বাঃ আছেন বইকি! পরিবেশনের তদারকি করছিলেন যে! বলেছিলেন বাড়ির লোকের মানে, আমাদের সঙ্গে খাবেন। নীচেই আছেন।
দীপকের মৃতদার বড় ভগ্নীপতি সস্নেহ সুরে বলেন, তুমিও তো খাওনি এখনও?
দীপক মাথা নাড়ল, সেজকাকা, ছোটকাকা, পিসেমশাই, বাবা, আপনি, কেউই তো খান নি আপনারা?
আহা আমাদের কথা আলাদা, সে হচ্ছে পরে। কিন্তু তুমি ছেলেমানুষ, এতটা অনিয়ম! তাছাড়া–ওই সব মেয়েলি কাজটাজগুলোসারতে তো হবে যা হোক করে!
পুরুষমানুষ দীপক, সহসা আর এক পুরুষের হৃদয় স্পর্শে প্রায় কেঁদে ফেলে–আর ওসব! ছোড়দির এই হল!
ভগ্নিপতি আশ্বাস দেন, হয়েছে সেরে যাবে, মেয়েদের এসব বয়সে ওরকম ঢের হয়। ঘাবড়াবার কি আছে? যাও যাও, তোমরা খেয়ে নাও গে। অতনু পরের ছেলে
সহসা ঘরের মধ্যে থেকে তীক্ষ্ণ তীব্র একটা শব্দ আসে, খায় নি কেন? খায় নি কেন ওরা? বিয়েবাড়িতে খায়নি কেন?
এঁরা শশব্যস্তে গিয়ে বলেন, খাচ্ছে-খাচ্ছে, এই সবাই খেয়ে নেবে একেবারে।
খাচ্ছে না, কেউ খাচ্ছে না। আমি বলি নি, তাই খাচ্ছে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে অমিতা।
তা যা দিকিন, অতনুকেই একবার ডাক দিকি। বললেন দীপকের বাবা জগন্ময়।
মহাশ্বেতার মনে পড়ে গেল, পাগলিনীর প্রথম উন্মত্ত অভিব্যক্তি। কাছে এসে চাপা ধমকের সুরে বলল, ওকে আবার কেন বড় মামা? যতই তোক নিষ্পর, ওর কানে এসব কথা তোলার দরকারই বা কি? আত্মীয় হয় সে আলাদা কথা!
না না, সে কি!
মৃতদার বলে ওঠেন, অতনু তো এ বাড়ির আত্মীয়ের বাড়া। দেখেছি তো ছেলেবেলা থেকে।
.
কানাঘুসো শুনছিল অতনু। সবটা না জেনে যাওয়াও যায় না, অন্য কাজেও লাগা যায় না।
দীপক এসে আবেদন জানালো।
কানাঘুসোটা অনেকটা ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল, অতনু অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে দীপকের দিকে তাকিয়ে বলল, ডাক্তার বলে ডাকতে এসেছ আমায়?
আহা ডাক্তার বলে কেন, এমনি বাড়ির লোক বলেই। সবাই তো গেছেন।
চল। নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল অতনু।
কিন্তু কে জানতো ডাক্তারের করস্পর্শেই ক্ষ্যাপা রোগী আরও ক্ষেপে যাবে?
স্পর্শ?
সে আর কতটুকুই বা? আঙুলের আগা কটি দিয়ে রক্তবহা ধমনীর রক্তধারার গতি করতে যতটুকু স্পর্শ অপরিহার্য।
ও মা–আ আ! কেঁদে উঠেছে অমিতা, ও আমাকে ছুঁয়ে দিলে, পুজো করতে যাচ্ছিলাম আমি!
পুজো! অমিতা আবার পূজো করে কখন?
জগন্ময় হতাশ দৃষ্টি মেলে জয়াবতীকে শুধালেন, পূজো করে?
না, কই? মহারাজজীর কাছে নিয়ে যাওয়ার নামে তো তেমন ইয়ে হল না!
অতনুর মুখ যেন ভাবলেশ-শূন্য। বাড়ির লোকের সঙ্গে খাবে বলে খাবার সময়টা টালবাহানা করে কাটিয়ে দিয়েছিল সে, সে কি এই দেখবার জন্যে?
ক্ষীণতম একটু আশা কি ভিতরে ধুকধুক করছিল না, যদি সেই সূত্রে কোনও মমতাময়ীর দেখা মেলে! যে সকলের খাওয়ার যত্নের সূত্র ধরে একবার সামনে এসে দাঁড়াবে।
জগন্ময় এতক্ষণে মেয়েকে ডেকে কথা কন, অমন উতলা হচ্ছ কেন মা অমিতা? এ যে অতনু, দীপুর বিয়ে বলে সেই ম্যাড্রাস থেকে এসেছে, চিনতে পারছ না?
বাপ, কাকা, অতনু, উপস্থিত সকলকেই চমকে দিয়ে খিল খিল করে হেসে ওঠে অমিতা, তুমি তো ভারি মজার কথা বল বাবা! নেমন্তন্ন খেতে রেলগাড়ি চড়ে এল?
হাসি কান্না, অসংলগ্ন কথা! আর বাকী কি!
জগন্ময় সকলের অলক্ষ্যে বুঝি নিজের গলাটাই একবার টিপে ধরেন নিজে, তারপর আবার সহজ হবার চেষ্টা করেন, বাঃ আসবে না? দীপুর বিয়ে! দেখতে আসবে না?
না না না!
চীৎকার করে উঠে বসে অমিতা, ও দীপুর বিয়ে দেখতে আসে নি, আমাকে দেখতে এসেছে। বল বল অতনু, তুমি আমাকে দেখতে এসেছ কিনা!
অতনু দাঁতে ঠোঁট চেপে বোধকরি নিজেকে সংহত করে নিয়ে শান্ত গম্ভীর গলায় বলে, এসেছি তো, তাই তো এসেছি। তোমার হঠাৎ অসুখ করে গেল, ওষুধ দিতে হবে না? কোত্থানে কষ্ট হচ্ছে বল।
কষ্ট! অমিতা সহসা অতনুর একটা হাত সজোরে চেপে ধরে বলে ওঠে, কোন্খানটায় নয়? সবখানে কষ্ট, জানো না? ছি ছি ছি, আবার বলে কিনা ডাক্তার হয়েছে! ডাক্তারে বুঝতে পারে না কোথায় কষ্ট!
অতনু কষ্টে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সরে এসে নিচু গলায় বলে, ঘুমের ওষুধ ছাড়া উপায় নেই। কাল স্পেশালিস্ট দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
রাতটা তুমি থাকো বাবা!
জগন্ময়ও মেয়ের মত ওর হাতটা সজোরে চেপে ধরেন, একজন কেউ না থাকলে বড় ভরসা-ছাড়া হয়ে যাব। রাত তো অনেক হয়েছে।
বাড়ি অতনুদের কাছেই, একটা গলি বাদে, চাকরির জন্যেই দূরে যাওয়া। নইলে এখানে থাকতে তো অনেকে অতনুকে এ বাড়ির ছেলে বলে ভ্রম করত।
তা সে আজ বছর আট হয়ে গেল।
এতদিন অদর্শনে একটু সমীহ এসেছে, একটু দূরত্ব এসেছে। তাই অতনুর হাত ধরে। অনুরোধ করেন জগন্ময়, রাতটা তুমি থাক বাবা!
মহাশ্বেতা ততক্ষণে সরে এসে সেজ মামীর নিকটবর্তী হয়ে সন্ধ্যার ঘটনা আনুপূর্বিক বিবৃত করছে, জগন্ময়ের কথায় সেজমামীকে ইশারা করে, এই দেখ, আবার কি বিপত্তি ডেকে আনা নয়। থাকতে তো বলছেন, শেষে না বলেও আমার কাছে থাকুক!
তা মহাশ্বেতার আজ গৌরবের দিন। একে তো প্রথম দর্শনের গৌরব, তাছাড়া ভবিষ্যদ্বাণী সফল হওয়ার গৌরব।
কারণ পরমুহূর্তেই অমিতার ভাঙা ভাঙা গলা শোনা যায়, তুমি আমার কাছে থাক অতনু! আর কেউ না, শুধু তুমি। চুপটি করে বসে থাকো।
উক্তিটা পাগলের। কিন্তু উপস্থিত সকলে তো পাগল নয়? লজ্জায় লাল হয়ে ওঠেন ওঁরা।