এ কী!
এটা কী! এ কোন ধরনের অসুখ?
এই সাজ, আর এই চীঙ্কার! খানিক আগেও তো সবাই দেখে গেছে সহজ স্বাভাবিক অমিতা। বসে আছে, কাজ করছে।
তোমরা যাবে? আর একবার চীৎকার করে ওঠে উন্মাদিনী।
যাব না তো কি আর থাকবার জন্যে এসেছি!
অসুস্থ বলে ক্ষমা করেন না কেউ। হাঁড়িমুখে, কালিমুখে, আগুনমুখে বেরিয়ে আসেন সবাই। কেউ কেউ এমনিই নীচে নেমে যান, কেউ কেউ বা জয়াবতীকে একটু উপদেশের কামড় দিয়ে যান–মেয়ের যখন শরীর খারাপ, তখন বাড়িতে এত লোক জড় করা উচিত হয় নি জয়াবতীর।
এরপর আসেন বাড়ির কর্তারা, আর আত্মীয়রা, একে একে, দুইয়ে দুইয়ে। ঘরে ঢোকেন না, ঘরের বাইরে থেকে কি বৃত্তান্ত শোনেন, এবং সকলেই রায় দেন, বেশি খাটুনি, কম খাওয়া, ভিড় গরম, সব কিছু মিলিয়ে হিস্টিরিয়াই দেখা দিয়েছে, আজ ওকে ডিসটার্ব না করে ঘুমুতে দেওয়া হোক।
কিন্তু জয়াবতী প্রতিষেধকটা মোক্ষম চান।
তোমরা একটা ডাক্তার টাক্তার এনে দেখাও ঠাকুর-জামাই, একটু ঠাণ্ডা ওষুধ ওর পেটে পড়ক, যাতে ঘুম থেকে ওঠার পর আর কিছু বিঘ্ন না থাকে!
ডাক্তার!
তাই তো!
আহা ইস!
মুখে মুখে হিসেব হয়ে যায় কজন ডাক্তার আত্মীয় আজ নিমন্ত্রণে এসেছিলেন, আর ঠিক এই মুহূর্তেই কিভাবে ব্যাপারটা না জানায় সবাই প্রস্থান করেছেন।
অন্তত সাত-আটজন ভাল ভাল ডাক্তার ছিল!
ইস একটু আগে জানালে না?
আরে আমাদের তরুর জামাই তো মানসিক রোগেরই চিকিৎসক, এই–এইমাত্তর চলে গেল!
দীপকের মুখ দিয়ে আর কথা বেরচ্ছিল না, চুপ করে জটলার একপাশে দাঁড়িয়েছিল সে।
এর আগে বেচারা জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলছিল, কারণ এ ঢেউ বিদায় না হলে ফুলশয্যার কথাই উঠবে না। একটা করে ব্যাচ নিঃশেষ হচ্ছিল, আর একটা করে অশ্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল সে, কিন্তু এ কী অভাবিত দুর্ঘটনা।
এ কী কূলে এসে তরী ডোবা!
আর তাছাড়াও ছোড়দির এই অবস্থা তাকে বিমূঢ় বিচলিত করে তুলেছিল। ছোড়দি তার সকল সুখ দুঃখের অংশীদার, তার আশৈশবের আশ্রয়। পিঠোপিঠি হলেও স্বভাবগুণে অনেক বড়। এই বিয়েটার ছোড়দিই তো মূলাধার।
মা বাপকে রাজী করানো তো বটেই, তার উপর দীপকের যা কিছু ইচ্ছে বাসনা, সবগুলি ছোড়দির মাধ্যমেই পেশ হয়েছে, এবং সেগুলি কার্যকরীও হয়েছে। আরও আশ্বাস দিয়ে রেখেছিল ছোড়দি তাদের, মধুচন্দ্রের পারমিটও আদায় করে দেবে সে ওপরওলাদের কাছ থেকে।
কোথায় তলিয়ে গেল সব আশা! পাগল একা অমিতাই হয় নি, দীপকের মনে হচ্ছিল সেও পাগল হয়ে যাবে।
নতুন বৌ কাঠ হয়ে বসে আছে পাশের ঘরে, তার প্রতি কারও দৃষ্টিপাত নেই। ফুলশয্যার অনুষ্ঠানটাও যে যো সো করে করে দেবে কেউ সে ভরসা নেই। হাতের কাজললতা গরম হয়ে উঠছে। হাতে বাঁধা সুতোয় জং ধরে গেছে। ধরবেই তো! এই গরম, তাছাড়া জল লাগছে সাবান লাগছে দুদিন ধরে। ও সুতো কি খোলা হবে আজ?
রাত কত হল?
না এমনি করে বসেই কেটে যাবে এই রাত? তাছাড়া আরও এক ভয়ে বুক গুড়গুড় করছিল সেকেন্ড ইয়ারের পড়ুয়া মেয়েটার। বিয়ের আগে থেকে দীপকের মুখে সে অবিরতই ছোড়দির মহিমার কথা জেনেছে, ছোড়দির বুদ্ধির প্রশস্তি শুনেছে, এসেও দেখছে কাল থেকে সারা বাড়িতে শুধু অমিতা অমিতা রব। কোনও কাজ হবে না অমিতা এসে না দেখলে।
সেই অমিতার বুদ্ধির গোড়াতেই এমন দুর্বিপাক ঘটল, নতুন বৌ এসে বাড়িতে পা দিতে না দিতে। যুগ যতই সভ্য হোক, আর মহিলাকুল যতই আলোকপ্রাপ্তা হোন, অপয়াকে অপয়া না বলবে কে? যুগ পালেটেছে বলে তো আর সাপের বিষ অমৃত হয়ে যায় নি?
এই কঘণ্টা আগেও আলোকোজ্জ্বল আর উৎসবমুখর বাড়িখানার দিকে তাকিয়ে বুকটা আনন্দের আবেশে শিথিল হয়ে আসছিল তার। তার জন্যে, এই সব কিছুই তার জন্যে, তাকে কেন্দ্র করেই সব।
কিন্তু এই বিপদপাতে কোন্ কে যেন কেচ্যুত হয়ে পড়ল সে বেচারা!
তবু দুটি নিকটআত্মীয়া মহিলার নিভৃত আলোচনা কানে আসে নি ভয়ে মুহ্যমান নববিবাহিতার। ওঁরা নিতান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বলছিলেন এইটুকু কৃপা।
হ্যাঁ গা, নতুন বৌয়ের মা কিছু তুকতাক করে দিল না তো?
ওমা সে কি? কেন?
আহা কেন আর বুঝছ না? ঘরে দস্যি বিধবা ননদ থাকলে পাছে মেয়ের ষোলোআনা সুখ না হয়! জানতে তো পেরেছে ওই মেয়েই সর্বময় কী, সকলের আদরের আদরিণী, মাথায় মণি!
কি জানি ভাই, না দেখে আর কি বলব! তবে জগতে কিছুই অসম্ভব নয়।
দীপক দূর থেকে দেখছে, ঘরে বৌ বসে বসে ঢুলছে। একবার কাছে যাবার প্রবল ইচ্ছে বিবেকের দংশনে গুটিয়ে যাচ্ছে। ছি ছি, ছোড়দির এই অবস্থা, আর আমি কি না!
মনটাকে জোর করে টেনে এনে ছোড়দির ব্যাপারে দিতেই কানে এল ডাক্তার প্রসঙ্গ।
আর খানিক আগে জানাজানি হলেই যে অন্তত গণ্ডা-দুই ডাক্তারকে এখানে এনে বসানো যেত সেই কথাই হচ্ছে।
দীপক সহসা বলে ওঠে, অতনুদা তো রয়েছেন!
অতনু! তাই বটে, অতনু এসেছিল যে!
অতনু তো ভাল ডাক্তার। এখন অবশ্য মিলিটারীর ডাক্তার, আর তাতে বিদ্যে ভোতা হয়ে যায় এটাও ঠিক, তবু ভাল ছাত্র ছিল, স্কলারশিপ পেয়েছে দুবার।
মরা হাতী লাখ টাকা! আর লাখ টাকা না হোক, পাঁচটাকাই যদি হয়, তবু তো পাঁচ টাকাই। সেটুকু কাজও তো হবে।
অমিতার বাবা স্রেফ মাটিতে বসেছিলেন, রগ দুটো টিপে ধরে। দীপকের কথায় ক্লান্ত স্বরে বলেন, সে কি এখনো আছে?