কোথায় তোর বর অমিতা? মহাশ্বেতা হাত পা ছেড়ে দিয়ে খাটের ওপর বসে পড়ে করুণ সুরে বলে, সে কি আর আছে হতভাগী?
বাঃ, তাকে তোমরা সরিয়ে দিচ্ছ বুঝি? আছে, আছে সে। নীচে আছে। এসেছে বিদেশ থেকে। তাকে একবার ডেকে দাও না গো মহাদি!
অমিতার কি নেশা লেগেছে? নেশাচ্ছন্নের মত চোখ মুখ কেন তার?
মহাশ্বেতা বেনারসী শাড়ির একটা কোণ অমিতার চোখে তুলে ধরে বলে, এ শাড়ি তুই কেন পরেছিস? এ কি তুই পরিস? এ তো নতুন বৌয়ের শাড়ি। তোর কাপড় তো এই!
অমিতার পরিত্যক্ত ইঞ্চিপাড়ের শান্তিপুরী হাফ-শাড়িটা তুলে এনে ধরে মহাশ্বেতা।
ও কাপড় বিচ্ছিরী, ছিঃ! অমিতা সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে, ও আমি পরবো না।
অতঃপর আর সংশয় থাকে না মহাশ্বেতার।
কিন্তু এ কী আকস্মিক!
এ কী আকস্মিক!
জল খাবি অমিতা?
না না, জল খাব কেন? আমি নেমন্তন্ন খাব! অমিতা চোখ ভুরু নাচিয়ে বলে, কত কি ভাল ভাল রান্না হয়েছে। ওকেও ডেকে নিয়ে এসো না মহাদি! দুজনে একসঙ্গে খাই।
মহাশ্বেতা কাছে এসে দৃঢ়স্বরে বলে, তুই সব ভুলে যাচ্ছিস কেন অমি, সে তো নেই। সে তো বিলেত থেকে আসতে গিয়ে প্লেন ভেঙে মারা গেল, মনে নেই?
অমিতা ভাবশূন্য মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
ভাল করে ভাব, চেষ্টা করে মনে কর মহাশ্বেতা যেন মন্ত্র পড়ায়, সেই তুই দমদমে গেলি, তার মৃতদেহের সামনে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলি, তারপর মামার সঙ্গে- ইয়ে, তোর বাবার সঙ্গে চলে এলি, কিছু মনে পড়ছে না?
আবার আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে অমিতা।
তোর বরের নাম ছিল বীরেশ্বর, সেই চিঠি-ছাপা হল, পদ্য ছাপা হল–আপ্রাণ চেষ্টা করে মহাশ্বেতা, কত ঘটা করে বিয়ে হল–ভুলে যাচ্ছিস কেন?
দূর, তুমিই সব ভুলে যাচ্ছ মহাদি, আমার বরের নাম তো অতনু-অতনু সেন! সেই কোথায় যেন চলে গেল, কত দুঃখু হল আমার! একবার ডেকে আনো না মহাদি!
আনছি, তুই বসে থাক। বেরোস নে ঘর থেকে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মহাশ্বেতা, বেরিয়ে এসে ছিটকিনিটা ঠেলে বন্ধ করে দিয়ে জয়াবতীকে ডেকে–একান্তে টেনে নিয়ে গিয়ে কপালে করাঘাত করে খবরটা দিল।
.
সমস্ত অভ্যাগতের চোখ এড়িয়ে জয়াবতী এসে মেয়ে নিয়ে ঘরে খিল দিলেন। অবিশ্যি মহাশ্বেতাও রইল, নইলে মাথায় জল দিয়ে বাতাস করবে কে?
জয়াবতী ঘরে ঢুকে প্রায় আছড়ে পড়ে বললেন, অমি, অমু, কি হয়েছে মা? খেটে খেটে শরীরটা খারাপ লাগছে? গরম লাগছে? এই ভারী শাড়িটা খুলে দিই মা, নরম কাপড় পরে শোও একটু।
শাড়িটায় টান দিলেন জয়াবতী। অমিতা মায়ের হাতটা ঠেলে দিয়ে বলে উঠল, আঃ!
অমি, আমাকে আর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিসনি মা! তুই সহজ হ ঠিক হ! মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন জয়াবতী।
ছেড়ে দাও বলে ফুঁসে উঠে মায়ের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল অমিতা।
অমি, অমু, অমি! আমায় চিনতে পারছিস না?
চোখ দুটো কপালমুখী করে অমিতা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, পারছি। তুমি তো বড় পিসিমা।
আমি বড় পিসিমা!…ও মহা, একখানা থান ইট এনে আমার মাথায় বসিয়ে দে মহা, আমার সকল জ্বালা জুড়োক। এ দৃশ্য আমি আর একদণ্ডও সহ্য করতে পারছি না। ..অমু, অমিতা, আমি যে তোর মা অমি!
না, তুমি মহাদির মা। বলে সরে গিয়ে ও-দেওয়ালে গিয়ে দাঁড়ায় অমিতা।
জয়াবতী বারবার বোঝাতে চেষ্টা করলেন, গরমে ঘামে আর কতদিনের পরিশ্রমে এমন হচ্ছে তোর। গয়না কাপড় খুলে রাখ মা, পরে পরিস, নেমন্তন্ন খাবার দিন পরিস, এখন নরম কাপড় পরে শো
বুনো গোঁ ধরে হাত ছাড়িয়ে নিল অমিতা, আঃ ছেড়ে দাও বলছি! লাগে না আমার?
তবু দুজনের সঙ্গে একলা জোরে পারা শক্ত।
বেনারসী শাড়ি থেকে মুক্ত করলেন ওকে জয়াবতী আর মহাশ্বেতা। মাথায় মুখে জল দিলে শাড়িটা যে যাবে! দামী শাড়িটা!
জোর করেই জল দিয়ে শুইয়ে দিলেন জয়াবতী মেয়েকে। কিছুক্ষণের জন্যে চোখটা বুজল সে, বোধকরি ঘুমিয়েই পড়ল।
ঘুমোনো ভাল লক্ষণ! মহাশ্বেতা বলল, হিস্টিরিয়ায় ঘুম ভাল।
হিস্টিরিয়া বলে আর আমায় প্রবোধ দিস নে মহা, জয়াবতী চাপাগলায় ডুকরে উঠলেন, যা হয়েছে তা বুঝতে পেরেছি, আমার কপালের উপযুক্তই হয়েছে। নইলে আমার একটা ঘরণী গিন্নী মেয়ে স্বামীপুত্তুর ফেলে চলে গেল, আর একটার নগরে না উঠতেই বাজারে আগুন লাগল।
তবু সেও তো বুক বেঁধে সয়ে ছিলাম। এ আমার কি হল মহা? কেন হল?
মহা বিজ্ঞের মত বলে, আজকাল সব ডাক্তারদের নানান মতামত বেরুচ্ছে। বলছে, বেশি বয়সের আইবুড়ো মেয়ে কি কমবয়সী বিধবার পাগলামী হিস্টিরিয়া এসব হওয়ার কারণ না কি… ঢোক গেলে মহাশ্বেতা, তুমি গুরুজন কি আর বলব! তবে
জয়াবতী মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালেন–ঘুম কি, না আচ্ছন্ন? ভুরু কুঁচকে উঠছে, ঠোঁট কাঁপছে, কাঁপছে নাকের পাটা। গলা আরও নামিয়ে বললেন, এই বাড়িভর্তি লোক, এখন ডাক্তারের ব্যবস্থাই বা কি করে করি? অথচ
যাক যাক একটু। ভিড়টা একটু মিটুক, ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। হয়তো ঘুমোলেও কিছু কমতে পারে। আশ্বাস দিয়েই আবার আশঙ্কার ঢেউ তোলে মহাশ্বেতা, তবে আশা কম। বড্ড ভরা বয়েস তো!
জয়াবতী বলেন, ভগবান জানেন, পাপের মন, পাঁচজনে জড় হয়েছে। কেউ কিছু খাইয়ে দিল না তো?
ওকে আর কে কি খাওয়াবে? ও কী বা খায়?
চা কে করেছিল আজকে? তোদের সে মামীর বোনঝি না? জয়াবতী সন্দেহে কুটিল হয়ে ওঠেন।