- বইয়ের নামঃ দোলনা
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. কুমারী মেয়ে
দোলনা — উপন্যাস– আশাপূর্ণা দেবী
কুমারী মেয়ের পক্ষে এহেন কাজ শুধু যে অস্বাভাবিকই তা নয়, রীতিমত গর্হিতও। অথচ সুমনা সেই গর্হিত আর অস্বাভাবিক কাজটাই করে বসেছে। আর তার জের চালিয়ে যাবার জন্যে মরণপণ করেছে।
মাথায় হাত দিয়ে পড়েছে বাড়ির সবাই। ভেবে পাচ্ছে না কী উপায়ে ওকে এই বিপজ্জনক খেয়াল থেকে মুক্ত করা যাবে। শুধু খেয়াল বললেও বোধহয় ঠিক হয় না। এ তো একেবারে পাগলামি। পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে নাকি আছে একথা, সাময়িকভাবে কখনও কখনও কাউকে উন্মাদরোগ আশ্রয় করে, কিন্তু সুমনাদের সংসার কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি তাদের সবচেয়ে দামি মেয়েটাই তেমন একটা আশ্রয়স্থল হবে।
.
সুমনার মা সুজাতা প্রথমটা তো সুমনার এই অসম সাহসিক কীর্তিতে হইচই, রইরই করে উঠেছিল, আর সুমনার বাবা কান্তিকুমার ভ্রূকুটি করে বলেছিলেন, পাগল নাকি?
কিন্তু অতঃপর যখন দেখা গেল পাগলের আচরণই করছে সুমনা, তখন কান্তিকুমার ধরলেন ধমক, আর সুজাতা সদুপদেশ।
প্রথমে রঙ্গমঞ্চে ছিল মাত্র ওই দুটি কুশীলব। কারণ এখানে সাঁওতাল পরগনার এই স্বাস্থ্যের জন্যে বিখ্যাত গ্রামটিতে মাত্র তিনজনই এসেছিলেন ওঁরা। মা বাপ আর মেয়ে।
কলকাতায় একান্নবর্তী বড় পরিবার, সেখানে বাকি ছেলেমেয়েদের রেখে আসতে অসুবিধে হয়নি। সুমনার জন্যে আসা। কিছুদিন যাবৎ লিভার-দোষে ভুগছিল সুমনা। তাই বি. এ. পরীক্ষাটা শেষ হতেই মেয়ে নিয়ে স্বাস্থ্যোদ্বারে এসেছিলেন কান্তিকুমার। কে জানত শারীরিক স্বাস্থ্য-অর্জন করে ফেরার মুখে সে হঠাৎ এমন মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
ব্যাধিগ্রস্ত ছাড়া আর কী!
হিতাহিতজ্ঞান হারানো মানেই ব্যাধি।
সুজাতা বলে, সুমি, একবার খোলা বুদ্ধি আর ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখ, তুই যা করতে চাইছিস, সেটা সঙ্গত কিনা। আমি কিছু বলছি না, তুই নিজেই ভেবে দেখ। ওই জীবটার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে, সেন্টিমেন্টকে সরিয়ে রেখে চিন্তা কর। কলকাতার বাড়িটা আর সেখানের সকলের মুখ মনে কর, তারপর ভাব তুই কী করতে চাইছিস।
সুমনা নিচু করে রাখা মাথাটা উঁচু করে বলে, ভেবেছি, অনেক ভেবেছি।
ভেবেছিস! ভেবে তুই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিস!সুজাতা ক্ষোভ আর হতাশাজড়িত কণ্ঠে বলে, তা হলে তোর বাপ যা বলেছে, তাই ঠিক। তুই পাগলই হয়ে গেছিস।
সুমনা উত্তর দেয় না, জানলার পথে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কান্তিকুমার গম্ভীরমুখে বলেন,তুমি কি চাও সমাজে আর আমাদের মুখ তুলে দাঁড়াবার উপায় না থাকে?
সুমনার চোখটা ছলছল করে আসে।
বাবার কাছে এমন বকুনি খাওয়াটা বোধহয় তার এই প্রথম। নিষ্ঠুর কঠিন বকুনি। বাবার কাছে বকুনি খাওয়ার বিষয়বস্তুটা প্রায়শই থাকে স্বাস্থ্য-বিধি মেনে না চলা।
সুমি, ওষুধ খাসনি?…সুমি, এই জোলো হাওয়ায় ওই পাতলা জামা পরে বেড়াচ্ছিস?… সুমি, তোমার মার কাছে শুনলাম তুমি নাকি ফলের রস খেতে চাও না! সাধারণত এই হচ্ছে বাবার বকুনির ভাষা।
কিন্তু সুমনার এই দুঃসহ জেদের নির্লজ্জতায় কান্তিকুমারের সেই স্নেহপ্রবাহ শুকিয়ে গেছে। আজ তিনি মেয়ের মুখ শুকনোর কথা ভাবছেন না, সমাজে নিজের মুখ না থাকার কথা ভাবছেন।
বাবার কথায় সুমনার চোখে জল এলেও কষ্টে সে জল চোখে আটকে রেখে বলে সুমনা, এতে আর তোমাদের দোষ কী? তোমাদের কেন–
কান্তিকুমার ভুরু কুঁচকে বলেন,তুমি শিশু নও সুমনা! আমাদের কেন, সেটুকু বোঝবার ক্ষমতা তোমার আছে। তোমার অসুস্থতা নিয়ে আমরা দুমাসের জন্যে চেঞ্জে এসেছি, এটাই সকলের জানা, হঠাৎ যদি এরকম একটা ব্যাপার নিয়ে ফেরা হয়, তা হলে
চুপ করে যান কান্তিকুমার।
আর বেশি বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় বলেই চুপ করে যান, কিন্তু আর বেশি বলার কি দরকারই ছিল? যথেষ্ট কি বলা হয়নি?
সুমনার গলা বুজে আসে।
যে তর্ক মায়ের সঙ্গে করেছে, সে তর্ক বাবার সঙ্গে চালাতে পারে না। বাষ্পভরা কণ্ঠে বলে, বেশ, আমার জন্যে যদি তোমাদের মুখ নিচু হয়, তোকসমাজে অপমানিত হতে হয়, আমাকে তোমরা ত্যাগ করো।
কান্তিকুমার স্তব্ধ।
কান্তিকুমার বিমূঢ়।
অনেকক্ষণ পরে নিশ্বাস ফেলে বলেন, আমরা তোমায় ত্যাগ করব!
তা ছাড়া যখন উপায় নেই
সুমনা গলাটা পরিষ্কার করে নেয়।
তা ছাড়া উপায় নেই? চমৎকার!কান্তিকুমার ক্ষুব্ধ বেদনার্ত কণ্ঠে বলেন, এ ছাড়া সমাধানের আর কোনও পথ তোমার মাথায় এল না, কেমন? আশ্চর্য!
সুমনা কথা বলে না। সুমনা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুমনা কি ওই আকাশের কাছে আশ্রয় খোঁজে? সুমনা কি আকাশের কাছে শক্তি খোঁজে?
কান্তিকুমার উত্তর সম্পর্কে একটু অপেক্ষা করে তারপর আবার বলেন, তোমার পক্ষে ওটাকে ত্যাগ করা সম্ভব নয় তা হলে। তার বদলে বরং আমাদেরও ত্যাগ করতে প্রস্তুত? সুমনা, আমি কি তা হলে সত্যিই বিশ্বাস করব, তুমি পাগল হয়ে গেছ?
সুমনা মাথা নিচু করে বলে, বাবা! বুঝতে পারছি তোমাদের খুব একটা বিপদে আমি ফেলছি। তাই ওকথা বলতে পেরেছি। কিন্তু সত্যি এও ভাবছি, এটা মেনে নেওয়া কি এতই অসম্ভব তোমাদের পক্ষে? ইচ্ছে করলে কি
হয় না সুমি, হয় না,কান্তিকুমার আবেগভরে বলেন, তা যদি সম্ভব হত, তোমাকে এত করে বলতে হত না। তোমার বোধশক্তি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে বলেই বুঝতে পারছ না এটা কতখানি অসম্ভব।