ওষুধটা তুমি তাড়াতাড়ি দিয়ে দাও অতনু!
আজ্ঞে দিই।
কিন্তু এত রাত্রে পাওয়া যাবে কোথা?
আমার সঙ্গে আছে। চাকর-টাকর কাউকে দিয়ে আমার ব্যাগটা আনিয়ে দিতে পারবেন?
চাকর ছোটে।
.
অমিতা ওষুধটা খাও। তেমনি শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করে অতনু, খেয়ে নাও কষ্ট কমবে।
কষ্ট কমবে? কষ্ট কমবে? সহসা এক কীর্তি করে বসে পাগলিনী, উঠে বসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকের ওপর, মাথাটা ওর কাঁধের কাছে চেপে ধরে ডুকরে ওঠে, তুমি বুঝি আমায় বিষ দিচ্ছ অতনু? দাও তাই দাও। সব কষ্ট সেরে যাবে আমার!
কি হচ্ছে? নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অমিতাকে শুইয়ে দিয়ে এবার ধমকে ওঠে অতনু, যথারীতি ডাক্তারের মতই, ওষুধটা ফেলে দিলে? বিষ দেব কেন? বিষ দিলে পুলিশে ধরে তা জানো না?
পুলিশে ধরে? পাগলিনীর বিহূল প্রশ্ন।
ধরে না? আমি পুলিশে যাই এই চাও বুঝি তুমি?
না অতনু, না! তুমি রাগ কোরো না। আবার কাঁদতে বসে পাগল।
মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেওয়া হয় জোর করে, ঘর অন্ধকার করে বাতাস করতে থাকেন জয়াবতী।
বাকী সকলে চলে যায়।
.
নামমাত্র হিসাবে খেতেও বসে সকলে, আর রাত আড়াইটের সময় নতুন কনের হাতের সুতোটাও ভোলা হয় নিতান্ত অনাড়ম্বরে।
শাঁখ বাজে না, উলু পড়ে না। দীপক ক্লান্ত গলায় বলে, দোহাই তোমাদের, একটু ঘুমুতে দাও আমায়।
এমন সাহস কারও হয় না যে এই কথাটুকু ধরে ঠাট্টা করে।
অতনু থাকলে জগন্ময় ভরসা পাবেন, তাই জগন্ময়ের ঘরের একাংশে অতনুর বিছানা পাতা হয়। সবাই যে যার একটু গড়িয়ে নিতে যায়।
নিথর নিস্তব্ধ বাড়িটায় শুধু ঘূর্ণমান পাখার ব্লেডের শন শন শব্দের সঙ্গে ভারী হালকা নানা রকমের নিঃশ্বাসের শব্দ ওঠা-পড়া করে।
অতনুও কি একটু ঘুমের ওষুধ খাবে? মাথার শির ছিঁড়ে পড়ার মত যন্ত্রণাটা কমাতে?
এ কী অভাবনীয় অদ্ভুত পরিস্থিতি! কী এর অর্থ
অতনু কেন সেই দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এই উৎসববাড়িতে এল? কোন্ বাসনায়? কোন্ লোভে?
হ্যাঁ লোভ বইকি। লোভ ছাড়া আর কি। দীপকের বিয়ের উৎসব না দেখতে পেলে জীবন বৃথা হয়ে যেত না অতনুর। শুভেচ্ছা জানিয়ে টেলিগ্রাম করে তো উপসংহার করে দিয়েছিল। আবার কেন মাতাল হয়ে উঠল মন? কেন জরুরী প্রয়োজনের ছাপ মেরে ছুটির আবেদন করে তখুনি সে ছুটি মঞ্জুর করিয়ে নিয়ে ছুটেছিল বিমান অফিসে?
শুধু একটুখানি লোভ! উৎসববাড়ির এলোমেলোয় যদি একান্তে কোথাও দেখা হয়ে যায়! যদি শুধু একবার বলা যায়, কী অমিতা, কেমন আছ?
তবু এ প্রশ্নকেও বারবার মনের মধ্যে তোলাপাড়া করে দেখেছে, কেমন আছ এ প্রশ্ন কি আর এখন করা যায় অমিতাকে? ব্যঙ্গের মত শোনাবে না? যদি অমিতা বলে বসে সে কথা? যদি নিজেই সে তিক্ত ব্যঙ্গে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, ঘটা করে আকাশে উড়ে ছুটে এলে বুঝি ঠাট্টা করতে?
তবে কেমন আছ এ প্রশ্ন থাক। অন্য কথা বলবে অতনু।
বলবে দীপক খুব লায়েক হয়ে গেছে তো? এই বয়সেই প্রেমে পড়া, বিয়ে করা, সব সেরে নিল! •
না, এ কথাটুকু নিয়েও দ্বিধা করেছে অতনু। ভেবেছে, থাক থাক ওকথা। কে বলতে পারে কোন্ কথায় কোন কথা এসে যাবে। হয়তো এ কথায় অমিতার ঠোঁটটি আরও বেঁকে যাবে। হয়তো আরও তীক্ষ্ণ করে বলবে সে, পুরুষমানুষ একটু পুরুষমানুষের মত হওয়াই তো ভাল।
হয়তো বা কিছুই বলবে না, শুধু সেই একজোড়া নীল চোখের স্থির দৃষ্টি দিয়ে অতনুর পৌরুষকে ধিক্কার দিয়ে উঠবে।
আর নয়তো বা সেই ওর চিরদিনের ভঙ্গিতে হেসে উঠে বলবে, প্রেমে পড়ার উপযুক্ত বয়স ওর হয় নি একথা মনে হচ্ছে তোমার?
তবে থাক, দীপকের কথা থাক।
দীপকের বৌয়ের কথাই বরং জিগ্যেস করবে অতনু, যদি উৎসববাড়ির গোলমালে কোথাও একান্তে পায় অমিতাকে। বলবে, কেমন বৌ হল দীপকের? সুন্দর? কি পড়ে? অবশ্যই এখনও ছাত্রী দীপকের বৌ!
আচ্ছা, এ প্রশ্নেই কি অমিতা ছেড়ে কথা কইবে? যা দুষ্টু সে! হয়তো বলে উঠবে, বৌ কেমন হল, সেটা আমার মাধ্যমেই জেনে নিতে চাও বুঝি অতনুদা বিনা খরচে? উঁহু ও চলবে না, সোনা পত্তর বার করো তবে বৌয়ের কথা। সোনা আনো নি? ঠিক আছে, পকেটে দুচারটে নয়া পয়সা কি আর নেই? তাই নিয়ে চল। বৌকে বলব কেমন একখানি চালাক লোক দেখো। তারপর হয়তো চোখ মুখের সেই অপূর্ব ভঙ্গী করে বলবে, আমার বিয়েতে তো স্রেফ ফকি মারলে, দীপকের বিয়েতে নয়া পয়সাই সই। আচ্ছা, আমার বিয়েতে কিছু দিলে না কি বলে?
না, ওসব কথা হয়তো আর বলবে না অমিতা।
হয়তো ভয়ানক কি এক রকম বদলে গেছে সে। হয়তো শান্ত মৃদু হেসে বলবে, বৌ ভালই, দেখো নি এখনো? চল দেখাই গে।
অমিতা যদি শান্ত হয়ে গিয়ে থাকে, না জানি কী অদ্ভুত দেখতে সে জিনিসটা! দেখলে যন্ত্রণা হবার মত বোধ হয়।
উৎসববাড়ির গোলমালে একান্তে কোথাও দেখা হয়ে গেলে অমিতা যদি শুধু নীল চোখ দুটো তুলে একটু শান্ত হাসি হাসে?
না, তা হলে আর কোনও প্রশ্ন নয়, কোনও কথা নয়, শুধু অতনুও দেখিয়ে দেবে সেও শান্ত হতে জানে। শান্তই তো হয়ে গেছে সে। আর হয়ে গেছে ভেবে নিজের উপর রীতিমত একটা আস্থা এসে গিয়েছিল। তবে হঠাৎ কেন কলকাতায় আসার একটা উপলক্ষে অশান্ত হয়ে উঠল রক্তবাহী শিরাগুলো?
যদি না আসত অতনু! যদি ছুটি মঞ্জুর না হত তার!
এমন অদ্ভুত আর লজ্জাকর পরিস্থিতিতে তো পড়তে হত না। তখনকার সেই ভয়ঙ্কর বিপদের মুহূর্তটা কী প্রবল শক্তিতেই কাটিয়ে উঠেছিল অতনু! এখন আর মনে পড়ছে না, কী করেছিল সে, কী বলেছিল। শুধু মনে পড়ছে কান দুটো অসম্ভব গরম হয়ে উঠে ঝা ঝাঁ করছিল। সেই ঝ ঝ গরমটা এখন মাথার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তোলপাড় করছে।