মহাশ্বেতা কি উত্তর দিত কে জানে, সেজ মামীর বোনঝির স্বপক্ষে না বিপক্ষে, কিন্তু উত্তর দেওয়ার আগেই দরজায় ধাক্কা পড়ল, বৌদি, বৌদি, আছ নাকি এখানে? অমিতাই বা কোথায় হাওয়া হল? কে আছ এখানে? আবার সজোরে ধাক্কা।
বলা বাহুল্য খুলতে হয় দরজা।
রক্ষে যে অমিতার ঘুম ভাঙে না।
কী ব্যাপার! সেজ দেওর বিজয় ঘরের ভিতরের দৃশ্যটা চকিতে দেখে নিয়ে বলে, হল কি? শুয়ে কে? অমি? শরীর খারাপ হয়েছে?
ঠাকুরপো! জয়াবতী ভ্যাক করে কেঁদে ফেলেন।
আরে বাবা, হল কি?
বিজয়ের স্বরে ব্যস্ততা। ফার্স্ট ব্যাচের যুগ্যি মিষ্টি বার করা ছিল, এখন মিষ্টির ভাড়ার চাবির মধ্যে সংরক্ষিত। আর চাবি জয়াবতীর আঁচলে। সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছিল বেচারা বৌদিকে।
খুব কসে ধমকে দেবার মনোভাব নিয়েই এসেছিল বিজয়। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে বলে, কি, মাথাটাথা ঘুরে গেছে বুঝি? যাবেই তো, যা চরকীর মত ঘুরছে কদিন! থাক, একটু রেস্ট নিচ্ছে নিক। তা সবাই মিলে ভিড় বাড়াচ্ছ কেন, একা ঘর অন্ধকার করে একটু ঘুমুতে দাও। আর তুমি মিষ্টির ঘরের চাবিটা চট করে দাও দিকি আমাকে। শীগগির শীগগির, লোক খেতে বসে গেছে।
বৌদি আঁচল থেকে চাবি খুলে দেবার আগেই তার আঁচলটা টেনে নিজেই দ্রুত হস্তে গিট খুলে চাবিটা নিতে নিতে বিজয় আর একবার বলে, মেয়েটা খেয়েছিল কিছু? নাকি উপোস করেই ঘুরছিল?
এ কথার আর উত্তর শোনার অবকাশ হয় না বিজয়ের, চাবি নিয়ে দৌড় মারে সে।
জয়াবতী আর মহাশ্বেতা ঘরের বাইরে এসে চুপি চুপি কথা বলেন।
তোর বড় মামাকে একবার ডাক দিকি মহা! হতাশ নিঃশ্বাস ফেলেন জয়াবতী।
বড়মামা তো সেই বাইরে। রাশ রাশ লোক সেখানে। গিয়ে কি বলব?
বলগে অমির হঠাৎ শরীর খারাপ হয়েছে।
কি হয়েছে জিগ্যেস করবেনই। তা হলেই সোরগোল পড়ে যাবে। আমি বলি কি, একটু ব্রোমাইড খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলে–
না মহা, নিজেদের বুদ্ধিতে কিছু করতে ভরসা নেই। যদি হিতে বিপরীত হয়?
আশা, আমি কি আর একেবারেই আনাড়ী গো? আমার পিসশাশুড়ীর যখন মাঝে মাঝে ভীমরতি বাড়ে, বাড়ির লোককে উৎখাত করেন, তখন তো ওই ব্রোমাইডই ভরসা!
এবার বোধকরি জয়াবতী ওঁর পরমহিতৈষী ভাগ্নীর ওপর একটু বিরক্ত হন, বেজার মুখে বলেন, কী যে বলিস মহা! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা!
আহা তুলনায় আর ভুল কি? সবই তো সেই মাথায় রক্তচড়া?
ব্যস, আর কথা চালানো যায় না। হুড়মুড়িয়ে ছাতের দ্বিতীয় ব্যাচের মহিলারা নামছেন রূপের ছটায়, রঙের ছটায়, সোনা-মোতির ছটায়, আর কথার ছটায় তুফান তুলতে তুলতে।
ওরই মধ্যে একজনের নজর পড়ে যায় বারান্দার এ পাশের কোণের ঘরের সামনে মনুষ্যমূর্তি দুটির প্রতি। উৎসবের উল্লাসেই অকারণ খিলখিলিয়ে ওঠে সে, কি গো মেজখুড়ি, তোমরা ওখানে আঁতুড়ের দোর আগলানোর মতন করছ কি দুজনে?
জয়াবতী তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসেন, বোধকরি পরিস্থিতি ঢাকতে বলতে যান, ভাল করে খেয়েছ তো? কিন্তু ততক্ষণে মহাশ্বেতা রক্ষক হয়েও ভক্ষকের ভূমিকা নিয়ে বসে।
আর বোলো না নদি, এদিকে তো মহা বিপত্তি! অমিতা এক মস্ত রোগ বাধিয়ে বসে মামীর তো নাড়ি ছাড়িয়ে দিচ্ছে?
ওমা সে কি?
রূপ, রং, গন্ধ, শব্দের সেই প্রবল তুফান মুহূর্তে একটিমাত্র সূক্ষ্ম সুরের তরঙ্গে কেন্দ্রীভূত হয়, ওমা সে কি? কি হল?
কি হল? কি হল? কি হল? জিগ্যেস করে উত্তরের অপেক্ষা কেউ করে না, ঠেলে ঢুকতে চেষ্টা করে ছোট্ট সেই ঘরখানার মধ্যে।
না, মহাশ্বেতাকে দোষ দিতে জয়াবতী পারেন না। আইন বাঁচিয়ে কাজ করেছে সে, রোগের নাম বলে নি। শুধু বড়মামীর অবস্থাটা বর্ণনা করেছে।
কি হয়েছে মা অমিতা!
কি হল হঠাৎ?.. মাথা ঘুরে গেছে? বুক কেমন করছে?
আহা মরে যাই, ভেতরে আগুনের জ্বালা পুরে রেখে বাইরে সহজের মত ঘুরে বেড়ায় বই তো নয়। অ মা অমিতা, কী কষ্ট হচ্ছে মা?
দেখা গেল নিমন্ত্রিতা নারীমণ্ডলীর প্রত্যেকেই স্নেহময়ী মমতাময়ী করুণাময়ী। ঘুমন্ত মানুষটাকে ঠেলে, গায়ে হাত বুলিয়ে, কপালের চুল সরিয়ে আকুল প্রশ্ন করতে থাকেন তারা সহসা কি হল অমিতার?
যে অমিতা গুণের খনি, কাজের অবতার, সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি, আর অভাগ্যের প্রতীক।
ঘুম!
ঘুমই।
মাথায় রক্তচড়া রোগীর অস্বাভাবিক ঘুম হলেও মহানিদ্রা তো নয়! এমন সুগভীর সহানুভূতির আর মমতার স্পর্শে যে মহানিদ্রার মহাশিলাও গলে জল হয়ে যেতে পারে!
জয়াবতীর ভাজ আহা মরে যাই, আহা মরে যাই রবে অমিতার বুকের ভিতর হাত বুলোতে যেতেই সহসা ধড়মড় করে উঠে বসে অমিতা, আর জয়াবতীদের সমস্ত সাবধানতা ব্যর্থ করে দিয়ে তীক্ষ্ণ চীৎকার করে ওঠে, কে? কে এরা? এত ভিড় কেন ঘরে? একলা থাকব আমি, একলা থাকব।
নীল মৃদু বাল্ব জ্বলছিল ঘরে, অপমানাহত রমণীকুল জোরালো আলোটা জ্বেলে দেন, আর মুহূর্তে ধরা পড়ে যায় অমিতার ইতিহাস।
মাথায় জল দেওয়ার প্রতাপে কপালের সেই টিপের বাহারটা অমিতার ঘুচেছে, কিন্তু দুই কানে তখনও দুটি মকরকুণ্ডল, গলায় মুক্তোর পেন্ডেন্ট, দুই হাতে দুগাছি চূড়। বাহুল্য বোধে কনেসাজানিরা যেগুলো পরিত্যাগ করেছিল।
অমিতার পরনে শুধু সায়া-ব্লাউজ, যে কাপড়খানা পরেছিল বিকেলে সেখানা মাটিতে লুটোচ্ছে, আর খাটের বাজুর ওপর কনের নতুন লাল বেনারসীটা ছড়ানো জড়ানো!