লোভ…লোভ…নেশা…নেশা!…মহাদি তুমি যদি না আসতে!.আমি মরতে চাই নি।…আমি পাগল হতে চাই নি।…অতনু…তুমি কেন?
ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসে কণ্ঠস্বর…থেমে যায় অর্থহীন অসংলগ্ন কথা।
জগন্ময় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে পারেন, জয়াবতী পারেন মাথা খুঁড়তে, কাকা খুড়িরা ঘন ঘন চোখ মুছতে পারে, দীপক পারে আকুল হয়ে মৃতার বিছানায় মুখ মাথা ঘষতে, অতনু কিছুই পারে না।
অতনু শুধু কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে খাটের বাজু ধরে।
যা পারে তাই করে অতনু। জ্বালাকরা শুকনো চোখে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে নীল হয়ে যাওয়া ওই মুখটার দিকে, যে মুখ থেকে মাত্র কিছু ঘণ্টা আগে উচ্চারিত হয়েছিল, বেশ, আর পাগলামী করব না। শুধু তুমি একবার আদর করো।
জীবনের সমস্ত কিছুর বিনিময়েও একটা চলে যাওয়া মুহূর্তকে ফিরিয়ে আনা যায় না।
কিন্তু যদি যেত? অতনু কি ওর সেই অসামাজিক ইচ্ছাটাকে পূরণ করতে করতে পারতো?
পারতো না।
পারলে, এখনই কি ওই চূর্ণবিচূর্ণ মৃত্যুবিবর্ণ দেহখানাকে বুকের মধ্যে ভরে নিতে পারতো না? নিজের দেহের সমস্ত স্নায়ু শিরা অস্থি মজ্জা মুচড়ে মুচড়ে দেওয়া যন্ত্রণাটাকে প্রকাশ করতে পারতো না উদ্দাম উন্মত্ত এক আদরের মূর্তিতে?
দুরন্ত সেই বাসনা তো লক্ষ বাহু মেলে ছুটে গিয়ে আছড়ে পড়তে চাইছে ওই দেহটার কাছে।
তবু কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতনু।
কাঠ হয়েই দাঁড়িয়ে রইল শেষ পর্যন্ত, যতক্ষণ না মৃত্যুর মাশুল শোধ করা হল।
.
না, শোকে কেউ মরে না।
মা নয়, বাপ নয়, ভাই নয়, প্রেমাস্পদ নয়। অনেক ঝড় আর অনেক ঝঞ্ঝার পর আবার এক সময় যখন বাড়ি ফিরল সবাই, তখন আর শোক করবারও ক্ষমতা নেই কারুর।
সবাই এক গ্লাস করে শরবৎ খেয়ে শুয়ে বাঁচল।
অতনুর আবার শুয়ে পড়বারও জো নেই। জো নেই শুয়ে পড়ে থাকবার। ছুটি ফুরিয়েছে। তাকে চলে যেতে হবে।
এঁরা বললেন, আমাদের সঙ্গে ভাগ্য জড়িয়ে তুমিও অনেক ভুগলে বাবা, বলবার আর কিছু নেই। শুধু বলছিলাম, আর দুদিন বিশ্রাম করে যাওয়া যায় না?
অতনু শুকনো গলায় বলল, না।
ও বাড়িতে দাদা বৌদি বললেন, আর দুটো দিন থেকে গেলে কি খুব ক্ষতি হত?
অতনু বলল, হ্যাঁ।
পরের দুর্ভাগ্যে তোমারও তো কম দুর্ভোগ গেল না, চোখমুখ একেবারে বসে গেছে। ট্রেনে একটু খেয়ো ভাল করে।
খাব।
পৌঁছনো চিঠিটা দিতে বেশি দেরি কোর না, ভাবনায় থাকছি।
দেরি করবো কেন?
সত্যিই তো, দেরি করবে কেন?
এ পর্যন্ত কখন কোন্ সময় অতনু অস্বাভাবিক আচরণ করেছে? কেই বা করে?
অতনুর মত যারা সুস্থবুদ্ধি সহজ সাংসারিক নিয়মের মানুষ হয়?
একজন মরে যাচ্ছে বলেই যে কোনও অনিয়ম করা চলবে, তা তো আর সংসারের নীতি নয়।
অতনু যদি নিয়ম ভাঙতো, নীতি ভাঙতো, বিধিব্যবস্থার ব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দিত, তাহলে অমিতা বাঁচতো।
কিন্তু কী লাভ হতো সেই বাঁচায়? কে মূল্য দিত সেই জীবনকে?
মৃত্যু মহৎ, মৃত্যু সুন্দর, মৃত্যু সমস্ত ভালমন্দের উপর সমাপ্তির রেখা টেনে দিয়ে যায়, তাই মৃত্যুর চরণে জীবনের সমস্ত শ্রদ্ধার অর্ঘ্য। জীবন জানে মৃত্যুর হাতেই আছে সেই অমৃত, যা অমরত্ব এনে দেয়।
অমিতাকে বাঁচালে প্রতিদিনের তিল তিল মৃত্যুতে অমিতার মূর্তি বিকৃত হতো, কুৎসিত হয়ে উঠতো, ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়ে মূল্য হারাত।
মৃত্যু তাকে এক জ্যোতির্বলয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে গেল, সেখানে অমিতা ক্ষয়হীন সৌন্দর্যের মধ্যে বেঁচে থাকবে।
.
না, অতনু এসব কথা ভাবছে না।
অতনু অন্যকথা ভাবছে।
অতনু চলন্ত ট্রেনে বসে ধূ ধূ বিস্তৃত প্রান্তরের পানে চেয়ে শুধু বিগত সেই খানিকটা সময়কে বারবার উল্টেপাল্টে দেখছে।
অতনু যদি সেই নির্মমতার অভিনয়টুকু না করতো! মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে ভালবাসে বইকি। তাই অমিতার মৃত্যুর চেয়েও দুঃসহ হয়ে উঠছে অতনুর, অমিতা তাকে পরম নিষ্ঠুর ভেবে গেল বলে!
কিন্তু এমনও তো হতে পারে, সবটাই অতনুর ভুল, অমিতা পাগলই হয়েছিল। পাগল না হলে কেউ পাগলের আচরণ করতে পারে?
অতনু কি পারছে ট্রেনের দরজাটা খুলে ওই ছুটন্ত প্রান্তরটায় ঝাঁপিয়ে পড়তে? যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অমিতা তিনতলার সেই ছাদটা থেকে?
পারছে না। অতনু পারছে না। ভয়ঙ্কর দুরন্ত সেই ইচ্ছের প্রলোভনকে জয় করে বসে আছে স্থির হয়ে হয়তো একটু পরে হাতের বইখানা খুলে ধরে পড়তে শুরু করবে।
তাছাড়া আর কি?
পাগল না হলে কেউ পাগলের আচরণ করতে পারে? অতনু হচ্ছে সেই স্বাভাবিকদের দলে, যারা মরবার মন্ত্রও জানে না, বাঁচবার মন্ত্র আবিষ্কার করতে শেখে নি! যারা উন্মাদ ইচ্ছের দুরন্ত আবেগকে প্রশমিত করতে পারে, শুধু হয়তো চোখের সামনে একটা বই খুলে ধরে।