে তোলে সে। আরও ছুঁড়ে দিয়ে বলে অলক, এ বেটা নির্ঘাত কোনও রাজবাড়ির ছাঁ। দেখছিস না কী কার্তিকের মতন মুখ, কী সোনার মতন রং!
ওর সত্যিকার মা জানবেও না ও বেঁচে আছে, বড় হচ্ছে। হয়তো চোখের সামনে দেখলেও চিনতে পারবে না। ভাবলে কী অবাক লাগে, না রে দাদা?
তা লাগে। অলক ছেলেটাকে নামিয়ে দিয়ে বলে, ভাবলে কত কীই অবাক লাগে। এই যে তুই দুদিনের জন্যে বেড়াতে গিয়ে কার না কার একটা জিনিস কুড়িয়ে এনে তার জন্যে সবত্যাগ করছিস, এও একটা পরম আশ্চয্যি। সিদ্ধার্থ তো বলছে তুই পাগল হয়ে গেছিস। বলছে, যে মেয়েদের মধ্যে মাতৃত্বের অংশ বেশি, তাদের নাকি খুব ছেলেবেলায় বিয়ে-টিয়ে হয়ে বাচ্চাটাচ্ছা হয়ে গেলেই মঙ্গল। নইলে এই রকম সব ম্যানিয়া–
থাম দাদা! সুমনা প্রায় ধমকে ওঠে, তোর সিদ্ধার্থ দেখছি অনেক কথা শিখেছে।
কিন্তু তুইও তো যা তা করছিস মনা। এম. এ-তে ভর্তি হলি না, বাড়ির কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখিস না
বাড়ির কেউও আমার সঙ্গে রাখে না।
বেশ তাই সই! অলক বলে, কিন্তু সিদ্ধার্থ? সে বেচারার কী দোষ? কী যন্ত্রণা তার! এদিকে এই, ওদিকে বাড়িতে বিয়ের জন্যে উৎপাত করছে–
বাঃ চমৎকার! সুখবর তো! তাড়াতাড়ি লাগিয়ে দে না। পাড়ার একটা ঘটার বিয়ের নেমন্তন্ন খাওয়া যাবে।
নাঃ সত্যিই তুই ভারী নিষ্ঠুর হয়ে গেছিস মনা! আগে এমন ছিলি না। আচ্ছা, বিয়ে-টিয়ে হওয়া, মানে সত্যি মা-হওয়া মেয়েও তো কত দেখেছি তারা তো পড়ছে লিখছে খেলছে গান গাইছে, সবই করছে। তোর মতন তো এমন জড়ভরত হয়ে ঘরে বসে থাকছে না।
থাকে না, তা জানি—
সুমনার উত্তর দেওয়া হয় না।
ছেলেটা হামা দেবার চেষ্টায় মুখ তুলতে গিয়ে থুবড়ে পড়ে গিয়ে ককিয়ে কেঁদে ওঠে। সরবে ছেলে ভোলাবার অভ্যাস সুমনার নেই, অনেক দুলিয়ে থাবড়ে চুপ করিয়ে বলে,দেখলি তো? কী অবস্থা! সবাইয়েরই অনেক আত্ম-পরিজন আছে, এ বেচারার আমি ছাড়া আর কে আছে বল?
তা মেজোকাকা তো ঝি রাখতে চেয়েছিলেন, তুই নাকি রাজি হোসনি?
আচ্ছা দাদা, ঝি কি যত্ন করতে পারে?
কেন পারবে না? শুধু তোর মতন মোমের পুতুল মায়েদের কাছেই পারে না। সত্যি সিদ্ধার্থ বলছিল–
ও বুঝি তোকে উকিল খাড়া করেছে রে দাদা?
তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করে ওঠে সুমনা।
অলক বলে, আমি কারও উকিল-টুকিল নই। নিজেই জজ। আমার মনে হয় তোর খুব ভুল হচ্ছে। এই তো তোদের প্রফেসর আর. কে. সেনের সঙ্গে দেখা হল সকালে। তুই ভর্তি হোসনি শুনে হায় হায় করতে লাগলেন, কারণ জানতে চাইলেন। কী আর বলি বল? বললাম, শরীর খারাপ। শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। কী হয়েছে, কোনও ডাক্তার দেখছে, পরীক্ষার আগে থেকেই তো ভুগছিল, এখনও সারছে না কেন, ডাক্তাররা কী বলছে, এই সব বহু প্রশ্ন।..কী করে যে পাশ কাটিয়ে উত্তর দিয়ে এসেছি! আরও বললেন, তাই রেজাল্ট বেরোবার পর দেখা করতে আসতে পারেনি। অথচ আমি ভাবছি। নিজেই একদিন আসতে পারেন বললেন।
অলক খানিক পরে উঠে যায়।
একমাত্র যে মানুষটা সুমনার কাছে বাইরের বাতাস একঝলক করে এনে ছড়িয়ে দিয়ে যায় মাঝে মাঝে।
.
ও চলে যায়। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সুমনা। বসে বসে ভাবে।
প্রফেসর আর. কে. সেন!
দেবতার মতো যাঁকে ভক্তি করত সুমনা।
করত!
হ্যাঁ, করত ছাড়া আর কী!
সুমনার জীবনে বর্তমান বলে আর কিছু নেই। সবই অতীত হয়ে গেছে। নইলে প্রফেসর সেনকে সে প্রণাম করতে যায়নি পাস করার পর। করবার কথাও মনে পড়েনি।
সুমনা কি জানোয়ার হয়ে গেছে? তাই পৃথিবীতে মানুষ আছে–এ কথা ভুলে গিয়ে গুহাবাসীর জীবন যাপন করছে কেন?
হঠাৎ এই প্রথম ছেলেটার ওপর ভয়ানক একটা আক্রোশ আসে সুমনার। মনে হয় শত্ৰু, শত্রু, পরম শত্রু ও সুমনার।
অথচ এই শত্রুর শত্রুতার বিরুদ্ধে কিছু করবার নেই। নিরুপায় আত্মসমর্পণে আত্মহত্যার পথে এগিয়ে চলতে হচ্ছে।
আত্মহত্যা বইকী!
নইলে সিদ্ধার্থকে অকারণে অপমান করে বিদায় দিতে পারে!
সিদ্ধার্থের প্রতীক্ষার প্রহর ব্যর্থ করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে বসে থাকতে পারে?
অনেকক্ষণ ভাবে।
অতঃপর ঠিক করে, এই একটা অনির্দিষ্ট অনিশ্চিতের মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া চলবে না। একটা কিছু করতে হবে।
এই জানোয়ারের মতো গুহার জীবন আর নয়।
.প্রফেসর তাঁর পাকা চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে মৃদুগম্ভীর স্বরে এলেন, স্ট্রেঞ্জ! তোমার দাদা তো এসব কিছুই বলল না আমায়।
ওর লজ্জা করেছিল।
মাথা নিচু করে বলে সুমনা।
প্রফেসর বলেন, তুমি আমার কাছে তোমার অসুবিধের কথা বললে বলেই এ কথা বলছি, আমার মনে হয় প্রথমেই তোমার বাবার পরামর্শই নেওয়া উচিত ছিল তোমার। অথবা তাঁর পক্ষেই উচিত ছিল তোমার সেন্টিমেন্টের বশে না চলে, জোর করে ঠিক ব্যবস্থা করে ফেলা। পরিত্যক্ত শিশুদের জন্যে গভর্নমেন্ট থেকে ব্যবস্থা আছে বহু সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান আছে, অনাথ আশ্রম আছে, খোঁজখবর করে যে কোনও এক জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। মায়া পড়ে গেছে সত্যি কথা। পড়াই স্বাভাবিক। মেয়ে-মনের কাছে একটি অসহায় শিশু! কিন্তু সুমনা, যে মায়া তোমার জীবনে অকল্যাণ ডেকে আনবে তাকে তো প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। তোমার কেরিয়ার, তোমার পারিবারিক জীবন, তোমার বিবাহিত জীবনের ভবিষ্যৎ, সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত করে এভাবে জড়িয়ে পড়বে কেন তুমি, তা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। তুমি এমন একটা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, এই অদ্ভুত কারণে তুমি পড়া ছেড়ে দিলে! এক্ষুনি একটা যা হোক চাকরি করতে চাইছ! এ কী! আমরা জানি তুমি পড়বে, পাশ করবে, রিসার্চ করবে, রীতিমত একটা কেরিয়ার গড়ে নেবে। তা নয়–নো নো, মাই গার্ল! তোমার মতো ইনটেলিজেন্ট মেয়ের পক্ষে এ একটা অদ্ভুত অবাস্তব কল্পনা যে, যে কাজটা একটা সাধারণ দাই বা ঝিকে দিয়ে হতে পারে, সেই কাজটার জন্যে তোমার অমূল্য সময়টা নষ্ট করবে তুমি।
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সুমনা।
প্রফেসরের যুক্তির মধ্যে ও যেন নিজের কল্পনার অবাস্তবতাটা সুস্পষ্ট দেখতে পায়। কান্তিকুমার যখন বলেছেন, বুঝিয়েছেন, তখন সুমনা শুনেছে মনের মধ্যে একটা বিরুদ্ধ ভাব নিয়ে। সমস্ত যুক্তি
প্রতিহত করবে এই সংকল্প নিয়ে পাথর মনে শুনেছে।
কারণ, সুমনার ধারণায় কান্তিকুমারের সে কথা সম্পূর্ণ স্বার্থ থেকে উদ্ভূত কথা।
স্বার্থের জন্যে মানবিকতাকে বিসর্জন দিচ্ছেন কান্তিকুমার। একটু অসুবিধের জন্যে কচি শিশুটাকে দূর ছাই করছেন সুজাতা।
পরিবারের আরও সবাইয়ের সম্পর্কে ওই একই কথা। এমনকী সিদ্ধার্থকেও তাই ভেবেছে সুমনা।
সবাই স্বার্থপর।
আপন স্বার্থের হানি হবে বলে, একটা অসহায় শিশুর কথা ভাবে না। ওরা বিশ্রী, ওরা বাজে।
কিন্তু প্রফেসর সেন!
তাঁর সঙ্গে তো কোনও স্বার্থের সংঘর্ষ নেই।
তিনি কেন?
কানের মধ্যে বাজতে থাকে শেষ কথাগুলো। তোমার মতো ইনটেলিজেন্ট মেয়ের পক্ষে এ একটা অদ্ভুত অবাস্তব পরিকল্পনা যে
সুমনা এক সময় ইনটেলিজেন্ট বলে গণ্য ছিল না? সবাই তাই বলত। কিছুদিন ধরে তার নির্বুদ্ধিতার সমালোচনা শুনতে শুনতে সে কথা ভুলেই গেছে সুমনা।
কিন্তু প্রফেসর আরও কথা বলছেন। বলছেন, তোমাদের তো শুনেছি জয়েন্ট ফ্যামিলি, বাড়িতে আরও তো অনেকে আছেন, তোমার মা রয়েছেন, কেউ একটা বেবির ভার নিতে পারছেন না?
কেউ নেবেন না।সুমনা ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলে, রাস্তায় কুড়োনো
ইট ইজ ট্রু! প্রফেসর গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, খুবই স্বাভাবিক। গৃহস্থ ঘরের মেয়েরা এই ভাবেই চিন্তা করতে অভ্যস্ত। সবচেয়ে ভাল হচ্ছে কোনও মিশনে দিয়ে দেওয়া। তোমাকে এইসব বাজে কল্পনা ছাড়তে হবে সুমনা– দৃঢ়স্বরে বলেন প্রফেসর, তুমি কালই চলে এসো আমার কাছে। এখনও চান্স আছে। জানো না বোধহয় আমি সম্প্রতি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে এসেছি। আমি তোমায় নিয়ে নিতে পারব। অপরের পরিত্যক্ত সমস্যাকে নিজের জীবনের সমস্যা করে তুলো না।
আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে আসে সুমনা।
আবার সমুদ্রের ডাক!
আবার অসীমের হাতছানি!
এর কাছে ভারী ক্ষুদ্র লাগে কেবলমাত্র হাসি-কান্নার লীলা দিয়ে গঠিত একটা অবোধ প্রাণীকে। ভেবে অবাক লাগে, নিজের সেই ঘরটির মধ্যে ওকে অত বিরাট মনে হয় কেন?
ঘরটা ছোট্ট বলে?
সত্যি কতটুকুই বা ঘর।
ওটা সুমনার পড়ার ঘর বলেই গণ্য ছিল। বড় হয়ে ইস্তক রাত জেগে পড়ার জন্যে, অথবা নিজস্ব নির্জনতায় রাত জেগে ভাবার জন্যে এই ছোট্ট ঘরটির মধ্যেই নিজের খাট আনিয়ে নিয়েছিল সুমনা।
খাটটা কোনওরকমে ধরে।
চারদিক ঘিরেই তো সেলফ ভর্তি বই আর বই।
বই! ওই নামে একটা জিনিস আছে বটে!
কিন্তু সুমনা ভুলে গিয়েছিল।
ছি ছি ছি!
নিজের ওপর ঘৃণায় ধিক্কারে চোখে জল এল সুমনার। মনে হচ্ছে কে যেন ওর বোকামির সুযোগ পেয়ে ভারী ঠকিয়েছে। কী করে সে সারাটা দিন?
সেই–প্রফেসরের ভাষায় বলতে বলে অপরের পরিত্যক্ত সমস্যাকে ছবার ফুড তৈরি করে খাওয়ায়, শিশুপালনের নিয়ম অনুসারে এক ঘণ্টা তেল মাখায়, তার পর চান করায়, পাউডার মাখায়, চুল আঁচড়ে দেয়, বিভোর হয়ে দেখে, নাচায় হাসায়, কান্না ভোলায়, ঘুম পাড়ায়।
আর ও যখন ঘুমিয়ে থাকে? তখন ওর জামাপত্র কাঁচে, শুকোয়, পরিপাটি করে পাট করে রাখে, আর বাকি সময় সেলাই করে।
কাঁথা জামা, জামায় ফুল লতা!
নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে যেন মুখোমুখি দেখতে থাকে সুমনা। আর ধিক্কার দিতে থাকে সেই দাঁড় করানো সুমনাকে।
বাসে ওঠার মুখে চোখ পড়ল।
দাঁড়িয়ে রয়েছে ও ফুটপাথে।
কেমন যেন অন্যমনস্ক, অনুজ্জ্বল। সিদ্ধার্থকে এমন দেখেনি কোনওদিন। ব্যথায় উদ্বেল হয়ে উঠল বুক। মনে ভাবল, কতটুকুর জন্যে কতখানি হারাতে বসেছি আমি!
দ্রুতপায়ে রাস্তা পার হয়ে ওদিকে গিয়ে পড়ল।
কাছে গিয়ে টোকা মারল পিঠে।
চমকে ফিরে তাকাল সিদ্ধার্থ। একটু বা অবাক, একটু বা ম্রিয়মাণ হয়ে ফিকে করে হেসে বলল, কী ব্যাপার? শ্রীমতী ম্যাডোনা গুহা ছেড়ে বাইরে?
সুমনা উচ্ছ্বসিত হবে।
সুমনা ওর অভিমান ভাঙাবে।
তাই হেসে বলে ওঠে, হয়েছে! খুব ঠাট্টা শিখেছ। একই ঠাট্টা বারবার করে কারা জানো? বোকারা।
বোকা সে কথা তো অস্বীকার করছি না।
দেখো, তুমি যদি আমার সঙ্গে এ রকম অসহযোগিতা করো, আমি কোথায় যাই বলল তো?
তোমার তো কোথাও যাবার দরকার নেই, তোমার তো গুহার আশ্রয় অটুটু।
আবার! ভাল হবেনা বলছি৷ খালি খালি ওই সব বলে রাগিয়ে দাও কেন? সুমনা ছলছলে চোখের দৃষ্টিটি তুলে তুলে ধরে আরতির প্রদীপের মতো।
রাগিয়ে দিই কেন? সিদ্ধার্থ বলে ভাবি, যদি তাতে বরফের গায়েও একটু অগ্নিকণা জ্বলে ওঠে।
বাজে কথা ছাড়ো। শোনো, প্রফেসর আর. কের কাছে গিয়েছিলাম। উনি খুব বকলেন। বললেন, পড়া ছাড়া চলবে না। আরও বললেন, এখন ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে রয়েছেন। আমাকে নিয়ে নিতে পারবেন। অবিলম্বে যেতে বললেন। আর দেরি করলে হবে না।…ঝুলেই পড়ি কী বলে?
সুমনা!
কী?
এই সব সাধু সংকল্প শুধু মিনিট কয়েকের মতো? না কি ভ্যালু কিছু আছে?
সুমনা ছেলেমানুষের মতো আবদারের সুর ধরে।
বাঃ না আহা! একবার ওরকম হয়েছে বলে–না, সত্যি এবার আর নড়চড় নেই। ওঁর বকুনিতে!
প্রফেসর আর. কে ভাগ্যবান।
বাঃ ওঁকে আমি কীরকম ভক্তি করি জানো?
এতদিন জানতাম না। এইবার জানলাম। অবশ্য জানার স্থায়িত্ব কতক্ষণ তা জানি না।
তুমি খালি খালি আমার ওপর এরকম অনাস্থা প্রকাশ করছ কেন বলো তো?
আস্থা খুঁজে পাচ্ছি না বলে।
শোনো, আর ওরকম হবে না। এখন তোমার ওপর আস্থা রাখতে পারি কিনা বলো?
কী বাবদ?
ধরো–ওর উপযুক্ত একটা জায়গা–মানে কষ্ট না হয় এ রকম জায়গা।না, গলাটা কাঁপতে দেবে সুমনা, অবাস্তব বুদ্ধি আর অনিষ্টকারী মায়া নিয়ে নিজের কেরিয়ার নষ্ট করবে না। তাই কথা শেষ করে পরিষ্কার গলায়, তোমাকে জোগাড় করে দিতে হবে। আর যাতে মাঝে মাঝে দেখতেনা পাওয়া যায়–
চট করে দানপত্রে সই করে বোসো না সুমনা! বাড়ি গিয়ে ভাবো গে।
ভেবেছি। এখানেই ভেবে নিয়েছি। ভাবাটা আর বাড়ির জন্যে তুলে রাখব না। ওখানে মন দুর্বল হয়ে যায়।
সিদ্ধার্থ এতক্ষণে উপহাসের স্বর ছেড়ে মমতার স্বর ধরে।
বলে, কিন্তু তোমার গলা কাঁপছে।
ওটা সাময়িক।
সুমনা, যদি তুমি মন প্রস্তুত করতে পেরে থাকো, জায়গা খুঁজতে সময় লাগবে না। এতদিন ধরে ওই সন্ধানই করে বেড়াচ্ছি।
কেন বলো তো? সুমনা বিস্মিত হয়। আমি তো তোমাকে বলিনি। বাবা কি
না সুমনা! কান্তিকাকা আমায় কিছুই বলেননি। আমি এমনি, হঠাৎ একদিন কী খেয়াল হল, ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে সিদ্ধার্থ, ভাবতে শুরু করলাম–যদি তুমি বিয়ে নামক ব্যাপারটাকে একেবারে অর্থহীন অবান্তর বলে উড়িয়ে না দাও, যদি ওকে কাছছাড়া করতে রাজি হও–আমি এ সমস্তই যদির ওপরে ভেবেছি সুমনা, রাগ কোরো না তুমি–হ্যাঁ, যদি রাজি হও, তা হলে তখন যেন আবার খুঁজে বেড়ানোর দুর্ভোগ না পোহাতে হয়। তাই
সুমনা একটু চুপ করে থাকে।
কী বলতে গিয়ে থামে।
তারপর আস্তে আস্তে থেমে থেমে বলে, সে রকম ভালমতো কোথাও দেখেছ নাকি?
তারা তো অনেক ভাল ভাল কথাই বলল।
কী বললে তুমি?
বললাম? যা সত্যি তাই বললাম। শুধু সময়টার একটু হেরফের করলাম আর কি। অতদিন আগে না বলে বললাম সম্প্রতি পাওয়া গেছে
সুমনার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসে কেন? সেই ক্ষীণ গলা থেকে প্রশ্ন ওঠে, বিশ্বাস করল?
এক কথায় করে না। অনেক বলতে হয়েছে। আরও অনেক প্রমাণের দরকার। কিন্তু ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ কথা হবে? চলোনা কোথাও গিয়ে বসা তোক একটু।
কোথায়?
ধরো কোয়ালিটিতে। যেটা কাছাকাছি হবে।
কোয়ালিটিতে!
সিদ্ধার্থ আর সুমনা। গিয়ে বসবে, আগে আগে লুকিয়ে এক-আধদিন যেখানে এসে বসত।
এসব এখনও আছে পৃথিবীতে?
সুমনা ভুলে যায় অজীন আর অঞ্জনাকে একটু দেখতে বলে চুপি চুপি এসেছে সে, ঘণ্টাখানেকের জন্যে।
ভুলে যায় প্রফেসরের কাছে কেটে গেছে দেড় ঘণ্টার উপর। ভুলে যায় সিদ্ধার্থের সঙ্গে শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেটে গেল আধ ঘণ্টাটাক, আর ভুলে যায় চা খেতে ঢুকলে আরও কতখানি সময় হারানো। সময় গড়িয়ে পড়ে যাবে বিকেলের গা থেকে।
চা-টা উপলক্ষ।
তবু সিদ্ধার্থ জোর করে খাওয়ায় কিছু। তারপর পরামর্শে আর আলোচনায় গম্ভীর হয়ে ওঠে।
ও বাড়িতে আর ভাল লাগে না সুমনার।
চিরকালের জায়গা যেন অপরিচয়ের বর্ম পরেছে।
কে জানে শুধু সুমনারই এরকম অনুভূতি, না সব মেয়েরই হয়। বিয়ে না হওয়া বড় মেয়েদের!
হয়! সবাই জানে সে কথা।
সুমনা জানে না। সুমনা জানত না। বড় হয়ে যাওয়া মেয়েদের মতো ছিল না সুমনা।
এখন সুমনা ভাবে, শুধু তারই মনে হচ্ছে বাড়িটা যেন পরের। বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে সুমনাকে। কী গ্লানি, কী যন্ত্রণা!
কান্তিকুমার মুখের ওপর একটা স্নেহহীনতার আবরণ পরে ঘুরে বেড়ান, সুজাতা প্রতি পদে কপালে করাঘাত করে আর সুমনার বুদ্ধিকে ধিক্কার দেয়। বাড়ির লোকেদের চোখে ক্রমশই একটা অনমনীয় সংকল্পের দৃঢ়তা। ঘোটরা কাছে আসতে চায়, কিন্তু বোধ করি উপরওলাদের নিষেধে থতমত খায়।
অসহ্য!
বড় অসহ্য!
যাকে নিয়ে এত গোলমাল, তাকে বিদায় করে দিলেই হয়তো আবার আস্তে আস্তে ওরা প্রসন্ন হবে।
হয়তো বাবা বলবেন, সুমি, আজ তোর কটায় ক্লাস? গাড়িকে বলে রাখব।
হয়তো মা বলবে, মনটা খারাপ লাগছে? চল একটু তোর মেজোমাসির বাড়ি বেড়িয়ে আসি।
হয়তো ছোটকাকাও বলবেন, সুমিটার চেহারাটা বিশ্রী হয়ে গেছে, ওকে একটু দেখাশোনা কোরো বউদি।
আর হয়তো ঠাকুমা বলবেন, মনা, আয়না কাছে। একটু বোস না। কদিন তোর মুখে একটু ঠাকুর দেবতার গান শুনিনি।
হয়তো এ সমস্তই হবে।
কিন্তু সুমনার আর ভাল লাগবে না। সুমনার চোখে ধরা পড়ে গেছে সবকিছুর ফাঁকি। জেনে ফেলা হয়ে গেছে কীসের কী মূল্য।
তাই, আবার যদি সেই মূল্যহীনতার বোঝাকে পরম মূল্যবানের ভানে বয়ে মরতে হয়, তার চাইতে যন্ত্রণা আর নেই।
টিকতে পারবে না।
আর সেই ছোট্ট ঘরখানার বিরাট শূন্যতা!
সেও কি অহরহ গ্রাস করতে আসবে না সুমনাকে?
কিন্তু এ বাড়িতেও সুমনাকে নেবে না।
সিদ্ধার্থর বাড়িতে। সুমনা বুঝতে শিখেছে।
শুধু সুমনার বুঝতে শেখা নয়, নিজের মুখে বলতেও লজ্জা পায় না সিদ্ধার্থ। বলে, তোমার হিতৈষিণী জেঠিমা যা একখানি ছুরি বসিয়ে রেখেছেন, তাকে টেনে তুলতে গেলেই রক্তপাত! রোগীর মৃত্যু। অতএব
অতএব কী করা, সেই আলোচনাতেই কেটে যায় ঘন্টার পর ঘণ্টা।
বিকেল গিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে।
স্থির হয়, বিয়েটার আর দেরি করা নয়।
ওটা করে ফেলে ঘাঁটি শক্ত করে নিয়ে ছোট একটি ফ্ল্যাট নেবে সিদ্ধার্থ!
কোথায় পাবে?
তাও আছে তার সন্ধানে।
এক বন্ধুর বাসার বড় ভাড়া বেশি। দুখানা ঘর বিলি করতে চায় সে। অবশ্য বাড়িওলার চোখে ধুলো দিয়ে।
হোক! অত সততায় কাজ নেই। ইদানীং তো এই তালেই ঘুরছে সিদ্ধার্থ। সামনেই যে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পরীক্ষা তার, তা খেয়ালও করছে না।
বাসা নেবে।
দুজনে পাতবে ছোট সংসার।
না, কান্তিকুমারের কাছে হাত পাতবে না সিদ্ধার্থ। হাত পাততে গেলেই কথা উঠবে উভয় পক্ষের সম্মতির!
সম্মতি!
কোথায় সেই সাপের পা, ব্যাঙের হাঁচি, স্বাতীনক্ষত্রের জল?
অসম্মতি তো অনিবার্য। তা ছাড়া–কী দরকার সেই বর বামুন নাপিত পুরুত, হইহই রইরই!
সুমনার আর রুচি নেই তাতে।
এ বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে তার বিয়েতে যে সমারোহ হবার কথা, তার একটা আভাসময় কল্পনা মনের মধ্যে ছিল সেই কোন ছেলেবেলা থেকে।
ঠাকুমা কান্না ভোলাতে বসলেই বলতেন, সে যা লোক নেমন্তন্ন হবে! কলকাতার শহরে ধরবে না। গয়না যা হবে, এই বড় বড় দশ আলমারি। আলো যা জ্বলবে রাতকে মনে হবে দিন। আর বাজনা যা বাজবে–দেশসুদু লোকের কানে তালা ধরে যাবে
সে বিয়ের সম্ভাবনা সুমনা নিজে নষ্ট করেছে।
আর হয়তো তার প্রয়োজন ঘুচে গেছে। এ বাড়ির ঋণ আকণ্ঠ হয়ে উঠেছে সুমনার। আর বেশি না জমে।
অতএব ওরা নিজেরা বিয়ে করবে।
আর তার আগে একদিন সিদ্ধার্থের সঙ্গে গিয়ে জন্মপরিচয়হীন ছেলেটাকে জন্মপরিচয়হীনের গোত্রে মিলিয়ে দিয়ে আসবে।
করবে মন কেমন হবে কষ্ট। কী আর করা যাবে।
ভুলে যাবে লেখাপড়ার মধ্যে। সত্যি তো আর নিজের নাড়িছেঁড়া ধন নয়।
.
অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল দুজনেই।
সুমনার মনে পড়ল দুটো ছেলেমানুষের কাছে রেখে এসেছে ছেলেটাকে। সিদ্ধার্থের মনে পড়ল, সে এক বন্ধুর উদ্দেশে পাইকপাড়ায় যাচ্ছিল।
.
চোরের মতো ভয়ে ভয়ে ঢুকল সুমনা।
কান পেতে দেখল কোথাও কোনও কান্নার গলা আর্তনাদ করছে কিনা। গুমরে উঠছে কিনা।
না। কোথাও কিছু না।
বরং বড় বেশি যেন নিথর। বুকটা ছাঁৎ করে উঠল।
কিছু বিপদ ঘটেনি তো?
পড়ে যায়নি তো অজীনের হাত থেকে? দেরি হচ্ছে দেখে অঞ্জু দুধ খাওয়াতে গিয়ে টাকরায় সটকে দেয়নি তো?
ওপরে গিয়ে কী দেখবে সুমনা? নিথর ঘুমন্ত একটা শক্ত হয়ে যাওয়া ফুলের দেহ?
শিশু অন্তর্যামী।
তাই কি মুক্তিপিপাসু সুমনার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গেছে তার কাছে? আর ক্ষোভে ধিক্কারে নিজেই। মুক্তি দিয়ে গেছে সে সুমনাকে?
অরুণা!
নিজের গলা নিজের কাছে অপরিচিত ঠেকল। কদর্য ঠেকল।
অরুণাও চমকে তাকাল।
পড়ছিল নীচের দালানে বসে। অবশ্য গল্পের বই। নইলে অত নিবিষ্ট হবার কথা নয়।
কী বলছ দিদি?
কী বলছে।
কী বলতে ডেকেছিল সুমনা?
ও!
বলল, বাড়িটা এত চুপ কেন?
কী জানি। এমনি।
কী জানি। এমনি!
অরুণা কি বাড়ির সমস্ত খবর রাখে?
কী জানি এমনি, মানে? বাড়ির সবাই বাড়িতেই আছে তো?
আছে তো! শুধু জেঠিমা জেঠামশাই পাঠ-বাড়ি থেকে এখনও
জানি। বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় সুমনা।
তাড়াতাড়ি ঘরের দিকে যায়।
না দেখলে বিশ্বাস নেই।
ঘরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়াল।
মার কাছে খোকা!
কোলে নয়!
কাছে নিয়ে আগলাচ্ছেন।
সুমনা অস্ফুট মন্তব্য করে, কী হয়েছে?
নাঃ হবে আর কী?
সুজাতা মেয়ে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে গম্ভীর মুখে বলে, তুমি তো আজকাল নিত্যই বেরোচ্ছ, এটাকে অন্তত সারদার মার জিম্মাতেও রেখে যেতে পারো। আমাদের না বলে ছোটদের কাছে রেখে গেলে
না, মরে যায়নি। ঘুমোচ্ছে।
কিন্তু ঘুমন্ত দেখলেও যে এত মন-কেমন করে তা তো জানত না সুমনা। তবু ছুটে এল না। আস্তে কাছে এসে আস্তে বলল, প্রফেসর আর. কে. সেনের কাছে গিয়েছিলাম, দেরি হয়ে গেল।
সুজাতা চলে যেতে যেতে বলে, প্রফেসর মাস্টার, এদের সঙ্গে এখনও সম্পর্ক আছে তোমার? আমরা তো জানি তোমার ইহকাল পরকাল সবই এখানে বন্ধক দেওয়া হয়ে গেছে!
হ্যাঁ, গিয়েছিল। সহসা সুমনা রুক্ষকণ্ঠে বলে ওঠে, আর থাকবে না। যার জন্যে এত, তাকে এবার বিদেয় করে দিচ্ছি। বলেই
ঘুমন্ত কচি মুখটার দিকে চোখ পড়তেই চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ে তার। সমস্ত রুক্ষতা গলে গলে পড়ে।
.
বাসা নিচ্ছিস? সেই আলাদা বাসায় থাকবি?
সিদ্ধার্থের মা বিস্ময় বিরক্তিতে ফেটে পড়েন, বাড়ি ছেড়ে আলাদা থাকতে যাবি?
এইরকমই তো ঠিক করছি।
ঠিক করছিস! একেবারে ঠিক করছিস। হঠাৎ বাড়ির কী অপরাধ হল?
বড্ড বেশি গোলমাল! পড়া হচ্ছে না।
সিদ্ধার্থের মা সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলেন,দেখ, তুই আসিসনে আমার সঙ্গে চালাকি করতে। বাড়িতে গোলমাল বলে তুমি আলাদা বাসাভাড়া করছ! এতবার এত একজামিন দিলি, আর এটাই এত বড় হয়ে উঠল! আরও কী মতলব ফেঁদেছিস তাই বল।
এতই যদি বুঝতে পারছ মা, বাকিটাও তা হলে অনুমান করে নাও।
করতে আমার বাকি নেই সিদ্ধি!
সহসা হেসে ওঠে সিদ্ধার্থ।
বলে,মা, তুমি একটা জ্যোতিষালয় খুলে বোসো না কেন? দুদিনে পসার করে ফেলতে পারবে।
সিধু, বাজে কথায় ভাঁওতা দিয়ে আসল কথা চেপে যাচ্ছিস। আমি বলছি, ঠাকুরঝির ভাগ্নের মেয়েকে বিয়ে করো আর না করো–ও মেয়েকে বিয়ে করা চলবে না। কিছুতেই না।
কী যে বলো মা! অচল কীসে! ওরা আমরা এক জাত। ওর বাবা-মানে মর্যাদায়—
জননী গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,তোমার বাপেরও একটা বংশমর্যাদা বলে জিনিস আছে—
সিদ্ধার্থ সহসা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে, আছে, অতি উত্তম। কিন্তু কান্তিবাবুর মেয়েকে বিয়ে করলে সে মর্যাদা রসাতলে যাবে কীসে?
জননী কী বলতে যাচ্ছিলেন, অকুস্থলে পিসিমা এসে হাজির হলেন, এবং ঘৃণাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ইতিহাস জানতে তো বাকি নেই, তবে আবার ন্যাকা সাজছিস কেন সিধু? কান্তিবাবুর ও মেয়ের কি আর এদিকে বিয়ে হবে? দূরে বিদেশে-টিদেশে যদি হয়।
সিদ্ধার্থ এক পলক চুপ করে থেকে দৃঢ়স্বরে বলে, এই দেশেই হবে পিসিমা। তবে এ বাড়িতে জায়গা হবে না জানি, তাই নূতন বাসা নিয়েছি।
আচ্ছা ভালই করেছ– সিদ্ধার্থের মা নীরস স্বরে বলেন, বাপভাইকে তুমিই নিজেই বোলো।
আমি বলতে পারব না। কান্তিবাবু একটা মিথ্যে গল্প বানিয়ে ওই ধর্মের ধ্বজা মেয়েকে আর সোহাগের নাতিকে নিয়ে দিব্যি ঘর করছেন। নাতির জুতো আসছে, জামা আসছে, লজ্জার বালাই মাত্তর নেই। সেই মেয়েকে তুই বিয়ে করবি?
না করে উপায় নেই বলেই করব।
গম্ভীরভাবে বলে সিদ্ধার্থ। হয়তো কথাটা কিছু ভেবেই বলে না। হয়তো শুধু মাকে থামাবার জন্যে বলে। কিন্তু হঠাৎ পিসি ওই কয়েকাক্ষর সংবলিত বাক্যটুকুর গুঢ়ার্থ আবিষ্কার করে চেঁচিয়ে উঠে বলেন, কী বললি?
কী বললাম
ওই মেয়েকে বিয়ে না করে উপায় নেই তোর?
সহসা সিদ্ধার্থের মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ খেলে যায়। মুখে ফুটে ওঠে একটা সংকল্পের আভাস, তাই স্থির স্বরে বলে, হ্যাঁ তাই-ই।
সিদ্ধার্থের মা কিছুক্ষণ পাথরের মতো অনড় হয়ে তাকিয়ে থেকে বলেন, তাই! তাই অত বুকের পাটা তার! ছি ছি ছি সিধে! তোরা আবার এম. এ., বি. এ. পাসের বড়াই করিস! তোরা আবার শিক্ষার অহংকার করিস। ঘি আর আগুনের হুঁশিয়ারি করতে গেলে বড্ড তোদের অপমান হয়, তাই যে হুঁশ করিয়ে দিতে আসে, তাকে ব্যঙ্গ করিস, বিদ্রূপ করিস, নিচুমন বলিস। ওই মেয়েটার সঙ্গে অত ঘোরাঘুরি দেখে তোর দাদা যেদিন আমাকে দিয়ে বারণ করিয়েছিল, সেদিন দাদাকে যে বড্ড অপদস্থ। করেছিলি? আজ একথা নিজের মুখে কবুল করতে লজ্জা করল না তোর?
সিদ্ধার্থ দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বলে, করল না তো দেখছি।
হঠাৎ পিসি বলে ওঠেন,দেখ বউ, ঘরের ছেলে, তাই আমি সন্দেহ ব্যক্ত করিনি। তুমিই বা কী মনে করবে। কিন্তু লক্ষ্মীছাড়া ছেলে যখন নিজে মুখে কবুল করল, তখন বলি–এ সন্দেহ আমার গোড়াগুড়িই হয়েছিল!
হয়েছিল নাকি! বাঃ। চমৎকার তো!
বলে ব্যঙ্গের একটা তীক্ষ্ণ হুল ফুটিয়ে চলে যায় সিদ্ধার্থ।
ঠিক, ঠিক বলেছে সুমনা।
বিশ্বাস কথাটা একটা অভিধানের শোভা, অর্থহীন শব্দ। বিশ্বাস জিনিসটা একটা শেকড়হীন রঙিন ফুল। ওকে যদি কাঁচের বাটিতে ফটিক জলে ভিজিয়ে রেখে দাও, বাহারের আর শেষ নেই। কিন্তু একটি ফুল তুলতে যাও–ডালপালা সবসুদ্ধ উঠে আসবে।
পিসিমার গোড়াগুড়িই সন্দেহ হয়েছিল! তা হলে মারই বা হতে বাধা কী। হয়তো বাবা দাদা সকলেরই হয়েছে।
এদের কাছে কী মূল্য সিদ্ধার্থের সুনাম-দুর্নামের?
দুটোই সমান।
তবে একটার বিনিময়ে যদি সিদ্ধার্থ খানিকটা সংঘর্ষের হাত এড়াতে পারে, কেন তা করবে না?
৪. বাবা এলেন
বাবা এলেন।
এল দাদারা।
সিদ্ধার্থের মাথা নিচু, কিন্তু কথা স্পষ্ট।
হ্যাঁ! আরও আগেই বলা উচিত ছিল আমার।
তা হলে ওই পুণ্যের নিশানটি সমেতই বিয়ে করছ?
দেখি!
অনেক বড় বড় কথা কয়ে এসেছ চিরদিন, এত ছোট কাজটা করতে লজ্জা করা উচিত ছিল।
সিদ্ধার্থ মাথা তুলে বলে, জীবনে উচিত কাজ কে কটা করতে পারে বাবা? এইবার ভাবছি, দেখি তেমন কাজ একটা করা যায় কি না।
তোমার থেকে যে বংশে এই কলঙ্ক হবে ধারণা করিনি।
ধারণা করেননি? আশ্চর্য তো! গোড়াগুড়িই ধারণা করা উচিত ছিল, চিরদিনই তো আমি আপনাদের কুলাঙ্গার ছেলে।
সিদ্ধার্থ চলে যায়।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন এঁরা।
চরম অপরাধে অপরাধী ব্যক্তি এমনভাবে মাথা উঁচু করে, আর উপরওলাদের ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করে চলে গেল যে, মনে হল অপরাধী এঁরাই।
কান্তিকুমারও ঠিক ওই একই সময় একই কথা ভাবছিলেন। এ যুগে অপরাধীরাই নিরপরাধীকে ব্যঙ্গ করে বিদ্রূপ করে। তাকেই অপরাধী বানিয়ে ছেড়ে দেয়।
নিজের ঘর সংসারের কথা নিয়ে নয়, একটা কেস নিয়ে ভাবছিলেন।
সহসা ভাবনার জাল ছিঁড়ে একটি নম্র মূর্তি এসে সামনে দাঁড়াল।
সুমনা।
কতদিন পরে বাবার ঘরে এসে দাঁড়াল।
বাবা!
কিছু বলবে?
হ্যাঁ! সুমনা বলল। টেবিলের উপর নখের একটা আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলল, প্রফেসর আর. কের কাছে গিয়েছিলাম।
ভাল।
সুমনা বাবার এই নির্লিপ্ত স্বরের মধ্যে থেকেই বুঝি সাহস সংগ্রহ করে নেয়।
তাই এবার স্পষ্ট গলায় বলে,উনি এখন ইউনিভার্সিটিতে রয়েছেন, আমাকে আসতে বলেছিলেন, নিয়ে নিলেন।
ও! তা হলে ভর্তি হলে? আচ্ছা। ভাল, শুনে সুখী হলাম।
একটু চুপচাপ।
কয়েকটা নিশ্বাসের শব্দ।
তারপর আবার কথার শব্দ।
বাবা, হয়তো তোমাদের খুশি করবার মতো আর একটা খবরও দিতে পারব–তোমাদের
কান্তিকুমার হাতের বই থেকে চোখ তুলে সচেতন হয়ে প্রশ্ন করেন, কী বলছ?
বলছি–খরবটা হয়তো তোমাদের খুশি করবে; ওকে একটা শিশু আশ্রমে রাখবার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। অনাথ আশ্রম বলতে পারল না।
কান্তিকুমার কেমন অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের ওই দৃঢ় নম্র মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে থেমে থেমে বলেন, তুমি! তুমি ব্যবস্থা করেছ? তুমি নিজেই?
টেবিলে আর কয়েকটা আঁকিবুকি পড়ে।
আমি একা নয়, সিদ্ধার্থ সাহায্য করেছে।
সিদ্ধার্থ! সিদ্ধার্থ তোমায় সাহায্য করেছে?
হ্যাঁ বাবা!
কান্তিকুমার যেন মেয়ের দিকে চাইতে পারছেন না, যেন মেয়ের কাছে বড্ড বেশি ছোট হয়ে গেছেন। অথচ উলটোই হওয়া উচিত ছিল তো। কান্তিকুমারই তো পারতেন মেয়েকে ধিক্কার দিয়ে উঠতে। বলতে পারতেন, এই সিদ্ধান্তই যদি করলে, সেটা আমাদের জানালেই কি শোভন হত না? তোমার কাছে এইটুকুর জন্যে যে মাথা খুঁড়ে ফেলেছিলাম আমরা। এখন তুমি পাড়ার ছেলের সাহায্য নিতে গেলে। যেন কত অসহায় তুমি, কত দুঃখী।
কিন্তু বলতে পারলেন না।
কেন পারলেন না সেইটাই আশ্চর্য!
শেষ পর্যন্ত যে সেই এক থোকা ফুলের মতো ছোট্ট শিশুটার জায়গা হল না তাঁর বাড়িতে, তাকে বিদায় করে দিতে হল, এই লজ্জাটাই হয়তো মূক করে রাখল তাঁকে।
হয়তো এমনিই হয়।
যাকে দুরছাই করি, আপদ বালাই করি, সে যদি একদিন স্বেচ্ছায় বিদায় গ্রহণ করে, যদি বলে, তবে গেলাম, তখনই লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। উঠতে বসতে যার কথায় বলি, মরেও না–সে যখন মরে তখন মনে হয়, একটা চাবুক খেলাম বুঝি।
এমন চাবুক থাকেই মানুষের জন্যে।
সুমনা যখন বলল, তোমাদের খুশি করবার মতো খবর, তখন কি কান্তিকুমার ধারণা করতে পেরেছিলেন এতবড় একটা চাবুক আসছে তাঁর জন্যে?
চাবুক-খাওয়া মানুষ আর বেশি কী বলবে?
কান্তিকুমারেরও আর সাধ্য হল না বেশি কথা বলবার।
কিন্তু বাড়ির মধ্যে কথার ঢেউ উঠল।
কে যে প্রথম বলল! কী করে যে রাষ্ট্র হল, এই এক রহস্য। সুমনা তো বাবাকে ছাড়া আর কাউকে বলেনি। আর কান্তিকুমারও বলতে যাননি কাউকে। তবু প্রকাশ হয়ে গেল।
হয়তো অসাবধানী অলকের কথার মধ্যে থেকেই আবিষ্কৃত হয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ উঠল। সে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল বালুবেলায়।
বটে, বটে, তাই নাকি?…সত্যি? তা হলে সুমতি হল?..ঘাড়ের ভূত নামল তবে এতদিনে?
আরে বাবা, বুঝছ না, গ্রহে করেছিল, কুগ্রহে…হ্যাঁ তবু দুর্মতি কেটেছে তাও ভাল। তবে কিনা সেই তো মান খসালি, লোকটাই যা হাসালি!
এইরকম চলতে লাগল প্রথমদিকে।
তারপর বাতাসটা ঈষৎ অন্যমুখো বইতে শুরু করল।
…দেখ মানুষের মন! ছেলেটাকে নিয়েই সংসারে যত অশান্তি, অথচ চলে যাবে শুনে পর্যন্ত…আহা যতই হোক কচি ছেলে তো! নইলে চোখেই দেখছি না, কোলেও নিচ্ছি না, তবু
অতঃপর বাতাস আরও মস্ত এক মোড় নিল।
ছোটখুড়ি বললেন, মনে করেছিলাম ছেলেটাকে একটা সোয়েটার বুনে দেব, লাল পশম খানিকটা রেখেওছিলাম, কিন্তু সুমনার ভয়ে সাহস হয়নি। চলে যাবে শুনে মনটা এত ইয়ে হচ্ছে! ছোট বাচ্চার নাম করা জিনিস
দুদিনের মধ্যে একটা হাতকাটা সসায়েটার বুনে ফেলে সুমনার ঘরে রেখে গেলেন তিনি।
আর সেই সোয়েটারের কাটা খাল বেয়েই আসতে লাগল কাঠের পুতুল, তুলোর হাতি, প্লাস্টিকের ভালুক, রবারের বল…এটা ওটা সেটা।
দাতা-ঠাকুমা, জেঠিমা, পিসিমা, মায় ছোটকাকা এবং বুড়ো ঝিটা পর্যন্ত।
সকলেরই নাকি ছেলেটাকে কিছু দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, শুধু সুমনার মেজাজের ভয়েই
এখন আর কেউ ভয় পাচ্ছে না।
এখন সুমনার ছেলের জিনিসে সুমনার ঘর ভরে যাচ্ছে।
আর আক্ষেপের বুলিতে বাড়িতে বাতাস ম ম করছে।
আহা সেই অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়াই হল, শুধু জেদ করে কতকগুলো মাস বাড়িতে রেখে রেখে বাড়িসুদ্ধ লোকের মায়া বাড়িয়ে দিল…ছোট ছেলেমেয়েগুলো মরছে কেঁদে কেঁদে…
আহা আজকাল আবার বুলি ফুটেছে..কী মিষ্টি করে দাদা-দাদা ডাকে..বুক ঘষটে চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের বাইরে চলে আসতে শিখেছে তো…সবাইয়ের চোখে পড়ছে।…বড় খাসা ছিরিখানি হয়েছে কিন্তু!
হয়তো এ আক্ষেপের সুর একেবারে ফাঁকা নয়। হয়তো ওই উপহারের সম্ভার ভুয়োনয়। ছোট স্বার্থ ছোট চিন্তা আর ছোট বুদ্ধির সম্বল নিয়ে আবরণ রচনা করে নিজেকে যে ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখে মানুষ, সে গণ্ডির বাইরে আছে মানবিকতার নির্মল নীল আকাশ।
কেউ যখন বলে গুডবাই তখন সে গণ্ডিতে ফাটল ধরে, ছোট স্বার্থের আবরণ ভেদ করে সেই গণ্ডির বাইরে গিয়ে পড়ে মানুষ। সেই আকাশে, সেই নীল নির্মলতায়।…
তাই সুমনার ছেলের জন্যে উপঢৌকনের সমারোহও ভুয়ো নয়।
এতদিনের নীচতার আর সংকীর্ণতার অনুতাপ দেখা দিয়েছে লাল হাতি, নীল ঘোড়া, সাদা খরগোশের মূর্তি নিয়ে।
কিন্তু সুমনার ঠোঁটের রক্ত নীল হয়ে উঠছে কেন?
ওই খেলনা পুতুল জামা জুতোর স্থূপের মাঝখানে উদ্দাম খুশিতে পিছলে বেড়ানো ছেলেটাকে ছিনিয়ে তুলে নিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে কেন তার?
যেন ওর প্রাণের পুতুলটিকে ওই অপমানের গ্লানির মধ্যে ডুবে থাকতে দেখতে পারছে না সুমনা।
কী লজ্জা!
কী অপমান!
বড়জেঠি দিয়ে গেছেন একটি কাঠের রাধাকেষ্ট! বলেছেন, পুতুলের ছলে এখন থেকেই রাধাকেষ্টর স্পর্শ পাক।
অথচ সুমনা বসে আছে। সে দৃশ্য দেখছে।
কিন্তু কত আর দেখবে সুমনা?
একসেট নতুন বিছানা আনল সুজাতা। চোখটা ছলছল করে বলল, এটাও বেঁধে দিস সুমি! আহা যেখানে থাকুক ভাল থাকুক।
সুজাতার চোখের কোলে জলের চিকচিকিনি।
না, সুমনার চোখে জল নেই।
সুমনা ধারালো কণ্ঠে বলে ওঠে, কী হবে এসব?
কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠে সুজাতা। জিনিসগুলোর দিকে চেয়ে দেখে। থতমত খেয়ে বলে, কী আর হবে, সঙ্গে দিয়ে দিবি।
মনে রেখো মা, ওকে অনাথ আশ্রমে পাঠানো হচ্ছে। অনাথ কথাটার মানে জানো নিশ্চয়ই? নতুন জামা জুতো বিছানা খেলনার পাহাড় নিয়ে অনাথ আশ্রমে ঢুকতে যাওয়ার মতো নির্লজ্জ ঠাট্টা আর কিছু আছে?…এসব কিছু নেবে না ও। যেমন নিঃসম্বল হয়ে এসেছিল, তেমনি নিঃসম্বল হয়ে চলে যাবে।
সুজাতা ভয় পেল।
সুজাতা অপমানিত হল।
সুজাতা নিজেকে ধিক্কার দিয়ে সরে গেল। তবু ভাবতে লাগল, ছেলেটা চলে যাবে।
আর ভাবল, আমার মেয়েটা? কী নিষ্ঠুর!
.
চলে যাবে।
কাল চলে যাবে।
সঙ্গে সিদ্ধার্থ যাবে, অলক যাবে, সুমনা যাবে।
সুমনা না হলে কে নেবে দায়িত্ব, সাবধানে পৌঁছে দেবার? সুমনা কুড়িয়ে এনেছিল, সুমনাই যাবে ফেলে দিতে।
বুদ্ধিমান পৃথিবীর সমস্ত বিবেচনা দাঁড়িপাল্লার একদিকে, আর একদিকে শুধু সুমনার ব্যাকুল ভালবাসাটুকু…অবুঝ হৃদয়খানি।
সুমনা জিতবে কীসের জোরে?
সবাই যখন চলে গেছে, শুয়ে গেছে, রাত্রি গম্ভীর হয়ে গেছে, ঘুমন্ত শিশুটার দিকে নিষ্পলক চেয়ে বসে আছে সুমনা।
কাল থেকে সুমনার বিছানার পাশের এই জায়গাটুকু শূন্য পড়ে থাকবে।…অবোধ শিশুটা জানে না কী ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে সুমনা তার বিরুদ্ধে। একান্ত নির্ভরতায় নিশ্চিন্ত সুখে এলিয়ে শুয়ে আছে ভয়ংকর সেই বিশ্বাসহন্ত্রীর বুকের কাছে।
ওরে সোনা, ওরে মানিক! ওরে পাগলঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত শিশুটাকে বুকের মধ্যে চেপে পিষে ফেলতে চায় সুমনা।
ছাড়বে না। কিছুতেই ছাড়বে না সে।
কিছু চাই না তার। কিছু না।
চাই না উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ…সুখময় দাম্পত্য জীবন…সামাজিক প্রতিষ্ঠা। এই চরম পাপের মূল্যে সেই পরম প্রাপ্তিকে কিনতে চায় না সুমনা। সুমনা ওকে এমনি করে আঁকড়ে ধরে থাকবে। জগতের কে পারে ছিনিয়ে নিতে দেখবে সে!
কান্তিকুমার সিদ্ধার্থকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
এসে দাঁড়াতেই একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে কান্তিকুমার রুদ্ধস্বরে বলেন,তোমার বাবা এসে আমায় যাচ্ছেতাই করে গেলেন।
কেন গেলেন, বুঝতে দেরি হয় না সিদ্ধার্থের, তবু মাথা চুলকে বলে,আজ্ঞে—
কেন, তা তুমি অবশ্যই বুঝতে পারছ। আশ্চর্য! আমার কুমারী মেয়ের নামে অকারণ এই অপবাদ দেবার কী উদ্দেশ্য তোমার? আমি তো কোনওদিন এতটা নীচ ভাবিনি তোমাকে।
কুমারী মেয়ে!
সিদ্ধার্থ কুণ্ঠিত ভাবটা পরিহার করে বলে, আপনার কুমারী মেয়ের নামে অপবাদ যা রটাবার তা আপনার নিজের বাড়ি থেকে রটানো হয়েছে। আমি শুধু সেই অপবাদের কদর্যতাকে একটু মোলায়েম আচ্ছাদন দিয়ে ঢাকতে চেয়েছি। আর ওইটুকু না করলে আমার বাড়িতে সংঘর্ষ উঠত প্রবল। তার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হতে অনেক শক্তি ক্ষয় হত। বৃথা শক্তিক্ষয়ে দরকার কী?…আপনি তো উকিল মানুষ, আপনাদের নীতিতে তো ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক কার্যোদ্ধার!
নীতিকথা থাক। আমি বলছি, তোমার এই পদ্ধতিকে সমর্থন করি না।
কান্তিকুমার জোরের সঙ্গে বলেন।
সিদ্ধার্থ মুখ নিচু করে বলে, এ ছাড়া উপায় দেখতে পাচ্ছিলাম না। এলগিন রোডের কাছাকাছি একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট নিয়েছি, হয়তো অতটুকুর মধ্যে ওর কষ্ট হবে, তবু আমার বিশ্বাস, ও পারবে।
কিন্তু এই মিথ্যা অপবাদটা কি অপরিহার্য ছিল?
হয়তো ছিল না। হয়তো ছিল। অপবাদটা যে এসেইছিল। আমার পরিবার আমার স্ত্রীকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখবে, ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে, এ আমি সইতে পারছিলাম না, তাই অপবাদটা ভাগ করে নিলাম। আপনি আমার ওপর অপ্রসন্ন হবেন না কাকাবাবু, আমি বলছি এ ভালই হল।
.
অলক গাড়ি বার করে রেখে এসে মাথায় হাত দিয়ে পড়ল।
সুমনা যাবে না।
সুমনা ছেলেটাকে দুহাতে বুকে চেপে ধরে খাঁচার বাঘের মতো ঘরের মধ্যে পদচারণা করে বেড়াচ্ছে।
ব্যাপার কী?
অলক অবাক হয়ে বলে।
সুমনা নীরব।
শুধু পদচারণায় অস্থিরতা বেড়ে ওঠে।
মনা! কী হল? টাইম দেওয়া আছে, দেরি হয়ে যাচ্ছে যে।
ও যাবে না।
দৃপ্তম্বর ঠিকরে ওঠে।
যাবে না।
অলকের বিস্ময়ের পালা।
এত ব্যবস্থা, এত বলা কওয়া, টাকাপত্র জমা দেওয়া! এখন বলছিস যাবে না?
হ্যাঁ বলছি।
সুমি, তুই কি পাগল হলি?
সুমনা ঘরের কোণের দিকে চলে যায়। ক্রুদ্ধস্বরে বলে, হ্যাঁ হয়েছি। কী করবি?
আমি আর কী করব? আমি তো হাঁ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সিদ্ধার্থটা সেইখানে বসে থাকবে।
বসে থাকবে?
হ্যাঁ সেইরকমই তো কথা আছে। সিদ্ধার্থ বসে থাকবে, আর আমি তোদের নিয়ে।
না! কোনও কথা নেই। তোদের কোনও কথা থাকবে না। তোর কথা, তোর সিদ্ধার্থের কথা সব উড়িয়ে দেব আমি। আমি একে নিয়ে চলে যাব।
চলে যাবি! কী সর্বনাশ! কোথায় চলে যাবি?
যেখানে খুশি। শুধু তোদর এই বাড়ির মধ্যে থেকে। বনে জঙ্গলে যেখানে হোক চলে যাব।
মনা! মাথাখারাপ করিস না। এত ভেবেচিন্তে একটা ব্যবস্থা করা হল, তুই রাজিও হলি, এখন উলটো-পালটা করলে চলবে কেন?
চলবে! আমি চালাব।
সিদ্ধার্থ বলবে কী?
জানি না। যা ইচ্ছে বলুকগে।
জানিস, ও ওর বাড়িতে মনোমালিন্য করে আলাদা ফ্ল্যাট নিয়েছে। বিয়ে করবে বলে সাজিয়েছে! এখন তুই ।
দাদা তুই যা! যা এখান থেকে।
তুই যাবি না?
না।
বেশ। যাই সেখানে। খবর দিই গে। ওই কথাই বলি গে। বেশ বুঝতে পারছি মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে তোর।
অলকের একা বেরিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে খবর ছড়িয়ে পড়ে।
অলক খবর দিতে যাচ্ছে, সুমনা যাবে না।
সুমনা ছেলেকে ছাড়বে না!
গত কদিনের অনুতাপদগ্ধ মনোভাব মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আশাভঙ্গের আক্রোশে আবার হিংস্র হয়ে ওঠে ওরা।
এও হয়। এই রকমই হয়।
গুডবাইয়ের পর আবার যদি কেউ থেকে যাবার বায়না করে, শুকিয়ে যায় সকলের সব স্নেহধারা।
যোগমায়া সুজাতার কাছে এসে দাঁড়ান, মেজোবউমা, এটা কী হল?
সুজাতার মন ভেঙে গেছে।
মন কেমন একটু করছিল সত্যি, কিন্তু মস্ত একটা আশাও সৃষ্টি হচ্ছিল বইকী!
কালো ছায়াটা সরে যাবে। যে ছায়া গ্রাস করে রেখেছে সুমনাকে।
ভেবেছিল, সুমনা প্রথমটা অবশ্যি মনমরা হয়ে থাকবে, কিন্তু কলেজ যাবে, পড়াশোনা করবে, ভুলে যাবে। বলে সত্যিকার ছেলে মরে গেলে তার মৃত্যুশোক ভুলে মা আবার খাচ্ছে পরছে হাসছে। আর এ তো!
ভুলে যাবে। সুমনা ভুলে যাবে, লোকেও ভুলে যাবে। নিন্দেটাও মুছে যাবে।
তারপর মেয়ের বিয়ে দেবে সুজাতা। ঘটা করে।
সেই ছেলেবেলা থেকে যার মেয়ের বিয়েতে যত ঘটা দেখেছে, সব মনের মধ্যে আঁকা আছে সুজাতা। ভাঙা আশা আবার জোড়া লাগছিল।
সে আশা গুঁড়িয়ে গেল।
ক্রমশ পাগলামির লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে সুমনার মধ্যে। হায় ভগবান! মায়ের জাত হয়েও চুপিচুপি বলছে সুজাতা, জগতে এত শিশুমৃত্যু, শুধু যেখানে তেমন একটা মৃত্যু ঘটালে সব দিক বজায় থাকত সেখানে তুমি উদাসীন।
মেয়ের রণমূর্তি দেখে পর্যন্ত ছাইপাঁশ পাপ মহাপাপ অনেক কিছুই ভাবছিল সুজাতা, এহেন সময় শাশুড়ির ওই তীক্ষ্ণ প্রশ্নে তার সহ্যের বাঁধ ভাঙল।
বিরক্তস্বরে বলল, কী হল–তার আমি আর কী বলব বলুন। আপনিও দেখছেন, আমিও দেখছি।
যোগমায়া ক্রুদ্ধ।
আমি শুধু দেখছিই মেজোবউমা-জানছি না কিছুই। যা জানবার সেটা তোমাদের কৌটোতেই লুকনো আছে।
আছে তো থাক।
বলে জীবনে যা না করেছে সুজাতা তাই করে। যোগমায়ার সামনে থেকে উঠে চলে যায়।
যায় মেয়ের কাছে।
তীব্রতর হয়ে বলে, যাবি না? ছেলে দিবি না?
না।
শেষ অবধি কী করবি ভেবেছিস, তাই আমাকে বল লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে!
তোমাদের বাড়ি থেকে চলে যাব, এইটুকুই শুধু ভেবেছি এখন। আর বেশি কিছু ভাবিনি।
তবে ছেলে কোলে করে রাস্তায় গিয়ে হাত পাতগে যা পাজি মেয়ে!…ক্ষোভে দুঃখে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে সুজাতা। আরও বলে, ছেলে গলায় বেঁধে তো আর চাকরি করা হবে না। ওই ভিক্ষে করাই হবে। তাই করাবে তোকে ওই শনি।
কান্না চাপতে চাপতে চলে যায় সুজাতা।
ওদিকে, রান্নাবাড়ির দিকে স্বর্ণপ্রভা উদ্দাম ঝড় তুলেছেন। ঘোষণা করেছেন, তিনি না হয় বলে পাপের ভাগী হয়েছেন, দশেধর্মে দেখুক এবার ছেলে কার! শুধু মানুষ করলেই যদি এই অবস্থা হত, তা হলে আর কাজীর বিচারের সেই গল্পটা সৃষ্টি হত না।
জয়ন্তীকুমার চটি ফটফটাতে-ফটাতে এল। ন্যাকা সাজল। বড়বউদি–জয়ন্তী বলে, অলক গাড়ি নিয়ে সুমিকে কোথায় যেন নিয়ে যাবে বলল, একা চলে গেল যে?
বড়বউদি বলেন, কী জানি ছোট ঠাকুরপো! অলক তো আমার ছেলে নয়। ও হচ্ছে সংসারের ধানচালের মতন। সর্বজনীন! ও যে আমার ছেলে, সে কথা ও তিলেক মনে রাখে না। আমিও মাঝে মাঝে ভুলে যাই।
হা! সত্যিকার কিনা, তাই ভুলে যাও। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসতে তা হলে টানের জোর হত।বলে অদূরস্থিত মেজোবউয়ের ওপর একটা তীব্র দৃষ্টিপাত করে চলে যায় জয়ন্তীকুমার।
কারও কিছু এসে যাচ্ছে না।
তবু সবাই হিংস্র হয়ে উঠেছে।
উঠবে বইকী!
আহা ভাবের কণিকাটুকুও মুছে ফেলছে। একটা অসুবিধে, একটা অনিয়ম, একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন চিরতরে থাকবে কেন সংসারে? চলে যাচ্ছিল, আহা করছিলাম! ফের থাকছে যে আর আহা থাকে?
বলে একটা ভাগ্নে ভাইপো পুষে, চিরকাল তাকে ঘরের ছেলের আসনে ঠাঁই দিয়ে, সে বড় হয়ে গেলে লোকে তাকে বলে, হল তো বাপু অনেক, এবার খুঁটে খেতে শিখেছ, এইবার পথ দেখো!…চিরদিনের বুড়ো চাকর, কর্তাকে মানুষ করেছে, তার অসুখ করলে লোকে বলে, ওরে সর্বনাশ! হাসপাতালে দাও।
যেখানে আইনত দাবি নেই, সেখানে আর সব দাবিই অচল।
অলক রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে সেই কথাই ভাবতে ভাবতে যায়।
জগৎ জুড়ে উদার সুরে আনন্দ গান বাজছে–কিন্তু সে গান মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করছে কই?
না কি গভীরতাই নেই কোথাও কোনখানে!
শুধু তার ভান করে মানুষ?
যে মুহূর্তে নিজের গায়ে আঁচড় এসে পড়ে, ভেঙে যায় সব উদারতার ভান। ধরা পড়ে গভীরতার ছদ্মবেশ।
কে জানে মানুষ সম্পর্কে বেশি অবিচার করে ফেলেছে কিনা অলক। যাক এখন আপাতত কর্তব্যে মন দেওয়া যাক। মনুষ্যপ্রকৃতির বিচার পরে করলেও চলবে।
আগে গেল সিদ্ধার্থের বাড়ি, সিদ্ধার্থ আছে?
বয়সে অলক বছর তিনেকের ছোট হলেও বরাবর সিদ্ধার্থই বলে,দাদা বলে না। ছেলেবেলার ঘুড়ি ওড়ানোর সঙ্গী, বড় হয়ে বড় বড় আলোচনার সঙ্গী।
আবাল্য এসে ডেকেছে সিদ্ধার্থ আছে?
সিদ্ধার্থের বাড়ির যে কেউ সস্নেহ সুরে জানিয়েছে, সে বাড়ি আছে কি নেই। থাকলে ডেকে দিয়েছে।
আজ কিন্তু যেই প্রশ্ন করল, সিদ্ধার্থের দাদা বিরক্ত মুখে ভুরু কুঁচকে বলল,কেন, সিদ্ধার্থের খবর তুমি রাখো না? এত বন্ধু!
অলক অবাক হল। বলল, কী খবর?
তিনি আর এ বাড়িতে থাকেন না।
কবে থেকে?
বিমূঢ় প্রশ্ন। কারণ এত তাড়াতাড়ি চলে যাবার কথা তো ছিল না।
কথা ছিল রেজেস্ট্রিটা হয়ে গেলে যাবে।
কবে থেকে?
মনে নেই। অগ্রাহ্যভরে বলেন দাদা, কাল না পরশু কবে যেন। যাক, অন্যত্র থাকাই মঙ্গল। সর্বদা যদি তাঁর সেই চন্দ্রবদন দেখতে না হয়, সেটাই সুখের। দরজাটা মুখের উপর বন্ধ করে দেন দাদা।
বুঝতে অসুবিধে হল না একটা রাগারাগির বিপর্যয় ঘটে গেছে।
আর তাতে আশ্চর্যও হল না অলক।
এটাই স্বাভাবিক। এই দেখতেই অভ্যস্ত সবাই। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে বলেই যে আপন জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে নেবার স্বাধীনতা থাকবে তার, এত আবদার আসেনি এখনও দেশে।
আমরা তোমায় ভালবাসি, প্রাণের থেকে ভালবাসি, সেই পাওয়াটাই কি যথেষ্ট নয় তোমার পক্ষে? তুমি আবার অপর একজনকে ভালবাসতে যাও কী বলে? গর্হিত! নিতান্ত গর্হিত! হ্যাঁ, করছ বটে তোমরা আধুনিকেরা, কিন্তু আমরা অনুমোদন করছি না সেটা। কিছুতেই প্রসন্ন দৃষ্টি ফেলছি না তোমার ভালবাসার ওপর।
তোমার কষ্ট হবে?
তুমি সারাজীবন নিশ্বাস ফেলবে? তাতে কী! আমাদের আওতা ছাড়িয়ে আমাদের বাদ দিয়ে তোমার যে সুখ, সে সুখে সহানুভূতি নেই আমাদের।
এই তো!
এই রকমই তো।
এর ওপর আবার সিদ্ধার্থ আলাদা বাসা করে নব-বিবাহিতাকে নিয়ে সংসার পাততে চায়। এর পরেও ক্ষমা করা হবে!
কথায় কথায় ওদেশ দেখাই বলে, আর ওদেশের ফ্যাশানগুলো রপ্ত করে নিয়েছি বলে, সত্যি তো আর ওদেশি হয়ে যাইনি আমরা।
একটা সন্দেহযুক্ত মেয়েকে বিয়ে করা গর্হিত।
বিয়ে করেই আলাদা হওয়াটাই গর্হিত।
মা বাপের সঙ্গে চোটপাট করা তো আরও গর্হিত! তিন-তিনটে গর্হিত কাজ করেও পরিত্যক্ত হবে না সিদ্ধার্থ?
সিদ্ধার্থকে তবে খুঁজতে যেতে হবে তার নতুন বাসায়। সে বাসা অলক আগে দেখে এসেছে।
তবু বুদ্ধি করে সেই শিশু প্রতিষ্ঠানে ফোনে খোঁজ করল।
ওখানে কি উপস্থিত আছেন উনি? সিদ্ধার্থ মজুমদার! আজ একটি বেবিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল যাঁর?
একটু পরেই যাবার কথা!
না।
যায়নি।
অতএব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে গেল সেই নতুন বাসায়।
আর অবাক হয়ে দেখল চারদিকের ঝড় উপেক্ষা করে ঘর সাজাচ্ছে সিদ্ধার্থ।
এটা কী হচ্ছে?
টবে গাছ প্রতিষ্ঠা।
ওদিকে সংসার প্রতিষ্ঠা তো মাথায় উঠল।
কেন? মানে?
সুমি এখন বলছে, ছেলে ছাড়বে না!
ছেলে ছাড়বে না!
সিদ্ধার্থ হাসল।
বলল, বলবে জানতাম।
বলবে জানতে?
হ্যাঁ অলক!
সিদ্ধার্থ একটু রহস্যময় হাসি হাসে, জানতাম। কারণ সুমনাকে যে জানি। তাই তো বাড়ির লোককে একটা মিথ্যে কথা বলে চটিয়ে এলাম।
মিথ্যে কথা।
হ্যাঁ, হিসেবমতো মিথ্যেই! তবে জানো তো কোনও মিথ্যেকে যদি বারবার সত্যি বলে ঘোষণা করা যায়, সেটা আর মিথ্যে থাকে না, সত্যি হয়ে ওঠে।
তুমি যে রহস্যময় হয়ে উঠেছ সিদ্ধার্থ! বাড়ির লোককে চটিয়েছ সেটা বুঝে এলাম।
গিয়েছিলি বুঝি?
হ্যাঁ। তোমার দাদা বললেন তোমার এই চন্দ্রবদন যত না দেখতে হয় তাঁদের ততই মঙ্গল! ব্যাপার কী?
বাপার বলতে কিছু না। ওই ছোট্ট একটু অনৃতভাষণ! ভেবে দেখলাম, সুমনা যখন ছেলেটাকে ছাড়বেই না, তখন ওটাকে দুজনে ভাগ করে নিলেই ওর ভার কমে। ছেলেটাকে নিজেরই কুকীর্তির ফল বলে চালিয়ে দিলাম আর কি
সিদ্ধার্থ!
আহা হা চমকাচ্ছিস কেন বাবা? তোর বোনের তো আর তাতে জাত যাচ্ছে না। কান্তিকাকা ডেকে ধমকালেন। বললেন, আমার কুমারী মেয়ের নামে দুর্নাম রটাচ্ছ কোন সাহসে! দিলাম একটু শুনিয়ে। বললাম, দুর্নাম তো আপনারাই রটিয়ে বেড়িয়েছেন। বেচারা ভদ্রলোককে শুনিয়ে দেবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু তখন টাটকা বাড়ি থেকে ঝগড়া করে এসেছি। কিন্তু তুই অমন বজ্রাহত বনস্পতি মেরে গেলি কেন? বুদ্ধিটা কিছু খারাপ হয়েছে?
কিন্তু এ তুমি কী করলে সিদ্ধার্থ?
ঠিকই করলাম অলক! চল এখন সেই বিদ্রোহিণীকে জানিয়ে আসি, তোমার পোষা বৎসটিকে আর বিদায় দিতে হবে না। তাকে মজুমদার শাবক নামে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা হবে।
স্বপ্নহতের মতোই বাড়ি ফেরে অলক।
ভাবতে পারে না, এ সিদ্ধার্থের উদারতা, না নির্বুদ্ধিতা!
কিন্তু নির্বুদ্ধিতা কি একা সিদ্ধার্থেরই?
কতবড় নির্বোধ সুমনা!
.
সুমি! সুমি!
সুজাতা এসে আছড়ে পড়ল, সুমিকে তা হলে তোরা নিয়ে যাসনি? আর আছড়ে না পড়ুক ভিড় করল বাড়ির সবাই।
না তো। ও তো যাবে না বলে জেদ ধরে
তাই তো জানি অলক, হঠাৎ দেখছি নেই। জানি না কোথায় চলে গেল, আর কী করে চলে গেল। কেউ তো দেখতেও পায়নি। ঘরভরা জিনিস, সব পড়ে বাবা! সিদ্ধার্থের দিকে তাকায় সুজাতা,ছেলেটা বাড়ি থেকে চলে যাবে বলে, পাঁচজনে দিয়েছিল আদর করে খেলনা পুতুল জামা জুতো। সব ফেলে রেখে শুধু ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় পালিয়ে গেল।
সিদ্ধার্থ শুকনো মুখে বলে, এমনি কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে যায়নি তো
কোথাও যায় না বাবা! এই ঘরটার ভিতর পড়ে থাকে। কী খেয়াল হল নিজেই বলল, কোথায় আশ্রমে ভর্তি করে দেবে, নিজে কলেজে ভর্তি হয়েছে–আজ হঠাৎ কী মতি হল, বলল, যাব না। তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাব! কিন্তু সত্যি চলে যাবে, ভাবিনি।
কেঁদে ফেলল সুজাতা।
কিন্তু পুরুষদের তো আর কাঁদা চলে না।
তাই তাঁদের ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে যেতে হয়, কোথায় পালাল খেপে যাওয়া মেয়েটা, তাই খুঁজতে।
হ্যাঁ, বাপ কাকা জেঠা দাদা প্রেমিক, সবাই ছোটাছুটি করছে।…ব্যাপারটার গুরুত্ব আর অস্বীকার করা যায় না।
থানায় থানায় খবর চলে যায় একটি শিশু-সমেত একটি তরুণী মেয়ে নিখোঁজ। বুদ্ধি ঈষৎ অপ্রকৃতিস্থ। মেয়েটি লম্বা ফরসা…চশমা চোখে…বাচ্চাটি গৌরাঙ্গ স্বাস্থ্যবান।
কিন্তু আশ্চর্য, এত তাড়াতাড়ি এমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সুমনা!
সন্দেহ নেই বাড়ি থেকে বেরিয়েই ট্যাক্সি চেপেছে। কিন্তু কোন্ দিক লক্ষ্য করে?
.
তা হয়রানি হয় বইকী!
সকলেরই হয়।
আরও হয়রানি হয় থানার কার্যতৎপরতায়। বাচ্চা সমেত মেয়েছেলে এক-একটা ধরে ফেলেছে প্রায় সকলেই।
তাই শনাক্ত করতে ছুটতে হয় মুচিপাড়া থানায়, তালতলা থানায়, বড়বাজার থানায়।
একটা আধবয়সী ঝি মনিবের ছেলে কোলে রাস্তা পার হতে বিভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, তার সেই বিভ্রান্তির সুযোগ তৎপর পুলিশ ছাড়েনি।
একটা বাজারের শাকওয়ালী দিনের শেষে খালি ডালা আর ভর্তি গেঁজে নিয়ে ফিরছিল, সঙ্গে একটা বছর আষ্টেকের ছেলে, তাদের আটকে রেখে চৌদ্দপুরুষান্ত গালাগালি খাচ্ছে পুলিশ।
ধরে রেখেছে একটা স্কুলের মেয়েকে।
শুকনো মুখ, শ্রীহীন শাড়ি, ছেঁড়া চটি। অপরাধের মধ্যে তার চোখে চশমা।…সঙ্গে বাচ্চা নেই। তা না থাক–চশমাটা তো রয়েছে।
তাঁতির মাকুর মতো কলকাতার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত টানাপোড়েন করে বেড়ান কান্তিবাবু, অলক, সিদ্ধার্থ।
আর বেলা যখন পাঁচটা, তখন টেলিফোন বেজে ওঠে কান্তিকুমারের ঘরে, থানা থেকে নয় রেলওয়ে স্টেশন থেকে। মেয়ে গলা।
না, সে বলবেনা কোথা থেকে বলছে। হাওড়া কি শেয়ালদা। শুধু জানাচ্ছে…তাকে যেন আর খোঁজা হয়, সে কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
.
সুজাতা তীব্র তিরস্কারে বিঁধে রেখে চলে গিয়েছিল।
সুজাতা ভাবেনি সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে সুমনা। যেতে পারবে।
ছেলে কোলে করে যাবে কোথায়!
তাই নিজের ঘরে গিয়ে খাটের বাজুতে মাথা ঠুকছিল আর ভাবছিল আরও তীব্র কিছু বলতে পারলে ভাল হত। আরও কঠিন আরও মর্মান্তিক। যাতে রাগে-অপমানে ছটফটিয়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠে সুমনা।
ছেলেটাকে একবার চোখ ছাড়া করে রেখে এলেই যে সুমনার ঘাড়ের ভূত নামবে, এ বিষয়ে সন্দেহ মাত্র নেই সুজাতার। নিজের হাত যদি থাকত সুজাতার, কবে মেয়েকে ওই ভূতের হাত থেকে উদ্ধার করত। কিন্তু সুজাতার নিজের হাতে কিছুই নেই। হাত না থাকলেই সব বিষ জিভে উঠে আসে। এই নিয়ম। তাই সুজাতা ভাবছিল আরও বিষ ছড়িয়ে আসতে পারলে হয়তো কাজ হত।
ভাবেনি, কাজ হচ্ছে তখন অন্য পথে।
.
মা চলে যাবার পর সুমনা ড্রয়ার খুলল। গুনে টুনে দেখল না। সে ধৈর্য নেই এখন। যত যা টাকা পয়সা ছিল, মুঠো করে তুলে নিয়ে বটুয়ায় ভরল। পোস্ট অফিসের পাশবইটা নিল।
আগে মাঝে মাঝেই আদর করে টাকা দিয়েছে সবাই, বই কিনতে শাড়ি কিনতে। সব ফুরোয়নি। সুজাতাই জোর করে জমা দিইয়ে দিয়েছিল, সুমনার ঘোরতর আপত্তি অগ্রাহ্য করে।
জীবনে এই প্রথম মায়ের বুদ্ধিটা সত্যিকার বুদ্ধি বলে মনে হল সুমনার।
টাকা নিল, গয়না নিল না।
গলার হারটা আর হাতের বালা দুটো খুলে ড্রয়ারে রেখে ড্রয়ারের চাবিটা রেখে দিল ড্রয়ারের ওপর। তারপর ছেলেটাকে তুলে কাঁধে ফেলল।
সিঁড়ি দিয়ে নামা চলবে না।
সবাই দেখতে পাবে।
বাথরুমের দিকে জমাদার ওঠবার লোহার সিঁড়িটার দিকে তাকাল। ওই ওইটাই এখন ভরসা।
নেমে গেল ঘুরে ঘুরে।
দেখতে পাবে না। কেউ এদিকে আসে না।
যদি দেখতে পায়?
বলবে, বেশ করেছি চলে যাচ্ছি। আমাকে আটকাতে পারো না তোমরা। আমি নাবালিকা নই।
অদৃশ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে যেন ঝগড়া করে সুমনা।
দামাল হয়ে ওঠা ভারী ছেলেটাকে কাঁধে ফেলে রাখা সহজ নয়। অনবরত তাকে চেপে ধরতে হচ্ছে। তবু দ্রুত পায়ে বাড়ির পিছনের গলিটা পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়ে সুমনা। কিন্তু আশ্চর্য, একটা চেনা মুখের সামনে পড়ে না।
কলকাতা শহর এমনিই।
পাড়ার লোকও তাকিয়ে দেখে না।
অথবা দেখলেও কিছু বলে না।
সামনের নীল বাড়ির জানলা দিয়ে দেখেছিল নীল বাড়ির একটা মেয়ে। মাকে গিয়ে বলল, কান্তিবাবুর বড় মেয়ে সেই ছেলেটাকে কোলে নিয়ে কোথায় বেরোল।
মা বলল, একলা?
তাই তো দেখলাম।
তা হলে ডাক্তারের কাছেটাছে গেল বোধহয়। শুনেছি তো বাড়ির লোকের সঙ্গে নন কো-অপারেশন! লজ্জাও করল না ঘাড়ে করে রাস্তায় বেরোতে?
ও দিকের হলদে বাড়ির বারান্দা থেকে দেখলেন হলদে বাড়ির গিন্নি। মেয়েকে ডেকে বললেন, দেখ, দেখ কান্তি উকিলের মেয়েটা সেই ছেলেটাকে ঘাড়ে করে একটা ট্যাক্সিতে উঠছে। কোথায় যাচ্ছে বল দিকি?
মেয়ে সবজান্তার ভঙ্গিতে বলে, অনাথ আশ্রমে।
অনাথ আশ্রমে?
হ্যাঁ। এইবার তো বলেছে দিয়ে দেবে।
কে বললে তোকে?
ওর খুড়ি ছোটপিসির চেনা নয়?
এটা একটা উত্তর নয়, তবু উত্তর বলে মেনে নিল মা।
দেখল পাড়ার কটা ছোট ছেলে।
যারা রাস্তার মাঝখানে ইট খাড়া করে ক্রিকেট খেলছিল। দেখল এ বাড়ি ও বাড়ির কটা চাকর, যারা একটা বাড়ির রোয়াকে বসে গুলতানি করছিল। ওরা শুধু দেখল, কোনও মন্তব্য করল না।
কিন্তু সুমনার বাড়ির কেউ দেখতে পেল না। সুমনা নির্বিবাদে একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসল।
আপাতত লোকের চোখ থেকে তো রক্ষা পাওয়া যাক, তারপর ভাবছি, অতঃপর কী করব! ভাবল সুমনা।
.
প্রফেসর আর কের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে?
বলবে, আপনার নির্দেশ মানতে পারলাম না। হেরে গেলাম। এখন বলুন এর পর কী করব।
না। তা হয় না।
প্রফেসর যখন বলবেন,আমি তোমায় ইনটেলিজেন্ট বলেই জানতাম সুমনা
.
কোথায় যাবেন?
ড্রাইভার জানতে চাইছে।
ঠিক যে কথাটা সুমনা নিজেই নিজের কাছে জানতে চাইছিল এতক্ষণ।
বলল, শেয়ালদা স্টেশন।
শেয়ালদা কেন বলল?
গন্তব্যস্থান কি তবে নির্বাচন করা ছিল সুমনার?
না, তা নয়।
ওর হঠাৎ মনে হল হাওড়ায় অনেক ভিড়, হয়তো অনেক চেনা মুখ বেরোবে। শেয়ালদা একটু লুকোনো, একটু চাপা, একটু নিশ্চিন্তের।
স্টেশনে নেমে কী করবে? তা জানে না সুমনা।
কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই বুঝি সন্ধ্যা হয়।
গাড়ি থেকে নামবার আগেই দেখল কাকিমার ভাই আর ভাজ। ওঃ রানাঘাটে যাচ্ছেন ওঁরা। যেটা কাকিমার বাপের বাড়ি। গতকাল যেন ওঁরা এসেছিলেন না সুমনাদের বাড়িতে? কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে? অবশ্যই সবই জেনে গেছেন, শুনে গেছেন।
ওঁদের সামনে নামা চলবে না।
ব্যাকুল হয়ে ড্রাইভারের উদ্দেশে নিবেদন জানাল, দেখুন, শুনছেন? আমার বলতে ভুল হয়েছিল, শেয়ালদা নয়, হাওড়া।
বলতে ভুল হয়ে গিয়েছিল!
শেয়ালদা নয় হাওড়া! পাগল নাকি!
বয়েস মারাত্মক, সঙ্গে একটা কচি ছেলে।
বাঙালি ড্রাইভার রিস্ক নিতে রাজি হয় না। বলে,ঠিক আছে, অন্য গাড়ি দেখে নিন না।
না। সময় নেই!
ড্রাইভার বেঁকে বসেছে। যাবে না।
কাঠকবুল। কিছুতেই না।
অন্য গাড়ি নিন না। অভাব তো নেই।
তা আপনারই এত আপত্তি কীসের? অমনি তো যাবেন না, পয়সা দেব তো?
পয়সা!
পয়সা দেখাতে এসেছেন!
ড্রাইভারি করছি বটে, কিন্তু আমরা ভদ্রলোকের ছেলে। আমাদের পয়সা দেখাতে আসবেন না।
বেশ তো আপনারা ভদ্রলোকের ছেলে, সেটা তো মস্ত একটা সুবিধে আমাদের। ভদ্রঘরের মেয়ের সুবিধে অসুবিধে অবশ্যই দেখবেন।
না। আমার মিটারটা মিটিয়ে দিন।
সুমনা এবার চোখ গরম করে।
এভাবে আমাকে নামিয়ে দিতে আপনি পারেন না। পাবলিকের প্রয়োজন আপনাকে দেখতেই হবে।
মাপ করবেন।
গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়েছে ও।
অগত্যাই নামতে হল সুমনাকে।
আর হঠাৎ মনে হল, টাকা থাকলেই কি সব হয়? বজায় থাকে মান মর্যাদা? সামান্য একটা গাড়ির ড্রাইভার! সেও এমনভাবে অপমান করল কেন তবে? কই প্রতিকার তো নেই সুমনার হাতে!
বাড়িতে প্রতিপদেই মনে হয়েছে, অপমানিত হচ্ছি। এতটুকু এদিক ওদিক হলেই মনে হয় আর, আর না। চলে যাব।
চলে যাব। মান মর্যাদা বাঁচাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
যেন সমস্ত বাইরেটা সম্মানের রাজ-সিংহাসন পেতে বসে অপেক্ষা করছে।
এই তো তার প্রমাণ।
আর এই তো তার শুরু।
এরপর যখন চাকরির চেষ্টায় ঘুরবে? কে জানে কত অপদস্থ হতে হবে। হয়তো ছেলে সম্পর্কে প্রশ্নের আর শেষ থাকবে না। হয়তো তারা মন্তব্য করবে কটু। হয়তো বলবে, না না ওরকম একটা দুধের বাচ্চা সমেত শিক্ষয়িত্রী আমরা রাখি না।
বিধবা?
তাতে কি, ছেলের বাপের একটা নাম পরিচয় তো ছিল।
বানাবে সুমনা?
যা খুশি?
তাতেই কি অপমানের হাত থেকে রেহাই পাবে?
তা যদিই বা রেহাই পায়, ত্রুটি তো হবেই প্রতিপদে। একজন কুমারীর চেয়ে, একজন পরিবারের গণ্ডির মধ্যকার বিবাহিতা মেয়ের চেয়ে। অসুখ করতে পারে ছেলের, আবদার করতে পারে। পড়ে গিয়ে মাথা ফাটাতে পারে।
শিউরে উঠল সুমনা।
কিন্তু সেই ত্রুটির খেসারত ত দিতে হবে তাকে নীরবে গঞ্জনা খেয়ে। হয়তো ওরা বলবে, আপনার দ্বারা চলবে না।
সুমনাকে মিনতিতে ভেঙে পড়ে বলতে হবে, দেখুন আমার না হোক, এই বাচ্চাটার মুখের দিকে চান একবার! চাকরি গেলে, কী খেতে দেব ছেলেটাকে?
যে সুমনা বাড়িতে কারও এতটুকু কথা সইতে পারে না, বাবার নয়, মায়ের নয়, জেঠি জ্যেঠা কাকা কাকি ঠাকুমা পিসিমা, কারও কথা নয়, সেই সুমনা!
না, স্বাবলম্বন মানেই সসম্মান জীবন নয়। সেই অবলম্বনটুকু রক্ষা করতেও ক্ষেত্র বিশেষে অসম্মান বহন করতে হয়!
.
হাওড়ায় এসে পৌঁছল।
গিয়ে বসল থার্ড ক্লাসের ওয়েটিং রুমে।
এই ভাল। সুমনার পরিচিত জগতের সবাই তো প্রথম শ্রেণীর, তারা কেউ এলে এদিকে উঁকি দেবে না।
ছেলেটা কাঁদছে।
স্টেশন থেকে কিছু কি খাওয়াবে ওকে?
কী খাওয়াবে?
একমাত্র খাওয়ানো চলে ফল। লেবু কলা। কিনল, খাওয়াতে চেষ্টা করল একটু। কিছু বা খেল, কিছু খেল না। সুমনার মনে হল, এতটা অবিমৃষ্যকারিতা না করলেই হত! অন্তত অচিনের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সঙ্গে নেওয়া উচিত ছিল।
খাওয়ার, পরার।
কিন্তু সে জিনিসগুলো কি একটা আধটা?
ফুড স্টোভ স্পিরিট দেশলাই, সসপ্যান বাটি চামচ, ফিডিং বটল, সেগুলো সাফ করবার জন্যে ব্রাশ সাবান। তা ছাড়া স্নানের প্রসাধনের তোয়ালে তেল সাবান চিরুনি, পাউডার কাজল, জামা জুতো মোজা, কাঁথা বালিশ–আরও কত কত!
অবশ হয়ে এল সমস্ত শরীর।
সুমনার ঘরটা ভর্তি যা কিছু যত কিছু সবই তো ওর দরকারি। প্রত্যেকটি মুহূর্তে দরকার।
সেই জিনিসের বোঝা কীসে নিত সুমনা? মস্ত একটা সুটকেসে? সেটা কে বইত? মুটে? মোটঘাট আর ছেলে নিয়ে কোথায় গিয়ে উঠলে বেশ শোভন হত, সুন্দর হত!
কে সসম্মানে দরজা খুলে দিয়ে বলত, এসো এসো!
নাঃ ঘরে বাইরে কোথাও সম্মানের আশা নেই, এই নাম-গোত্রহীন ছেলেটাকে নিয়ে। তবু তো হতভাগা ছেলেটার জন্যে ভেবে আকুল হচ্ছে সুমনা। ভাবছে, কতক্ষণ খায়নি, কতক্ষণ ভাল করে শোয়নি।
কোলের ভিতর কতক্ষণ থাকতে পারে–দুষ্ট দুরন্ত ছেলে? কতক্ষণ ভাল লাগে?
আচ্ছা, সুমনা যে চলে এল, পালিয়ে এল, তাকে কেউ খুঁজে বেড়াচ্ছে না? বেড়াচ্ছে অবশ্যই। অলক, সিদ্ধার্থ, বাবা!
সিদ্ধার্থ অপদস্থ হবে।
সেই আশ্রমের কর্তৃপক্ষের কাছে।
সিদ্ধার্থ জীবনে আর কখনও ক্ষমা করবে না সুমনাকে।
কিন্তু সুমনাও তো আর কারও ক্ষমা চায় না, ভালবাসা চায় না, প্রতি প্রেম স্নেহ সহানুভূতি কিচ্ছু চায় না। সুমনা শুধু একটা জেদের অহংকার নিয়ে পৃথিবীটা দেখতে চায়। আর পৃথিবীকে দেখাতে চায়।
এতক্ষণ এত আলোড়নেও যা হয়নি, তাই হল। হঠাৎ একঝলক জল এসে চোখ উপচে গাল ভাসিয়ে দিল।
.
অ মেয়ে, যাবে কোথায়?
একটি নিতান্তই গাঁইয়া বুড়ি প্রশ্ন করে, কোথায় যাবে?
সুমনা ইচ্ছে করলেই উত্তর না দিয়ে থাকতে পারে। মুখ ঘুরিয়ে বসতে পারে। কিন্তু তা পারতে দেয় না তার শিক্ষা-দীক্ষা সভ্যতা।
চোখের জল মুছতে গেলে বেশি প্রকাশ।
তাই মুখ ফিরিয়ে ধরা গলায় বলে,শ্রীরামপুর।
হ্যাঁ, এই মুহূর্তে স্থান নির্বাচন করে ফেলেছে সুমনা। শ্রীরামপুরেই যাবে। সেখানে দীপা আছে। অসামান্য নয়, সামান্য বন্ধু। তবু এই ভয়ংকর মুহূর্তে তার নামটাই মুখে এসে গেল।
বুড়ি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই সবিস্ময়ে বলে,ওমা, ছিরামপুর যাবে তো সেই এস্তক বসে কেন? দু দুখানা গাড়ি তো ছেড়ে দিল।
ছেড়ে দিল!
আর নেই গাড়ি?
থাকবে না কেন, ঘণ্টায় ঘণ্টায় আছে। তুমি একা যাচ্ছ বুঝি?
সেখানে স্টেশনে লোক থাকবে।
এবার থেকে অহরহই মিথ্যা বলতে হবে সুমনাকে। মিথ্যার জাল রচনা করেই কাটাতে হবে জীবন।
বুড়ি বলে, ছেলেটি বুঝি প্রথম?
হ্যাঁ।
খাসা গোপালের মতন চেহারাখানি! তা যাই বলো বাছা, দুরন্ত ছেলে নিয়ে এমন একা যাওয়া আসা করা ঠিক না। বড় ভয়। আর কাউকে নিতে হয় সঙ্গে।
সুমনা তীব্রস্বরে বলে ওঠে, বাড়িতে আর যদি কেউ না থাকে?
অ। কেউ নেই বুঝি? মনে কিছু কোরো না বাছা, বুড়োমানুষ কী বলতে কী বলি। তবে যাবে যদি উঠে পড়ো। এই আবার একটা ট্রেন ছাড়বে।
সুমনা উঠে যায়।
কেউ চুপ করে থাকবে না।
সবাই কথা বলবে। তোমার নিভৃতে যে কথাকটি মনের মণিকোঠায় তুলে রাখতে চাও, সেই কটিকে পেড়ে নামানোতেই আনন্দ সবাইয়ের।
একটা কথাহীন পৃথিবী খুঁজে পাওয়া যায় না, যেখানে সুমনা নিশ্চিন্ত হয়ে জীবনটা কাটাতে পারে?
সে-পৃথিবীকে আবিষ্কার করতেই হবে।
কিন্তু ওরা যদি খুঁজে বার করে?
সুমনা স্টেশন থেকে বাড়িতে ফোন করবে। জানিয়ে চলে যাবে। বলে যাবে, আমায় খুঁজো না।
.
কিন্তু খুঁজো না বললেই কি না খুঁজে থাকবে এরা? বাপ, ভাই প্রেমিক?
কলকাতা যেমন বড় শহর, তেমনি হাতের মুঠোর শহর।
রেলপুলিশকে জানাতেই বা কতক্ষণ? রেলপুলিশেরই বা জানতে কতক্ষণ? শেষ অবধি ওরকম একটি কে-এর খবর দিয়ে দেয় তারা।
এবার বর্ণনাটা নিখুঁত দেওয়া হয়েছিল এদের কাছে। রং গড়ন উচ্চতা, নাম ধাম বয়েস। দেওয়া হয়েছিল সঙ্গের বাচ্চাটির বিবরণ।
শ্রীরামপুর স্টেশন।
কী ভেবে ওখানে গেল সুমনা? এমন কে আছে ওর ওখানে?
না, তেমন কেউ নয়।
তবু ভেবেছিল দীপার কাছে আগে যাবে।
তারপর গুছিয়ে নেবে।
তারপর দেখবে পৃথিবীটা কত বড়।
ভেবেছিল সুমনা। সারাদিন হাওড়া স্টেশনের ওয়েটিংরুমে বসে ভেবেছিল। বাড়িতে বাথরুমের বারান্দা থেকে জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতেও ভেবেছিল, একবার এদের চোখের আওতা থেকে চলে যেতে পারলে হয়! তারপর দেখব।
সুজাতা বলেছিল, ছেলে কোলে করে রাস্তায় ভিক্ষে করিস, তা ভিন্ন আর কী গতি হবে তোর।
সুমনা দেখবে আর কোনও গতি হয় কি না।
এতবড় বিরাট পৃথিবীতে কখনও কি কোনও সত্যি-মা এমন করে শিশু বুকে চেপে রাস্তায় নামে না? সুমনা মিথ্যে মা, কিন্তু সুমনার ভালবাসাটা তো মিথ্যে নয়?
আর সুমনার জেদ!
সুমনার জেদের অহংকার।
যে অহংকার দেখিয়ে দিতে চায় পথে পথে ভিক্ষে করা ভিন্ন আর কোনও পথ আছে কিনা।
সারাটা দিন বৃথা ভাবনায় কাটিয়েছে সুমনা। সামান্য একটা ড্রাইভারের ঔদ্ধত্যে ভেবেছে সমস্ত পৃথিবীটাই বুঝি উদ্ধত দৃষ্টি মেলে উদ্যত হয়ে আছে অপমান করবে বলে। তা কেন? পৃথিবী অনেক বড়!
সুমনা একদিন ওর ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলে, নিয়ে গিয়ে দাঁড়াবে ওদের সেই বাড়িতে। ঢুকবে জমাদার আসার চোরা সিঁড়ি দিয়ে নয়, সদর দরজা দিয়ে। সুমনার সেই অহংকারী মাকে বলবে, শোনো, শুনে যাও, আমি ভিক্ষে করিনি, আমি সম্মান হারাইনি। আমি আমার ছেলেকে মানুষ করে তুলেছি।
ভয়ানক একটা উত্তেজিত মানসিক অবস্থায় কোনও পরিকল্পনা দাঁড়ায় না। তবু আকাশের গায়ের দ্রুত চলন্ত মেঘের মতো চিন্তাভাবনাগুলো ছুটোছুটি করে।
বি.এ. পাশের ডিগ্রিটাকে সম্বল করে কোনও মফস্বলের স্কুলের টিচারির জন্যে দাঁড়ালে, দাঁড়ানোটা ব্যর্থ হবে না। মাস্টারি একটা ঠিকই জুটিয়ে নিতে পারবে। আর মাস্টারি-ই একমাত্র পেশা, যাতে ছুটি আছে অনেক।
গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটি, এই দুটো বড় ছুটিতে অচিনকে সে যত্নে ডুবিয়ে রাখবে। খুচরো ছুটিও তো আছেই। বাকি সময়টার জন্যে রাখতেই হবে একটা ঝি। উপায় নেই। কিন্তু? হঠাৎ চমকে উঠল সুমনা, যদি সুমনার অনুপস্থিতির অবকাশে সেই ঝিটা অচিনকে চুরি করে নিয়ে পালায়?
ভয়ে হৃৎপিণ্ডটা ঠাণ্ডা হয়ে এল সুমনার। ছেলেটাকে অকারণেই আরও চেপে ধরল।
অথচ এমন চাপাচাপির মধ্যে থাকতে সে একান্ত নারাজ। ট্রেনের কামরায় বেদম দৌরাত্ম্যি করবে সে।
কী সুন্দর ছেলেটি আপনার!
বলল একটি সহযাত্রিনী। লেডিস কম্পার্টমেন্টটাই বেছে নিয়েছে সুমনা। সহযাত্রিনী ফের বলে, একা এত দুরন্ত ছেলে নিয়ে ট্রেনে উঠেছেন?
সুমনা গম্ভীর ভাবে বলে, না। পাশের গাড়িতে এর বাবা আছে।
এর বাবা! মেয়েটি হাসে,আপনার কেউ নয় তো?
না! আমার কেউ না।
বলে সুমনাও হাসির ভান করে।
হয়তো আর বেশিক্ষণ থাকলে মেয়েটির কৌতূহল আরও প্রবল হত, হয়তো বলে বসত, আপনি বুঝি সিঁদুর চিঁদুরকে কুসংস্কার ভাবেন?হয়তো বলত, কই এর বাবা তো একবারও খোঁজ নিতে এলেন না? কিন্তু ঈশ্বরের অপার অনুগ্রহ, মেয়েটা কোন্নগরে নেমে গেল।
আর সুমনা ভাবতে লাগল।
খুব অবলীলায় মিথ্যে কথাটা বলে ফেলতে পারল সে। একটুও বাধল না, বা ওর প্রশ্নের উত্তরে বলে উঠতে পারল না, তা একা ছাড়া গতি কী? এটা যে আমার কুড়োনো ছেলে!
সহজেই বলল পাশের গাড়িতে এর বাবা আছে। তা হলে পারবে সুমনা অবিরত মিথ্যার জাল রচনা করতে।
কে বলতে পারে সত্যিই আছে কি না!
হয়তো আছে। এই গাড়িতেই ওর মা কিংবা ওর বাবা আছে। তারা নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে বসে আসে। তাদের আর মিথ্যা কথা বলতে হবে না।
শুধু সুমনাকেই রচনা করে চলতে হবে সহস্র মিথ্যার জাল।
না করে উপায় নেই।
সত্যি কথা কেউ শুনতে চায় না, বুঝতে পারে না। সত্যি কথাকে হজম করবার ক্ষমতাই নেই। কারও। সরাসরি সত্যিকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখলে থতমত খাবে। আহত হবে।
ওদের বাঁচাবার জন্যেই মিথ্যার জালের দরকার। ওরা সেই বানানো মিথ্যা শুনে সন্দেহ করবে, মুখ বাঁকাবে, মুচকি হাসবে, তবু সেটাই হজম করতে পারবে।
কিন্তু দীপার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে কোন মিথ্যার মাধুরী রচনা করে?
দীপা!
তার সহপাঠিনী।
যাকে সুমনা বলত, ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করে পড়া! বাস্য! তোর মতো অবস্থা আমার হলে, স্রেফ খাতা থেকে নাম কাটিয়ে দিয়ে বাড়ি বসে কুটনো কুটতাম বাটনা বাটতাম!
সেই দীপা।
যে সুমনার সৌভাগ্যর দিকে করুণ নয়নে তাকাত। যে বলত, তা তুই আর বলবি না কেন? ভগবান তোকে জগতের সব সুবিধেগুলো একঙ্গে ঢেলে দিয়েছেন। আমাদের তো খেটেপিটে মানুষ হতে হবে? বেঁচে থাকতে হবে?
আজ সুমনার দিকে কোন দৃষ্টিতে তাকাবে দীপা? যে সুমনাকে খেটে-পিটে শুধু নিজেকেই বাঁচিয়ে রাখলে চলবে না। আরও একটি প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, মানুষ করতে হবে।
দীপা যদি বলে, এ কী, তোর এ কী হাল?
তার উত্তরে কী বলবে সুমনা?
কী বলবে, ভাবতে ভাবতে শ্রীরামপুর এসে গেল।
ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে।
সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।
কিন্তু এই রাত্তিরে এই ঘুমন্ত ছেলে নিয়ে বন্ধুর বাড়ি? তার তো মা বাপ আছে, সে তো একা নয়!
তবে কী করবে সুমনা?
ঠিকানাও তো জানা নেই।
শুধু নাম।
কোনও রিকশাওলা চিনবে দীপা সান্ডেলের বাড়ি?
ওঃ সান্ডেল বাড়ি যাবেন?
বলল একজন সবজান্তা।
তা অনেক পথ পার করে সারা টাউনটা ঘুরিয়ে নিয়েও গেল কোনও এক সান্ডেল বাড়ি। কিন্তু ডাকাডাকিতে যিনি বেরিয়ে এলেন, তিনি দীপা সান্ডেল নাম্নী কাউকে না জানলেও, জেরায় সুমনার সমস্ত কিছু জেনে ফেলবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন।
তাঁর জেরার হাত এড়িয়ে ছাড়ান পেতে সময় লাগল।
অগত্যা সেখান থেকে বিদায়।
সাইকেল রিকশাওয়ালা দয়াপরবশ হয়ে বলে,ঠিকমতন ঠিকানা না জেনে কি এত রাত্রে আসতে আছে দিদিমণি? আমি বলি কি, আপনি আজকের মতন ফিরে যান। ট্রেন এখনও আছে। কাল আবার তখন–কোনও বেটাছেলেকে সঙ্গে করে
থাক তোমাকে আর উপদেশ দিতে হবে না। ধমকে ওঠে, সুমনা, কখন তোমাদের লাস্ট ট্রেন?
আজ্ঞে এগারোটা পঁয়তাল্লিশ।
রাগের মাথায় হাতের ঘড়িটাও হাতে বেঁধে নেওয়া হয়নি। যেটা নিতান্তই দরকার ছিল।
এইসব নিচু ক্লাশের লোকেরা যখন মুরুব্বিয়ানা করতে আসে, তখন তাদের ধমক দিয়ে দাবিয়ে দেওয়াই ঠিক; তাই ধমকে ঠাণ্ডা করে দিতে উদ্যত হয় সুমনা, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ছেলেটা জেগে উঠে পরিত্রাহী চিৎকার জুড়ে দেয়।
আর সেই কান্না ভোলাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে সুমনার মনে পড়ে, সাত আট ঘণ্টা ছেলেটা কিছু খায়নি। হাওড়া স্টেশনের ওয়েটিংরুমে সেই যা খাওয়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বসে খানিক খানিক সময় বাদ শুধু জল খাইয়েছে। এখন কটা ঘণ্টা জলও নেই।
ঘুমিয়ে পড়েছিল।
খিদেয় আর খেলার ক্লান্তিতে।
জেগে উঠে রসাতল করতে চায়।
ভোলাবার ব্যর্থ চেষ্টায় কাঁদো কাঁদো হয়ে সুমনা বলে, এই শোেনন। দুধ পাওয়া যাবে কোথাও?
দুধ!
লোকটা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত সুরে বলে, এত রাতে দুধ কোথা?
দুধ কোথা? সুমনা ধমকে ওঠে, বলতে চাও বাচ্চাটা না খেয়ে মারা যাবে?
আজ্ঞে আমি কী করব? ছেলের দুধ সঙ্গে নেই?
না নেই। থাকলে তোমায় বলা হত না।
কিন্তু কথা কার কানে যাচ্ছে?
ছেলেটা যেন শত্রুতা সাধার ভূমিকা নিয়েছে।
সুমনা কী করবে?
সুমনা কি ওকে ঠাস করে একটা চড়িয়ে দেবে?
সুমনা কি নিজে হাউহাউ করে কাঁদবে?
সুমনা কি আশপাশের কোনও বাড়ির দরজায় করাঘাত করে বলবে, একটু দুধ দিতে পারেন? একটু দুধ? বাচ্চাটা মারা যাচ্ছে
ভাষাটা কী রকম শোনাল? ঠিক রাস্তার ভিখিরির মতন না?
ভাবতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল সুমনা।
তা হলে সুজাতার কথাই ঠিক? ছেলে নিয়ে ভিক্ষেই করতেই হবে তাকে? মাত্র এই ঘণ্টা কয়েক বাড়ির আশ্রয় ছেড়ে চলে এসেছে সুমনা, এর মধ্যেই ভিক্ষাবৃত্তির ভাষা মুসাবিদা করছে?
এই নোটটা তোমায় দিচ্ছি–সুমনা বলে, যেখান থেকে হোক একটু দুধ এনে দিতে হবে।
ব্যাপারটা যে গোলমেলে, তা বুঝতে দেরি হয় না লোকটার। সে দ্রুতবেগে গাড়ি চালাতে চালাতে বেজার মুখে বলে, নোট নিয়ে কী করব? এখন দুধ পাওয়া যাবে না। আপনি বরং স্টেশনে চলে যান। মাস্টারমশাইকে বলে যদি কিছু ব্যবস্থা হয়–
স্টেশনমাস্টারকে দিয়ে দুধের ব্যবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা যে কতখানি, সে কি আর জানে না সুমনা?
তবু ভাবে, যাক, স্টেশনে তো চায়ের দোকান থাকে, রাত অবধি খদ্দেরও থাকে তাদের। সেখানেই যদি–
সে দুধ আদৌ দুধ কি না, সে দুধ খেলে ছেলের পেটের অসুখ করবে কি না, দুধ পেলে খাওয়াবে কীসে করে, এসব কথা কিছু ভাবছে না সুমনা। শুধু ওর সমস্ত একাগ্রতা, সমস্ত ইচ্ছাশক্তি ঝিনুক কয়েক দুধের স্বপ্নের কাছে মাথা খুঁড়ছে।
না, চিন্তাশক্তি এখন নেই সুমনার। থাকলে হয়তো ভাবত, ভাগ্য কত সহজেই মানুষকে নতিস্বীকার করায়। বুঝতে পারত ভদ্রঘরের মেয়েরা এত সহজে ভিক্ষার হাত বাড়ায় কেন? শিশু, শিশুই হচ্ছে সমস্ত নিরুপায়তার মূল।
আশ্চর্য, পথের দুধারে তো লোকের বসতি আছে। একটা ছোট ছেলে যে কেঁদে হন্যে হয়ে যাচ্ছে, কারও কানে যাচ্ছে না? কেউ একবার ঘরের জানলা খুলে বাড়ির দরজা খুলে বলতে পারছে না, এ কী এত কাঁদছে কেন?
সুমনা আশ্চর্য হতে পারে।
সুমনা জগতের কী জানে?
পৃথিবীর কতটুকু দেখেছে সে?
সুমনা কি জানে অহরহ এ কান্না শুনতে শুনতে কানে ঘাঁটা পড়ে গেছে পৃথিবীর! ক্ষুধার্ত শিশুর দুরন্ত কান্না, তার গা সহা!
.
এই তো স্টেশন। নেমে পড়ল সুমনা। উদ্দাম ক্রন্দনরত ছেলেটাকে রিকশাওলাটারই কোলে দিয়ে বটুয়া থেকে পয়সা বার করে দিল।
যে বটুয়াটা সম্বল করে এসেছে সুমনা। ভাগ্যিস শুধু এইটুকু জ্ঞান তার ছিল যে, এই বিশ্ব সংসারে টাকাটাই মূল জীবনীরস!
কোথায় তোমাদের স্টেশনমাস্টার?
ওই তো ইদিকেই আসছে, লোকটা বলে।
আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি এগিয়ে এসে পার্শ্ববর্তী ইনস্পেক্টরকে উদ্দেশ করে বলেন, এই তো, এই ইনিই তো ঘণ্টাতিনেক আগে
পৃথিবীটা কত বড়, দেখা হল না।
তার আগেই সন্ধানী পুলিশ দেখে ফেলল সুমনাকে।
এখানে বসে ছিল এরা।
কান্তিকুমার, সিদ্ধার্থ, অলক।
রেল-পুলিশের টেলিফোন পেয়ে যারা সুমনা ফেরার আগেই এসে পৌঁছে গেছে।
পুলিশ যা প্রশংসনীয় কাজ করল, তার তুলনা কী?
এই যে এদিকে আসুন। দেখুন দিকি—
আমি! আমি যাই! দৃঢ়স্বরে বলে সিদ্ধার্থ, সন্দেহের সৃষ্টি হবে না তাতে।
কান্তিকুমার মোটা চশমার ভিতর থেকে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,তাতে সন্দেহের সৃষ্টি হবে না?
না। আপনি বুঝে দেখুন কাকাবাবু। স্ত্রী পুত্র এই পরিচয়ই সবচেয়ে সন্দেহহীন। আমার স্ত্রী আর পুত্র। স্ত্রী আমার সঙ্গে ঝগড়া করে ছেলে নিয়ে চলে এসেছে।
পুলিশ তাই বিশ্বাস করবে? স্বভাববহির্ভূত তীব্ৰস্কর কান্তিকুমারের
করবে। নিশ্চয় করবে, সিদ্ধার্থ ব্যগ্রভাবে বলে, যদি আপনি সহযোগিতা করেন, যদি আপনি সে পরিচয় অস্বীকার না করেন।
কান্তিকুমার আজ অবোধ হয়ে গেছেন, দিগভ্রান্ত হয়ে গেছেন, তাই সিদ্ধার্থ তাঁকে বোঝাতে আসছে, কোন জবাবটা সন্দেহহীন হবে, কীভাবে কথা ফেললে পুলিশ বিশ্বাস করবে।
হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট কান্তিকুমারকে!
হাতি আর ব্যাঙের প্রবাদটা তা হলে মিথ্যে নয়?
কিন্তু কান্তিকুমার বুঝি তাঁর মেয়ের উপর সিদ্ধার্থের ওই আধিপত্য বিস্তার সহ্য করতে পারছেন না। না কি এই ভয়ংকর একটা লজ্জার বিপদে পড়ে সত্যিই অবুঝ হয়ে গেছেন?
তাই আবার বিচলিত কণ্ঠে বলেন, পুলিশ মানেই বোকা নয় সিদ্ধার্থ, বিবাহিতা অবিবাহিতা বোঝার ক্ষমতা ওদের আছে।
হঠাৎ অলকও বলে ওঠে, তা সত্যি, সিঁদুর টিদুর কিছু নেই—
পাগলামি করিসনে। সিদ্ধার্থ বলে, সিঁদুর আজকাল অনেকেই পরে না। আর হিন্দু বিয়ের এই একটা সুবিধে, কাগজেপত্রে পাকা প্রমাণ দেখাতে হয় না। বিশ্বাসভাজন সাক্ষী দুএকজন থাকলেই হল। তা বাবা আর দাদা, এই চাইতে উপযুক্ত বিশ্বাসভাজন সাক্ষী আর কে হতে পারে? আপনারা বলবেন–
.
গাড়ি নিয়েই এসেছে, মস্তবড় মোটরগাড়ি।
এসেছে বাপ, ভাই আর স্বামী!
নিজেরাই যারা খবর দিয়েছে, আর মেয়ে খুঁজতে যারা হন্যে হয়ে এসেছে। আর এসেছে এতবড় গাড়ি চড়ে। তাদের খুব বেশি হয়রান করে না পুলিশ। হয়তো বা করত, যদি শুধু একটা বেওয়ারিশ তরুণী মেয়ে হত!
কিন্তু না। এর অনেক ওয়ারিশান। আর সঙ্গে একটা ক্ষুৎপিপাসায় বিদ্রোহী, উদ্দাম, চিৎকারপরায়ণ বাচ্চা ছেলে। আটকে রাখতে চাওয়া মানেই নিজেদের জীবন মহানিশা করে তোলা। তাই ছেড়ে দিতে দেরি করে না।
তবু জেরার অভিনয় একটু করে বইকী!
বলে, ওঁর মুখ থেকে তো একটাও কথা আদায় করতে পারিনি, ব্যাপারটা কী বোঝান আমাদের।
প্রধান ব্যাপার মাথাটা একটু ইয়ে-বলে ওঠে অলক।
প্রশ্নকারী তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আপনি ওঁর কে?
দাদা।
ওঃ দাদা! থাক, আপনার এখন কথা বলবার দরকার নেই। বাবাকেই বলতে দিন। হ্যাঁ আপনি কী বলছেন?
কান্তিকুমার তেমনি গম্ভীর শান্তকণ্ঠেই বলে যান, খুব একটা কিছু ঘোরালো ব্যাপার নয়। শুনছি তুচ্ছি কথা কাটাকাটি থেকেই
আপনার মেয়ে-জামাইয়ের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না?
ছিল।
মেয়ের মাথায় কোনও
না। শুধু একটু রাগী বেশি।
কতদিন বিয়ে হয়েছে?
বছর দুই।
হু। ঠিক আছে।…আপনার কিছু বলবার আছে? সিদ্ধার্থের দিকে তাকায় সে মর্মভেদী দৃষ্টি হেনে।
সিদ্ধার্থ কান্তিকুমারের মতো স্তিমিত নয়, শান্ত নয়, ভাগ্যের হাতে আত্মসমর্পিত মূর্তি নয়।
সে চটপট বলে ওঠে, বলবার কিছু নেই মশাই, একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন দয়া করে–ছেলেটা খেতে না পেয়ে চিল্লাচ্ছে।
কেন, মায়ের কাছে খেতে পায় না?
প্রশ্নকারীর স্বর তীক্ষ্ণ।
কিন্তু সিদ্ধার্থ সপ্রতিভ।
ওসব কথা বাদ দিন না মশাই, মায়ের কাছে আবার কোন ছেলেটা খেতে পাচ্ছে এ যুগে? জন্মাবধি ফুড কিনতে কিনতে তো
আপনারা তো বলছেন হিন্দু। হিন্দু বাঙালি। উনি লোহা সিঁদুর ইত্যাদি ব্যবহার করেন না কেন?
কেন আর! ফ্যাশান! কিন্তু সব কিছুর আগে বাচ্চাটাকে একটু খাওয়াতে দিলে ভাল হত না? ওর খাদ্যটা যখন এসেই গেছে–
এসে গেছে!..সুমনা চমকে তাকায়। বলে ওঠে, কই? কোথায়?
হ্যাঁ, এই যে!…অলক—
অলক তার হাতের ব্যাগ থেকে একটা তৈরি ফুড ভর্তি ফিডিং বটল বার করে দেয়। যেটা আসার আগে সুজাতা করে দিয়েছে।
এ বুদ্ধি সিদ্ধার্থর।
আর বুদ্ধিটা জোরালো।
পিতৃহৃদয়ের আকুলতাটা প্রকাশ পেল। সুমনা ফুডের বোতলটা প্রায় ছিনিয়ে নেয় অলকের হাত থেকে। মুখে ধরে ছেলেটার।
আর সন্দেহের কী থাকতে পারে!
তবু চলে টানাটানি।
ঝগড়ার কারণটা কী?
সিদ্ধার্থ সহসা হেসে ওঠে। বলে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার কি আর কারণ থাকে মশাই?
তবু। বাড়ি থেকে চলে আসার মতো
ওটা মুডের ব্যাপার।
যাক শেষ পর্যন্ত সুমনার সাক্ষ্যেও গরমিল হল না। সমস্ত দৃশ্যটার ওপর চোখ বুলিয়েই ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করে নিতে পেরেছিল সে।
বাপ, ভাই আর স্বামী।
ঠিকই তো৷
রাগ! হ্যাঁ রাগ করেই বটে। রাগের কারণ? নেহাত তুচ্ছ।
তুচ্ছ কারণে আপনি এইভাবে বাড়ি থেকে চলে আসতে সাহসী হলেন?
চলে আসা আবার কী? এখন সুমনা জোরালো–এখানে আমার এক সহপাঠিনীর বাড়ি আছে–
সহপাঠিনী!
তার মানে পড়ুয়া মেয়ে।
স্টুডেন্ট আপনি?
হ্যাঁ।
হ্যাঁ, বি. এ. পাশ করে বেরিয়েছে এবার। এম. এ. পড়ার প্রস্তুতি চলছে। বাপ হাইকোর্টের উকিল।
ও বাবা! যেতে দাও যেতে দাও। তবু–মরণ কামড়!
কিন্তু আগে তো ওই সহপাঠিনীর কথা বলেননি?
রাগ করে বলিনি। আপনারা ধরলেন কেন?
হু, রাগটা আপনার একটু বেশি। হিতাহিত জ্ঞান হরে নেয়। নাম ঠিকানা কী সহপাঠিনীর?
কী দরকার আপনার?
আছে দরকার।
লিখে নিন। দীপা সান্ডেল। শ্রীরামপুর, সান্ডেল পাড়া।
শেষ পর্যন্ত খোলা বাতাসে।
লিখুক না, লিখে নিক। খুঁজুক গিয়ে।
ছেলেটাকে কোলে নেয় সিদ্ধার্থ। হাত বাড়িয়ে।
আর ভাগ্যের দয়া, আদৌ আপত্তি করে না সে। হয়তো এতক্ষণের বন্দিত্বের পর মুক্তির বাতাস পেয়ে। না কি শিশুহৃদয়ের সহজাত বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরেছে সে, এখানে আশ্রয় আছে।
সুমনাও দিয়েছে সেই প্রসারিত হাতের ওপর।
সুমনা বিশ্বাস করে কাউকে ছেলে দেয় না। সুমনা এগিয়ে দিয়েছে নির্ভয় নির্ভরতায়।
.
উঃ!
গাড়িতে উঠতে উঠতে বেশ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে সিদ্ধার্থ, সামান্য ব্যাপার নিয়ে কী কাণ্ডটাই করলে! বাড়িসুষ্ঠু লোকের ঘাম ছুটিয়ে দিলে একেবারে!
অলক উঠে পড়ে বলে, যা বলেছ! খেতে পাইনি সারাদিন!
খেতে তো আমরাও কিছু পেলাম না মশাই, রেলপুলিশ বলে, আপনি তো স্ত্রী পেলেন, ছেলে পেলেন।
সিদ্ধার্থ পকেটে হাত পুরে বলে,ও হ্যাঁ হ্যাঁ।
কান্তিকুমার গাড়িতে ওঠেন না।
কান্তিকুমার ট্রেনে যাবেন।
অলক যাবে গাড়ি চালিয়ে।
অলক পারবে? তা আবার পারবে না?
কান্তিকুমারের চেয়ে ভাল পারবে। কান্তিকুমার বড় বেশি টায়ার্ড।
.
বেশি রাতের নির্জন রাস্তা!
অলক গাড়ি চালাচ্ছে নিঃশব্দে, সহজ মসৃণতায়। সময়ের মসৃণতায় মুহূর্তগুলি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
বাচ্চাটা পেটভরে খেতে পেয়ে গাড়ির দোলানিতে ঘুমিয়ে অচেতন। সুমনারও বুঝি কোনও চেতনা নেই। ও ভুলে গেছে বড় ক্লান্ত হয়ে কখন যেন একবার মাথাটা হেলিয়ে সিদ্ধার্থের কাঁধে রেখেছিল, আর তেমনিই রেখে বসে আছে।
সিদ্ধার্থ এক সময় আস্তে আস্তে বলে, তোমার সংসার আমি সাজিয়ে রেখেছি সুমনা! আমার বুদ্ধিতে যা কুলিয়েছে, সব কিনে কিনে জড়ো করেছি, শুধু–
সিদ্ধার্থেরও লজ্জা আছে।
সিদ্ধার্থও কথা বলতে গিয়ে থামে?
সুমনা ঘাড় সোজা করে চোখ তুলে তাকায়। সেই তাকানোর মধ্যেই রয়েছে প্রশ্ন। সে প্রশ্ন যেন নরম সুরে বলছে, শুধু কী?
শুধু একটা জিনিস বাকি রেখেছি। কেনাটা তুলে রেখেছি দুজনে মিলে কিনব বলে।
এবার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রশ্ন আসে।
কী? কী জিনিস?
মাথাটা নিচু করে অলকের কান বাঁচিয়ে আস্তে বলে সিদ্ধার্থ, দোলনা! একটা বেতের দোলনা!
দোলনা!
দোলনা কিনবে তারা দুজনে মিলে! বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় সুমনা। ব্যাকুল একটা হাতে হাত চেপে ধরে সিদ্ধার্থর।
সিদ্ধার্থ সে হাতকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলে, হ্যাঁ। পালা করে দুজনে দোল দেব ব্যাটাকে।
সিদ্ধার্থ!
হ্যাঁ। ও থাকবে আমাদের কাছে, আমাদের দুজনের কাছে। এত চমৎকার একটা সমাধান হাতের কাছে ছিল, অথচ কত হাতড়েই বেড়াচ্ছিলাম! আশ্চর্য নয়? তুমি একটা কোথাকার কার ছেলেকে এত ভালবাসবে, এও অসহ্য! তাই বেশ গুছিয়ে একটা দাবি খাড়া করে ফেলেছি। নিজের বলেই চালাতে শুরু করেছি।
সিদ্ধার্থ!
কী, রাগ হল নাকি! কেন, চেহারাটা কি আমার এতই খারাপ যে, আমাকে তোমার ওই রাজপুত্রটির বাপ বললে বেমানান হবে?